বাংলাদেশের অনেক জেলায় নিজের জায়গা বাঁচানোর জন্য মসজিদ নির্মাণের কথা শোনা যায়। অনেক সময় সরকার রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে। আগে জমি অধিগ্রহণ করলে জমির মালিককে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন টাকা দেয়া হত না। সরকারের এই জমি অধিগ্রহণ ঠেকানোর জন্য অনেকে সেই জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করে ফেলতেন। মানুষের ধর্মীয় অনুভুতির কারণে সরকার মসজিদটা টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হত।
বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ মসজিদ ঢাকার বাইতুল মোকাররম মসজিদও নির্মাণ করা হয়েছিল এর নিকটবর্তী জমিকে সরকারের অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা করার জন্য। এই কাহিনী প্রথম শুনেছিলাম প্রায় ৩০ বছর আগে আমার বাবার কাছে। এখন ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি এটি সত্য ঘটনা ছিল নিঃসন্দেহে। ১৯৫০/৬০ এর দশকে ঢাকার অভিজাত লোকেরা বাস করতেন পল্টন এবং সেগুন বাগিচা এলাকায়। তখনকার ঢাকা শহর উন্নয়নের পরিকল্পনা অনুসারে সদর ঘাট থেকে আসা রাস্তাটা নবাবপুর হয়ে সোজা উত্তর দিকে গুলিস্থান এলাকা হয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দিকে আরও উত্তরে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন এই রাস্তাটা মসজিদের দিকে না গিয়ে মসজিদের কাছে এসে পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে জিপিওর সামনে দিয়ে জিরো পয়েন্টে মিশেছে। ফলে বাইতুল মোকাররম মসজিদ এবং এর আশে পাশের মার্কেট এলাকা সরকারী অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাছাড়া মসজিদ না হয়ে রাস্তা হলে উত্তর দিকে পল্টন এলাকার অভিজাত লোকের মালিকানাধীন আরও কিছু বাড়িঘর রাস্তার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হত।
১৯৫৯ সালে ঐ এলাকার কিছু অবাঙ্গালী ব্যবসায়ী (লতিফ বাওয়ানি অন্যতম ছিলেন) দ্রুততম সময়ে নিজেদের জায়গা জমি এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য তৎকালীন শাসক আয়ুব খানের নিকটে একটা মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব দেন। তারা যুক্তি দেখান যে নতুন এবং পুরাতন ঢাকার এই সংযোগ স্থলে মসজিদ নির্মাণ করলে ঢাকার উভয় অংশের মানুষ উপকৃত হবে। আয়ুব খানের প্রশাসন এই প্রস্তাব মেনে নেয় কিন্তু ব্যবসায়ীদেরকে এই মসজিদ নির্মাণের খরচ বহন করতে বলেন।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ বাওয়ানি (তখন অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের মধ্যে ইস্পাহানী, আদমজি, বাওয়ানি প্রমুখ প্রসিদ্ধ ছিলেন) এই মসজিদ নির্মাণের সকল খরচ বহন করার দায়িত্ব নেন। যে স্থানে বর্তমানে মসজিদটি অবস্থিত সেখানে ঐ সময় একটা বড় পুকুর ছিল। ঐ পুকুরের নাম ছিল ‘পল্টন পুকুর’। সারা শহরের ময়লা এই পুকুরে এবং তার আশেপাশে ফেলা হত। ফলে এটা প্রায় পানি শূন্য ছিল তখন। বিখ্যাত নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘আব্দুল হোসেন এম থারিয়ান এন্ড কোম্পানিকে’ মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠান ঢাকা নিউ মার্কেট, শাহবাগ হোটেল (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বা পিজি হাসপাতাল ), ‘আদমজি কোর্ট বিল্ডিং’, ডিআইটি বিল্ডিং (বর্তমানে রাজউক ভবন) নির্মাণ করে সুনাম অর্জন করে।
এই মসজিদটি ৮ তলা। প্রায় ৪০,০০০ মুসুল্লি নামাজ পড়তে পারে। ১৯৬০ সালে আয়ুব খান নির্মাণ শুরুর উদ্বোধন করে। ১৯৬৩ সালে আংশিক নির্মাণের পরে নামাজ পড়া শুরু হয় এবং ১৯৬৮ সালে পুরো মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এই মসজিদের সাথে রয়েছে মোগল স্টাইলের বাগান।
১৯৬৪ সালে বায়তুল মোকাররম মার্কেট চালু হয়। এই মার্কেটের দোকান বিক্রি করে লতিফ বাওয়ানি সাহেব প্রচুর টাকা আয় করেন যার ফলে মসজিদ নির্মাণের খরচ অনেকাংশে উঠে যায়।
মসজিদ নির্মাণ করলে তার সওয়াব মানুষের মৃত্যুর পরেও যোগ হতে থাকে যতদিন মসজিদ টিকে থাকে। এই ধরণের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি মসজিদের সওয়াব কি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লতিফ বাওয়ানি সাহেব এখনও কবরে শুয়ে পাচ্ছেন? আমরা জানি ছলচাতুরী এবং লোক দেখানো এবাদত হিসাবে আসবে না। ইমাম বুখারির প্রথম দিকের হাদিসে আছে, আমাদের নবীজি (সা) বলেছেন;
"নিশ্চয়ই মানুষের কর্ম নিয়তের উপর নির্ভরশীল, এবং প্রত্যেকের কর্মফল হবে তার নিয়তের উপর। "
সূত্র এবং ছবি - ডেইলি বাংলাদেশ ডট কম
গো নিউজ ২৪ ডট কম
ইতিহাসনামা
প্রথম আলো
উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০২৩ রাত ১:০১