শামসুর রাহমানের কবিতা / আল মাহমুদ
----------------------------------------------------
শামসুর রাহমান ও আমার বয়সের তফাৎ খুব বেশি নয়_ পাঁচ-ছয় বছর হবে। তবে পঞ্চাশে আমরা যারা লেখালেখি শুরু করি তাদের মধ্যে শামসুর রাহমান ছিলেন সবার অগ্রজ। বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত 'কবিতা' পত্রিকাসহ ওপার এবং এপারের প্রায় প্রতিটি সাহিত্য পত্রিকায় শামসুর রাহমানের কবিতা ছাপা হচ্ছিল। এ অর্থে তিনি ছিলেন আমিসহ সে সময়ে লিখতে শুরু করা অন্য সব কবির একই সঙ্গে প্রেরণা এবং ঈর্ষার পাত্র। তার কবিতা আমার সব সময় ভালো লেগেছে। সহজ-সরল পয়ারের ভঙ্গিতে লেখার ক্ষেত্রে শামসুর রাহমান খুবই দক্ষ ছিলেন। তার পয়ার লেখার এই সহজাত অভ্যাসকে আমরা খুব অবাক হয়ে অবলোকন করতাম। তবে শামসুর রাহমানের কবিতার যা আমাকে প্রকৃতপক্ষে আকৃষ্ট করেছে তা হলো_ সবসময় তার একটা নম্র-ভদ্র পয়াররীতি আবিষ্কার করা এবং তার ব্যবহার। এ ধরন তার কবিতাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং মহিমান্বিত করেছে। তাই বলা যায়, তরুণরা যাদের সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস, তারা শামসুর রাহমানের কবিতায় মুগ্ধ হতো না, যদি সেখানে সত্যি সত্যি আন্তরিকতার অভাব থাকত। অভাব নেই বলেই স্বভাবটাও স্বতন্ত্রভাবে সবার চোখে পড়েছে। শামসুর রাহমান যখন দেখেন আস্তাবলের সহিস তার প্রিয় ঘোড়ার পিঠে হাত বুলাচ্ছে, শীতের শুকনো ডালের মতো কাঁপতে কাঁপতে বুড়ো ভিস্তি তার চামড়ার মসৃণ মশক বয়ে নিয়ে যাচ্ছে অথবা গলিত কুষ্ঠ রোগিণীটিকে অকপটে জড়িয়ে ধরে অন্ধ খোঁড়া ভিখারি চুম্বনের পর চুম্বন এঁকে দিচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এ কবি মানুষ, পশু, প্রেম, দুঃখ-বেদনা, নগর ও নাগরিক সম্পর্কে তার বক্তব্য একটু আলাদাভাবে উচ্চারণ করবেন।
আকাশে চাঁদ উঠেছে। আর সমস্ত শূন্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সোনার দিনারের মতো অসংখ্য তারা। তখন কবি শামসুর রাহমানের এই পুরনো নগর ভ্রমণ করতে হঠাৎ চোখে পড়ে, গোরস্থানে ফিসফিস করতে করতে কারা যেন কবর খুঁড়ছে। কান পেতে শুনেছেন তিনি সেসব কথাবার্তা। সেসব বাক্যালাপ এমন সব মানুষের, যাদের গোর নির্মাণ স্বাভাবিক জীবিকা। জীবন সম্পর্কে এসব নেহাত মানুষের উপলব্ধি কবি শামসুর রাহমানকে মুগ্ধ করেছে :
কোদালে অবহেলে উপরে আনি
মাটির ঢেলা আর মড়ার খুলি।
শরীফ কেউকেটা কী করে চিনি
শরীফ কেউকেটা কী করে চিনি?
মাটির নীচে পচে অন্ধ গোরে
হয়তো সুন্দরী কুরূপা কেউ।
করো না বেয়াদপি বান্দা তুমি
করো না বেয়াদপি বান্দা তুমি।
বাদশা কেউ নেই গোলাম সব,
বেগম পেতে চায় বাঁদীর সুখ :
আউড়ে গেছে কতো সত্যপীর।
(কবর খোঁড়া গান, 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে')
এভাবে আমরা শামসুর রাহমানের কবিতায় মুগ্ধ হই। চেনা জগৎকে আরেকটু বেশি করে চিনিয়ে দেওয়ার কাজ শামসুর রাহমান করতেন খুব নিপুণ হাতে। এবং সেক্ষেত্রে তার ব্যবহৃত শব্দের যে আয়োজন ছিল তাও আমাদের চেনা জগতেরই। উপমা বা চিত্রকল্পের ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারটা খাটে।
ব্যক্তি শামসুর রাহমান ছিলেন খুবই পরিশীলিত, নম্র-ভদ্র একজন মানুষ। মানুষের প্রতি তার এক ধরনের আগ্রহ ছিল। তিনি অন্যের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করতেন। এ গুণ তো ছিলই, আরও গুণ ছিল। তা হলো_ শামসুর রাহমান নিজের কবিতার ব্যাপারে খুব দৃঢ় ছিলেন, আত্মবিশ্বাস প্রবল ছিল। তাছাড়া লিখেছেন দু'হাতে। তিনি এত বেশি লিখতেন যে মাঝে মধ্যে অবাক লাগত, কীভাবে এত লেখা সম্ভব। তিনি লিখেছেন এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এ সক্ষম হওয়ার কারণ তার কবিতার নিজস্বতা।
শামসুর রাহমান আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তার কবিতা এখনও আমাদের আন্দোলিত করে, আমরা তার কবিতা পাঠ করে রোমান্টিকতা এবং প্রেমের অবিস্মরণীয় নির্যাস পান করি। এ রোমান্টিকতা পাঠকের হৃদয়কে অতীতে স্পর্শ করেছে, ভবিষ্যতেও করবে বলেই আমার বিশ্বাস। #
[ দৈনিক সমকাল । ২১ আগস্ট ২০০৯ ]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




