গরু একটি গৃহপালিত প্রানী, ইহার চার পা এবং দুইটি শিং আছে। গরু ঘাস খায়....
প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময়ে গরু রচনাটা মুখস্ত করাটা ছিল ফরজ। এই রচনা না শিখলে জীবন ব্যর্থ হয়ে গরুতে পরিণত হওয়ার সম্ভবনা খুবই বেশী এবং যারা গরু হতে সক্ষম হবেন না তারা ছাগল বা গাধাতেও পরিনত হওয়ার নজীর আছে।
যাইহোক আজকের উদ্দেশ্য গরু নিয়ে রচনা না লেখা, আসলে গরুর চোখে দেখা মানুষদের নিয়ে রচনা লিখতে চাই। এতে যদি আমি গরুতেও পরিনত হই তাতে খুব বেশী কিছু যায় আসে না, কারন মানুষ কখইন গরুর মত হতে পারবে না, কারন গরুরা মানুষের চেয়ে উত্তম। গরু দুধ দেয়, গরু হাল চাষ করে এবং ষাড়ের লড়াইয়ে আহত হয়েও আমাদের আনন্দ দিয়ে থাকে। এখনেই শেষ নয় গরু তার জীবন, মাংস, চামরা, হাড্ডি, পাকস্থলী, কলিজা, ফেপরা, শিং, লেজ এমন কি গোবরও মানুষরে জন্য উতসর্গ করে বা করতে বাধ্য হয়। কোন মানুষ এতকিছু উতসর্গ করতে সক্ষম নয় অন্য কারো জন্য তাই হিসাবটা সহজ, মানুষ সৃষ্টির শেষ্ঠ জীব কিন্তু গরু মানুষের চেয়েও উত্তম।
এবার শুরু হোক গরুর কথা:
না তোমারদের মানুষের মত কোলে কোলে আদরে, দোলনায় দুলে আমার বড় হয়ে উঠা হয় নি। জন্মের দিন থেকে আমাকে শিখতে হয়েছে নিজের পায়ে দাড়ানো এবং পথ চলতে শেখা। কেই্ আমার মুখে দুধের বোতল তুলে ধরেনি, আমাকে শিখতে হয়েছে কিভাবে মায়ের বুক থেকে দুধ শুষে নিয়ে বেচে থাকতে হবে জন্মের প্রথম দিন থেকেই। ছোটবেলায় আমাকে বঞ্চিত করে তোমরা আমার মায়ের বুক থেকে চুরি করে নিয়েছ আমার অধিকারের দুধ। ভেবে দেখ একবার তোমার মায়ের বুক থেকে দুধ নিয়ে আমাকে খাওয়ানো হচ্ছে আর তোমার ছোট্ট বাবু টা ট্যা ট্যা করে কাদছে। ভেবে দেখেছ?
একটু বড় হওয়ার পরথেকেই আমার গলায় দড়ি দিয়ে রাখা হতো। যদিও মাঠের ঐ পারে সবুজ ঘাসের মাঠ আমাকে ডাকত কিন্তু খুটির সাথে বেধে রাখা আমি শুধু স্বপ্নই দেখতাম ঐ সবুজ ঘাসের রসালো কচি কচি পাতা। আমার তথাকথিত মালিক একদিন তার প্রতিবেশীর সাথে গল্প করছিলেন, তিনি বললেন "লালু" ও বলতে ভুলে গিয়েছি আমার একটা নামও দেয়া হয়েছিল, লালুটার গড়ন ভাল, ঠিক ঠিক মত পেলে পুষে বড় করলে কোরবানীর হাটে ভাল দাম পাওয়া যাবে।
আমার আদর যত্ন বেড়ে গেল অনেক। অন্যান গরু ভ্রাতারা যখন কাধে হাল নিয়ে টেনে টেনে হ্দ্দ। তখন আমি রাজকীয় আরামে বসে বসে খড় খাই আর জাবর কাটি, ভাবি আমি বড়ই ভাগ্যবান।
একদিন খুব সকালে আমার তথাকথিত মালিক, আমাকে নদীতে নিয়ে খুবছে দলাই মলাই করলেন। পানি আমার ততটা পছন্দ নয় কিন্তু কি আর করা আমার গলায় দড়ি বাধা।
একটা খুব বড় বাক্স কিন্তু তাতে গোল গোল চাকা চাগানো ছিল। অজানা একটা পোড়া পোড়া গন্ধ আসছিল এই আজব জিনিসটা থেকে। লোকজন একে ডাকছিল ট্রাক বলে। কতগুলো অজানা মানুষ আমার তথাকথিত মালিকের সাথে কথা বলছিল। অজানা মানুষগুলো বলল বাহ কি অসাধারণ একটা গরু। অহংকারে আমার শিং চক চক করে উঠল, গর্বীত হয়ে উঠলাম নিজের প্রসংশায়। অজানা মানুষগুলো এবং আমার তখাকথিত মালিক হাত মেলালেন। আমার দড়ি তুলে দেয়া হল অজানা মানুষগুলোর হাতে!!
ট্রাকে তোলা হল আমাকে, একি একি আরো দড়ি অনেক দড়ি - আমাকে বেধে ফেলা হল আষ্ঠে পৃষ্ঠে। তারপর সেই আজব বাক্স (ট্রাক) নড়তে শুরু করল। জীবনে প্রথম অজানার ভয় গেথে গেল আমার মনে। অজানা মানুষগুলো থামলো আরও অনেক গ্রামে, গঞ্জে এবং আরও অনেক গরু তুলে আনল ট্রাকের উপর। আস্তে ভরে উঠল ট্রাক, গায়ে গা ঘেষাঘেষি আরও অনেকগুলো গরুর সাথে।
কতক্ষন বা কিভাবে সময় কাটল জানা নেই, গরুরা টয়লেটে যায় না, যেখানে যখন চাপ আসে তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয় এবং সে কারনে আমাদের ট্রাক ক্রমশ গন্ধময় হয়ে উঠছিল নাম না জানা গরুদের গোবর আর চুনার গন্ধে।
এমন মানুষের আর গরুর সমারোহ দেখিনি কখনো, হাজার হাজার মানুষ এবং গরু। শোনা গেল এর নাম করটিয়ার হাট। অনেক মানুষ এল, আমার গায়ে হাত দিয়ে ছুয়ে দেখল, দাত দেখল, লেজ ধরে টানল।
একসময় জানলাম, আমি বিক্রী হয়ে গেছি স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যাক্তির কাছে।
পরের দিন, আমার নতুন মালিক গর্ব করে তার মোবাইল ফোন দিয়ে বিভিন্ন জায়গযায় ফোন করছিলেন এবং গর্ব করে বলছিলেন তিনি কতবড় একটা গরু কিনেছেন। এমনকি আমার সামনে দাড়িয়ে তার এবং আমার ছবি তুললেন অনেকগুলো। একে নাকি বলে "সেলফী", উনি বললেন তার ফেসবুকে কয়েকটা সেলফী দিয়েছেন এবং অনেক লাইক পেয়েছেন। তার বন্ধুরা হিংসায় জ্বলছে কারন তাদের এত বড় এবং দামী গরু কেনার ক্ষমতা নেই।
আমাকে দেখা শোনো করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মানিক নামে একটা ছেলেকে। মানিক আমাকে খেতে দিত, আমার সাথে ফিস ফিস করে কথা বলত। আহারে এত সুন্দর গরুটারে মাইরা ফালাব। ঐ হারামজাদার কোরবানী হবো না, দুই নম্বরী টাকা দিয়া গরু কিনলে কোরবানী হয় না।
শেষ মেষ কোরবানীর দিন এসে গেল।
আমি খুব শক্তিশালী কিন্তু মানুষের মিলিত শক্তির কাছে আমার শক্তি যথেষ্ট ছিল না। আমাকে ধরে শোয়ান হলো, লম্বা দাড়ীওয়ালা এক মানুষ সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে আমার গলায় ধারালো ছুড়ির পোচে কেটে ফেলল আমার চামরা, রগ -- ব্যথার বর্ণনা করে কোন লাভ নেই কারন মানুষেরা কখনও বুঝবে না কারন মানুষদের কোরবানী করা হয় না।
মরনের ঠিক আগে যখন আমি গরুদের বেহেস্তের স্বপ্ন দেখছিলাম তখন জানালাম আমি গরুদের বেহেস্তে যাব ঠিকই কিন্তু এই লোক দেখানো , সমাজ দেখানো ধর্মবাজরা কখনই বেহেস্তে যাবে না।


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




