somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভৌতিক গল্প-সেই আংটিটা

১৯ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সামনে উবু হয়ে বসে থাকা লোকটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল পাভেল। লোকটার কালিঝুলি মাখা মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। চুল উস্কোখুস্কো, কতদিন পানি লাগেনি কে জানে! গায়ে একটা ত্যানার মত পাঞ্জাবী, আর লুঙ্গি। বসে বসে গাছের ডাল দিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি কাটছে। এই লোক আবার জ্যোতিশ্চন্দ্র হয় কিভাবে!

ছোটবেলার বন্ধু রুদ্র'র কাছে এই জ্যোতিষের সন্ধান পেয়েছে পাভেল। এই লোক নাকি বিরাট এলেমদার আদমি। কারও উপর প্রসন্ন হলে তাকে রাজা বানিয়ে দিতে পারেন, আর ক্ষেপে গেলে পথের ফকির বানাতেও দেরি হয় না।
দুই বন্ধুর আবার এইসব অতিপ্রাকৃত বিষয়ে ভীষণ আগ্রহ। ছোটবেলায় স্কুল ফাঁকি দিয়ে দুইজন ঘুরে বেড়াত বিভিন্ন সাধু-সন্ন্যাসীর আস্তানায়, আর পীর ফকিরের মাজারে। অবশ্য পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করার মতলবে ফকিরদের দ্বারস্থ হওয়ার সেই ভূত পাভেলের মাথা থেকে অনেক আগেই নেমে গেছে। কিন্তু রুদ্র সেই আগের মতই অন্ধভাবে এসবে বিশ্বাস করে। পরের দিকে পাভেল রুদ্রকে অনেকটা এড়িয়েই চলত। রুদ্র'র বাবা বিশাল ধনী, তার ছেলের পক্ষে এসব পাগলামী মানায়। ছাপোষা পরিবারের সন্তান পাভেল। তিনবেলা ভাতের চিন্তা, সেই সাথে পরিবারের ভার মাথায় চেপে বসলে সেখানে আর কোন খেয়াল রাখার জায়গা থাকে না।

এতদিন পর পাভেল আবার বাধ্য হয়েছে কোন জ্যোতিষীর কাছে আসতে। গত ছয় মাসে তার জীবনে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে পরপর। প্রথমে তার বাবা মারা গেলেন, বাবার শোকে তিন মাস পর মা। কয়েকদিন পরেই অফিস থেকে আসল বরখাস্তের নোটিশ, কোন কারণ দেখানো হয়নি তাতে। প্রেমিকা তুলির বিয়ে হয়ে গেল মাস খানেক আগে, লন্ডন প্রবাসী পাত্রের সাথে। পাভেল শুনেছিল বিয়েতে তুলির খুব একটা অমত ছিল না।

এসব ঘটনার যেকোন একটাই বড়সড় ধাক্কা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট, সেখানে এতগুলো পরপর। হতাশ হয়ে পাভেল এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও করেছিল। ঠিক এই সময়, অর্থাৎ এক সপ্তাহ আগে রুদ্র'র আগমন। পাঁচ বছর কোন খবর নেই। তারপরে হুট করে দুপুরবেলা সে পাভেলের বাসায় এসে হাজির। অনেকদিন নাকি পাভেলের সাথে দেখা হয়নি, বন্ধুর জন্য মনটা আনচান করছিল। এসেই পাভেলের মুখ দেখে বুঝে নিলো অবস্থা বেশি ভাল না। সবকিছু শুনল রুদ্র পাভেলের মুখ থেকে। তারপর সে এই জ্যোতিষীর ঠিকানা দিয়েছিল পাভেল কে। বলেছিল, এই লোক অনেক বড় গুণী মানুষ। যোগসাধনা করেন, মানুষের চোখে চোখ রেখে তার ত্রিকাল বলে দিতে পারেন। কিন্তু সাধারণ লোকে সাধনায় অসুবিধে করে বলে লোকচক্ষুর আড়ালে, শ্মশানে গোরস্তানে পড়ে থাকেন। এই লোক কে যদি পাভেল খুঁজে বের করতে পারে তাহলে তিনিই তার সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন। 'তোর তো এখন আর এসবে বিশ্বাস নেই। কিন্তু এই লোকের দেখা পেলে তোর বিশ্বাস ফিরে আসতে দেরী হবে না।' বলেছিল রুদ্র।

হঠাৎ মুখ তুলে পাভেলের দিকে তাকাল লোকটা। কোটরে বসা দুই চোখ, দুই টুকরো কয়লার মত জ্বলছে। শয়তানি হাসি সে চোখে। তারপর, লোকটা কথা বলে উঠল।

'কি জন্য এসেছিস? তোর কপালটা কি স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড নাকি যে ডাস্টার দিয়ে লেখা মুছে আবার নতুন করে লিখে দেব? কপালের লেখন খন্ডান যায় না রে পাগলা!'
অবাক হল না পাভেল। কে জানে, এই লোকের কাছে যারা আসে তারা হয়তো ভাগ্য বদলানোর ইচ্ছা নিয়েই আসে। বলল, 'আমাকে রুদ্র পাঠিয়েছে।'
'ঐ পাগলাটা? নিজে জালিয়ে শখ মেটেনি, এখন আবার তোকে পাঠিয়েছে আমাকে জালাতে?’ বলল বটে লোকটা, তবে পাভেল দেখল রুদ্র'র নাম শুনে লোকটার মুখ এখন কিছুটা প্রসন্ন। ব্যঙ্গের একটা হাসি মুখে লটকে বলল লোকটা, 'তা বলুন রুদ্র'র মহামান্য অতিথি, কি করতে পারি আমি আপনার জন্য?’
'রুদ্র যা বলল তা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো আপনি ত্রিকালজ্ঞ। কিছুই আপনার অজানা নয়। আমি কেন এসেছি আর কিভাবে আমাকে সাহায্য করবেন সেটা আপনিই বলুন না?’ কিছুটা তেড়িয়া মেজাজ দেখাল পাভেল।

স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল লোকটা পাভেলের দিকে। তারপর আচমকা বাম হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ওর কপালের দুইপাশ চেপে ধরল। পাভেল চমকে লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু লোকটা ওর কপাল চেপে ধরার সাথে সাথে ওর মনে হল ওর পুরো শরীর টা নরম কাদা দিয়ে তৈরি। নড়াচড়া করার শক্তি সম্পুর্ণ হারিয়ে ফেলেছে যেন সে।

যেমন আচমকা পাভেলের কপাল টিপে ধরেছিল তেমন আচমকাই আবার কয়েক সেকেন্ড পরে ছেড়ে দিল লোকটা। তারপর গড়গড় করে মুখস্ত বলার মত বলে গেল, 'ছিয়াশিতে জন্ম। ম্যাট্রিক দিয়েছিস দু'হাজার দুই এ। এইচ এস সি দুই বারে পাশ। ভাল চাকরী করতিস। চাকরীটা চলে গেছে। বিয়েটাও ফসকে গেছে। বাবা মা'র একজন অথবা দু'জনেই মারা গেছে কিছুদিন আগে। আরও বলব?’ পাভেলের হা করে তাকিয়ে থাকা মুখের দিকে একটা হাসি ছুড়ে দিয়ে বলে গেল লোকটা, 'যে মেয়েটার সাথে তোর বিয়ের কথা ছিল তার বাম গালে একটা তিল আছে। মেয়েটা নদী ভালবাসে। তোরা ঠিক করেছিলি বিয়ের পর নৌকা নিয়ে দেশের সব কয়টা নদী ঘুরে দেখবি...' লোকটার হাত চেপে ধরল পাভেল। 'থামুন!’ ধমকে উঠল ও। যেসব কথা কারো জানার কথা নয় সেসব এই লোক কিভাবে জানে? 'কে বলেছে আপনাকে এসব কথা?' জিজ্ঞেস করল ও।
'তুই বলেছিস। এইমাত্র।' ফিক ফিক করে হাসছে লোকটা, পাভেলের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ দেখে খুব মজা পেয়েছে যেন।

ভাষা হারিয়ে চুপ করে থাকল পাভেল। কিছুক্ষণ পর বলল, 'তাহলে আপনি এখন বলুন, আমি কি করব?’
'শোন। উপরে একজন বসে আছে।' আঙুল দিয়ে উপরে দেখাল লোকটা। 'আমরা হচ্ছি তার হাতে সুতোয় বাধা পুতুল। সে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নাচায়। আমরা নাচি। তার ইচ্ছে রদ করার ক্ষমতা কোন বাপের ব্যাটার নেই।' লোকটার গলা এখন কিছুটা নরম। 'আমারও ক্ষমতা নেই তোর জন্য কিছু করার। সামনে আরও বিপদ আসবে তোর। আমি সেগুলো আটকাতে পারবো না। তবে এইটা রাখ।' এই বলে নোংরা পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে কি একটা বের করে পাভেলের হাতটা টেনে নিয়ে খোলা তালুর উপর রাখল লোকটা। জিনিসটা কাল রঙের একটা আংটি। খুব সম্ভব লোহার তৈরী। পাথরের জায়গায় একটা মানুষের মুখ খোদাই করা।
'কি হবে এটা দিয়ে?' জিজ্ঞেস করল পাভেল।
'বাড়ি গিয়ে গোসল করে পরবি আংটিটা। সবসময় এটা পরে থাকিস। বিপদ আপদ যা আসে আসবে। এই আংটিটা তোর বিপদ কাটাতে না পারলেও তোর মাথা ঠান্ডা রাখবে, কিভাবে বিপদ কাটবে সেটা বুঝতে সাহায্য করবে। কখনও খুলবি না। আর এইবার চোখ বন্ধ কর। আমি তিন পর্যন্ত গোনার পর চোখ খুলবি।'
চোখ বুজল পাভেল। লোকটা গুনতে শুরু করল, 'এক...দুই...তিন।'
চোখ খুলতেই পাভেল দেখল, একা একা বসে আছে সে। সামনে কেউ নেই। আশে পাশে যতদূর চোখ যায় কোন জনমানুষের চিহ্ন নেই। স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন লোকটা।

*******

বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল পাভেলের। মধ্যরাতের শুনশান গলি দিয়ে সে যখন বাড়ি ফিরছে তখন হঠাৎ ঘাড়ের কাছটা শিরশির করে উঠল। পিছনে কার পায়ের শব্দ? ঘুরে তাকিয়ে অবশ্য কাউকেই দেখতে পেল না পাভেল। মনের ভুল ভেবে আবার পা চালাল সে।

বাসায় ঢুকেই অবাক হয়ে গেল পাভেল। বসার ঘরের আলো জ্বলছে। আর সোফায় বসে পা নাচাচ্ছে রুদ্র। পাভেল ঢুকতেই ভ্রু নাচাল। 'কি রে? দেখা হল জ্যোতিশ্চন্দ্রের সাথে?’
’তা হয়েছে। কিন্তু তুই ভিতরে ঢুকলি কিভাবে?' জিজ্ঞেস করল পাভেল।
'অনেকদিন মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন আমি দোস্ত। নিয়মকানুন সব ভুলে গেছি। পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়েছি আর কি। পরে ছাদে উঠে তোদের বাসার ভেতর।' ক্ষমাপ্রার্থনার হাসি দিল রুদ্র। 'এখন বল, কি বললেন জ্যোতিশ্চন্দ্র?’
'কি বলবেন? এই আংটিটা দিয়ে বললেন সবসময় পরে থাকতে।' পকেট থেকে আংটিটা বের করল পাভেল।

আংটিটার দিকে চোখ পড়া মাত্র লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। মুখের ভাব আমূল বদলে গেছে। চোখে যে দৃষ্টি সেটা একমাত্র ছাগলের দিকে তাকিয়ে থাকা ক্ষুধার্ত বাঘের সাথেই তুলনা করা চলে। 'দেখি আংটিটা!’ পাভেলের দিকে হাত বাড়িয়ে চাপা গলায় হুংকার ছাড়ল সে।
'ত-তুই এরকম করছিস কেন?’ রুদ্র'র ভাবভঙ্গি দেখে ভড়কে গেছে পাভেল।
'আংটিটা দে আমাকে!’ আবার গর্জে উঠল রুদ্র। মনে হল বুকের অনেক গভীর থেকে উঠে এল গর্জনটা। গলার স্বরও বদলে গেছে তার। কেমন ঘড়ঘড়ে, জান্তব আওয়াজ। চোখ দুটো জ্বলছে জলজল করে।
কি মনে হল পাভেলের, আংটিটা মুঠোয় ভরে ফেলল সে। তারপর, হঠাৎ করে রুদ্র'র বাড়ানো হাতের দিকে চোখ গেল তার। বহুদিনের পঁচন ধরে শুকিয়ে যাওয়া মড়ার মত শুকনো, কোঁচকানো সে হাতের চামড়া। আঙুলের মাংসহীন হাড় গুলো জড়িয়ে রেখেছে। বড়বড় লোম উঠেছে এখানে সেখানে। পাঁচটা আঙুলের মাথায় তীক্ষ্ণ, বাঁকানো নখ!

গলা শুকিয়ে এল পাভেলের। এ আর যেই হোক, রুদ্র নয়! প্রচন্ড অবিশ্বাসে পিছু হটতে গিয়ে সোফায় হোচট খেয়ে পড়ে গেল সে। ওদিকে রুদ্র'র মুখেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক চেহারা দ্রুত বদলে রূপ নিচ্ছে এক ভয়াবহ দানবে। মুখের চামড়ায় কালচে রং ধরল, তারপর পঁচে গলে গিয়ে খসে পড়তে শুরু করল চামড়া। একটা চোখ কোটর থেকে খসে বাইরে ঝুলে পড়ল, চোয়ালের চামড়া দু'ফাঁক হয়ে বেরিয়ে আসল তীক্ষ্ণ শদন্ত। লকলকে জীভ বেরিয়ে ঝুলে পড়ল মুখের এক পাশ দিয়ে। দমকা বাতাসের একটা ঝাপটার সাথে পাভেলের উপর ঝুকে আসল শয়তানটা। 'দে আংটিটা!’
আংটি দেবে কি, পাভেল তখন ভয়ে আধমরা। থরথর করে কাঁপছে তার পুরো শরীর। দানবটা ধীরে ধীরে পাভেলের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এল। এত কাছে যে বিচ্ছিরী পঁচা গন্ধ এসে ধাক্কা মারল পাভেলের নাকে। যে কোন মূহুর্তে জ্ঞান হারাবে সে।

তারপর, হঠাৎ করে পাভেলের উপর থেকে সরে গেল বিভৎস মুখটা। মনে হল কে যেন এক টান মেরে সরিয়ে নিয়ে গেল। তৃতীয় এক ব্যক্তি এসে ঢুকেছে ঘরে। সেই জ্যোতিষী!

রুদ্রবেশী দানবটার ঘাড় ধরে তাকে টেনে সরিয়ে এনেছে লোকটা। নিস্ফল আক্রোশে হাত পা ছুড়ছে দানবটা, কিন্তু জ্যোতিষীরর কোন বিকার নেই। যেন একটা ছ'মাসের শিশুকে ধরে রেখেছে। 'তাহলে এই ব্যাপার? এই শয়তান তোর পিছনে লেগেছে? আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার!' কথা কয়টা বলে পকেট থেকে একটা শিশি বের করে পাভেলের দিকে ছুড়ে দিল লোকটা। ’এটা খুলে ওর গায়ে ছিটিয়ে দে দেখি?’
শিশিটা পাভেলের গায়ে এসে পড়ল। তখনও সম্বিৎ ফিরে পায়নি সে। কোনমতে কাঁপাকাঁপা হাতে শিশির মুখ খুলল। ওদিকে, পাভেলের হাতে শিশিটা দেখেই আক্রোশে তীব্র গর্জন করে উঠল দানবটা, আর তার ছটফটানির মাত্রাও বেড়ে গেল দ্বিগুন।
পাভেল আর দেরি করল না। শিশির ভেতরের তরল টা ছুড়ে দিল দানবটার গায়ে। মনে হল আগুন ধরে গেছে, এইভাবে চেঁচিয়ে উঠল সাথে সাথে শয়তানটা। কিন্তু ঘাড়ে চেপে বসে আছে জ্যোতিষীর বজ্রমুষ্টি, একচুলও শিথিল হল না। ছটফট করতে তীব্র আক্ষেপে ধারালো নখ দিয়ে নিজের গায়ের মাংস খুলে আনতে শুরু করল দানবটা, সেই সাথে চলছে কানফাটানো আর্তনাদ।

পাভেল এতক্ষণ হা করে তাকিয়ে ছিল অবিশ্বাস্য এই দৃশ্যের দিকে। হঠাৎ দেখল, দানবটার জায়গায় ছটফট করছে রুদ্র, সেই পুরানো রক্তমাংসের রুদ্র। মুখ তুলে পাভেলের দিকে তাকালো সে। 'দোস্ত, বড় কষ্ট হচ্ছে আমার! আমাকে বাঁচা দোস্ত, আমাকে বাঁচা!’
কেমন যেন ঘোর পেয়ে বসল পাভেলকে। ধীরে ধীরে দু পা এগিয়ে গেল সে, উদ্দেশ্য রুদ্রকে জ্যোতিষীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নেবে। কিন্তু সাথে সাথে তীব্র ধমক শুনতে পেল, 'খবরদার! ওর মায়ায় ভুলিস না!' বিড়বড় করে কি যেন বলে তীব্র ঘৃণার সাথে এক দলা থুতু ছিটিয়ে দিল জ্যোতিষী রুদ্র'র মুখে। সাথে সাথে আরেকবার বুক ফাটা আর্তনাদ করে উঠল রুদ্র। তারপর দপ করে আগুন জ্বলে উঠল তার শরীরে, নিমিষে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সে। ঘরের বাতাসে কেবল ভেসে রইল মাংস পোড়ার তীব্র কটু গন্ধ।

এতক্ষণে হুঁশ ফিরে পেয়ে লোকটার দিকে তাকালো রুদ্র। 'আ-আ-আপনি...’ তোতলাচ্ছে সে।
'হ্যা, আমি।' মুচকি হাসল জ্যোতিষী। 'দেখা যাচ্ছে ঠিক সময়েই পৌছেছিলাম।'
'কিন্তু, আপনি কিভাবে জানলেন?’
'ধ্যানে। তোর পিছনে আমি একটা কালো ছায়া দেখতে পাই। বুঝতে পারি তোর বড় কোন বিপদ আসন্ন, এবং সেটা এই পৃথিবীর কারও কাছ থেকে নয়। আংটির ক্ষমতা খুব সামান্য, ওটা তোকে বাঁচাতে পারত না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে নিজেই আসতে হল।'
'আর...আর রুদ্র?’
'এ রুদ্র নয়, সে তো নিজের চোখেই দেখলি। তোর বন্ধু রুদ্র তিন বছর আগেই মারা গেছে। এই প্রেত তোর পিছে লেগেছিল অনেক আগে থেকে। তোর জীবনে ইদানীংকালের ভেতর যেসব বিপদ এসেছে তার সবগুলোর পিছনেই এর হাত ছিল।'
'ত-তার মানে? আমাকে এসব বিপদে ফেলে ওর কি লাভ?’
'ও আসলে আমার কাছেই আসতে চেয়েছিল। কিন্তু খুবই নিম্নস্তরের শক্তি ধরে ওর মত অশরীরী রা, আমার ধারে কাছেও যে কারণে ও ভিড়তে পারত না। এ জন্যেই ও তোর সাহায্য নিয়েছিলো। প্রথমে তোকে নানা বিপদে ফেলে মানসিক ভাবে দুর্বল করে নেয়। তারপর রুদ্র সেজে আসে তোর কাছে। জানত আমার কথা বললে পুরানো বন্ধুর কথা তুই ফেলবি না। আংটিটা আমার কাছে আছে এটা কেউ জানত না। আমি বেশিদিন হাতে রাখতে চাইনি, কারণ অশরীরী জগতে আমার একটু বেশিই আনাগোনা। যে কেউ জেনে যেতে পারত। এই আংটিটা দেখতে খুবই সাধারণ, কিন্তু এটা হাতে পেলে ওর শক্তি বহুগুণে বেড়ে যেত। মানুষের চেয়ে এটা অশরীরী দের জন্যেই বেশি দরকারী।'
'কিন্তু ও যদি ভালভাবে চাইত, তা হলেই তো আমি দিয়ে দিতাম। এর জন্য এত ঝামেলার কি দরকার ছিল?’
'ওই যে বললাম, নিম্নস্তরের অশরীরী। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। আংটিটা দেখে লোভের ঠেলায় মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। আর এমনিতেও ও তোকে মেরেই ফেলত।'
'এখন তাহলে কি হবে?’ অসহায় মুখে প্রশ্ন করল রুদ্র।
'ওরা যেহেতু জেনে গেছে এটা তোর কাছে আছে, আমার মনে হয় আংটিটা তোর কাছে রাখা আর উচিত হবে না। আমি নিয়ে যাচ্ছি। আর তোর বিপদের কারণ উদঘাটিত হয়ে গেল, আশা করা যায় আর কোন বিপদে তুই পড়বি না। সুতরাং এই আংটিরও আর কোন দরকার নেই তোর। আসি।' মৃদু হেসে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল জ্যোতিষী। হতভম্বের মত দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল পাভেল।



...
শেষ চমকটা অবশ্য তখনও পাভেলের জন্য অপেক্ষা করছিল।

*********

পরদিন সকালবেলা।
এমন ভয়ই পেয়েছিল পাভেল, শেষ পর্যন্ত একা একা নিজের বাড়িতে না থেকে পাশের আংকেলের বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়েছিল। সাতসকালে বাড়িতে আসতেই দেখল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে দুই জন লোক। সেই জ্যোতিষী!... আর... রুদ্র!

’র-রুদ্র? তুই? তুই না মরে গেছিস?' প্রায় ককিয়ে উঠল পাভেল।
'আমি মরিনি। ভয় পাসনে। গায়ে হাত দিয়ে দেখ, আমি রক্তমাংসের মানুষ।' হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল রুদ্র।
রুদ্র'র হাত স্পর্শ করে ভয় অনেকটা কাটল পাভেলের। তাছাড়া সকালের আলো চার দিকে, রাস্তা দিয়ে লোকজন চলাফেরা করছে। কাল রাতের ঘটনাগুলো কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছিল এখন। কিন্তু... ওরা এখানে কেন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জ্যোতিষীর দিকে তাকালো পাভেল।
'আংটিটা কোথায়?’ পাভেলের চোখ তার দিকে ফিরতে জিজ্ঞেস করল জ্যোতিষী।
'কোথায় মানে? আমি না ওটা কাল রাতেই আপনাকে দিয়ে দিলাম?’ হকচকিয়ে গেল পাভেল।
'সব কথা খুলে বল। গতকাল আমার কাছ থেকে আসার পর কি কি হয়েছে সবকিছু।’
জ্যোতিষীর কথা মত সব খুলে বলল পাভেল। কথা শেষ হতেই হতাশায় মাথার চুল খামচে ধরল রুদ্র। 'সব শেষ হয়ে গেল গুরু! হতচ্ছাড়া প্রেতটাকে কিছুতেই আটকানো গেল না!’
'চল, দেখি কি করা যায়। কিছুতেই ছাড়ব না ওই শয়তানকে আমি।' দৃঢ় গলায় বলল জ্যোতিষী।
'দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।' বলল পাভেল।
'অল্প কথায় বুঝিয়ে দিচ্ছি।' জ্যোতিষী থেমে দাঁড়াল। 'ওই আংটিটা প্রেতজগতের অনেকেই হাতে পেতে চায়। রুদ্র'র রূপ ধরে একটা প্রেত তোকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল আংটিটা হাতানোর জন্য। তোর মুখে রুদ্র'র নাম শুনেই আংটিটা আমি তোকে দিই। কিন্তু রুদ্র'র রূপধারী এই প্রেত আংটিটা দখল করার আগেই আরেকটা অশরীরী, এবং এ প্রথম প্রেতের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী, তোর বাড়িতে পৌছে যায় এবং প্রথম প্রেতকে সরিয়ে আংটি টা দখল করে।'
'তার মানে...তার মানে...’ বিশ্বাস করতে পারছে না পাভেল।
'তার মানে কাল রাতে দ্বিতীয় প্রেত আমার চেহারা নিয়েই তোর বাড়িতে গিয়েছিল। তুই বিনা দ্বিধায় তাকে আংটিটা দিয়ে দিয়েছিস।'
'আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি...’ কি বলবে বুঝতে পারল না পাভেল।
'তোর কোন দোষ নেই। তুই তো আর আসল ঘটনা জানতিস না।' এবার রুদ্র মুখ খুলল। 'যাই হোক দোস্ত, এবার আমরা যাই। অনেক কাজ বাকি। শয়তানটাকে ধরতেই হবে।'
'হ্যা, হাতে সময় বেশি নেই। তাহলে এবার তুই চোখ বন্ধ কর?’ পাভেলের দিকে তাকিয়ে বলল জ্যোতিশ্চন্দ্র। চোখ বুজল পাভেল।
'এক...দুই...তিন!’

১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×