থিম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এ পর্বের মুভিগুলো হবে খানিকটা স্পর্শকাতর। আগের পর্বের মত এবারেও কোনও হলিউড ফিল্মের জায়গা হয়নি, আর এই ছবিগুলো আমার দৃষ্টিতে সত্যিকারের মনে দাগ কাটার মত।
এই প্রসঙ্গে আমার সবচেয়ে প্রিয় মুভিটা একটা বহুবিখ্যাত ইতালিয়ান সিনেমা - Roberto Benigni'র Life Is Beautiful (Italian: La vita è bella)। ধারণা করছি, এই মুভিটা প্রায় সবার দেখা, তাই রিভিউতে এই মুভি রাখিনি। তবু যদি কারও অদেখা হয়ে থাকে, তবে তাদেরকে বলব, এই সিনেমা না দেখে মারা যাওয়াটা ঠিক না। মুভিটা শেষ করার পর 'সিনেমা' সম্পর্কে আপনার ধ্যান-ধারণা আর অনুভূতি জায়গাটা নড়ে উঠবে। একই সাথে কমেডি আর ট্রাজেডি'র এমন অপূর্ব সমন্বয়ের আর কোনও উদাহরণ আছে কিনা আমি জানি না। আমার মুভি-দেখা জীবনে 'লা ভিতা এ বেলা' একটা ল্যান্ডমার্ক হয়ে থাকবে।
ভূমিকা শেষ করে পোস্ট শুরু করছি। এবং এবারের পাঁচটা মুভিও যথারীতি ভিন্ন ভিন্ন দেশের এবং পাঁচটা বিভিন্ন ভাষার।
Forbidden Games (French: Jeux interdits)
দেশ: ফ্রান্স
ছবিমুক্তির সন: ১৯৫২
পরিচালক: René Clément
যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা'র কথা উঠলেই অবধারিতভাবে ২য় বিশ্বযুদ্ধের ছবিগুলোই চলে আসে সবার সামনে। এই মহাযুদ্ধ বিশ্বচলচ্চিত্রের ওপর তার স্থায়ী প্রভাব রেখে গেছে। ফ্রান্সের এই ছবিটা ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে হলেও পুরো মুভিজুড়ে যুদ্ধের প্রকোপের কিছুই নেই। সিনেমার শুরুতে দেখা যায় - প্যারিসে জার্মান বোমারু বিমানের আক্রমনের ফলে দলে দলে লোকজন শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। সেই দলের মাঝেই একটা ছোট পরিবার - বাবা, মা আর পাঁচবছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে পলেত। পালানোর পথেই জার্মান প্লেনের গুলিবর্ষণে বাবা-মা দুজনই একসাথে প্রাণ হারায়। অবুঝ মেয়ে পলেত কী করতে হবে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে একটা দলছুট ঘোড়া'র পেছন পেছন এক গ্রামে এসে পৌঁছে। মিশেল নামে আরেক আট-দশ বছর বয়সী ছেলে তাকে খুঁজে পায়, আর বাড়িতে নিয়ে যায়। মিশেলদের পরিবারে পারিবারিক দ্বন্দের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দিন যেতে থাকে পলেতের, আর তার সব আবদারের একমাত্র ভরসাস্থল হয়ে ওঠে মিশেল। প্রাণবন্ত কাহিনীতে ছবিটা আগাচ্ছিল, কিন্তু শেষ দৃশ্যটা যেভাবে হল - তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। পুরো মুভিতে যুদ্ধের দামামা নেই, কিন্তু শেষ দৃশ্যে পাঁচবছর বয়সী একটা মেয়ের চোখ আপনাকে ক্ষতবিক্ষত করে যাবে। এইটুকু একটা মেয়ে এতটা নিখুঁত এতটা বাস্তব অভিনয় কেন করবে? সিনেমা দেখে সহজে আবেগাক্রান্ত হওয়ার মত মানুষ আমি না, কিন্তু এই ছবি'র শেষ দুই মিনিটের কোনও ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না...
এই মুভিতে বাড়তি ভাল লাগা হল, মাঝে মাঝে এর অপূর্ব ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। গিটার-পিয়ানোর চমৎকার কম্পোজিশনের হালকা সুর মুভিটা দেখার আনন্দ অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সবশেষে, ছবিটা সত্যি মনে দাগ কাটার মত।
ছবিতে আমার রেটিং: ৯/১০
Two Women (Italian: La ciociara)
দেশ: ইতালি
ছবিমুক্তির সন: ১৯৬০
পরিচালক: Vittorio De Sica
তের বছর বয়সী কিশোরী 'রসেতা' খানিকটা দূর্বল হার্টের মেয়ে। যুদ্ধকালীন রোমে মুহুর্মুহ বোমা-বিস্ফোরনে তার মূর্ছা যাবার দশা। শেষটায় তার মা ঠিক করে, মেয়েকে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে দূরে রাখতে রোম ছেড়ে গ্রামে নিয়ে যাবেন। শুরু হয় মা-মেয়ের অনিশ্চিত যাত্রা। বিপদসঙ্কুল পথ পেরিয়ে গ্রামে পৌছানোর পর সেখানেও দেখা যায় আতঙ্কের পরিবেশ। কখনও ইতালীয়ান সৈনিক চার্জ করতে আসে, কখনও বা বৃটিশ সৈনিক আশ্রয় চাইতে আসে। এই দেখা গেল মার্কিন সৈনিকেরা আনন্দে প্যারাড করতে করতে এগিয়ে গেল, আবার পরমুহুর্তে জার্মান বোমারু বিমান এসে সবটা তছনছ করে দিল ! এমন সব দিনের পর হঠাৎ খবর আসে, মুসোলিনী'র পতন হয়েছে। জার্মান বাহিনী পিছু হটছে ! অন্যসব রিফিউজির মত আশায় বুক বেঁধে মা-মেয়ে আবার রোমে ফেরার পথ ধরে... অথচ তারা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, যুদ্ধের ভয়াবহতা তখনও শেষ হয়নি। এক পৃথিবী বীভৎসতা আর নিষ্ঠুরতা তখনও অপেক্ষা করে আছে নিষ্পাপ কিশোরী 'রসেতা' আর তার মায়ের জন্যে !
কিংবদন্তী পরিচালক ভিত্তোরিয়া ডি সিকা'র এক ক্লাসিক সৃষ্টি এই 'টু উইমেন'। এই মুভিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার জিতে নেন সোফিয়া লরেন, যেটা ছিল 'ইংরেজী-ভিন্ন' অন্য কোনও ভাষা'র মুভিতে অভিনয় করে অস্কার জেতার প্রথম ঘটনা ! মুভি দেখার পর স্বীকার করতে হয়, এটা তাঁর প্রাপ্য ছিল।
ছবিতে আমার রেটিং: ৮.৫/১০
Voces Inocentes (English title: Innocent Voices)
দেশ: মেক্সিকো
ছবিমুক্তির সন: ২০০৪
পরিচালক: Luis Mandoki
ছবির কাহিনী 'এল সালভাদর' রাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের সময়কার। সামরিক জান্তা আর স্থানীয় গেরিলা বাহিনী'র নিরন্তর যুদ্ধে মধ্যবর্তী ছোট এক গ্রামে নরক নেমে আসে। প্রায় রাতে শুরু হয় এলোপাথারি গুলিবর্ষণ - দরিদ্র লোকগুলোর বেড়ার ঘর ভেদ করে মেশিনগানের গুলিতে ঘরে বসেই মারা যেতে থাকে বৃদ্ধ-তরুণ-শিশুরা। সেই গ্রামের 'শাভা' নামে এক কিশোরের বয়ানে পুরো সিনেমার কাহিনী আগায়। প্রতিদিনকার জীবনে বেঁচে থাকাটাই সেখানে একটা মিরাকল-এর মত ব্যাপার; তার উপর দেখা যায় আরেক আতঙ্ক - যেকোনও ছেলের বয়স বারো'র উপর হলেই তাকে বাধ্যতামূলকভাবে আর্মিতে যোগদান করতে হবে। শ্বাসরুদ্ধকর সব ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিটা দিনের কাহিনী আগাতে থাকে। বাচ্চা ছেলেগুলোর সামনে দু'টা মাত্র পথ - হয় নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে গেরিলাদলে যোগ দিতে হবে, নাহয় আর্মিতে যোগ দিয়ে নিজ আত্মীয়-স্বজন-গ্রামবাসীদের দিকে বন্দুক উঁচু করে ধরতে হবে ! শিউরে উঠার মত একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে 'শাভা'র জীবনে, এক অর্থে বলতে গেলে ওখানের প্রতিটা শিশুর জীবনে। তাদের শৈশব খুন হয়ে যায় যুদ্ধের ডামাডোলে। সামনে শুধু একের পর এক সুনিশ্চিত অনিশ্চয়তা...
রুদ্ধশ্বাসে দেখার মত একটা মুভি। ছবির মাঝে মাঝে ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহৃত গানগুলোর লিরিক অপূর্ব। খেয়াল করে শুনলে ওই গানগুলোই ছবির মানবিক বোধটাকে আরও গভীর করে তোলে। মুভিটা একইসাথে টাচি এবং মারাত্মক পাওয়ারফুল।
এই ছবিতে আমার রেটিং: ৮.৫/১০
Turtles Can Fly
দেশ: ইরাক, ইরান
ছবিমুক্তির সন: ২০০৪
পরিচালক: Bahman Ghobadi
আমার ধারণা এই ছবিটা তূলনামূলক অনেকের কাছেই বেশ পরিচিত। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের সময়কার ঘটনা, ছবি'র স্পট ইরাকি-তুর্কিশ সীমান্তে এক রিফিউজি ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে মোটামুটি চালু-টাইপের এক কিশোর, যাকে সবাই 'স্যাটেলাইট' নামে ডাকে। গ্রামে ডিশ-অ্যান্টেনা সেটাপের কাজ জানা আর সেই সাথে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজী জ্ঞানের কারণে স্যাটেলাইট নামের এই কিশোরই ঐ অঞ্চলে বহির্বিশ্বের সংবাদ জানার একমাত্র মাধ্যম। সেই রিফিউজি ক্যাম্পে এক ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় স্যাটেলাইট, কিন্তু ওই কিশোরী'র পরিবার আবার বড় অদ্ভূত ! মেয়েটার পরিবার বলতে - বয়সে তারচে' দু'তিন বছরের বড় এক পঙ্গু ভাই, যার কিনা ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে পারার ক্ষমতা দেখা যায় মাঝে মাঝে; আর আছে একদম ছোট আরেকজন - যে এখনও ঠিকমত কথা বলতেও শিখেনি। এই অনাথ পরিবারটার গল্প যতই আগাতে থাকে, ততই অস্বাভাবিকতা টের পাওয়া যায়। কিশোরী বার বার প্ল্যান করতে থাকে, কাঁধের ওই পিচ্চিটাকে 'বোঝা'র মত বয়ে না বেড়িয়ে মেরে ফেললেই তো হয় !
এই সিনেমাটাও পুরোটা সময় জুড়ে চুম্বকের মত আকৃষ্ট করে রাখে। ছবি যতই আগাতে থাকে, এর পরতে পরতে দেখা যায় ওই কিশোর ভাই-বোনের পেছনে ফেলে আসা এক ভয়ানক আর নির্মম ইতিহাস ! ছবিটা যেখান থেকে শুরু হচ্ছিল, ঠিক সেখানে এসেই শেষ হয় - আর এর মাঝে কয়েকটা শিশু-কিশোরের চোখে আমাদের দেখিয়ে যায় যুদ্ধকালের বিভীষিকা। ফুলের মত কিছু জীবনকে চিরতরে নষ্ট করে ফেলার এক নির্দয় কাহিনী।
ছবিতে আমার রেটিং: ৮.৫/১০
The Boy in the Striped Pyjamas (in USA: The Boy in the Striped Pajamas)
দেশ: যুক্তরাজ্য, হাঙ্গেরী
ছবিমুক্তির সন: ২০০৮
পরিচালক: Mark Herman
মনকে স্তব্ধ করে দেয়ার মত একটা সিনেমা। এই ছবিশেষের অনুভূতিটা আমার জন্য ছিল ভয়ানক তীব্র। আরেকটা ২য় বিশ্বযুদ্ধের ছবি, এবারের গল্পটা সরাসরি জার্মানীর। এস-এস অফিসার রাল্ফ প্রমোশন পেয়ে একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের 'কমান্দান্তে' হয়ে বার্লিন ছেড়ে চলে আসেন এক গ্রামাঞ্চলে। সপরিবারে। তার বারো বছর বয়সী মেয়ে আর আট বছর বয়সী ছেলে'র এই নতুন পরিবেশে ভিন্ন জীবনে মানিয়ে নিতে খানিক সময় লাগে। তবে ছোট্ট ছেলে ব্রুনো খুব শিঘ্রীই তারা বাবা'র বাংলো'র আশেপাশে কৌতূহলী হবার মত উপকরণ খুঁজে পেতে থাকে। অ্যাডভেঞ্চারের বশে নিজের অজান্তেই সে চলে যায় এক ইহুদী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, বন্ধুত্ব করে ডোরাকাটা পোশাকের (Striped Pyjama) এক ইহুদী সমবয়সী ছেলের সাথে। কাঁটাতারের এপারে আর ওপারে এক নাযি (Nazi) সন্তান আর এক ইহুদী শিশু'র মাঝে গড়ে উঠে গাঢ় বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্বের কোনও বাস্তব ভবিষ্যৎ থাকার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু দুই শিশু'র চিন্তায় ওসব কেন আসবে? ওরা তো যুদ্ধের কিছুই জানে না ! তাদের সরল কার্যকলাপে সবার অজান্তে এরপর ঘটতে থাকে শিউরে উঠার মত ঘটনা। আমি প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে এরপর দেখছিলাম - কী হয়, কী হয় ! ছবিশেষে আর্তনাদ করে উঠতে ইচ্ছা করছিল। সিম্পলি, বোবা আর্তনাদে ফেটে পড়ছিলাম !
ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল সবটা। হলোকাস্টের ভয়াবহতা অবশ্যই জানতাম, কিন্তু এভাবে দেখতে হবে কখনও ভাবিনি। চিরস্থায়ীভাবে মনে একটা গাঢ় দাগ কেটে গেল মুভিটা।
ছবিতে আমার রেটিং তাই: ৯/১০
পোস্টের একদম শুরুতে একটা ইতালিয়ান মুভি'র কথা বলছিলাম: Roberto Benigni'র Life Is Beautiful (Italian: La vita è bella)। যেকোনও সময় আমার বিচারে এই ছবি'র রেটিং হবে: ১০/১০
***********************************************************************
সিনেমা শুধু টাইমপাসের জন্য মনে করি না, আমাদের চিন্তা-ভাবনায়ও সিনেমা ভালভাবেই প্রভাব রাখে। পৃথিবী'র শ্রেষ্ঠ সব পরিচালকেরা তাদের অসাধারণ সব ফিল্ম রেখে গিয়েছেন এবং এখনও তৈরি করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। প্রতিসপ্তাহে অন্তত একটা ভাল সিনেমা দেখবেন - এই আশা রাখি। সবাইকে শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২০