প্রথম দৃশ্য
দৃশ্যপটঃ সকাল ১০টা ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশন এর প্লাটফরমের দৃশ্য। এইমাত্র ভৈরব থেকে একটি ট্রেন এসে প্লাটফর্ম এর ভিতরে ঢুকেছে।প্লাটফরমের হকার আর কুলিদের হন্তদন্ত ছুটোছুটি শুরু হল।বাঙ্গালিদের চিরন্তন তাড়াহুড়োর পরিচিত দৃশ্য এর আরও একটি মঞ্চায়ন।কালো রঙের বিশাল আকৃতির ট্রাঙ্কটি নিয়ে ট্রেন এর দরজায় এসে দাঁড়ালো সোহান। বাইরে তাকিয়েই দেখতে পেল কুলির সাথে উচ্চস্বরে কথা বলছেন এক মধ্যবয়েসি স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক।
“কতবার বলব আমার জিনিসে হাত দিবি না। এই তোদের মতো গোলামদের জ্বালায় শালা শান্তি পেলাম না। শুওরের বাচ্চা একদম হাত লাগাবি না”
কুলিটার বয়স খুব বেশি নয়। অল্পবয়স্ক একটি ছেলে। পরনে হাফপেন্ট আর উদাম গা। গালি শুনে বেশ হকচকিয়ে গেল বেচারা। চারদিকে তাকাতেই তার চোখ পরল সোহানের উপর।সোহান হাতে থাকা ব্যাগটা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।ছেলেটি দৌড়ে এগিয়ে এলো।
“মামা, ধরন লাগব?”
সোহান ট্রাঙ্কটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো
“কত দিব?”
“ত্রিশ টেহা দিয়েন”
“পনের টাকা দিবো, হবে?”।
“বিশ টেহা দিয়েন”
বলেই সোহানের জবাব এর অপেক্ষা না করেই ট্রাঙ্কটি মাথায় তুলে নিল ছেলেটি। বেশ দ্রুত হাটতে লাগল। দ্রুতপায়ে অনুসরণ করলো সোহান।এই শহরের মানুষের উপর তার কানাকড়ির বিশ্বাস নেই। খবরের কাগজ খুললেই চুরি পকেটমার আর বাটপারির খবর।
দৃশ্যপটঃ রেলস্টেশন থেকে বের হওয়ার গেট।গম্ভীর মুখে দাড়িয়ে আছেন টিকেট চেকার।এই ধরনের চাকরি যারা করে এদের মুখে ভাবগাম্ভীর্য থাকা আবশ্যেক। কুলি ছেলেটি বের হয়ে গেল গেট দিয়ে।যদিও হাতের ব্যাগের ওজন খুব একটা না তারপরও একটু পিছনে পরে গিয়েছিলো সোহান। আর এতেই ঘটলো বিপত্তি। টিকেট চেকার আটকে দিলো সোহান কে।
“টিকেট দেখান”
“টিকেট?”
“হ্যাঁ”
পকেটে হাত বাড়াল সোহান। ওয়ালেট টা বের করে আনতে আনতে গেটের অন্যপাশে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখল ছেলেটাকে। অসহায়ের মতো দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই সোহানের। জানে তাকে টিকেট ছাড়া গেটের অন্যপাশে যেতে দিবে না।
ওয়ালেটের মধ্যে খুজে পেলো না তার টিকেট। টিকেট চেকার হাত বাড়িয়ে আছে। চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ভাব। বিসমিল্লাহ বলে পকেটে আবারও হাত ঢুকালো সোহান। বের করে আনল টিকেট। চেকার এর হাতে দিয়েই ছুটে বের হয়ে আসলো গেট দিয়ে।
চারপাশে তাকিয়ে খুজলো ছেলেটাকে। কোথাও দেখতে পেলো না। হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো ক্ষণিকের জন্য। ধির পায়ে হাটা শুরু করলো। বিশ্বাস করতে পারছেনা তার সাথে এইরকম একটি জিনিস হয়ে গেছে। মনের মধ্যে এখনো আশা খুজে পাবে ছেলেটাকে।
টিকেট কাউন্টার পার হয়ে রাস্তায় নেমে আসলো সোহান। ট্রাঙ্কের ভিতরে তার সব কাপড়চোপড় রয়েছে আর প্রথম মাসের খরচটাও তো এর মধ্যেই ছিল। ঠিক মতো চিন্তা করতে পারছেনা সোহান। সূর্যের আলোটা অসহ্য হয়ে চোখের উপর লাগছে। দিনের শুরুটা এর থেকে খারাপ হতে পারে না ভাবল সোহান।হাত দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে শুনতে পেলো
“অই মামা এইহানে আহেন”
শব্দের স্থলের দিকে তাকাল সোহান। ছেলেটি দাড়িয়ে আছে বেশ খানিকটা দূরে কয়েকটি অটোরিকশার পাশে। পাশেই মাটিতে ট্র্যাঙ্কটি রাখা। এগিয়ে গেল সোহান।
“কি মামা, এত দেরি কল্লেন কে। আমার টেহা দেন আমি জাইগা”
কি বলবে খুজে পেলনা সোহান।
পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে পঞ্চাশ টাকা বের করে দিল সোহান।
“পুরোটাই রেখে দে”
ছেলেটির মুখে হাসি ফুটে উঠল।
“গাড়িতে তুইলা দেওন লাগবো মামা?”
“না, লাগবে না”
“সেলামালিকুম মামা” বলে খুশি মনে হাটা শুরু করলো ছেলেটি। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চিন্তা করল সোহান এই নগরীর সব মানুষ ঠিক একরকম নয়। এইখানে যেমন স্যুট টাই পরা ভদ্রলোকও অশুভন আচরণ করতে পারে তেমনি বারো তের বছরের এক ছেলেও রাখতে পারে সততার অদ্ভুত এক নিদর্শন। আশ্চর্য পৃথিবী আর তার থেকেও আশ্চর্য এই পৃথিবীর মানুষগুলো।
ট্র্যাঙ্কটা একপাশে রেখে সিগারেট নিতে গেল সোহান। বেন্সন সিগারটে সুখটান দিতে দিতে ভাবল সোহান দিনের শুরুটা খারাপ হয় নি।
বাস এর মধ্যে উঠেই মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল আসলাম হুজুরের। তার আসল নাম আসলাম। মাদরাসায় অনেক দিন পরাতে পরাতে কখন যে নিজের নাম এর সাথে হুজুর শব্দটা লেগে গেল তা নিজেও জানেন না। এখন কেউ হুজুর না বললে কেমন খালি খালি লাগে। বাসে ঢুকেই দেখতে পেলেন জানালার পাশের সিটটা দখল করে এক ছেলে বসে আছে। কানে আজকালকের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মতো কি একটা গুজে রেখেছে। একটুক্ষণ পরপর মাথা দুলাচ্ছে। সকালে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছেন ঠিক মনে করতে পারলেন না আসলাম হুজুর।পুরো রাস্তা এর পাশে বসে যেতে হবে ভেবেই মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বের হয়ে এলো “আস্তাগফিরুল্লাহ”।
হাথের ব্যাগটা উপরে রেখে সিটে বসলেন আসলাম হুজুর।
“বাবা, একটু সরবেন পিকটা ফেলাব”
“জি?, শুনতে পারলাম না। সরি আমার এয়ারফনের জন্য কিছু শুনতে পেলাম না”
হা করে মুখের ভিতরটা দেখিয়ে দিলেন হুজুর। আর কিছু বলতে হল না ছেলেটা সরে বসল। মনে মনে হাসলেন হুজুর। এসব ছেলেদের ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। এখনো নাক টিপলে দুধ বের হবে এদের।
সিটে গা এলিয়ে দিলেন হুজুর। পাচ মিনিটের মাথায় গভীর ঘুমে নেতিয়ে পরলেন। এই বেপারটা আগেও লক্ষ করেছে শান।কিছু মানুষ গা এলিয়ে দেয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পরতে পারে।এই অভ্যাসটা থাকলে বেশ সুবিধে হতো তার। সবচেয়ে ভাল হতো যদি
একটা সুইচের মতো থাকত। বাসে উঠেই সুইচ টিপে দিয়ে ঘুমিয়ে পরতে পারত। তবে হ্যাঁ ঘুমের বদলে এখন যা করছে তাও খুব একটা খারাপ নয়। বরং বেশ ভালই উপভোগ করছে শান।কানে আবারও এয়ারফোন গুজে দিল শান। জানালার বাইরে তাকাতেই ধাণ ক্ষেতের মধ্যে চোখ পরল একটা ছোট বাচ্চার উপর। দৌড়ে হাত নাড়তে নাড়তে বাসটার দিকে ছুটে আসছে।বাচ্চাটি জানে বাসের কাছেও আসতে পারবেনা তবুও যেন দৌড়ে বাসটাকে হারিয়ে দেওয়ার খেয়াল।
হাইওয়ে ইনে বাস থামার পরই ঘুম ভাঙল আসলাম হুযুরের। পাশের সীটের ছেলেটি নেই। চোখ ডলতে ডলতে বাস থেকে নামলেন হুজুর। বেশিক্ষন নেই দ্রুত খেয়ে নিতে হবে। দ্রুতপায়ে ঢুকলেন রেস্টুরেন্ট টিতে। পনেরো মিনিটের যাত্রাবিরতি। দ্রুত হাত ধুয়ে ওযুটাও করে ফেললেন হুজুর। কোথায় বসবেন চিন্তা করতে করতে চারদিকে চোখ বোলালেন। ছেলেটা কে দেখতে পেলেন একমনে খেয়ে যাচ্ছে আর এখনো কানের মধ্যে গুজে আছে জিনিসটা।আল্লাহপাক খাওয়ার সময় অন্য কিছু করা পছন্দ করেন না। ছেলেটাকে কথাটা বলা উচিত। আবার ভয়ও লাগছে কি না কি মনে করে। আবার ভয়ই বা কিসের এসব ছেলে ছুঁকরা কত দেখেছেন তিনি। নামাজটা পরে নেয়া দরকার ভাবলেন হুজুর। আবার পেটের খিদা নিয়ে নামাজ পড়াটাও ঠিক হবে না। অনেক ভেবে চিন্তে ছেলেটির পাশে বসেই পরলেন। হোটেল এর বেয়ারারা ছুটোছুটি করছে। তার দিকে কেউ ঘুরেও তাকাচ্ছে না। আজকাল মানুষজন আগের মতো আর সম্মান করে না। দেখেও না দেখার ভান করে। আল্লাহপাকের গজব কি আর এমনিতেই আসে?।
ছেলেটা একমনে খেয়েই যাচ্ছে। তিনি যে জলজ্যান্ত একজন মানুষ বসলেন তার কোন ভাবান্তরই নেই। দেশ থেকে আদব কায়দা নামক জিনিসটা একেবারেই উঠে যাচ্ছে।
অবশেষে তার দিকে অল্প বয়েসী এক ওয়েটার এগিয়ে আসল,
“কি নিবেন আপনে”
“পরোটা আছে?”
“না পরোটা শেষ”
“হালকা খাবার কি আছে?, ভাত খাব না”
“হালকা খাবার কিছু নাই যা আছে সব ভারি”
হুজুরের কথাটা শুনে মনটা বড়ই খারাপ হল। ছেলেটা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে।
“ঠিক আছে, পানি হবে?”
“কিসের পানি, ফিল্টার না জেনারেল?”
“ফিল্টার পানি হলে ভাল হয়”
“ফিল্টার পানি নাই”
ছেলেটাকে এই মুহূর্তে কষে একটা চড় লাগাতে পারলে ভাল হতো। অনেক কষ্টে রাগ দমন করলেন হুজুর। আল্লাপাক বলেছেন রাগ অত্যন্ত খারাপ ব্যাপার। হাদিসে এসেছে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় রেগে গেলে বসে যেতে এবং বসা অবস্থায় রাগ লাগলে শুয়ে পরতে। আসলাম হুজুর বসে আছেন। তিনি এখন চাইলেও শুয়ে পরতে পারবেন না। রেস্টুরেন্ট এর মেঝেতে ভর দুপুরে পাঞ্জাবি পাজামা পরে তার শুয়ে থাকার দৃশটা মোটেও স্বাভাবিক না। হাতের ইশারায় ওয়েটার ছেলেটাকে চলে যেতে বললেন হুজুর।
আজকে আর কিছু খাওয়া হবে না, নামাজটা পরে নেয়া উচিত।
শান দুটো পরোটা শেষ করে বের হল রেস্টুরেন্ট থেকে। খুব বেশি সময় নেই তাড়াহুড়ো করে পকেটে থাকা সিগারেট বের করে ধরাল। কান থেকে এয়ারফনটা খুলে নিল। কান এখনো ঝা ঝা করছে। প্রচণ্ড রোদ আকাশে। বাস এর সামনে দাড়িয়ে সিগারেট টানছে শান।
“বাবাজীর নাম কি?”
কথা শুনে ঘার ঘুরিয়ে তাকাল শান। পাশেই বাসএ পাশের সিট এ বসা হুজুর দাড়িয়ে আছেন। কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন টের ও পায়নি। মানুষ হাটাচলার দিক থেকে দুই প্রকার। এক প্রকার হাটা চলা করলে পুরো দুনিয়া টের পায় আর আরেক প্রকার হাটাচলা করে এতোটাই নিঃশব্দে যে বাতাশ ও টের পায়না। ইনি হচ্ছেন শেষের গোত্রের।
“আমি শান”
“কিছু মনে করবেন না বাবাজী একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হু করেন”
“জে, আপনার কানে ওটা কি ছিল? অনেকক্ষণ ধরে আমি পলো করেছি, ওটা দিয়ে কি গান শুনা যায় না?”
“জি ওটা দিয়ে গান শুনা যায়”
“হুম, দেখছেন আল্লাহপাকের কি কেরাসমতি। এইটাও কিন্তু আল্লাপাকের এক বিরাট বড় নিয়ামত। তাই না বাবাজী?”
“জী”
“তবে কথা হচ্ছে কি জানেন? আজকালকের মানুষেরা আল্লার নেয়ামতরে নষ্ট করতেছে, এই জে যেমন ধরেন আপনে এইটা দিয়ে যদি গান শুনেন আপনার কিন্তু কানে সমস্যা হতি পারে। বাজান কি মাইন্ড কইরলেন। আমি মূর্খধুরখ মানুষ মনে যা আসে বলে ফেলি। মনে কষ্ট নিয়েন না”
“না, ঠিক আছে” বলে শান সিগারেটটা ফেলে দিল।
“চলুন বাস ছেড়ে দিবে”
আসলাম হুজুর শান এর পিছন পিছন এগুলেন। মুখে ত্রিপ্তির হাসি নিয়ে এগুলেন। ছেলেটাকে কয়েকটা কথা শুনানো গেছে। বাসে উঠে সেই হাসি বেশিক্ষন থাকলো না। ছেলেটা বাস ছাড়ার সাথে সাথেই কানে জিনিসটা গুজে দিয়ে মাথা দুলানো শুরু করে দিয়েছে।
হুজুর চিটাগাং এ যে সরু গলিটিতে থাকেন সেখানে কুকুরদের অভয়াস্রম। সেখানে প্রতিদিন ই একটি কুকুর কে দেখতেন হুজুর মসজিদে যাওয়ার সময়। বিচিত্র এক রুগে আক্রান্ত কুকুরটা সারাক্ষণ ই মাথা দুলাতো। এই কুকুরের সাথে ছেলেটির মাথা দোলানোর খুব একটা তফাত নেই।পরক্ষনেই তওবা করলেন হুজুর। আল্লাপাক পবিত্র কোরআন মজিদ এ বলেছেন মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত। অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জিব। জন্তু জানুয়ারের সঙ্ঘে মানুষের তুলনা করলে আল্লাহ পাক নাখোশ হন। তওবা তওবা বলে আবারও গালে তিনবার হাত বোলালেন হুজুর। শান সিটে মাথা রাখতেই ঘুম চলে আসল।আসলাম হুজুর তার ঘুমের সুইচ এখনো খুজে পান নি। পাশেই ছটফট করছেন। মেয়ের বিবাহ নিয়ে বিশাল চিন্তায় আছেন।
রেজার ঘুম ভাঙল সকাল নটায়। সাধারণত এতো সকালে ঘুম ভাঙ্গে না। অলস শরীরে উঠে বসল বিছানায় রেজা। আজকের দিনের জন্য অনেক কাজ পরে আছে। পাড়ার কয়েকটা ছেলে বড় সমস্যা করছে। এদেরকে সাইজ করতে হবে। এ কাজে বেশিক্ষন লাগবে না। রফিক, পাড়ার ছোটভাই অনেক্ষন ধরে কল দিচ্ছে। গলির মুখে সবাই ওর জন্যে দাড়িয়ে আছে। থ্রি কুয়াটারটা পায়ে গলিয়ে উঠে দাঁড়াল রেজা। সকাল সকাল ভেজাল করার কোন ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু এদেরকে শায়েস্তা না করলেই নয়।হাতে ব্রেসলেট টা লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আজকে একবার সেলুনে যেতে হবে ভাবল রেজা। চুল টা ঠিক করে বের হয়ে পরল সে।
গলির মুখের চা দোকানটাতে দাড়িয়ে আছে সবাই। রফিক, ঝন্টু আর মন্টূকে দেখতে পেল। দোকানের বাইরে মোটরসাইকেল টা রফিকের ই হবে। আর ওআন ফাইভ মোটর সাইকেল। জিনিস ভাল।
“ভাই এত লেইট করলেন যে?”
“তগো লাইগা কি ঘুম বাদ দিয়া দিমু?”
“ওরা এখনো মাঠের সামনে খারাইয়া রইসে, ডাক দিমু?”
“তো বইয়া রইসত কেন, তগো কি সব বইলা দেওয়া লাগবো। বেইসিকস যদি ভুইলা যাস তাইলে কেমনে অইব” বলতে বলতে লাইটার দিয়ে সিগারেটটা ধরাল রেজা।
হাটা শুরু করল রেজা। একটু দূরে এসেই ঘুরে দাঁড়াল,
“তোর মোটরবাইক টা নিয়া আয়”
“কি কন ভাই মোটরবাইক লাগব? হাইটাই তো যাওন যাইব”
“তোরে যা বলসি কর”
রফিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোটরবাইকে উঠে বসল। তেল খুব একটা নেই। আজকে বিকেলে আবার মরজিনারে কথা দিছে বাইকে করে ঘুরতে বেরুবে। আজকালকের মেয়ে ছেলে বাইক ছাড়া ডেটিংএ আসতে চায় না। মরজিনাও এর ব্যতিক্রম না। মরজিনা দেখতে অতীব সুন্দরী।তার চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারেনা রফিক।কিন্তু তার মতো মেয়েরে সকালে বিকেলে রুটিন করে পিটানো উচিত। অত্যন্ত দুশ্চরিত্রা মেয়ে। আজকে যদি বাইক নিয়ে না যায় তবে ঠিক ই পাশের পাড়ার সুমন এর সাথে বাইকে করে বের হয়ে পরবে মাগি টা। এদিকে আবার রেজা ভাই এর কথা ফেলে কেমনে। রেজা ভাই এর কথার উপরে তো কথা চলে না। ভাই রে বললেই অবশ্য টাকা দিয়ে দিবে। দেখা যাক কি হয়।
আরওয়ান ফাইভে স্টার্ট দিতেই পিছনে উঠে বসলেন রেজা ভাই। রেজা ভাই বাইক চালাতে পারেন না। এই তথ্য আবার অতি গোপন। ভাই এর কড়া নিষেধ আছে কেউ যাতে না জানে। রেজা ভাই এর অনেকগুলা গোপন কথা আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সবাই কেমন করে যেন ভাই এর গোপন কথাগুলী জানে। রফিকের ধারনা রেজা ভাই নিজেই কথাগুলো সবাই কে বলে বেড়ান। এই যেমন রেজা ভাই চারবারের চেষ্টায় ম্যাট্রিক পাশ করেছেন। ইন্টার অবশ্য দুই বারের চেষ্টা তেই পার পেয়ে গেছেন। এই নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই।গত এক বছর যাবত রেজা ভাই কিছু করছেন না। এইবার তার শখ জেগেছে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। রফিক কে বলেছেন ফর্ম তুলে নিয়ে আসার জন্য। তাকে এক হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। রফিক পুরো টাকা টা দিয়ে মরজিনার জন্য একসেট ইমিটেসন এর গয়না না কিনেছে। রাস্তার পাশে নিয়ে বসেছিল, দেখে কিনার লোভ সামলাতে পারেনি। গয়না পেয়ে মরজিনা খুবই খুশি হয়েছিল।
“আল্লা এত সুন্দর গয়না কই তেইক্কা নিয়া আইলেন”
“পছন্দ হইসে তোমার?”
“হ পসন্দ হইসে। এইটা কি সত্যি সত্যি সুনার?”
“হ হ একদম খাটি সোনা।এক্কেরে আট আনা সোনা দিয়া বানানো। ধানমন্ডির কমলা ভান্ডার থেকে নিয়া আসছি। বিশাল বড় দোকান। তোমারে একদিন নিয়ে যাবো। দেখলে মাথা আউলাইয়া যাইব।”
“আল্লাহ আপনারে ইচ্ছে করতেসে জরায়ে ধরি”
এখন তো জরায়ে ধরবি কত কিছু করবি, শালী মাগীর জাত। মনে মনে বলল রফিক। মুখে কিছু বলল না। রফিক তখনি বুঝতে পেরেছিল মরজিনার হাথে ধরা খেয়ে যাবে। শালী বহুত চালাক। ধরা যখন খাবে তখন যা হবার হবে, মরজিনার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল রফিক।
তখনি পিছনে বসা রেজা ভাই মুখ খুললেন,
“রফিক, তোরে যে বলসিলাম ফর্ম নিয়া আসতে তার খবর কি?” জিভে কামড় দিল রফিক।
“হ ভাই গেসিলাম তো ফর্ম তুলতে।সেখানে এক বিরাট কাহিনী। গিয়া সিএনজি ভাড়া দিতে গিয়া দেখি পকেট ওয়ালেট নাই। সামনের পকেট পিছনের পকেট সব দেখলাম কোথাও কোন ঠিকানা নাই”
“কস কি! ওয়ালেট কি হাওায়ায় উইরা গেল”
“আমারও তো সেই একই কথা। ওয়ালেট যাবে কথায়।এর তো আর পাখনা নাই যে উরে যাবে। শেষমেশ সিএনজিআলার কলার চাইপা ধরলাম। শালা আমার ওইয়ালেট কই বাইর কর। সিএনজি শালা শুরু করল কান্দন। সেকি কান্দন। শেষমেশ আর কি করা খালি হাতে বাসায় ফিরত আসলাম একই সিএনজি তে করে। ড্রাইভারকে দুপুরের ভাত খাওাইয়া দিলাম। হাথে দুশো টাকাও গুজে দিলাম। খামাখা বেচারা কে দোষ দিয়ে লাভ আছে কন?”
“হুম”
“কি দিনকাল পরছে। পকেটমারদের জ্বালায় ঘর থেকে বাইর হয়ন যায় না” ঢোক গিলতে গিলতে বলল রফিক। ঠিক বুঝতে পারছে না ভাই কথাগুলো বিশ্বাস করছে কি না। মাঠের সামনে চলে এসেছে। বাইক থেকে নামলেন রফিক ভাই। এর মধ্যে কোথা থেকে যেন তার চোখে রোদ্রচশমা চলে এসেছে। রফিক এর মন টা খুশি হয়ে উঠল। রেজা ভাই এর চোখে চশমা মানে বিটলাদের কপালে খারাপি আছে।
রেজার কাধ টা এমনিতেই চওড়া আর মোটরবাইক থেকে নামার পর সেটাকে যেন আরো চওড়া মনে হল। দুলকি চালে হেটে এগুলো সে ছেলেগুলোর দিকে। এই ছেলেগুলোর মধ্যে কেউ একজন রফিকের নাম ধরে ডেকেছে। বিষয়টাকে ছোট করে দেখা যেত কিন্তু ছেলেটা নাকি তার নাম শুনেও ভয় পায় নি। আজকে দেখিয়ে দিতে হবে রেজা কি জিনিস। রফিক পাশে এসে দাঁড়াল।
“ভাই পা ছালান শালাদের সাইজ করে আসি”
“চল, কোন ছেলেটা নাম ধরে ডাকছে দেখা আমারে”
“ইয়ে মানে একটা সমস্যা হইসে যে”
“কি সমস্যা?”
“মাইন্ড কইরেন না। আমার প্যচ লাইগা গেছে কুনটার সাথে যে ভেজাল হইসে এইটাই ভুইলে গেসি। আজকালকের ছেলে ছোকরাদের চেহারা সব দেখতে একরকম”
“আজকালকের ছেলে ছোকরাদের চেহারা সব দেখতে একরকম গাধার বাচ্চা গাধা। তোর বাপ কি সবগুলারে পয়দা করসে যে একরকম চেহারা হইব? তরা যে কোনদিন মানুষ হবি”
ইতিমধ্যে বাকীরাও চলে এসেছে।
“ওই তরা কেউ চিনস না কোন বাল টার সাথে কথা হইসে?”
“চিনি ভাই আমি ভাল করেই। আপনি কন তো ডাইকা নিয়া আসি?”
“যা ডাইকা নিয়া আয়। বলিস তার আসল বাপ ডাকতাসে”
“ঠিক আছে বস” বলেই জব্বার হাটা শুরু করল
ঠিক এক মিনিট পর বাম গালে ঠাস করে একটা চড় খেলো জব্বার। দৃশ্যটা দেখে রফিকের মুখ হা হয়ে গেল। রেজার চেহারা দেখে মনে হলো তাকে পাচ তালার ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে।
জব্বার গালে হাত বোলাতে বোলাতে ফিরে আসল।
“ভাই চড় মারসে”
“তা তো দেখতেই পাইসি। এখন কি পুরো পাড়া মাইকিং করাবো?”
“ভাই এর কিন্তু একটা বিহিত আপনার করতেই হইব”
“তুই খারা এইখানে। বাকিরা আয় আমার লগে। টিটু রফিকের বাইক নিয়া আমার বাসায় যা। বিছানার নিচে দেখবি হকিস্টিক আর রাম দা রাখা আছে নিয়া আয়”
“ঠিক আছে বস”
রেজা ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটাকে দেখে মনে হচ্ছে একটু নেতা গুছের সামনে এগিয়ে এলো।
“কি সমস্যা?”
“ সমস্যা কিছু না। জব্বার রে মাইরা কাজটা ভাল কর নাই। এক বার বলব দুইবার বলব না। জব্বার এর পায়ে ধরে মাপ চাবা। আর কালকে থেকে যেন এইখানে না দেখা যায়। কথা কি কানে গেছে?”
“আর যদি মাপ না চাই?”
“শোন, পাড়ায় নতুন আসছ। দেখে তো মনে হয় বুদ্ধিশুদ্ধি খারাপ না। তুমি আর যাই হোক বেকুব না। কয়দিন আগে আর এক ছেলে বড় বারা বাড়ছিল। মোড়ের দুকানে জিজ্ঞেস কইর তারে কি করসি। লাশ খুইজা পাইবানা।থানা পুলিশ কইরা লাব নাই। আমি সপ্তাহে একদিন উনাদের সাথে নাস্তা করি, সকালের নাস্তা। আমার বড়ই আদর যত্ন করে তেনারা।ঘুষের টাকা তো তাই প্রতিদিনই পরোটা আর গরুর মাংস থাকেই।অত্যন্ত ভাল খাবার। যাইহোক সেই গল্প আরেকদিন কড়া যাবে। তোমার বইন তো মাশাআল্লাহ দেখতে খারাপ না। কুন জায়গায় পরে যেন? তুমার বইন রে বইল রেজা ভাই বলসে বোরখা পরে চলাফেরা করতে। লজ্জা হচ্ছে নারীর ভূষণ। দিন কে দিন জিনিসটা একদম উঠে যাচ্ছে। আমি জানি এখন তুমার আমারে ছিরে খাইতে ইচ্ছে করতেসে। জানো ছেলেটারে কি করেছি। মোড়ের যে দুকানটার কথা বলছি সেইখান এ দেইখ ছয়টা কুকুর আছে। এদের চউখের দিকে তাকাইলে বুঝতে পারবা লাশ কই গেছে। মাপ চাওয়া না চাওয়া তুমার ব্যপার। কুকুর গুলা অনেকদিন না খেয়ে আছে। অতিসত্বর এদের খাওয়ার ব্যবস্থা আমারেই করতে হবে।আইজ আমি আসি। ছাছা ছাছিরে সেলাম দিয়ো” ঘুরে দাড়িয়ে দুলকি চালে হাঁটা শুরু করল রেজা।
এতক্ষনে চোখ পড়ল টিটুর উপর। হকিস্টিক হাথে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সোজা আঙ্গুলে যেমন ঘি উঠে না তেমনি বাঙ্গালীদের জন্য সোজা কথায় কাজ হয় না। এদের জন্য মাথা বাঁকানো হকিস্টিক লাগে।
আমার নাম করিম। আমি ক্লাস টেন পাশ। বাড়ি আমার সিলেটে। তবে ঢাকায় আমার বাপের আমল থেকেই আছি। ভালই শুদ্ধ পারি। আমার স্ত্রী সবসময় বলে সাহেবদের মতো স্যুট লাগিয়ে শুদ্ধ বললে কেউ ধরতেই পারবনা আমি ম্যাট্রিক পাশ। আমার স্ত্রী দেখতে মাশাল্লাহ খারাপ না। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে বিয়ে করেছে আমায়। বেশ বড় ঘরের মেয়ে। তার মুখে প্রশংসা শুনলে মনটা ভরে যায়। বড়লোকের বেটি হলে কি হবে পালিয়ে বিয়ে করেছে বলে বাপ কখনোই মেনে নেয় নাই। শালা বুইরা খাটাশ। বিয়ের পরে আমি পরলাম বিশাল ঝামেলায়। অদিকে ওর বাপ মেনে নেয় না আর এদিকে আমার বাপ এর ইনকাম নাই।এ যেন উভয় সংকট। এই ঢাকা শহরে ম্যাট্রিক পাশ করা লোকের চাকরি নাই। ড্রাইভার হতে হলেও এইচএসসি পাশ করতে হয়। চাকরীর জন্য অনেক ঘোরাঘুরি করলাম। কিছুতেই কোন কাজ হলোনা।শেষমেস কোনরকম বিভিন্ন জায়গায় হাথে পায়ে ধইরা কয়টা টাকা যোগাড় করলাম। ঠিক করলাম টং দোকান খুলে বসব। যেইখানে থাকি সেই জায়গার পাশেই বিশাল এক রাস্তা হবে। বাংলাদেশি সরকার এত বড় রাস্তা করতে তিন বছর তো লাগবেই। যেই ভাবা সেই কাজ। রাস্তার পাশেই পসরা সাজিয়ে শুরু হল আমার ছোট টং এর যাত্রা। আপনাদের সাথে মিথ্যা বলবনা। আমার কিন্তু আয় ইনকাম বেশ ভালই আছে। বড় রাস্তার পাশেই তিন তিনটা ইউনিভার্সিটি। ওই গুলোর মামাদের উছিলায় বেশ ভাল রুটি রোজগার আমার। আজাকালকের ছেলে দের কে মামা বললে কোন এক বিচিত্র কারনে তারা বেশ খুশি হয়। আর উনাদের উছিলায় আমারও বেশ ভালই চলে যায়।
টং দোকানের দৃশ্য
দোকানটার ঠিক সামনে একটা বেঞ্চ পাতা। তার পাশেই আড়াআড়ি করে তিনটা চেয়ার পাতা। দোকানটার ভিতরে একটা মিনি ফ্রিজার রাখা। করিম দোকানের কাঠের মেঝেতে বসেই কাজ করে। ঠিক তার সামনেই একটা ট্রে তে চা য়ের কাপগুলো সারিবদ্ধ করে রাখা। চিনি কনড্যান্স মিল্ক সহ বাকি সরঞ্জাম গুলোও ট্রে তেই রাখা। এর পাশেই পানিভর্তি লাল একটা বালতি রাখা কাপগুলো ধোয়ার জন্য।
উপরের কাঠের কাঠামো থেকে সারি সারি চিপস এর প্যাকেট ঝুলছে। আরো ঝুলছে কেক আর হরেক রকমের বিস্কিট এর প্যাকেট। করিমের বসার জায়গার ঠিক ডানদিকে রয়েছে সারি সারি সিগারেটের বাক্স সাজিয়ে রাখা। এর পাশেই রয়েছে পানির ফিল্টার। হরেক রকম চা এর পাশাপাশি হাতে বানানো কফিরও ব্যবস্থা আছে করীম ভাই এর টং এ।
ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়েই ছেলে মেয়েরা ভিড় করে করিম ভাই এর দোকানে।
কেউ চা খায় কেউ বা কফি। অনেকেই আবার একটার পর একটা সিগারেট টেনে যায়। ক্লাস চলাকালীন সময় তো বটেই, সন্ধ্যার পরও ভিড় লেগেই থাকে।
আশেপাশে আরও কয়েকটা টং এর দোকান আছে। তবে করিম ভাই এর টাই বেশি চলে।
(চলবে)