রাত সাড়ে বারোটায় পিয়াস ভাইয়ের ফোন পেয়ে একটু অবাকই হলাম। এই সময় তো ভাই ফোন করে না।
বলেন ভাই। ফোন ধরলাম আমি।
-তূর্য, কালকে সকাল আটটায় আমার সাথে দেখা করতে পারবি? কদমতলা মোড়ে? পিয়াস ভাইয়ের গলাটা কেমন জানি ম্রিয়মাণ।
জ্বী ভাই, পারব।
-আচ্ছা। কেটে গেল ফোনটা।
কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। পিয়াস ভাই তো এইভাবে কথা বলার মানুষ না। তাকে বরং উল্টো কিসিমের লোক বলেই জানি।
পিয়াস ভাইয়ের পরিচয়টা দেয়া দরকার। উনি হচ্ছেন আমাদের এলাকায় স্কুল কলেজ পড়ুয়া যত পোলাপান আছে তাদের অঘোষিত লীডার। একটা পালসার চালিয়ে এলাকা কাঁপিয়ে বেড়ান সারাদিন। আমাদের যে কোন ধরনের সমস্যায় পিয়াস ভাই জান লড়িয়ে দিতে পারেন।
আমরাও তাই পিয়াস ভাই বলতে অজ্ঞান। আমাদের ভেতর অন্তত পাঁচজন পিয়াস ভাইয়ের মত স্পাইক করে। পিয়াস ভাই যেই সানগ্লাস ব্যবহার করেন তেমন সানগ্লাস আছে মোটামুটি সবার কাছেই। পিয়াস ভাইয়ের গম্ভীর গলা, চোখ তেরছা করে তাকানোর ভঙ্গি আমরা সবাই নকল করি। এক কথায় পিয়াস ভাই আমাদের হিরো।
সবার মধ্যে আমাকেই পিয়াস ভাই একটু বেশি ভালবাসেন বলে আমার মনে হয়। আমার মত সবসময় ছায়া হয়ে তার সঙ্গে আর কেউ লেগে থাকে না, এটাই মনে হয় কারন। তার অনেক কাজই আমি করে দেই। বিশেষ করে তিতলি আপুর কাছে ফুল, চিঠি এসব পৌছে দেয়া, বা গিফটের প্যাকেট নিয়ে আপুর কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা- এসব কাজের জন্য পিয়াস ভাই আর কারও উপর ভরসা করতে পারেন না।
যাই হোক। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো সাড়ে সাতটায়। প্রাইভেটের কথা বলে আগে ভাগে বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে। কদমতলা মোড়ে গিয়ে দেখি পিয়াস ভাই দাঁড়িয়ে আছেন, যদিও তখনও আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি।
কাছে যেতেই পিয়াস ভাই অর্ডার করলেন, আজকে সারাদিন আমার সাথে থাকবি। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে, কিছু কাজও আছে। কোন সমস্যা নাই তো?
-কি যে বলেন ভাই, জবাব দিলাম। কি কাজ?
বলব পরে। এখন চল।
আধা ঘন্টা পরে।
পিয়াস ভাই কদমতলা মোড় থেকে আমাকে নিয়ে হাটতে হাটতে একটা হোটেলে ঢুকেছেন। আমার জন্য পরোটা আর ডিমভাজির অর্ডার দিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। আমার নাস্তা করার পুরো সময়টা চুপচাপ ধোঁয়া গিলেছেন। নাস্তা শেষ হলে বিল মিটিয়ে হনহন করে হাটতে শুরু করেছেন। আমি তাকে অনুসরণ করছি।
পিয়াস ভাই হাটতে হাটতে বিভিন্ন অলি গলি দিয়ে বড় রাস্তায় উঠলেন। আমি চুপচাপ হাটছি আর তার কাজকর্ম দেখছি। ভাইয়ের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি যে তার সঙ্গে আছি সে ব্যাপারটা তার খেয়ালই নেই।
অধৈর্য লাগছে আমার। দুই একবার কিছু জিজ্ঞেস করব কি না ভাবলাম। কিন্তু ঝাড়ি খাওয়ার চেয়ে চুপ করে থাকাটাই বেটার মনে হল।
হুট করেই হাটা থামিয়ে আমার দিকে তাকালেন পিয়াস ভাই। আচ্ছা তূর্য, দেবদাস সিনেমাটা দেখেছিস না?
-দেখেছি তো। বললাম আমি। কেন?
ছ্যাকা খেলে কি শাহরুখ খান যা করে ঐসব কাজগুলো করা খুব জরুরী?
এহেন অদ্ভুত প্রশ্নে আমার টাশকি খাওয়ার যোগাড়। আমতা আমতা করে বললাম, কি জানি। আমি তো কখনও ছ্যাকা খাইনি।
হুম। পিয়াস ভাই আবার হাটতে শুরু করলেন।
দুপুর বারোটা।
সকাল থেকে এখন পর্যন্ত পিয়াস ভাই হেটেই চলেছেন। আমার সামনে হাটছেন বলে আমি তার চেহারা দেখতে পাচ্ছি না। এই উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটার মানে কি তাও বুঝতে পারছি না। দু'এক বার জিজ্ঞেস করেছি, ভাই আমরা যাচ্ছি কোথায়? জবাব মেলেনি। এদিকে পরোটা আর ডিমভাজি কখন হজম হয়ে গেছে। শেষমেশ পেছন থেকে পিয়াস ভাইয়ের শার্টটা টেনে ধরলাম।
ভাই, হাঁটছেন হাঁটেন। কোন সমস্যা নাই। কিন্তু আমার তো নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে গেল। গলায় যতটা সম্ভব মধু ঢেলে বললাম।
পিয়াস ভাই দুই এক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, যেন কি বলছি বুঝতে পারছেন না। তারপর বললেন, দাঁড়া। ব্যবস্থা করছি।
একটা রিকশায় উঠলাম দুইজন। রিকশাটা একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁর সামনে এসে থামল।
রেস্তোরাঁর ওয়েটাররা দেখলাম পিয়াস ভাইকে ভালমতই চেনে। কোনার দিকে একটা টেবিলে বেশ খাতির করে বসালো। ফ্রাইড রাইস আর চিকেনের অর্ডার দিলেন পিয়াস ভাই। নিজে কিছু নিলেন না। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনি কিছু খাবেন না?
চোখ পাকিয়ে তাকালেন পিয়াস ভাই। আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার পথে নামলাম দুইজন। এতক্ষণে আমি এটুকু অন্তত বুঝতে পারছি, ভাই বড় কোন সমস্যায় আছেন।নাহলে এরকম ছন্নছাড়া অবস্থায় কোনদিন তাকে দেখিনি।
কখন যেন আকাশে বেশ ভাল আকারে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি শুরু হবে যে কোন সময়। পিয়াস ভাই হঠাৎ থেমে আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, রিকশায় করে ঘুরি চল।
কিছু বলার আগেই ভাই হাত তুলে একটা রিকশা থামালেন। দুই জন উঠে বসলাম। আর উঠতে না উঠতেই বৃষ্টি শুরু হল।
রিকশাওয়ালা মামা হুড তুলে দিতে চাইলেন। কিন্তু ভাই নিষেধ করলেন।
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমরা দুইজন বসে বসে ভিজছি। রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাঁকা। দুই একটা প্রাইভেটকার বা বাস মাঝে মাঝে পানি ছিটিয়ে চলে যাচ্ছে। পিয়াস ভাই এর দিকে তাকালাম। চোখ বন্ধ করে আছেন। মুখ আকাশের দিকে।
ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, ভাই, আপনার কি হইছে?
চোখ না খুলে এবং মুখ না নামিয়েই জবাব দিলেন পিয়াস ভাই, আবার কথা বললে ঘাড় ধরে রিকশার থেকে ফেলে দিব।
আমি আবার চুপ।
একসময় পিয়াস ভাই নিজেই মুখ খুললেন।
তূর্য, আজকে আমার খুব দুঃখের দিন।
আমি মুখ হা করে বৃষ্টির পানি মুখে নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। পিয়াস ভাইয়ের কথায় চমকে গেলাম।
-ক্যান ভাই? জানতে চাইলাম আমি।
আজ তিতলির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। খবরটা হজম করার সময় দরকার। তারপর বললাম, কিন্তু ভাই, ক্যামনে কি? আমি তো কিছুই শুনি নাই?
-ছেলেপক্ষ দেখতে আসছিল গত পরশু। মেয়ে পছন্দ করে গেছিলো। আর ওর বাবা মা আমার কথা জেনে গেছে। পাড়ার চিহ্নিত গুন্ডার হাতে মেয়ে তুলে দেবে না।
-ভাই, আপনি আগে ক্যান বললেন না? এখনও সময় আছে, চলেন গিয়ে তিতলি আপুকে নিয়ে আসি। আমি বললাম।
-নাহ। তিতলি জানিয়েছে আমি যেন কিছু করার চেষ্টা না করি। তাহলে আত্মহত্যা করবে। ওর বাবা অসুস্থ। বাবার মতামতের বিরুদ্ধে যেতে চায় না।
এতক্ষণে ভাইয়ের মন খারাপের রহস্য বোঝা গেল। কিন্তু এ তো ভয়াবহ ব্যাপার। বলা নেই কওয়া নেই এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল, আর আমরা কিছুই করতে পারলাম না?
ভাই, আপনি তাহলে কি করতে চাইছেন? জানতে চাইলাম আমি?
-কিছুই না। তিতলি আমার হাত বেঁধে দিয়েছে। তাই ঠিক করেছি আজ সারাদিন দেবদাস হয়ে ঘুরবো। মন যা চায় তাই করব। মাল খাবো, মাঝ রাস্তায় তিতলির নাম ধরে চিৎকার করব, হাউমাউ করে কান্নাকাটি করব। কাল সকালে আবার ঠিক হয়ে যাব।
এক হাতে মুখ থেকে বৃষ্টির পানি মোছেন ভাই। আমার মনে হয় বৃষ্টির পানি ছাড়াও মুখ থেকে আরও বেশি কিছু মুছে নেয় তার হাত।
***********
সন্ধ্যাবেলায় আমরা বসে ছিলাম নদীর ধারে। নদীটার নাম বললাম না, বললে সবাই চিনে যাবে। এই নদীটা পিয়াস ভাই আর তিতলি আপুর ভালবাসার অনেক পুরনো সাক্ষী। আজ সেখানে পিয়াস ভাই একা একা বসে আছেন।
পিয়াস ভাইএর হাতে একটা হুইস্কির বোতল। ইতিমধ্যে ভেতরের সোনালি তরলের পরিমান অর্ধেকে নেমে এসেছে। পিয়াস ভাই অস্তগামী সূর্যের দিকে তুলে ধরলেন বোতলটা। সূর্যের হালকা আলো তরল পদার্থটাকে সামান্য লঘু করে তুললো কি?
পিয়াস ভাই তার দেবদাস দিবস পালনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন। এই বোতলটা শেষ করে তিনি আধা ঘন্টা চিৎকার করে কাঁদবেন। আমার দায়িত্ব হুইস্কির ঘোরে তিনি যেন উল্টোপাল্টা কিছু করে না বসেন সে দিকে লক্ষ্য রাখা।
-ওই তূর্য। পিয়াস ভাইয়ের গলা জড়িয়ে এসেছে।
বলেন ভাই। পেছন থেকে সাড়া দিলাম আমি।
-আমার আর তিতলির ব্যাপারটা শুরু কবে থেকে জানিস? চার বছর আগে। আমি ডেইলি ওর স্কুলের সামনে যেয়ে দাঁড়ায় থাকতাম। পিয়াস ভাই একঘেয়ে গলায় বলে যান, ও কোনদিন আমারে পাত্তা দেয় নাই। তারপরে মন্ডলপাড়ার সেই ছেলেগুলার সঙ্গে ঝামেলা হইছিল, তোর মনে আছে?
জ্বী ভাই, মনে আছে।
-ওরা তো আমারে পিটায়ে বিছানায় ফেলে দিছিলো। এক সপ্তাহ উঠতে পারি নাই। এক সপ্তাহ পরে যেইদিন গেছি তিতলির স্কুলের সামনে, সেইদিন তিতলি প্রথম আমার সাথে কথা বলল। জড়ানো গলায় বকবক করে যেতে থাকেন পিয়াস ভাই।
ভাই, এইসব কথা আমি জানি। আপনি আগেই বলছিলেন।
-আরে শুনবি তো? ছেমড়ি কি বলছিল জানিস? বলে কি না, এই এক সপ্তাহ কই ছিলেন? অন্য কোন স্কুলের সামনে দাঁড়াইতেছেন বুঝি?
হা হা করে হেসে ওঠেন পিয়াস ভাই। হাসিটা শেষ দিকে কেমন জানি ভাঙ্গা ভাঙ্গা শোনা যায়। তারপর, পিয়াস ভাই হাউমাউ করে হঠাৎ কেঁদে ফেলেন।
আমি তাকিয়ে থাকি। আমাদের সবার হিরো, এলাকার ত্রাস, প্রচন্ড সাহসী পিয়াস ভাই কেমন জানি শিশুর মত হয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন।
প্রতিদিন পৃথিবীতে কত রিলেশন গড়ে ওঠে, ভেঙ্গে যায়। কে খবর রাখে? তবুও, পিয়াস ভাই আমার খুব কাছের মানুষ বলেই হয়তো, তার অসহায় কান্নায় আমার বুকটা ফেটে যেতে চায়। আমিও হয়তো কেঁদে ফেলি। তবে সন্ধ্যার অন্ধকার, আর নিঃশব্দ হওয়ায় সেটা পিয়াস ভাইয়ের চোখে পড়ে না।
কাল সকালে পিয়াস ভাই আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবেন। কিন্তু চার বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার দুঃখ কি এক দিনে ঠিক হতে পারে?
আমি জানি, পিয়াস ভাই এক কথার মানুষ। কাল থেকে তিনি আবার আমাদের সাথে বসে আড্ডা মারবেন, মফিজের টং দোকানে বসে সবার খোঁজ খবর নেবেন। তার পালসার আবার এলাকা কাঁপাবে। কিন্তু ছোট্ট একটা ব্যতিক্রম থাকবে।
গলির শেষ মাথায় তিতলি আপুদের যে ছোট্ট দোতলা বাসাটা, সেই রাস্তায় পিয়াস ভাইকে আর দেখা যাবে না। তার জন্য আমি যে কাজগুলো করে দিতাম সেই তালিকা থেকে কয়েকটা কাজ বাদ পড়বে। কি আসে যায়?