১) রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের বাজেট ছিলো ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার। যেটার মধ্যে ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিলো রাশিয়া, যেটা ২০৩৫ এর মধ্যে ফেরত দেয়া লাগবে। ইতোমধ্যে রূপপুর এর দূর্নীতির অনেক গল্প শুনেছি, বালিশ উত্তোলন এর ফ্যান্টাসি গল্প শুনেছি। তবে আজকে যা শুনলাম সেটা তিলে চমকে উঠার মতো। শেখ হাসিনা নিজেই ৫ বিলিয়ন ডলার মেরেছেন এই প্রকল্প থেকে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের টোটাল ব্যক্তিগত সম্পদ ৪.৫ বিলিয়ন ডলার, আর হাসিনার একটা প্রকল্প থেকেই আয় ৫ বিলিয়ন ডলার। শুধু ভাবি বাকী যতগুলো প্রকল্প ছিলো বড় বড়, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, অন্যান্য সব পাওয়ার প্ল্যান্ট এগুলো থেকে কি পরিমাণ টাকা সরাইসে খোদ শেখ হাসিনা! বাকীদের হিসাব বাদই দিলাম। এইযে পদ্মা সেতু নিয়ে এত কান্নাকাটি করতো মহিলা, পদ্মা সেতুর বাজেট ৩.৬ বিলিয়ন ডলার, অর্থ্যাৎ অলমোস্ট দুইটা পদ্মা সেতু করে ফেলা যায়। যদিও এসব বাজেটও আসল খরচ থেকে কয়েকগুণ বেশি ধরা হয়। এখন বুঝতেসি কেন সারাবছর এত প্রজেক্ট পাশ হতো, কেন সরকারের এত মেগাপ্রজেক্ট করার পিনিক ছিলো, কেন এত ঋণ নিতো, দানের জন্য হাত পাইতা ঘুরতো সারাবছর; সবই এভাবে অর্ধেকটা পকেটে পুরে ফেলার জন্য, বাকী যা থাকতো তাও ক্রমান্বয়ে পকেটে পুরতে পুরতে একটা সময় অল্প কিছু টাকা বাকী থাকতো, অইটুকু দিয়েই কাজ কভার করা হতো কোনোমতে। Transparency International কন্সার্ন তুলসিলো দূর্নীতি আর সেফটি নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রে, দূর্নীতির খোলাসা তো হয়েই গেলো, কিন্তু আমার এই সেফটির ব্যাপারটা নিয়ে মারাত্মক ভয় হচ্ছে, আর এক ফোঁটাও ভরসা করতে পারছিনা এই ১৫ বছরের কোনোকিছুকেই!
২) সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে FY24 এ ৪১ হাজার কোটি টাকা লোন নিয়েছে, যেই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ছাপিয়ে তারপর সরকারকে দিয়েছে। অথচ গতবছরই যখন মূল্যস্ফীতি তুঙ্গে আর সরকার এর ঋণের পরিমাণ অনেক ছিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের সভায় সিদ্ধান্ত হয় FY24 এ সরকারকে কোনো ঋণ দেয়া হবে না। অথচ যখন দেশ মূল্যস্ফীতির অসুখে জর্জরিত, ২ অঙ্কের ঘরে চলে গেসে মূল্যস্ফীতি, তখন সরকার এই লোন চায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সেটা শুধুমাত্র "মৌখিক" অনুমোদন দিয়ে, গোপনীয়তা রক্ষা করে, সরকারকে ৪১ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দেয়, যেটা কোনো নিয়ম এবং কোনো নীতিমালার মধ্যেই পড়ে না। সরকার ৪১ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে, যেটা সম্পূর্ণ জনগণের সম্পদ, অথচ কোনো মানুষ, কোনো মিডিয়া সেটা জানে না, "গোপন" এ সেই ঋণ দেয়া হয়েছে। যদিও আমি এটাকে ঋণ বলতে নারাজ। অতিরিক্ত ৪১ হাজার টাকা ছাপানো মূল্যস্ফীতির আগুনের জন্য যে ঘি, এটা তারাও জানতো,কিন্তু আপন স্বার্থই পরমধর্ম তাদের কাছে। এই ঘটনাটা আমাকে জিম্বাবুয়ের মুগাবের কথা মনে করিয়ে দিলো অনেকদিন পরে। আরও মনে পড়লো মাইকেল জ্যাকসনের গানের একটা লাইন,"They don't really care about us"
৩) দরবেশ সালমান এর টোটাল ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকেই ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এই জনতা ব্যাংক গতবছর অন্য গ্রাহকদেরকে ঋণ দিতে পারে নি, পারার কথাও না, সব তো আগেই দরবেশ খেয়ে নিয়েছে, পাতিল তো ফাঁকা। দরবেশ মোট ২৮ টি কোম্পানি বানায়, জনতা ব্যাংক থেকে লোন নেয়ার জন্য এবং তাদের নামে এই ২৩ হাজার কোটি টাকা লোন তুলে। সবচেয়ে মজার কথা, সে একটা কোম্পানিকে দিয়ে লোন নেয়ায়, সেই লোনের টাকায় আরেকটা কোম্পানির লোন পরিশোধ করে। এসব কোম্পানির বাস্তবে কোনো অস্তিত্বও নেই। মজার কথা, বেক্সিমকো অনেক আমদানি করেছে ভারত থেকে, যেগুলোর বিল দেয় নাই মাল হাতে পাবার পরে, কতটুকু বাটপার ভাবা যায়! রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে ৫৬ মিলিয়ন ডলার লোন নেয় বেক্সিমকো, যেটা জনতা ব্যাংক বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে এনে দিয়েছিলো। আমরা ভাবতে থাকলাম, রিজার্ভ এভাবে দৌড়ায় কমে যাচ্ছে কেন,অন্যদিকে দরবেশ এন্ড ফ্রেন্ডস রিজার্ভ ফাঁকা করে পকেটে পুরছিলেন। সেই ঋণ ফেরত দেয়ার স্ট্রিক্ট নিয়ম থাকার পরেও জনতা ব্যাংক কোনো একশান নেয় নি। উলটা তারা এসব হিসাব গোপন করে দেখিয়েছে ২০২৩ এ নাকি ৫৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা ছিলো। অথচ এই হিসাবসহ হিসাব করলে দেখা যায় ১ হাজার কোটিরও বেশি টাকা লোকসান হয়েছে গতবছর। এসবকিছুর ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান, যাকে হয়তো দরবেশই তেলপানি দিয়ে চেয়ারে বসিয়েছিলো।
এর পরিনাম কি হলো? জনতা ব্যাংকে জনতারই ১.১০ লাখ কোটি টাকা ঝুঁকিতে পড়ে গেলো, জনতা ব্যাংক জনতাকেই লোন দিতে পারলো না, জনতা ব্যাংক বিদেশী ঋণদাতাদের কাছে কালো তালিকাভুক্ত হলো। অথচ জনতা ব্যাংক এ সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ টাকা রাখলো, সালমান সেসব টাকা অনায়াসে নিজের পকেটে ভরে নিয়ে চলে গেলো, লোনের সক্ষমতার সবটা নিজে একাই খেয়ে নিলো। কতটা মর্মান্তিক যে ব্যাপারটা!
৪) IFIC ব্যাংকে সালমানের শেয়ার ২%, তার ছেলের শেয়ার ২%, সরকারের শেয়ার ৩২.৭৫% এবং ৬১% শেয়ারের মালিক হলো সাধারণ শেয়ারধারীরা অর্থাৎ সাধারণ জনগণ যারা শেয়ার মার্কেট থেকে শেয়ার কিনেছে। অথচ এই ২% শেয়ার নিয়ে সালমান সেই ২০১০ সাল থেকে ১৪ বছর যাবৎ ব্যাংকটার চেয়ারম্যান। এই ব্যাংকটা টোটাল লুটপাট করেছে সালমান, সে তার নিজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর নামে, বেনামে ঋণ নিয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। মন চাইতো আর কোম্পানি খুলে ঋণ নিয়ে নিতো। ঋণ আসতো কোথা থেকে? মানুষের জমা রাখা টাকা।
আবার সে গতবছর তার নিজেরই একটা প্রতিষ্ঠান এসটিএল এর নামে ১ হাজার কোটি টাকা বন্ড ইস্যু করায় এই শর্তে যে এসটিএল যদি ব্যার্থ হয় পরিশোও,তাহলে সেই ঋণ IFIC নিজে পরিশোধ করবে। মানে কত বজ্জাত আর বাটপার! তার প্রতিষ্ঠান টাকা নিবে, জনগণের জমা টাকা থেকে, সেটা পরিশোধ করবে না, সেটা আবার ব্যাংক পরিশোধ করে দিবে জনগণেরই টাকা দিয়ে! প্যারাডক্সিকাল দরবেশ।
দিনশেষে মারা খাইলো কে? সাধারণ মানুষ আর দেশের অর্থনীতি।
৫) ৮ টা ব্যাংকের রিপোর্ট বেরিয়েছে, তারা ৪৫,০০০ কোটি টাকা লোন নিয়েছে। অথচ তাদের জমা টাকা ছিলো ২৪০০ কোটি(!), তাদের জন্য বৈধ ঋণসীমা ছিলো ১২০০ কোটি টাকা। তারা করলো কি, সবাই সবার সাথে হাত মেলালো, ফ্রেন্ডস ক্লাব টাইপ বানায় নিলো, তারপর একজন আরেকজনকে লোন দিলো, আরেকজন আরেকজনকে লোন দিলো, সেইজন আরেকজনকে লোন দিলো। এভাবে সবাই সবাইকে লোন দিয়ে ও নিয়ে ৪৫,০০০ কোটি টাকা গায়েব! বাহ! Innovation at It's peak!
এখানেও টাকা গেলো কার? মারা খাইলো কে? সাধারণ মানুষ আর দেশের অর্থনীতি।
৬) দেশের যত মেগাপ্রজেক্ট হয়েছে গত ১৫ বছরে ম্যাক্সিমাম এরই বাজেট ধরা হয়েছে প্রয়োজনীয় খরচের ৫-২০ গুণ বেশি। বেশিরভাগ প্রজেক্টেরই বাস্তবসম্মত প্রয়োজনীয়তা এবং স্বার্থকতা নেই। এদের বেশিরভাগই তৈরি হয়েছে বিদেশী ঋণের টাকায়, যেগুলোর জালে আমরা এখন জর্জরিত। সেই ঋণ করে আনা টাকা করা হয়েছে লোপাট, বিদেশে হয়েছে পাচার। শুধু একটা প্রকল্পের কথাই বলি। বঙ্গবন্ধু টানেলের বাজেট ১.১ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ আনা হয়েছে চীন থেকে। সেই ঋণ পরিশোধের জন্য চীন সময় দিয়েছে ২০ বছর(২% সুদে)। সেই টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩ কিমি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় যে টানেল, Rogfast(Boknafjord) Tunnel, Norway সেটার দৈর্ঘ্য ২৭ কিমি, Undersea Tunnel যার সর্বোচ্চ গভীরতম পয়েন্ট ৩৯২ মিটার,সেই টানেল নরওয়ে ও ডেনমার্ক দুই দেশকে কানেক্ট করবে। দৈর্ঘ্য প্রায় দশগুণ আর ফ্যাসিলিটি এত হবার পরেও ওই টানেলের বাজেট কত জানেন? মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের টানেলের বাজেটের প্রায় দ্বিগুন মাত্র, যদিও দৈর্ঘ্যে সেটা ১০ গুণ বেশি,তার উপর Undersea। অথচ বাংলাদেশের চেয়ে ওখানে শ্রমিক মজুরি ১০ গুণ বেশি, ইঞ্জিনিয়ারের বেতন ১০ গুণ বেশি, পরিবহন খরচ ১০ গুণ বেশি। বাংলাদেশ কি চাইলে সেটা চীনের ৫০০ মিলিয়ন বাদ দিয়ে, নিজেরই ৬০০ মিলিয়ন দিয়ে আরামসে সেটা করতে পারতো না? আরামসে পারতো, আরো কম লাগতো হয়তো। অথচ তারা চীন থেকে ঋণ আনলো, সেই ঋণের টাকা পকেটে ভরলো, আর ঋণের মূলা ঝুলায় দিলো জনগণের ঘাড়ে।
সবচেয়ে মজার কথা সমীক্ষায় বলসিলো এই টানেলে দৈনিক ১৭,০০০ ট্রাফিক এন্ট্রি হবে, বাস্তবতা পুরা ভিন্ন, এই টানেল থাকে ফাঁকা, ঐ শুরুর দিকে মানুষ ঘুরতে যাইতো, পরে থেকেই ফাঁকা। টোল এর পরিমাণ ২০০-১০০০ টাকা, সেই হিসাব ধরেই হিসাব করে দেখলাম আগামী ২০ বছরে টোটাল নেট লাভ টোল থেকে থাকবে মাত্র ৫-১০ মিলিয়ন ডলার। যেটা দিয়ে চীনের ৫০০ মিলিয়ন ঋণের শুধু ১ বছরের ২% সুদও পরিশোধ হবে না। তারা জানে,চীন ২০ বছর পরে আইসা ধরবে, তখন যে থাকবে তাকে ধরবে, আমার কি? আমি তো পগার পার, মারা খাক জনগণ! সবচেয়ে বড় আইরনি হলো এতো লোপাটের পরে সেই টানেলের আবার নাম দিলো হাসিনা তার বাপের নামে আর মানুষকে বললো,"দেখো কত বড় দয়া করসি তোমাদের, দেখো টানেল ভিক্ষা দিসি তোমাদেরকে, আমার দয়া না থাকলে তো জঙ্গলে থাইকা মরতা"
.
এমন আরো হাজার হাজার পয়েন্ট আছে, দেশের অর্থনীতিকে কতগুলো কোপ খেতে হয়েছে সেটা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠে। ড. ইউনুস যখন বাংলাদেশের দায়িত্ব নিলেন হাতে, সেই বাংলাদেশের অর্থনীতি তখন মুমূর্ষু অবস্থায়, দম যায় আর আসে। আমাদের হয়তো অনেক বছর সময় লাগবে এই ক্ষতগুলো সারাতে, হয়তো মূল্যস্ফীতির কামড় সহ্য করতে হবে অনেকদিন। এতদিন যে জিডিপি গ্রোথের মূলা ঝুলায় রাখসিলো, এখন মনে হচ্ছে সবই মিথ্যা। আমরা আরেকটা ১৯৭৪ দেখার দ্বারপ্রান্তে ছিলাম।
বাংলাদেশকে শোষণ করে দরিদ্র রাষ্ট্র বানানো হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে আমার মনে হয় আমাদের রিজার্ভের কয়েকগুণ টাকা লো্পাট হয়ে গেসে গত ১৫ বছরে। সবার বিচার হোক, সব চোরের সম্পদ জব্দ হোক, এটাই চাওয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ১২:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




