somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিয়তি (পর্ব-১) (উপন্যাস)

১২ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শাহেদ সেলিম

পর্ব-১

“সুখ নাইরে পাগল সুখ নাই! মটর ডিপার্টমেন্টে কোন সুখ নাই!”-সামনের বাসটির পেছনে লেখাটি পড়ে হাসান মনে মনে হাসলো। হাসান প্রায় আধঘন্টা ধরে মহাখালীর এই অসহ্য জ্যামে আটকা পড়ে আছে। হাসানের দৃষ্টি আবারও সামনের বাসের সেই লেখাটির দিকে স্থির হলো। হাসান মনে মনে হেসে বললো-“ভাই বাস, শুধু মটর ডিপার্টমেন্টে কেন পৃথিবীর কোথাও আর এখন মনে হয় সামান্যতম সুখ অবশিষ্ট নাই।”

প্রতিদিন অফিসে যাওয়া-আসার পথে প্রায় দুই থেকে তিন ঘন্টা হাসানকে এই অসহ্য যানজটের অত্যাচার সহ্য করতে হয়। এ সময়টাতে তখন তার মনে হাজারো চিন্তা-ভাবনা এসে ভীড় করে।তখন হাসানের নিজেকে কিছুটা দার্শনিক দার্শনিক মনে হয়। হাসানের একটা মস্ত বড় গুন হলো, যেকোন পরিস্থিতিতেই সে আপন মনে অনেক কিছু ভাবতে পারে।তা রাস্তাঘাটে,বাসের ভেতরে প্রচন্ড ভীড়ের মাঝে, অফিসে,বাথরুমে সবখানে।

বাসের পেছনে লেখা সেই কথাটির সূত্র ধরে আজকে হাসানের চিন্তার বিষয়বস্তু ঠিক হলো “সুখ”। সুখের সাথে নিয়তি কিংবা অদৃষ্টের একটা অদৃশ্য সম্পর্ক বিদ্যমান বলেই হাসানের ধারনা। কে জীবনে সুখী হবে আর কে হবেনা তার সবটাই বোধকরি পূর্ব-নির্ধারিত! কিন্তু তারপরও ‘সুখ’ নামক সেই সোনার হরিণের পেছনেই মানুষের গন্তব্যহীন নিরন্তর ছোটাছুটি!

হাসান নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করলো- “সে সুখী কিনা?” মনের ভেতর থেকে উত্তর এল-“জানিনা।” ইদানীং হাসানের এই এক সমস্যা দেখা দিয়েছে।তার মনে যত প্রশ্ন জাগ্রত হয় তার অধিকাংশেরি উত্তর হয়- “জানিনা।” হাসান কিছুটা বিরক্তি বোধ করলো।আর বিরক্তির কারনে তার দার্শনিক চিন্তাভাবনাতেও খানিকটা ছেদ পড়লো।

মহাখালীর জ্যাম ছেড়ে এখন সে পড়েছে বিজয় সারণীর জ্যামে।বাসের ভেতরে সামান্য পা ফেলবারও জায়গা অবশিষ্ট নেই।হাসানের বাসা উত্তরায়। সে হাউজবিল্ডিং থেকে বাসে উঠে। তাই সবসময় বাসে সিট পায়।অবশ্য এর পরের স্টপেজগুলো থেকে যারা ওঠে তাদের ভাগ্য হাসানের মত এতটা সুপ্রসন্ন নয়।তাদের অধিকাংশকেই বাদুড়ঝোলা হয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হয়।

বিজয় সারণীর কাছে বেশ কয়েকজন নেমে গেল।হাসানের পাশের সিটে একটি মেয়ে বসেছিল। সেও নেমে গেছে।তবে তার শরীরের পারফিউমের একটা হাল্কা সুবাস এখনো আশপাশে বিদ্যমান।হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আরেকটি মেয়ে হাসানের পাশে এসে বসল। যদিও আরও কয়েকটি সিট খালি ছিল। মেয়েটি এতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল।বসার জায়গা পাচ্ছিলনা।মহিলা সিট খালি ছিল।মহিলাদের জন্য আলাদা সিটের ব্যবস্থা থাকা সত্বেও মেয়েটি কেন তার পাশে এসে বসল এটা হাসানের কাছে একটা রহস্য!তবে হাসান এর আগেও বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছে যে, অনেক মেয়েই তার পাশে এসে বসে কোন রকম সংকোচ ছাড়াই। খুব সম্ভবত হাসানের চেহারায় একটা “ভালো মানুষ-ভালো মানুষ”ছাপ রয়েছে। অন্তত হাসানের নিজের তাই ধারনা।

হাসান সদ্য ওর পাশে বসা মেয়েটিকে আড়চোখে দু-একবার পর্যবেক্ষন করলো।মেয়েটিকে বেশ সুন্দরী বলা চলে।মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসানের মনে আবারও সুখ সম্পর্কে দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়ে গেল।আসলে হাসান এখন তার সুখ বিষয়ক ভাবনার সাথে এই মেয়েটির একটা যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টায় মত্ত।

আচ্ছা,এই মেয়েটি কি সুখী? জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? না, তা বোধহয় ঠিক হবেনা।মেয়েটি খারাপ ভাবতে পারে। এই ভেবে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিল হাসান। মেয়েটার বয়স কত হবে? বাইশ কি তেইশ? বোঝা যাচ্ছে ভার্সিটিতে পড়ে। গলায় ঝোলানো আইডি দেখে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হল হাসান।হাসানের মন বলছে যে মেয়েটি এই মুহূর্তে সুখী।যদিও বিষয়টি আপেক্ষিক এবং ক্ষনস্থায়ী।মেয়েটির পড়নে কলাপাতা রঙ এর থ্রিপিস।কানের দুল,হাতের ব্রেসলেট ড্রেসের সাথে বেশ মানিয়ে গেছে। এমনকি সে যে হাত-ব্যাগ নিয়েছে তাও তার গেটআপের সাথে বেশ সুন্দর মানিয়ে গেছে। হাসান মনে মনে মেয়েটির রুচির প্রশংসা করল। হাসান আড়চোখে বারবার মেয়েটিকে দেখতে লাগলো। হাসানের বন্ধুরা প্রায় বলে যে, ওর পর্যবেক্ষন ক্ষমতা অসাধারণ! মেয়েটি কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল থেকে গান শুনছে। মাঝে মাঝে আনমনে ডান পা মূদু দোলাচ্ছে গানের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে। মেয়েটি হাসানকে একবারের জন্যও লক্ষ্য করেছে বলে হাসানের মনে হলনা। আসলে সে হয়তো ডীজুসের সেই স্লোগানটার মত ‘হারিয়ে যাও’ টাইপের হারিয়ে গেছে নিজের একান্ত জগতে!হাসান একটা নিরাপদ দূরত্ব রেখে বসেছে মেয়েটির সাথে। ভদ্রতার ব্যাপারে বেশ সচেতন হাসান।

সামনে যেই জ্যাম, তা ছাড়তে আরও মনে হয় বেশ খানিকটা সময় লাগবে। হাসান বাসের ভেতরে আরও একবার চোখ বুলিয়ে নিল।বাসের ভেতরে প্রচন্ড গরমে হাঁস-ফাঁস করছে মানুষজন।নভেম্বর মাস,অথচ দিনের বেলা এখনও কি প্রচন্ড গরম! বাইরে রাস্তার গাড়িগুলো জ্যামে আটকা পড়ে দাঁডিয়ে আছে নিশ্চল,স্থবির। হাসানেরও নিজের জীবনটাকে এই যানবাহনগুলোর মতোই স্থবির বলে মনে হলো। যার কোন শুরু নাই, শেষ নাই, যেন শুধু অনন্তকালের অর্থহীন অপেক্ষার পালা!

আজকেও অফিসে পৌঁছাতে নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে। কথাটা মনে হতেই হাসান অসম্ভব বিরক্তি বোধ করলো। ওর চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। নতুন চাকরী। এ সময় পাংচুয়াল থাকাটা অসম্ভব জরুরী। অথচ সে কিনা পরপর তিনদিন এরকম দেরি করে ফেলল! কিন্তু কি করবে সে? রাতে হাসানের ঘুম আসে অনেক দেরিতে। তাই সকালে সময় মত ওঠাটা তার জন্য বেশ কষ্টকর একটা ব্যাপার। এছাড়া নিয়মে বাঁধা এ জীবনটার সাথে তার কোনরকম পূর্ব-পরিচয় নেই। ভার্সিটি লাইফটা অনেকটা নিজের মনের মত করেই বেশ আয়েশ করে কাটিয়েছে সে।

হাসানের পাশে বসা মেয়েটি রাপা প্লাজার সামনে নেমে গেল। বোধহয় এখানেই কোন ভার্সিটিতে পড়ে। ধানমন্ডিতে এখন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শপিংমল আর হাসপাতালের কোন অভাব নেই! হাসান নামবে মেট্রো শপিং মলের সামনে। ওখান থেকে রিক্সায় করে যাবে ওর অফিসে।

মেট্রোর সামনে আসলে হাসানের সবসময় পূর্বের কিছু স্মৃতির কথা মনে পড়ে যায়! আজকেও মনে পড়ল আরও বিশেষভাবে, কোন একটা বিশেষ কারনে! আজকে ১৪ই নভেম্বর! সুমির জন্মদিন! সুমির সাথে যখন হাসানের সম্পর্ক ছিল তখন অসংখ্যবার ওরা এই মেট্রোতে এসেছে। মেট্রোর ফুড কর্ণার ছিল ওদের অন্যতম ডেটিং স্পট!

হাসান রিক্সায় উঠবার আগ মুহূর্তে মেট্রোর সেই ছোট গেটটার দিকে এক পলক তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সময় কত দ্রুত কেটে যায়! তিন বছর আগের কথা অথচ এখনও মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা!
হাসানের এই মুহুর্তে মনে হল মানুষের মনটা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের মত হলে বেশ ভালো হত। সবকিছু ইচ্ছামত মুছে ফেলা যেত। তাহলে আর অতীত স্মৃতির এই দুঃসহ যন্ত্রনা অনন্তকাল এভাবে মানুষকে বয়ে বেড়াতে হতোনা।
(চলবে...)

১১ নভেম্বর,২০১০
ঢাকা

শাহেদ সেলিম
[email protected]

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×