যারা পুরোপুরি ইনট্রোভার্ট (অন্তর্মুখী) না আবার পুরোপুরি এক্সট্রোভার্টও (বহির্মুখী) না তাদেরকে বলে এমবিভার্ট। আমার ধারণা আমি একজন এমবিভার্ট মানুষ। অনলাইনে কিছু সাইট আছে যেখানে গিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জানা যায় একজন মানুষ ইনট্রোভার্ট নাকি এক্সট্রোভার্ট। বেশ কয়েকবার পরীক্ষা দেয়ার পরে আমার কাছে মনে হয়েছে আমি এমবিভার্ট। আসলে পৃথিবীর প্রায় ৪০% মানুষ এমবিভার্ট। ৩০% মানুষ ইনট্রোভার্ট আর ৩০% মানুষ এক্সট্রোভার্ট।
ইনট্রোভার্ট (অন্তর্মুখী) মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্যঃ
১। বাইরের জগতের চেয়ে নিজের মনের চিন্তা এবং ধারণায় মনোনিবেশ করে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই বৈশিষ্ট্যের সাথে আমার মিল আছে।
২। অনেক মানুষ বা দলের চেয়ে একজন বা দুইজন মানুষের সাথে সময় কাটাতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই ব্যাপারে আমার সাথে মিল তেমন পাই না। আমি দলের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করি। আবার একজন দুইজন মানুষের সাথে ভালো সময় কাটাতে পারি।
৩। ইনট্রোভার্ট নিজেকে চাঙ্গা করতে একা কিছুটা সময় কাটাতে চায়। এক্সট্রোভার্ট যারা তারা চাঙ্গা হওয়ার জন্য অনেক মানুষের আড্ডা বা দলকে পছন্দ করে। এই ব্যাপারে আমার অবস্থান নিজের কাছেই পরিস্কার না। অনেক সময় আড্ডা দিলেও মন চাঙ্গা হয়। আবার অনেক সময় একা সময় কাটালে মন চাঙ্গা হয়। মানসিক অবস্থার উপরে নির্ভর করে আমি কোনটা বেছে নেব। অনেক সময় আড্ডা দিতে ভালো লাগে আবার অনেক সময় একা সময় কাটাতে ভালো লাগে।
৪। কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে নিরব পরিবেশের প্রয়োজন হয়। আমার ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল কাজের জন্য নিরব পরিবেশ লাগে কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে লাগে না। যেমন ছোটবেলায় দেখেছি আমার আশে পাশে ছেলেপেলে হৈ হুল্লোড় করছে অথচ আমি তাদের মাঝখানে বসে পড়ালেখা করছি। আমার তেমন সমস্যা হতো না।
৫। ইনট্রোভার্টরা সাধারণত চিন্তাশীল হয় । সম্ভবত আমার সাথে মিল আছে। আমি চিন্তাশীল হতে চাই। কতটুকু পারি সেটা আমি জানি না। কালকে আমার এক বড় ভাই বলছেন যে আমি নাকি সব সময় শান্ত (calm) থাকি। আরও কয়েকজনে বলেছে। কিন্তু আমি একটু আশ্চর্য হই তাদের কথায়। কারণ আমি ভিতরে ভিতরে অস্থির থাকি মাঝে মাঝে । বাইরে থেকে হয়তো মানুষ বুঝতে পারে না।
৬। আত্ম সচেতনতা বেশী থাকে। আমারও আত্ম সচেতনতা মাঝামাঝি পর্যায়ে সম্ভবত।
৭। সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে। আমার ক্ষেত্রে আমি অনেক সময় চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আবার অনেক সময় অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেই। পরিস্থিতির উপর এটা নির্ভর করে।
৮। ইনট্রোভার্টদের একা থাকলে ভালো লাগে। সব সময় একা থাকতে আমার ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মানুষের কাছে গিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি। অফিসে আমি কাজের ফাকে কলিগদের কাছে গিয়ে গায়ে পড়ে হাসি ঠাট্টা করি যেন আমি নিজে উজ্জীবিত হই এবং সাথে সাথে তারাও যেন উজ্জীবিত হয়। তবে প্রতিদিন কিছু সময় একা থাকতে আমার ভালো লাগে।
৯। গ্রুপে কাজ করা পছন্দ করে না। আমি গ্রুপে কাজ করতে পছন্দ করি। গ্রুপে কাজ করলে কাজের চাপ কমে যায়। কাজটার ভুল ত্রুটি সহজে ধরা পড়ে। কাজটা আনন্দে পরিণত হয়। তবে এটা ঠিক গ্রুপে বেঁকা তেড়া লোক থাকলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরিবেশ নষ্ট হয়।
১০। কথা বলার চেয়ে লিখতে পছন্দ করে। আমার ক্ষেত্রে আমি দুইটাই পছন্দ করি।
১১। অনেক মানুষের মাঝে থাকার পরে ক্লান্ত বোধ করে। আমি সাধারণত ক্লান্ত বোধ করি না। তবে অনেক সময় গ্রুপ পছন্দ না হলে বিরক্ত লাগে।
১২। বন্ধুর সংখ্যা কম কিন্তু সম্পর্কটা গভীর। আমার ক্ষেত্রে এটা ঠিক আছে। আমার বন্ধু কম কিন্তু সম্পর্কটা গভীর।
১৩। ইনট্রোভার্টরা দিবা স্বপ্ন বা ডে ড্রিম করে। আমার সাথে তেমন মেলে না।
১৪। মনের বিশ্রামের জন্য নিজের মধ্যে ফিরে আসে। আমার সাথে মেলে। সারাদিনের কোলাহলের পরে নিজের মনের জগতে বিচরণ করতে ভালো লাগে। এতে শরীর এবং মনের ক্লান্তি কমে।
ইনট্রোভার্ট মানুষ আবার কয়েক রকমের হয়ঃ
১। সোশ্যাল ইনট্রোভার্টঃ এরা ছোট গ্রুপ পছন্দ করে। বেশী মানুষের গ্রুপ পছন্দ করে না।
২। চিন্তাশীল ইনট্রোভার্টঃ এরা সৃষ্টিশীল চিন্তায় এবং কাজে সময় কাটাতে পছন্দ করে।
৩। উদ্বিগ্ন ইনট্রোভার্টঃ এরা বেশী মানুষের সমাবেশে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।
৪। সংযত ইনট্রোভার্টঃ এরা সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। হঠাৎ কোন সিদ্ধান্ত নেয় না। খামখেয়ালী সিদ্ধান্ত নেয় না।
ইনট্রোভার্ট সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণাঃ
১। অনেকে ভাবে ইনট্রোভার্টরা লাজুক, স্বার্থপর, ভীরু বা কুণ্ঠিত। আসলে তা না। এই বৈশিষ্ট্য ইনট্রোভার্ট এবং এক্সট্রোভার্ট উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে।
২। এরা বন্ধুবৎসল না। এটা ভুল ধারনা। ইনট্রোভার্টরাও বন্ধুবৎসল হতে পারে।
৩। এরা নেতা হওয়ার উপযুক্ত না। এটাও ভুল ধারনা। ইনট্রোভার্টদের কিছু বৈশিষ্ট্য নেতা হওয়ার পক্ষে কাজ করে । যেমন তারা অধিনস্তের কথা বা চিন্তাকে সম্মান করে, তারা দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্যের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখতে পারে, এদেরকে দেখে মানুষ ভয় কম পায় তাই অনেকেই ইনট্রোভার্টদের নেতা হিসাবে পছন্দ করে।
এক্সট্রোভার্ট (বহির্মুখী) মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্যঃ
১। অনেক মানুষের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করে। আমি অনেক সময় পছন্দ করি অনেক সময় করি না।
২। নতুন কারও সাথে পরিচিত হতে পছন্দ করে। আমার এই ব্যাপারে অলসতা আছে। তবে নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে খারাপ লাগে না।
৩। এরা ইনট্রোভার্ট মানুষের চেয়ে কথা বেশী বলে। আমি গ্রুপে কথা বলতে পছন্দ করি। মানুষের কথার পিঠে কথা বলতে ভালো লাগে। গ্রুপের মানুষের কথার মধ্যে থেকে দুর্বলতা বা ঘাটতি নির্ণয় করে কথা বলে থাকি। তবে বলার চেয়ে শুনি বেশী। আমি প্রশ্ন বেশী করি। বক্তার ভুল কথার বিপরীতে কথা বলি অনেক সময়।
৪। এরা সামাজিক বেশী হয়। সোশ্যাল মিডিয়া এবং সমাজে এরা সক্রিয় বেশী থাকে। সোশ্যাল মিডিয়া আমাকে টানে না। তবে ব্লগ পছন্দ করি। সামাজিকতা মেনে চলি তবে বেশী ঘোরাঘুরি দৌড়াদৌড়ি ভালো লাগে না।
৫। এরা হৈ হুল্লোড় না করে চাঙ্গা হতে পারে না। একা থাকলে হাঁপিয়ে ওঠে। আমি এরকম না। অনেক সময় হৈ হুল্লোড় পছন্দ করি কিন্তু সব সময় না। হৈ হুল্লোড় আমার জন্য অপরিহার্যও না।
৬। এদের বন্ধু বেশী থাকে। আমার বন্ধু কম।
৭। গ্রুপে কাজ করতে পছন্দ করে। আমি পছন্দ করি গ্রুপে কাজ করতে।
৮। নতুন কিছুতে আগ্রহ বেশী থাকে। আমার অবস্থান মাঝামাঝি।
৯। এদেরকে দেখে এনারজেটিক মনে হয়। উৎসাহ, উদ্দীপনা বেশী থাকে।
১০। সহজে বন্ধু বানাতে পারে। আমার বন্ধু কম। কিন্তু বন্ধু ছাড়া ছোট বড় মানুষের সাথে সম্পর্ক করতে সমস্যা হয় না। সেই ক্ষেত্রে আমি সহজে সম্পর্ক তৈরি করতে পারি। কিন্তু বন্ধু বলতে আমরা যেটা বুঝি সেরকম বন্ধুত্ব সবার সাথে হতে চায় না।
১১। আবেগ প্রবণ হয় অনেক সময়। আমিও আবেগ প্রবণ। তবে বাস্তববাদী। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সবার সাথে এবং সব স্থানে আবেগ প্রদর্শন করি না।
এক্সট্রোভার্ট (বহির্মুখী) মানুষ সামাজিক যোগাযোগে ভালো হয়। সেলস মার্কেটিং, কাস্টমার কেয়ারের জন্য এরা ভালো। এদের সাংগঠনিক তৎপরতা বেশী থাকে। বেশীর ভাগ নেতা এক্সট্রোভার্ট হয়। বহির্মুখী হওয়ার কারণে এক্সট্রোভার্টদের মানসিক চাপ বা কষ্ট কম থাকে সাধারণত। সহজে নিজের সমস্যার কথা অন্য মানুষকে বলতে পারে। ফলে মনের কষ্ট কমে যায়। অন্তর্মুখী মানুষের ক্ষেত্রে এগুলির বিপরীত ঘটে থাকে। তবে অন্তর্মুখী মানুষ সাধারণত সৃষ্টিশীল কাজ, গবেষণা, শিল্প, সাহিত্যে ভালো করে। অনেকে ভাবে ইনট্রোভার্ট মানুষ স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক। এটা ভুল ধারনা। অন্তর্মুখীতা আর স্বার্থপরতা কিংবা আত্মকেন্দ্রিকতা এক জিনিস না। এক্সট্রোভার্ট (বহির্মুখী) মানুষও স্বার্থপর হতে পারে আবার ইনট্রোভার্ট মানুষ উদার এবং দয়ালু হতে পারে। সমাজে অন্তর্মুখী, বহির্মুখী এবং উভমুখি সব ধরণের মানুষেরই অবদান আছে। কেউ কারও চেয়ে মন্দ বা ভালো না।
আমার ধারনা ইনট্রোভার্ট মানুষ দীর্ঘদিন ব্লগিং করে। বাইরের দুনিয়ার ব্যস্ততা কম থাকার কারণে এরা ব্লগিংয়ের মত সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে দীর্ঘদিন নিয়োজিত রাখে। বহির্মুখী মানুষ বিভিন্ন সামাজিক কাজে এবং বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই তাদের অনেকেই ব্লগিংয়ে বেশী সময় দিতে পারে না।
ছবি – simply psychology
সূত্র – http://www.webmd.com, http://www.treasurers.org
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৩৯