somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লঙ্গিউ গুহা - চীনে মাটির নিচে প্রাচীন এক আশ্চর্যজনক পৃথিবী

১০ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের শিইইয়েন বেইসুয়েন গ্রামের মাটির নিচে আধুনিক বিশ্বের লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে আছে প্রাচীন পৃথিবীর এক নিদর্শন। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও বাইরের দুনিয়া তো দূরে থাক, খোদ চীনের নাগরিকরাও এগুলোর খোঁজ জানতেন না। ১৯৯২ সালের দিকে গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা হঠাৎ করেই ২০০০ বছরেরও পুরোনো এই কৃত্রিম গুহাগুলোর খোঁজ পেয়ে যান। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোন প্রত্নতত্ত্ববীদ, স্থাপত্যবীদ, প্রকৌশলী কিংবা ভূতত্ত্ববীদ এগুলো কে বা কারা তৈরী করেছে সে সম্পর্কে খোঁজ দিতে পারেননি। এমনকি এটাও অজানা যে এগুলো কিভাবে বা কেন তৈরী করা হয়েছিলো, সেটাও অজানা আজকের পৃথিবীর মানুষের কাছে।

লঙ্গিউ গুহার মোট সংখ্যা ৩৬টি। এই গুহাগুলো ৩০,০০০ বর্গমিটারের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। কঠিন সিল্ট পাথরের মাঝে খোদাই করে বানানো এই গুহাগুলো মাটির ৩০ মিটার নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। এগুলোর প্রতিটিতে পাথরের তৈরী ঘর, সেতু, নালা, এমনকি পুলও আছে। সেই সাথে আছে উপরের ছাদকে ঠেকা দেওয়ার জন্যে পাথরের থাম। এখন পর্যন্ত মাত্র একটি গুহাকে পর্যটকদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, গবেষকদের কাছেও লঙ্গিউ গুহাগুলো এক ধাঁধা। এর কিছু কারণ আজ তুলে ধরবো।




গুহাগুলো কিভাবে বানানো হয়েছে তা কারো জানা নেই

লঙ্গিউ গুহাগুলো বানাতে যে পরিমাণ শ্রমের দরকার হয়েছে, তা সত্যিই আতংকিত করে। এই কৃত্রিম গুহাগুলো খোদাই করে তৈরি করার সময় প্রায় ১০ লক্ষ কিউবিক মিটার পাথর অপসারণ করা হয় বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতি দিনে একজন শ্রমিক কতটুকু পাথর খোদাই করতে পারে হিসাব করে বিজ্ঞানীরা বের করেছেন যে, যদি ১০০০ মানুষ দিন-রাত কাজ করে তাহলে এই গুহাগুলো বানাতে সময় লেগেছে প্রায় ৬ বছর। বিজ্ঞানীরা প্রত্যেক শ্রমিক সমান হারে শ্রম দিয়ে কাজ করেছে অনুমান করে হিসাবটি করেছেন। কিন্তু, তা যদি সত্যি না হয়ে শ্রমিকদের শারীরিক শক্তি কম-বেশি হয়ে থাকে আর গুহাগুলোর শৈল্পিক গঠনশৈলীর কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে গুহাগুলো বানাতে আরো অনেক বেশি সময় লাগার কথা। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীন স্থাপত্যগুলোর আশে-পাশে নির্মানকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু, লঙ্গিউ গুহাগুলো এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এগুলোর নির্মানকাজে ব্যবহৃত কোন যন্ত্রপাতিই এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। শুধু তা-ই নয়, একটা গুহার সাথে আরেকটা গুহার যে সামঞ্জস্যতা, নির্মানশৈলী'র নির্ভুলতা আর গঠনে সাদৃশ্যতা এতো নির্ভুল ভাবে কিভাবে করা সম্ভব হলো, আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেননি।


গুহাগুলো নির্মানের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না

এই যে ১০ লক্ষ কিউবিক মিটার পাথরের ভিতর খনন করা হলো, সেই পাথরগুলো কোথায় গেলো! গুহাগুলো যে এলাকায় অবস্থিত, তার আশে-পাশে সেগুলোর কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। কোন চীনের কোন ইতিহাস বইতেও এর কোন রেকর্ড পাওয়া যায় না। অথচ, এমন কাজ করার জন্যে যে বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন, তা লুকিয়ে করা সম্ভবপর নয় বলে মনে করা হচ্ছে। তাহলে!


গুহাগুলোর দেয়াল আর ছাঁদে খাঁজ কাটা ওসব কিসের চিহ্ন?



প্রত্নতত্ত্ববীদ আর স্থাপত্যবীদরা অবাক চোখে দেখেছেন প্রতিটি গুহার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত কি রকম যেন খাঁজ কাটা। এরকম একই প্যাটার্নে খাঁজ কাটতে প্রয়োজন বিপুল জনশক্তি আর অফুরন্ত সময়। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে- কেন? কিসের উদ্দেশ্যে এরকম খাঁজ কাটা হলো? এগুলো কি শুধুই ডেকোরেশনের জন্যে করা হয়েছিলো? নাকি, খাঁজকাটা লাইন বা প্যাটার্নের মাঝে কোন নক্সা লুকিয়ে আছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে এখন পর্যন্ত যা পাওয়া গিয়েছে তা হচ্ছে- এই খাঁজ কাটা লাইনগুলো সাথে স্থানীয় একটি মিউজিয়ামে থাকা খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৮০০ বছরের পুরানো কিছু মৃতশিল্পের উপরের দাগের অনুরূপ।


গুহাগুলোতে কোন মাছ পাওয়া যায়নি

মাটির নিচে গুহাগুলো যখন প্রথম আবিস্কার হয়, তখন সেগুলোতে পানি ছিলো। ধরা হয়, সেগুলো অনেক দিন ধরেই গুহাগুলোতে ছিলো। পানিগুলো সেঁচে ফেলে দেওয়ার সময় ভাবা হয়েছিলো এগুলো এলাকার অন্যান্য তলাহীন পুকুরগুলোর মতোই কিছু হবে। চীনের দক্ষিণের এলাকাগুলোর বাসিন্দারা এরকম অনেক পুকুর খনন করে রাখেন। জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে এগুলো 'তলাহীন পুকুর' নামে এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত। সেগুলোতে মাছও পালন করা হয়। কিন্তু, গুহাগুলো থেকে যখন পানি সরিয়ে ফেলা হয়, তখন সেগুলোতে কোন মাছ ছিলো না, ছিলো না আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব। সত্যিই অবাক করা বিষয়!



গুহাগুলো ২০০০ বছর ধরে অক্ষত অবস্থায় টিকে রয়েছে

ব্যাপারটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতোই। গুহাগুলোর বয়স ২০০০ বছরেরও বেশি। তার উপর পানির নিচে ছিলো অনেক দিন। অথচ, একটি দেয়াল ধসে পড়েনি। পিলারগুলো অক্ষত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে এখনো। গুহাগুলোর কোন কোন দেয়াল মাত্র ৫০ সে,মি, পুরু। তারপরও, সেগুলোর কিছু হয়নি এতো কাল পরেও। গত দুই হাজার বছরে, চীনের ঐ এলাকার উপর দিয়ে অনেক গিয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, বন্যায় প্লাবিত হয়ে অনেক পর্বতের আকৃতি পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়েছে। অথচ, লঙ্গিউ গুহা এর ব্যতিক্রম। যেন গতকালকে কেউ ওগুলো বানিয়েছে।


নির্মানকারীরা আলো ছাড়া কিভাবে কাজ করলেন!

গুহাগুলো এতোটাই গভীর যে উপর থেকে সেগুলোর নিচে মেঝের দিকে তাকালে আলকাতরার মতো কালো অন্ধকার চোখে পড়ে। এটা সত্যিই খুবই অবাক করা বিষয় যে, এতোটা গভীরেও গুহাগুলোর মেঝে, কলাম আর সিলিং-এ খাঁজ কাটা সমান্তরাল লাইনগুলো খোদাই করা হয়েছে। এ নিয়ে চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধাপক জিয়া গ্যাং-এর সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন যে- গুহাগুলোর মুখ এতোটাই ছোট যে সেগুলো খনন করে বানানোর সময় অবশ্যই লন্ঠনের প্রয়োজন। দিনের একটা বিশেষ সময়ে, তেরছা ভাবে যখন সূর্যের আলো গুহাগুলোতে পড়ে, শুধু তখনই গুহাগুলো আলোকিত হয়। গুহাগুলোর যত নিচের দিকে যাওয়া যায়, সূর্যের আলো তত কমতে থাকে। একদম নিচে পৌঁছার পর প্রায় আর কিছুই দেখা যায় না। তাহলে, দুই সহস্র বছর পূর্বে চীনে যখন আলোকিত করার কোন যন্ত্র ছিলো না, তখন কিভাবে অন্ধকারে ঐ গুহা আর 'নক্সা'-গুলো বানানো সম্ভব হলো!



গুহাগুলো একটার সাথে আরেকটির কোন সংযোগ নেই কেন!

আগেই বলা হয়েছে, লঙ্গিউ গুহাগুলোর সংখ্যা ৩৬টি। এই সবগুলো গুহাই কিন্তু মাত্র এক বর্গ কিলোমিটার জায়গার মধ্যে বিস্তৃত। এতো ঘন করে থাকা এই গুহাগুলোর একটার সাথে আরেকটির তো সংযোগ থাকার কথা। অথচ, সেগুলোর মাঝে তা নেই। প্রতিটি গুহাই আলাদা আলাদা। অনেক গুহার দেয়ালই মাত্র ৫০ সে,মি, পুরু। তারপরো, সেগুলো কেটে পাশের গুহার সাথে কোন পথ করা হয়নি বলেই সেগুলো ইচ্ছেকৃত ভাবে করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কিন্তু, কেন এমন করা হয়েছিলো সেটার উত্তর আজ অবধি পাওয়া যায়নি।




কারা গুহাগুলো বানালো?

আজ পর্যন্ত কেউ জানে না কে ওগুলো বানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন সম্রাট বা নেতার নির্দেশ ছাড়া সাধারণ গ্রামবাসীদের পক্ষে এমন বিশাল কর্মকান্ড চালানো সম্ভব নয়। যেমন- বাইরের শত্রুদের থেকে রক্ষা পেতে চীনের তৎকালীন সরকার চীনের প্রাচীর তৈরীর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু, কোন সম্রাট তা করে থাকলে তো ইতিহাস বইয়ের রেকর্ডে তা থাকার কথা! অথচ, তা নেই।

গুহাগুলো আবিস্কার হওয়ার পর অনেক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। অথচ, এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর কেউ বের করতে পারেনি। এখনো বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু, আমাদের পূর্বপুরুষদের তৈরি এই গুহাগুলো আজও রহস্যের আবর্তে ঢাকা।

গুগল ম্যাপে লঙ্গিউ গুহাঃ

আপনি যদি লঙ্গিউ গুহাগুলোর অপার সৌন্দর্য দেখতে চান, তাহলে গুগল ম্যাপে Longyou Caves লিখে সার্চ দিতে পারেন।


মূলঃ April Holloway, Ten Enduring Mysteries of China’s Longyou Caves, Click This Link



সূত্রঃ

১) চীনের সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়ের 'ওয়ে ব্যাক মেশিন'
২) Longyou Caves-Quzhou Tourist Attractions-Chinahotel". vhotel.org
৩) Engineering geological characteristics, failure modes and protective measures of Longyou rock caverns of 2000 years old". inist.fr. 24 (2).
৪) Longyou Grotto's, ancient-wisdom, http://www.ancient-wisdom.com/chinalongyou.htm



বিভাগঃ পুরাতত্ব

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২০
১৬টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×