আজকেও ল্যাব কপিটা ফেয়ার করে জমা দেয়া হলো না রিমার। লিখতে বসার মতো একটু জায়গা বা পরিবেশ কোনটাই মিলেনি গত তিন-চার দিনে। সারাদিনের ক্লাশ শেষে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে শরীর। বাসায় ফেরার কথা মনে হতেই ক্লান্তিটা আরো ভারী হয়ে উঠেছে ওর জন্যে। অবশ্য বাসা না ভাবাই ভালো। সত্যিই তো, ওটা ওর বাসা না, আশ্রয়। আত্মীয়ের হলেও কথা ছিল- একেবারেই অনাত্মীয়ের আশ্রয়। নেত্রকোনায় ওর কলেজের ম্যাথ চিটার জামান স্যারের ছাত্র, ওদের পাশের গ্রামের ফারুক ভাই’র বাসা।
ছোট দুই রুমের বাসা। দেড় রুমেরও বলা যায়। কোন মেহমান চলে এলেই আর থাকার জায়গা থাকে না। ওকে তখন ছুটতে হয় উত্তরায় চাচার শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়ের বাসায়। আজকেও ও একটা সালোয়ার-কামিজ নিয়ে এসেছে ক্লাশ শেষে উত্তরায় যেতে হবে বলে।
ভার্সিটিতে ভর্তির এই চার মাসে অনেক চেষ্টা করেছে হলে অন্তত একটা ফ্লোরিং এর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু এতদিনেও কিছুই হলো না। তার এলাকারই থার্ড ইয়ার হিস্ট্রির ছাত্র মাসুদ ভাই সীটের তদবীরের জন্য নিয়ে গিয়েছিল এক বড় ভাই’র কাছে । রিমা অবশ্য জানে না উনি কিসের বড় ভাই, কোন মাপের বড় ভাই; তবু একটা সীটের জন্য তাকে না জেনে বুঝেই যেতে হয়েছে।
কারো বাসায় উপযাচক হয়ে থাকার বিড়ম্বনা অসহনীয়। মাঝে মাঝেই এখন সব ছেড়ে ছুঁড়ে গ্রামের পাশ ঘেঁষে মফস্বলের সেই শান্ত বাড়ীটায় চলে যেতে ইচ্ছে করে।
পরদিন ক্লাশের ফাঁকে মাসুদ ভাই আবার আরেক জন বড় ভাই’র কাছে নিয়ে যায়। এ সপ্তাহেই কাজ হয়ে যাবে বলে বড়ভাই আশ্বাস দেয়। মধুর ক্যান্টিন থেকে কার্জন হলের দিকে ফেরার পথে মাসুদ ভাই এ কয়দিন একটু পার্টির মিছিল মিটিং এ যাবার পরামর্শ দেয়।
জামান স্যারের কথাগুলো মনে পড়ে রিমার। কোন ধরনের রাজনীতিতে না জড়ানোর জন্য বার বার বলে দিয়েছেন স্যার। জামান স্যার সহযোগিতার হাত না বাড়ালে ওর ভার্সিটিতে পড়তে আসা হতো না। ওর নিজের ভাইটা ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় থেকেই পুরোদস্তুর বখাটে হয়ে গেছে। সিনেমা দেখা আর গাঁজা খাওয়াই ওর পেশা এখন। স্যার তার এক ছাত্রকে দিয়ে ঢাকা থেকে ফরম নিয়ে জমা দেবার ব্যবস্থা করেছেন। ওকে এখন থাকতেও হচ্ছে স্যারের এক ছাত্রের বাসাতেই। কয়েকটা কলেজের মধ্যে ও যখন একাই এ প্লাস পেল ভীষণ খুশি হয়েছিলেন জামান স্যার। যেন তার নিজের মেয়েই ভাল রেজাল্ট করেছে। ভার্সিটি এডমিশনের অর্ধেক খরচটাও জোগাড় করতে হয়েছিল স্যারকেই।
পরদিন সেকেন্ড পিরিয়ডেই দেখে মাসুদ ভাই ক্লাশের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন বেশ ব্যস্ত ভাব। রিমা খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল সীটের কথা।
- হ্যাঁ হ্যাঁ প্রসেস হচ্ছে, একটুতো সময় লাগবে। তো, আমার সাথে চল একটা মিটিং আছে। বড় ভাইরা থাকবে ওখানে।
- না থাক মিটিং এ যাব না। অন্য সময় গিয়ে দেখা করব।
- কাজের সময় যাবা না, যাবা অন্য সময়, তোমাদের কি মানুষ এমনি এমনি সীট দিয়া দিবে! চল... চল...।
ওর ইতস্তত ভাব দেখে মেজাজ খারাপ করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মাসুদ। কয়েক মুহূর্ত ভেবে যাবার সিদ্ধান্তই নেয় রিমা। একা যেতে খারাপ লাগছে। তাই মিতুকে রিকোয়েস্ট করে সাথে নেয়। মিতুও ওর মতই হলের একটা সীটের পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরছে। দুপুরের প্রচণ্ড রোদে প্রেসক্লাবের কর্ণারে এসে নামল ওরা। আরেকটু সামনেই মিটিং চলছে। রিমা ভাবে তার তো রাজনীতির সাথে জড়ানোর কথা না। তাহলে মিটিং এ যাবে কেন? দু-এক পা বাড়িয়েই সে থমকে দাঁড়ায়।
- ‘মাসুদ ভাই’ জামান স্যার শুনলে দু:খ পাবেন, আমি যাব না।
- আরে এখনো কি তুমি স্কুল কলেজের বাচ্চা নাকি! এখন পড় ভার্সিটিতে। মিতু বলে - কেন ভার্সিটিতে পড়লে স্যারদের কথা শুনতে হয় না?
- মাঝ রাস্তায় এসে আর নাটক করতে হবে না, চল’।
চোখ লাল করে রীতি মতো ধমকে ওঠে মাসুদ। যন্ত্রচালিতের মতো সামনে পা বাড়ায় রিমা।
দেড়-দু’শ লোকের সভা। নেতাদের বক্তৃতা চলছে। রাজনৈতিক দলের মিটিং। ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুটো ছেলে। উপস্থিত লোকদের চারপাশে পুলিশের কর্ডন। ছেলেদের সরিয়ে মাসুদ ভাই মিতু আর রিমাকে ব্যানার ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। ব্যানার হাতে আড়ষ্ট হয়ে উঠল রিমা। জীবনেও কোন মিটিং মিছিলে যায়নি ও। ব্যানার হাতে রাজপথে প্রকাশিত হয়ে ওঠা তো দূরের কথা।
সাংবাদিকরা ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। জামান স্যার যদি টিভিতে তার এই ছবি দেখেন তাহলে ভীষণ দু:খ পাবেন। চারটা বাজে দুপুরে খাওয়া হয়নি। একটু পানির জন্য আশে পাশে নজর বুলায় রিমা।
মাসুদ ভাই ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে একরকম জোর করেই এখানেই নিয়ে এল। নিজের ইচ্ছেয় এলে এতোটা খারাপ লাগতো না হয়ত। কেমন যেন বমি বমি লাগছে তার। ওতো আর ছাগল-গরু না, মানুষ। ওর ইচ্ছা অনিচ্ছারও মুল্য আছে। অথচ হলের একটা সীটের জন্য ও এখন কত দুর্বল। আর এ দুর্বলতাকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগালো মাসুদ ভাই। নিজেকে বড় অসহায় লাগে রিমার। কান্না পায় তার। জ্বালাও পোড়াও স্লোগান দিয়ে দু’শ মানুষের সভাটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দিকে এগিয়ে যায়। ব্যানার ধরে এগিয়ে যেতে হয় রিমাকেও।
পাঁচটার দিকে কার্জন হলে ফিরে রেখে ল্যাব থেকে সবাই বেরুচ্ছে। অরগানিক-ফোর ল্যাবটা মিস্ হয়ে গেল। বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে ও। নাবিলা এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। তাকিয়ে থাকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে!
এতক্ষণ ঘটে যাওয়া সবকিছু নাবিলাকে বলে রিমা। শুনে খুব মন খারাপ হয় ওর। দাঁড়িয়ে থাকে নিরবে। ওদের বাসায় তো গেস্ট রুমটা খালিই পড়ে থাকে, হলে সীট পাওয়ার আগ পর্যন্ত রিমাকে ওখানে থাকতে বলা যায়।
আবার মনে হয় বাসা অন্যরা একে উপদ্রব মনে করবে নাতো! তাছাড়া আম্মা বাড়তি ঝামেলা একদম পছন্দ করেনা।
সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলে নাবিলা।
- চলো সীট পাবার আগ পর্যন্ত আমাদের বাসায় থাকবে। একটা রুম খালি আছে।
- যদি কোথাও কিছু না হয় তখন দেখা যাবে- উত্তর দেয় রিমা।
নিজের ব্যাপারে ধারণাটা তার যথেষ্টই স্পষ্ট। ইমা আর নাবিলার বাসায় গিয়েছে ও প্রাসাদ যেন। দামী দামী জিনিসের জঙ্গল। ওদের চোখ ধাঁধানো শো-পিসগুলোর সামনে নিজেকে খুব বিবর্ণ লাগছিল তার। তবু ওদের সাথে ওর অবাক করা একটা অসম বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।
নাবিলা আর ইমার ল্যাব পার্টনার রিমা। সামার ভ্যাকেশনের পর দশ-পনের দিন ক্লাস হয়ে গেল রিমা এখনও আসেনি। তাই নিয়ে কথা বলছিলো ওরা।
ইমা বলে- জানিস, একদিন কথায় কথায় ও বলছিলো হলে সীট না হলে ও আর আসবেনা, ওর এলাকায় একটা কলেজে ভর্তি হয়ে যাবে। ওর বাবা সম্ভবত খুব অল্প টাকা পাঠায়।
নাবিলা বলে- ওতো নাকি কখনই কোন প্রাইভেট পড়েনি। কেমন ব্রিলিয়ান্ট দেখ। নিজে নিজে পড়েই এপ্লাইড কেমেস্ট্রিতে চান্স পেয়েছে। ওর ক্লাসের পারফরমেন্সও একসিলেন্ট! দেখ্ ল্যাবেতো ওই আমাদের সব করে দেয়।
- হ্যা, ভীষণ ষ্ট্রং পার্সোনালিটির মেয়ে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া থেকে এ পর্যন্ত কেবল দুটো সালোয়ার কামিজই পরতে দেখলাম। এ নিয়ে ওর মধ্যে কোন হেজিটেশনই নেই। কোয়াইট কনফিডেন্ট । আমরা মনে হয় এমনটা পারতাম না।
একমাসের বেশী পার হয়ে গেছে। রিমা ফিরে আসেনি ক্যাম্পাসে।
নাবিলা আর ইমা গাছতলায় বসে গল্প করছে। কথা হচ্ছিল রিমাকে নিয়ে। ইমা বলে- দেখিস ও একদিন ঠিকই ফিরে আসবে।
- না ও ভীষণ জেদি মেয়ে। আমার মনে হয় ও আসবেনা।
- আমার ধারণা ওকে আসতেই হবে।
- আমারও কিন্তু মনে হয় ও যেভাবে স্ট্রাগল করে উঠে এসেছে, তাতে করে ওই ছোট্ট কলেজে ও বেশিদিন নিজেকে ধরে রাখতে পারবেনা। তুলি এসে বসে ওদের সাথে। ও জানায় রিমা গতকাল ফোন করেছিল ওকে, বলেছে একটা টিউশনী জোগাড় করে দিতে পারলেও ও এসে কোন একটা ছাত্রী মেসে উঠবে।
সবাই সবার চোখে চোখে তাকায়। একটা নিরব আনন্দ স্পর্শ করে যায় ওদের।
রিমা ফিরে আসে ক্যাম্পাসে। আজিমপুরের যেখানে ও থাকে সেখান থেকে যাতায়াত খরচ অনেক। শেষবারের মতো হলে সীটের জন্য চেষ্টা করার কথা ভাবে। পরদিন আবার যায়।
অপরাজেয় বাংলার সামনে একটা মিটিং চলছে। বক্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ ভাই। মিটিং শেষ হবার অপেক্ষায় একপাশে দাঁড়ায় রিমা। কিছুক্ষণ মিটিং চলার পরই শুরু হল ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া, ককটেল-গুলি।
এলোপাথারি ছুটোছুটির মধ্যে দূরে কোথাও যেতে না পেরে, একটা পিলারের আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে পরে রিমা। একটা ককটেল এসে ওর পায়ের কাছে ফুটে । রিমা আরেকটা পিলারের পেছনে যাবার জন্য দৌড় দেয়। কিন্তু পরের পিলারটা পর্যন্ত যাওয়া হলোনা ওর। তার আগেই চিৎকার করে পেট চেপে ধরে গড়িয়ে পড়ে। রক্তে ভিজে ওঠে অনেকটুকু জায়গা।
হাসপাতালে নিতে নিতে দুর্বল শরীরে অনেক বেশি রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারায় ও। রক্ত দিতে ছুটে আসে ক্লাসের অনেকেই। আসে পার্টির অনেক ছেলে-মেয়েরাও। ওর সাথে আহত হয়েছে আরো চারজন ছাত্র।
মাসুদের পার্টির কর্মীরা মিছিল করে তাদের কর্মী আহত হওয়ার জন্য ।
দেড় ঘন্টার অপারেশন শেষে আই.সি.ইউ তে নিয়ে আসা হয় ওকে।
অনেক চেস্টা করেও আই.সি.ইউ’র সামনে যেতে ব্যর্থ হয় ইমা আর নাবিলা। নার্স জানায়-পেসেন্ট ভালো আছে।
ফিরে যেতে যেতে ইমা বলে-
আমার মনে হয় ও আবার দেশে চলে যাবেরে।
নাবিলা বিরক্ত হয়- আচ্ছা তুই কি অদ্ভুতরে! ও দাঁড়িয়ে আছে বাঁচা-মরার মাঝখানে আর তুই বলছিস ওর ফিরে যাবার কথা!!
(সাহিত্য সাময়িকী সৃজন ২০০৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)