ঢাকা থেকে বাসে চড়ে বাড়ি ফিরছিলাম।
তৎকালীন আমাদের ছাতারপাইয়ার সিটিং সার্ভিস বাস।
বাসের নাম ছিল সম্ভবত পাহাড়িকা (যতদুর মনে পড়ে)।
আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য ঢাকা থেকে বাড়ি আসার জন্য এই লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলোই ছিলো একমাত্র বাহন।
সব সিটপূর্ণ হয়ে গেলে আর যাত্রী না নেয়ার কথা থাকলেও লোকাল সার্ভিসের বাসগুলো ঠিকই যাত্রী নেয়।
অতিরিক্ত যাত্রীরা দাঁড়িয়ে যেতে হয়।
এই বাসটিতেও অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া হয়েছিল।
আমার পাশেই কোট টাই পরা এক ভদ্রলোক দুই দিকের দুইটা সিট ধরে দাঁড়িয়েছেন।
আমার চেয়ে বয়সে বড় কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তার সামনে আমি কখনো বসে থাকতে পারিনা, লজ্জা লাগে।
ভাবলাম ভদ্রলোককে সিটে বসতে দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে যাই।
চিটাগাং রোডে জ্যামে পড়ে ব্রেক করলো বাস। গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করলে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদেরই সমস্যা হয় বেশি।
ব্রেকের চোটে ভদ্রলোক ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলেন। ঠিক ঊনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন এসে পড়লো ভদ্রলোকের উপর।
তিনি আর দেরী করলেন না, ঠাশ করেই একটা চড় বসিয়ে দিলেন। সাথে কিছু গালি।
জীর্ন-শীর্ন শার্ট পরা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায় অত্যন্ত গরীব।
ভদ্রলোকের থাপ্পড় আর অভদ্র গালি খেয়ে লোকটা কোন প্রতিউত্তর না করে চুপচাপ থাকলো।
আমি বারবার তাকিয়ে দুজনের মুভমেন্ট দেখছিলাম।
ভদ্রলোক ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আর পেছনের লোকটা মলিন মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। কারন পুরো বাসের যাত্রীরাই এই কান্ড দেখেছে।
এটা নিশ্চয়ই তার জন্য লজ্জার বিষয়!
প্রায় আটদশ মিনিট পর বাস আবার ব্রেক করলো।
এবার ব্রেকের চোটে ভদ্রলোক ছিঁটকে পড়লেন আমার উপর!
ঠিক তখনই ভদ্রলোকের থাপ্পড় খাওয়া লোকটা হাত বাড়িয়ে উনাকে টেনে তুললো।
এবার বোধহয় সে কিছু বলার সাহস পেয়েছে।
স্যার, আমি গরীব মানুষ, অশিক্ষিত। গ্রামের একজন সাধারণ মুদি দোকানদার। আমার মা অসুস্থ, ঢাকায় ছোট ভাইয়ের কাছে টাকার জন্য এসেছি আজ। ঢাকা শহরের অনেক নিয়ম কানূন আমার জানা নাই।
স্কুল কলেজে কোনদিন পড়ার সুযোগ পাইনাই। আর তাই স্কুল কলেজে পড়ুয়াদের সম্মান করি খুব।
সেই সম্মানবোধ থেকেই আপনার চড়ের জবাব দেইনাই।
আপনি আমাকে চড় মেরে অনেক বড় শিক্ষিত আর ক্ষমতাবানের পরিচয় দিয়েছেন।
আর আমি আপনাকে পড়ে যাওয়া থেকে টেনে তুলে একজন মানুষের পরিচয় দিয়েছি।
আপনি ছিঁটকে গিয়ে যার উপর পড়েছেন, তিনি কিন্তু আপনাকে কোন চড় মারেননাই!
লোকটির কথা শুনে নতমুখে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন ভদ্রলোক। বাসভর্তি মানুষের কটুদৃষ্টি নিশ্চয়ই তাকে লজ্জিত করেছে। প্রবাদে আছে শরীরের আঘাতের চেয়ে কথার আঘাত অধিক ধারালো হয়। সেই ধারের আঘাতে লোকটা কতটা পর্যুদস্ত হয়েছে, সেটা তার চেহারা দেখেই অনুমান করা যাচ্ছিলো।
স্কুল কলেজের মলাটবাঁধা বইয়ে জীবন গড়ার বিদ্যা শেখানো হয়। কিন্ত চরিত্র আর নৈতিকতার শিক্ষা আসে পরিবার থেকে।
ভদ্রতা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না, এটা বংশগত শিক্ষা...