সূর্যমূখী শুনলেই আমার ভ্যানগঘ মনে পড়ে যায়
লোকে ঠিক কেমন উত্তর শুনতে চায়? জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে, লোকে প্রায় সবসময় একটা গল্প শুনতে চায়। হোমো স্যাপিয়েন্স এক গল্প বলিয়ে জীব, যে কিনা তথ্য বা লেখচিত্রের চেয়ে গল্প নিয়েই বেশি ভাবে। তাদের বিশ্বাস, মহাবিশ্বটাই বুঝি সজ্জন আর দূর্জনে ভরা, উত্থান-পতনে জমে ওঠা, শেষমেশ শুভ পরিসমাপ্তিতে পর্যবসিত এক গল্প। লোকে যখন জীবনের অর্থ খোঁজে, তারা এমন এক গল্প শুনতে চায়- যেখানে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার ব্যাখ্যা দেয়ার পাশাপাশি মহাজাগতিক নাট্যমঞ্চে সবার ভূমিকাটি ব্যাখ্যা করা আছে। এই ভূমিকা থেকেই লোকে খুঁজে ফেরে অমোঘ ‘কে আমি?’ প্রশ্নের উত্তর, আখেরে যার আলোয় অর্থবহ হয় নিজের অভিজ্ঞতা আর পছন্দ। [পৃষ্ঠা-২৬৯]
একটি মহৎ আখ্যান দাবী করে, জীবনের মহামঞ্চে মুমিনের ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি হল- আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা, তাঁর বাণী ছড়িয়ে দেয়া এবং তাঁর ইচ্ছার প্রতি নিরংকুশ আনুগত্য নিশ্চিত করা। মুসলিম আখ্যানে বিশ্বাস করলেই কেবল দৈনিক পাঁচবেলা পার্থনায় অর্থ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিংবা সেই একই বিশ্বাস অর্থপূর্ণ করে তোলে মসজিদ নির্মাণে অর্থব্যায়কে। অবশেষে একদিন অর্থবহ হয়ে ওঠে কাফির ও মুরতাদদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধও। প্রাতঃকৃত্য সমাপনান্তে পরিচ্ছন্নতা, মদ্যপান কিংবা যৌনাচারের মতন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জাগতিক কর্মকান্ডও অর্থবহ হয়ে ওঠে একই আলোয়। [পৃষ্ঠা-২৭২]
সমাজতান্ত্রিক আখ্যানে বিশ্বাসীর দুনিয়াটি একেবারেই ভিন্ন। এতে তার জীবনের একমাত্র কাজ হল আগুনঝরানো ভাষায় লাল মলাটের পুস্তিকা লিখে বিপ্লবের পালে হাওয়া জোগানো, হরতাল সংগঠিত করা আর আখেরে শ্রেণীশত্রুদের গলাকেটে বিপ্লব সম্পন্ন করা। এই আখ্যানটিও যাপিত জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আচরণকেও অর্থবহ করে তোলে। সেটি হতে পারে বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের শোষণের অভিযোগে একটি মার্কা বর্জনে কিংবা বড়দিনের দাওয়াতে গিয়ে বুর্জোয়া আত্মীয়ের সাথে তুমুল তর্কে। [পৃষ্ঠা-২৭৩]
তাহলে লোকে কেন বিশ্বাস রাখে এসব কাহিনীতে? এর অন্যতম কারণ হল, তাদের ব্যাক্তিগত পরিচয়টিই গড়ে উঠেছে এসব গল্পের ভিত্তিতে। লোকে এসব গল্প শুনে এসেছে আশৈশব। উপর্যুপরি একই গল্প তাদের বারবার শুনিয়েছে ঘরের লোক, শিক্ষক, প্রতিবেশী এমনকি পারিপার্শ্বিক সংস্কৃতির ধারকেরা। আর এই অব্যাহত ঘটনাটি শুরু হয়েছে, গল্পের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতন মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপক্ক্বতা গড়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই। যতদিনে বুদ্ধিবৃত্তি পরিপক্ক্ব হয়ে ওঠে, ততদিনে সিন্দবাদের বুড়োর মতন গল্পের চরিত্ররা আমাদের মগজে রীতিমত জাঁকিয়ে বসে। ফলে, অর্জিত বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য দ্বারা গল্পটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেয়ে তার সাফাই গাইতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠি। এই কাঠামোয় উত্তর খোঁজাটা হয়ে দাঁড়ায় বাচ্চাদের গুপ্তধন শিকারের মত। এই খেলায় বাচ্চারা তো মাথা খাটিয়ে ঠিক তাই খুঁজে বের করে, যা আগেই লুকিয়ে রেখেছিল বড়রা। চকোলেটের বাক্স লুকিয়ে রেখে ফলের ঝুড়ি উদ্ধারের কোনও সুযোগই এতে নেই। [পৃষ্ঠা-২৮১]
আমাদের নিজস্ব পরিচয় আর সামাজিক কাঠামোর পুরোটাই গড়ে উঠেছে কোন এক গল্পের ভিত্তিতে। কখনোবা গল্পটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা অচিন্ত্যনীয় হয়ে পরে। এই অপারগতা প্রমাণ কিংবা সাক্ষীসাবুদের অভাবে নয়, বরং ব্যাক্তিক এবং সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ তাসের ঘরের মতন গুঁড়িয়ে যাবে এই আশংকা থেকে উদ্ভূত। ইতিহাসে কখনো কখনো ভিতের চেয়ে ছাদটিই বেশি ভারী হয়ে যায়। নিজস্ব অর্থ ও পরিচয় যোগানো গল্পগুলো কাল্পনিক হলেও, লোকে অবলীলায় তা বিশ্বাস করে কেন? কিভাবে একটি গল্পকে সত্য বলে অনুভব করানো যায়? কেন লোকে গল্পে বিশ্বাস করতে চায় সেটি নাহয় পরিষ্কার, কিন্তু কিভাবে করে? হাজার বছর আগেই যাজক আর ওঝারা এই উত্তর খুঁজে পেয়েছেন- ধর্মাচার। ধর্মাচার এমন এক জাদুকরী ক্রিয়া যা বিমূর্তকে মূর্ত করে তোলে, গল্পকে করে তোলে বাস্তব। ধর্মাচারের প্রাণ হল মন্ত্রোচ্চারণ। পুরোহিত জলদগম্ভীর কন্ঠে উচ্চারণ করেন- ‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং, ইঁট পাটকেল চিৎ পটাং’ আর ভক্তরা নির্বিবাদে বুঝে নেয়- ‘মুশকিল আসান উড়ে মালি, ধর্মতলা কর্মখালি!’ [পৃষ্ঠা-২৮২]
এটি অবশ্যই হেত্বাভাস। ঈশ্বর কিংবা জাতিগত বিশ্বাসের কারণে দূর্ভোগ পোহাতে হলেই তা বিশ্বাসের সত্যায়ন করে না। এমনও হতে পারে, নিছক সারল্যের দাম চুকাতে হচ্ছে অনেককে। আদতে অধিকাংশ মানুষই বোকা বনতে চায় না, বা বোকা বনে গেলে স্বীকার করতে চায় না। ফলে তারা বিশ্বাসের পদপ্রান্তে আরও অর্ঘ্য হাজির করে চলে, যা চক্রাকারে তাদের বিশ্বাসকেই শক্তি যোগায়। উৎসর্গের মিথস্ক্রিয়া বড় জটিল। জনতার ওপরে ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য, যূপকাষ্ঠে দাঁড়ানো পুরোহিতকে বিনিময়ে কিছুই দিতে হয় না- বৃষ্টি, অর্থ বা বিজয় কিচ্ছু না। বরং তিনি গ্রহণ করেন অনেককিছুই। মাকড়সা একবার মাছিকে রাজি করাতে পারলেই খেলা শেষ। [পৃষ্ঠা-২৮৭]
উৎসর্গ কেবল আখ্যানের প্রতি বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে এমন নয়। এটি আরও অনেক ‘করতে না পারা’ ধর্মাচারের ক্ষতিপূরণ কিংবা দায়মুক্তির পথও বটে। মানবজাতির মহতী আখ্যানগুলোতে এমনসব মানদণ্ড রাখা হয়েছে, যা অধিকাংশ লোকে ছুঁতে পারে না। কতজন খ্রিস্টান অক্ষরে অক্ষরে দশটি ঐশী প্রত্যাদেশ মেনে চলেন? তাঁরা কি কখনো মিথ্যে বলেন না? কামনায় লালায়িত হন না? কতজন বৌদ্ধ মোহমুক্তির পথে হেঁটে নির্বাণ লাভ করেন? কতজন সমাজতন্ত্রী তাঁদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ শ্রমটুকু দেন এবং একই সাথে প্রয়োজনাতিরিক্ত এক টুকরো রুটিও গ্রহণ করেন না? আদর্শের পূর্বঘোষিত মানদণ্ড ছুঁতে অক্ষম লোকেরা উদ্ভাবন করেছে এক নতুন বিকল্প- যার নাম উৎসর্গ। একজন হিন্দু আয়কর ফাঁকি দিতে পারেন, গণিকালয়ে নিয়মিত হাজিরা দিতে পারেন, প্রবীণের সাথে অন্যায্য আচরণ করতে পারেন- এবং এরপরেও নিজের ধার্মিক স্বত্বাকে বুঝ দিয়ে শান্ত রাখতে পারেন কেননা তিনি বাবরী মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া সমর্থন করেন এবং সেখানে একটি মন্দির নির্মাণের তহবিলে মোটা অংকের চাঁদা দিয়েছেন। অতীতের মতন এই একুশ শতকেও স্বীয় অর্থ খোঁজার কন্টকাকীর্ণ পথনির্দেশকারী সিংহ-দরোজা বদলে যায় কিঞ্চিৎ উৎসর্গের খিড়কি-দুয়ারে। খোদ ঈশ্বরের দপ্তরেও ঐশী নথির চলৎশক্তি নিশ্চিত করতে স্বঘোষিত মুহুরীরা হাত পেতে থাকেন ঐশী টেবিলের নিচে। [পৃষ্ঠা-২৯১]
আমাদের হাতেই লেখা হয়েছে বাইবেল, বেদ কিংবা কোরান। আর আমাদের কল্পনাশক্তি এসব আখ্যানের শক্তি জুড়েছে। এই গল্পগুলো নিঃসন্দেহে সুন্দর, কিন্তু সেই সৌন্দর্য আসলে পাঠকের চোখে। জেরুজালেম, মক্কা, বারানসী কিংবা বুদ্ধগয়া নিজে নিজে পবিত্রভূমি হয়ে ওঠেনি, বরং তীর্থযাত্রীরাই সেই পবিত্রতা গড়ে তুলেছেন, এবং তীর্থফেরত যাত্রীদের অভিজ্ঞতার বয়ান সেই পবিত্রতাকে বর্ধিত করছে চক্রাকারে। এই বিশ্বজগৎ স্রেফ একতাল অণু-পরমাণুর জগাখিচুড়ি বই আর কিছু নয়। কোনকিছুই সুন্দর, পবিত্র বা আকর্ষণীয় নয়- যতক্ষন না আমরা সেই ঘোষণা দিচ্ছি। আমাদের অনুভূতিই পাকা আমকে সুস্বাদু, বাঁশির সুরকে মোহময় কিংবা গোময়ের ঘ্রাণকে জঘন্য রূপে সাব্যাস্ত করে। আমারই চেতনার রঙে, পান্না হল সবুজ, চুনি হল লাল। আমাদের অনুভূতিটুকু সরিয়ে নিলে হাতে থাকে অর্থহীন পেনসিল। [পৃষ্ঠা-২৯৮]
রাজনীতিবিদেরা যখন রহস্যভরা ভাষায় কথা বলেন, তখন সাবধান হওয়া ভাল। কেননা এসময় তাঁরা প্রকৃত দূর্ভোগের চিত্রটি আড়াল করে দূর্বোধ্য শব্দবন্যায় প্লাবিত করতে চাইছেন শ্রোতাদের চৈতন্যকে। চারটি শব্দের ব্যপারে খুবই সাবধানঃ উৎসর্গ, চিরকাল, বিশুদ্ধতা এবং মুক্তি। এগুলো শোনামাত্র মনে মনে বিপদের পাগলাঘণ্টা বাজিয়ে দেয়াই নিরাপদ। বিমূর্ত ভাষায় কোনও বক্তা যদি বলেন- ‘তাঁদের এই সুমহান আত্মোৎসর্গ চিরকাল আমাদের এই বিশুদ্ধ জাতির মুক্তির পাথেয় হয়ে থাকবে!’ তাহলে মহাবিপদ। আমাদের উচিৎ, হিংটিংছট মার্কা এসব যন্তরমন্তর এড়িয়ে নিজস্ব বিবেচনাশক্তি খাটিয়ে আসল চিত্রটি দেখার চেষ্টা করা। সেই বৃহত্তর চিত্রে হয়ত এক আহত সৈনিক গোঙাচ্ছে ব্যাথায়, নির্যাতিতা এক নারী হয়ত তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে, আতংকিত এক শিশু হয়ত ক্যামেরা দেখে কাঁপতে কাঁপতে দুহাত তুলে আত্মসমর্পন করছে বন্দুকভ্রমে। এই কষ্টগুলো রক্তমাংসের মানুষের বাস্তব অনুভূতি, কোনও বক্তিয়ার খিলজির ধোঁয়াটে গল্প নয়। গল্পের খোসাটুকু ছাড়িয়ে মানুষের প্রকৃত কষ্টগুলো দেখতে পাওয়া ও সহমর্মী হওয়া খুবই প্রয়োজন। [পৃষ্ঠা-৩০৮
সংগ্রহীত ]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১২:৪৩