somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাড়িওয়ালির অশরীরি মেয়ে (৮ম পর্ব-৯ম পর্ব)

১৯ শে নভেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





হাত মুছতে মুছতে শানু বিছানায় এসে বসে একটা সিগারেট ধরায় । এমন সময় দরজার দিক থেকে আবারও সে লেবু পাতার হালকা গন্ধ ভেসে আসায় সেদিকে তাকায় ।
অশরীরি মেয়েটি দরজায় হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । হঠাত করে শানুর মন থেকে নার্ভাস ভাব, ভয় ডর সবই কেমন জানি উধাও হয়ে গেছে । সিগারেটে লম্বা টান দিতে দিতে সে বলে আপনি কে সেটাত বললেননা ।
আমি কে সেটা বলা কি খুবই জরুরি!
অবশ্যই জরুরি । আপনার সাথে আমি কথা বলছি, অথচ আপনি কে তা জানতে পারবোনা এইটা কি হয় । আপনার কথায় আমি দু দুটা চিঠি পড়ে শুনালাম, আর আপনি আপনার পরিচয়টা দিতে পারবেননা । আপনি কে, এখানে কিভাবে আসলেন, কোথা থেকে আসলেন, কেন আসলেন ।
মেয়েটি কিছুটা শব্দ করেই হাসে এবার । সে হাসি শুনে শানু আবারও একটু একটু ভয় পেতে থাকে ।
বাহ আপনার দেখি সাহস ফিরে এসেছে, কিছুক্ষন আগেত প্রায় অজ্ঞান ই হয়ে গিয়েছিলেন আর এখন দেখি কত প্রশ্ন আপনার । একসাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দিব কিভাবে।
শানু ভাবতে লাগল এই অশরীরি মেয়ের সাথে বেশী চড়া গলায় কথা বলাটা সমীচিন হবেনা । একেত অশরীরি, তার উপর জ্বীন না অন্য কিছু সেটাও বুঝা যাচ্ছেনা । কোন ঝামেলায় পড়লে কিংবা তার কোন বিপদ হলে এই সময় কারো সাহায্য পাবার ও কোন সম্ভাবনা নেই । সে যা বলে তাই করে যাওয়াটাই বুদ্ধীমানের কাজ হবে । অবশ্য এটাও তার মনে হচ্ছে, এই মেয়ে তার বড়সড় কোন ক্ষতি হয়ত করবেনা, করার থাকলে এতক্ষনেই করে ফেলত ।
মেয়েটিই কথা বলতে শুরু করে।
আমার নাম , থাক আমার নাম জেনে আপনার কোন কাজ নেই । নাম থাকে জীবিত মানুষের , আমিত আর জীবিত মানুষনা । আমি অশরীরি মানুষ কিংবা মেয়ে বলতে পারেন ।
আমার জন্য নাম জরুরী কিছু না , আপনে চাইলেও এমন আরেকজনরে খুজে বের করতে পারবেননা , কাজেই নামের কোন দরকার নেই । আর আমি কোথাও থেকে আসি নাই, একসময় এখানেই ছিলাম, ভাল লাগে তাই এখানেই রয়ে গেছি ।
কি হলত আমার পরিচয় জানা ! ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ধরে রেখে মেয়েটি শানুর দিকে তাকিয়ে আছে ।
শানুও যথা সম্ভব নির্লিপ্ত ভাব ধরে রেখে জবাব দিল, ধন্যবাদ আপনার পরিচয় জানানোর জন্য ।
মেয়েটি আবারও শব্দ করে হেসে উঠে, হা হা হা, বাহ আপনি দেখি রাগ ও করতে পারেন, আপনার সাহসতো কম নয় । দেব নাকি ঘাড় মটকে, ছোট বেলায় ভুতের গল্প শুনেন নাই, ভুত ধরে ঘাড় মটকে দিত, বলেই মেয়েটি হাসতে থাকে ।
শানু আবারও কেমন জানি ঘোর লাগার মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে, সে বুঝতে পারেনা, কে এই অশরীরি, সে কি চাই, কেনইবা তার সাথে দেখা দিল । তার কি করা উচিত সেটা ঠিক ভাবে ভাবার মত শক্তি সে সঞ্ছয় করতে পারছেনা ।
মেয়েটি বুঝতে পারে, শানুর এই অবস্হা । নিজে থেকেই বলে, আপনার আর কস্ট করে ভাবতে হবেনা আমি কে । আমার পরিচয় দিচ্ছি , আপনি সুস্হির হয়ে বসুন ।
এই কথা শুনে আবার শানুর সাহস একটু ফিরে আসে, একটু শব্দ করেই সে বলে, বাহ কি সুন্দর আব্দার ! আপনি সুস্হির হয়ে বসুন । চোখের সামনে অশরীরি এমন একটা মানুষ থাকলে কেউ সুস্হির হয়ে বসতে পারে !
এইযে আপনিইত আমার পরিচয় বলে দিলেন, অশরীরি মানুষ । সমাধান হয়েই গেল । আমি জ্বীন ও না ভুত ও না । একসময় মানুষের মত আকৃতি অবয়ব সবই ছিল আমার, এখন শুধু অবয়বটাই আছে, রক্ত মাংসের শরীরটা অশরীরি হয়ে গেছে ।
কি করে হল ? এমনি এমনিত আর রক্ত মাংস গায়েব হয়ে যেতে পারেনা ।
সে অনেক লম্বা গল্প । বলা শুরু করলে রাত শেষ হয়ে যাবে ।
হউক তাতে সমস্যা নেই । আমি জানতে চাই কি করে আপনি এমন হয়ে গেলেন ।
কি করে এমন হয়েছি সেটা আমিও জানিনা । আর কেউ এমন হয়েছে কিনা সেটাও আমি জানিনা ।
আপনাদের দুনিয়ার ভাষায় আমি একবার মারা গিয়েছিলাম এটা জানি । এরপর এখানেই বা কি করে আছি তা জানিনা ।
মানে কি ? আপনি এখানে কি করে আছেন তা আপনি জানেননা, এটা একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা হল ।
আপনাকে বিশ্বাস করতে কে বলেছে ! আপনি বিশ্বাস করা না করা দিয়ে কিছুই আসে যায় না । একসময় আমি এই বিল্ডিং এ থাকতাম, তাই বিধাতা হয়ত মারা যাবার পরে আমাকে এখানেই রেখে দিয়েছে কিংবা এমন ও হতে পারে আমি যেভাবে মারা গেছি তার জন্য তিনি আমাকে এমন অশরীরি করে এইখানে রেখে একটা শাস্তি দিচ্ছেন ! আর কারো মারা যাবার পর এমন হবার কথাতো শুনিনি ।
আপনি কিভাবে মারা গেছেন ।
আপনার কি খুব শুনতে ইচ্ছা করছে !
হুমমম ।


আমি থাকতাম আমার মামা মামির কাছে । ওনারাই আমারে পালছেন অনেক দিন । বয়স যখন পাঁচ বছর তখন আমার বাবা-মা মারা যান । আমি হলাম আসল অভাগী, আমার জন্যই আমার বাবা মা মারা গেছেন । আমি যদি জেদ না করতাম তাহলে হয়ত এমন ঘটনা ঘটতোনা , আবার পরক্ষনেই ভাবী নিয়তির উপরে কোনদিন কি কারো কোন হাত ছিল ! নিয়তি লঙ্ঘন করার ক্ষমতাতো আসলে কারো নেই । যার কপালে যা লেখা রয়েছে তাই হয়েছে, তাই হবে, সেটা ঠেকানোর কোন উপায় নেই ।
আমাদের বাড়ী ছিল বরিশালের স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়ন এ । এইটা কিন্তু বাংলাদেশের বিখ্যাত জায়গা এখন পেয়ারার বাগানের জন্য । বর্ষায় এখান থেকেই সারা দেশে পেয়ারা সাপ্লাই করা হয়,নদী পথে সে পেয়ারা সবখানে পৌঁছাইয়া যায় । আমাদেরও অনেক পেয়ারার গাছ ছিল, বেশ বড় বাগান, মাঝে মাঝে বাবার সাথে আমিও নৌকায় করে সেখানে যেতাম, পেয়ারা পেড়ে আনার মৌসুমে । বাবা আরো দু-তিন নৌকা সাথে করে নিয়ে যেতেন, সবাই মিলে পেয়ারা নিয়ে এসে সেটা ভাসমান বাজারে বিক্রি করা হত । বাবার সাথে আমার পেয়ারার বাগানের স্মৃতিই বেশী মনে পড়ে, যার জন্য বাবা মারা যাবার পর আমি জীবনে আর কোন দিন পেয়ারা খাইতে পারি নাই ।
আমার নানা বাড়ি ছিল সন্ধ্যা নদীর ওপাড়ে । নদীর কাছাকাছিই ছিল বাড়ী । সেইবার আমার মামা আমাদের এখানে আসছিলেন আমার মা কে দেখার জন্য , শহরে তার কি কাজ ছিল, সেটা শেষ করে মাকে দেখতে এসেছিলেন । মামা যাবার সময় আমি বায়না ধরেছিলাম সাথে যাবার । নানা বাড়ীতে আমার সমবয়সী অনেক বাচ্চা কাচ্চা ছিল, সেখানে আমারও ভাল লাগত । আমার দিকে তাকিয়ে বাবাও রাজি হয়েছিলেন, বলেছিলেন ঠিক আছে দুদিন পরে মা সহ গিয়ে আমাকে নিয়ে আসবেন । সেই দুদিন আর কখনো আসেনি । আমাকে আনতে তারা রওয়ানা হয়েছিলেন ঠিকি, কিন্তু কালবৈশাখি ঝড়ে সন্ধ্যা নদীতে তাদের নৌকা ডুবে গিয়েছিল । একদিন পরে পাওয়া গিয়েছিল আমার বাবা মাকে ! আমার আর কোনদিন আমাদের বাড়ীতে ফিরে যাওয়া হয় নাই । ।
যখন আমার দশ বছর তখন আম্মা আমারে তার সাথে করে নিয়ে আসেন। আমি তখন ক্লাশ ফোরে পড়ি । আমার মামার বাড়ির পাশেই ওনাদের বাড়ি । মামার অবস্হা অত বেশী স্বচ্ছল ছিলনা, ওনার ও ছেলে মেয়ে ছিল
চারজন । আম্মা বাড়িতে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মামার বাড়িতে এসেছিলেন, মামির কাছে আমার মা মারা যাবার কথা শুনেন । আমার মাকে বেশ ভাল করেই চিনতেন । সব কথা শুনে তিনিই নিজে থেকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমাকে ওনার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখার জন্য । এমন না যে আর্থিক অবস্হা ভাল না বলে মামা-মামি এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন । ওনারা মন থেকে এটা চান ও নাই । বোনের স্মৃতি হিসেবে মামা আমাকে যথেস্ট আদর সোহাগ করতেন। কোনদিন নিজের সন্তানদের থেকে আলাদা করে দেখেননি । আমার মামিও অনেক ভাল মানুষ ছিলেন। আমাকে কোন দিন কোন বিষয় নিয়ে কস্ট দেয়া বা কথা শোনানো, কোনটাই করেন নাই ।
মামা মামি আম্মাকে কোন কথা দেন নাই, তার শংকিত ছিলেন ব্যাপারটা কেমন হবে ভেবে, কিংবা লোকে কি বলবে । আম্মা তাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে তোমাদের বোনের মেয়েকে আমি আমার নিজের মেয়ের মত করেই বড় করব , ঢাকায় নিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব, এইটা আমার ওয়াদা, আল্লাহ সাক্ষী । তাতেও তিনি মামা মামিকে গলাতে পারেন নাই । তারা বলেছিলেন ডাল ভাত যাই হউক আমরা কস্ট করে হলেও মেয়েটারে পেলে পুলে বড় করব । আমরা ওরে কারো কাছে দিয়ে দিতে চায়না ।
এত কিছু কিংবা কথাবার্তা যে এই লেভেলের হয়েছে তা আমার জানা ছিলনা । পরদিন সকালে আম্মা আবার আসেন । এইবার আমি ওনার সামনে পরে যায় । উনি আমার মার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন । তারপর এ কথা ও কথার পর বললেন তুমি আমার সাথে ঢাকা যাবা , ঐখানে স্কুলে পড়বা । আমাদের বাড়িতে থাকবা, আমার মেয়ের সাথে সময় কাটাবা ।
ওনাদের সম্পর্কে আমি জানতাম, গ্রামের সবাই জানত, বিত্তশালী পরিবার। চাচা যে ক্ষমতাবান, সরকারি বড় কর্তা, এইটা গ্রামের সবাই জানত, সবাই নানা দরকারে , বিপদে আপদে ওনার কাছে ছুটে যাইত । ও একটা জিনিস, আপনার বাড়িওয়ালিকে আমি আম্মা ডাকলেও বাড়িওয়ালাকে কখনো আব্বা ডাকি নাই । ওনাদের বাসায় আসার পর আম্মা যখন বলেছিলেন ওরে আমি পালব এখন থেকে, ও আমারে আম্মা ডাকবে, তখন উনি আমার দিকে একবার তাকাইয়া কি নাম জিজ্ঞেস করলেন, তারপর বললেন তুমি আমারে চাচা ডাইকো । আমিও সবসময় চাচাই ডাকছি, কখনো আব্বা ডাকতে ইচ্ছা হইছে তাও না । এত বড় ক্ষমতাবান সরকারি চাকরি করা একটা মানুষকে আব্বা ডাকতে আমারও ইচ্ছা হয় নাই ।
ওনি আমাকে বলার পর কেন জানিনা আমার খুব লোভ হল ওনার সাথে চলে আসার । ঢাকা শহরে থাকব, বড় লোকের বাড়িতে, ভিন্নরকম পরিবেশ, টেলিভিশন থাকবে, পুরা ব্যাপারটাই অন্যরকম । এমন না যে আমি অনেক কস্টে আছি, অভাবে আছি, কিন্তু তারপরও অন্যরকম একটা জীবনের জন্য কেন জানি আমার লোভ হয়েছিল, আমি সে লোভের হাতছানির কাছে বিনা দ্বিধায় ধরা দিয়েছিলাম । পরে কয়দিন একটু কস্ট হয়েছিল, মামা-মামি, মামাত ভাই বোনদেরকে ছেড়ে আসাতে, একসময় তাও ঠিক হয়ে গিয়েছিল ।
আমি আম্মার কথায় রাজি হয়ে গেছি, এ কথা শুনে মামা-মামি কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন । মামা ভেজা গলায় বললেন, কিরে মা এইখানে কি তোর অনেক কস্ট হইতেছিল । সাথে সাথে আমারও চোখে পানি এসে ভরে গিয়েছিল । কাঁদতে কাঁদতে আমি মামাকে বললাহয়ে বসে ম মামা আমার ঢাকা শহর দেখার খুব শখ । মামা কিছুক্ষন নির্বাক হয়ে বসে ছিলেন । তারপর আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন ঠিক আছে তোর যেহেতু ইচ্ছা করতেছে তাহলে তুই যা । আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন আপা আমার বোনের একটাই স্মৃতি আপনের হাতে তুলে দিলাম । তারে ঠিক মত পাইলা বড় কইরেন , মা মরা মাইয়া, বকা ঝকা দিয়েন না । আর কোন অপরাধ কইরা ফেললে, মাইরেননা, আমার কাছে পাঠাইয়া দিয়েন । মামার এই কথা শুনে মামি ও ডুকরে কেঁদে উঠলেন , আমিও । এর দুই দিন পরে আমি আম্মার সাথে লঞ্চে করে ঢাকায় রওয়ানা দিলাম । জীবনে প্রথম লঞ্চ চড়ার আনন্দে আমি টার্মিনালে আসা পর্যন্ত যে ছলছল চোখের কারনে কিছুই দেখতে পারছিলামনা, সে চোখ মুছে নিয়ে পরিষ্কার করে নতুন পৃথিবী দেখা শুরু করলাম । টার্মিনালে হাজারো মানুষ, আলো ঝলমলে সব লঞ্চ, চারিদিকে মানুষের হাঁকডাক- সবই বিষ্ময় নিয়ে হাজির হচ্ছিল আমার সামনে । নিজের আপন জনদেরকে পেছনে ফেলে আসার কস্টও সেই হাঁকডাকের ভিড়ে আস্তে আস্তে কমে যেতে লাগল । এই ডিসিশানের জন্য আমার খারাপ লাগাটাও কমে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে । মনে মনে ভাবছিলাম এই ডিসিশান না নিলে আমার জীবনে কোনদিন হয়ত লঞ্চ এই চড়া নাও হতে পারত । লঞ্চ টার্মিনাল ছেড়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে , আমিও আমার নতুন জীবনের দিকে এগিয়ে চলেছি ।
ঢাকায় শুরু হল আমার নতুন এক জীবন । অজ পাড়া গাঁয়ের জীবনের সাথে যার কোনদিক থেকে কোন মিল ছিলনা । প্রতিদিন টিভি দেখতে পারতাম, গ্রামেত এইটা কল্পনাও করা যেতনা সেসময় । আম্মা আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন । সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা । ঢাকায় আসার পর ওনার দুই ছেলে মেয়ের সাথে আমার পরিচয় করাইয়া দিলেন । দুই জনই আমার থেকে বড় । ছেলেটা চুপচাপ তেমন একটা কথা বার্তা বলতোনা । মেয়াটা ঢঙ্গী টাইপ, সাজু গুজু করে ঘুরতে পছন্দ করত । ইচ্ছা হলে আমার সাথে অনেক গল্প করত, সবই তার দিন যাপনের গল্প, আমি কেবল শুনতাম । জানিনা, একটা জিনিষ আমার ভেতরে অটোমেটিক কাজ করেছিল, যে যত যাই হউক আমি ওদের মত না , কিংবা তেমনটা হতেও পারবোনা । এখানে আছি, আমার আগের জীবনের চেয়ে হয়ত ভিন্ন একটা জীবন পাব, কিন্তু সেটা কখনোই আম্মার দুই ছেলে মেয়ের মত না , কাজেই আমাকে বুঝে শুনে চলতে হবে । তবে একটা জিনিস সত্য, ভাই বোন দুজন কোন দিন আমার সাথে খারাপ আচরন করে নাই , ইচ্ছা না হলে পাত্তা দিতনা, কিংবা কথা বলতোনা, কিন্তু বকা ঝকা গালা কিংবা খারাপ আচরন কখনো করে নাই ।
সরকারি কোয়ার্টারের কাছেই ছিল আমার স্কুল, সরকারি প্রাইমারি । বেশ কিছু কাপড়চোপড় কিনে দেয়া হয় আমাকে । বাসার ছোটখাট একটা রুমে আমার জায়গা হয়, যেটাতে অন্যান্য জিনিসও থাকত , তাতে আমার সমস্যার কিছু ছিলনা, কুঁড়ে ঘর থেকে সোজা বিল্ডিং ঘরে যার আগমন । টেবিল ফ্যানও ছিল একটা আমার, ফ্যান জিনিসটা দেখে শুরুতেত আমার মাথায়ই আসতোনা এটার ভেতর থেকে কেমনে বাতাস বের হয় !! হা হা হা হা । বাসার টুকটাক কাজ কর্মও করতাম আমি, দোকান থেকে এটা ওটা নিয়ে আসা, কেউ পানি চাইলে সেটা দেয়া । খবারের সময় সব কিছু টেবিলে নিয়ে রাখা । কোয়ার্টারের অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে মেশার সুযোগ আমার হতোনা, কারন আমি বাইরে বেরুতামনা, বিকালে বাসায় বসে টিভি দেখতাম । মাঝে মাঝে হালকা পড়ালেখাও করতাম, আম্মার সামনে বসে । পড়ালেখার প্রতি আমার কোন আগ্রহই ছিলোনা, যতটা ছিল টিভি দেখার প্রতি । এক জীবন টিভি দেখে কাটিয়ে দেয়া কঠিন কিছু মনে হয় নাই ।
এভাবেই জীবন চলে যাচ্ছিল । কেমনে কেমনে জানি আমিও ক্লাশ এইটে উঠে গেছিলাম। ক্লাশের শেষের দিকে যদিও ছিল আমার রোল নাম্বার, তাওতো উঠেছি । আম্মার কাছে জীবনটা ছিল আমার ভাল মন্দয় মেশানো । তিনি মাঝে মাঝে মাথা গরম হয়ে গেলে অনেক গালাগালি করতেন, কখন কি সে যে তিনি গরম হয়ে যান তার ও কোন ঠিক ঠিকানা ছিলনা । কখনো কখনো আমার ইচ্ছা হ্য এই মহিলার মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে দিতে । কি অশ্লীল ভাষায় যে তিনি গালাগালি করতে পারতেন তা বলবার মত না । আমি তখন মাঝে মাঝে রান্নাবান্নাও করতাম । লবণ একটু কম বেশী হলেই শেষ আমি । আবার ঘন্টাখানেক পরেই সব নরমাল । আমাকে ডাক দিতেন টিভিতে হিন্দী সিরিয়াল দেখার জন্য । চাচা কোন কিছুর মাঝেই ছিলেননা, তিনি তার অফিস আর কাজ কর্ম নিয়ে নিজের মত থাকতেন ।
নাইনের শুরুতেই আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিলাম । স্কুলে যেতামনা, ব্যাপারটা লক্ষ্য করার পর আম্মা জানতে চাইলে বললাম আমর লেখাপড়া ভাল লাগেনা, যথারিতী তিনি অনেকক্ষন গালাগালি করলেন, আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে নিয়ে অনেক কথা শুনালেন , তারপর এ নিয়ে আর কোন কথায় বলেন নাই, তার কৃপনতাও কিন্তু অনেক বড় লেভেলের । তার মত কৃপন আমি আর কাউরে দেখি নাই । নতুন বইখাতা কেনা লাগবেনা, ডেইলি কিছু টাকা দেয়া লাগবেনা, তিনি মনে হয় এই ব্যাপারটা ভেবে মেনে নিয়েছিলেন । আমাকে ঢাকায় আনা, লেখাপড়া করানো, সবকিছুই তার এক ধরনের খামখেয়ালেরই অংশ, গ্রামে মানুষের কাছে বলার জন্যও বটে । তার এই বাড়ির কাজ চলছে তখন, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই । বরং ঘরের রান্না বান্না সহ সব কাজ আমার হাতে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত মনে এই কাজে মনো নিবেশ করলেন ।
তেমন কোন ঘটনাবহুল ছিলনা আমার জীবন । গ্রাম থেকে আসার পর মাত্র দুইবার গ্রামে গেছি । মামা মামি সহ সবাই তখন আমারে অনেক আদর করত । প্রতিবার ফেরত আসার সময় মামা কানত আর বলত মারে তোর এই গরীব মামারে ক্ষমা করে দিস । আমার আসলে এইসব কোন কিছুই মাথায় কাজ করতোনা । গ্রামে গেলে আমার ভাল লাগতোনা, কারেন্ট নাই , টিভি নাই । সন্ধ্যা হলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যেত, মনে হত সিরিয়ালটার না জানি আজকে কোন ঘটনা ঘটে গেল । তাই ঢাকায় ফিরে আসার জন্য আমি পাগল হয়ে যেতাম । সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে আম্মা নিজের বাড়িতে চলে আসলেন একদিন । বাসাতে টানা কয়েকদিন অনেক আনন্দ হইছিল, সব আত্মীয় স্বজনরে দাওয়াত দেয়া হইছিল । তিনি সবাইরে নতুন কাপড় কিনে দিয়েছিলেন । ওনার ছেলে মেয়েরা খুব একটা খুশী ছিলনা, এইখানে তাদের কোন বন্ধুবান্ধব নেই বলে । যাই হউক কে জানত এই নতুন বাড়িই আমার জন্য কাল হবে, একদিন আমি এর ছাদ হতে পরে মারা গেলাম । তারপর থেকে অশরীরি হয়েই এখানে আছি । কেন , কিভাবে অশরীরি হলাম তা আমিও জানিনা ।
এই হচ্ছে আমার কাহিনী । কি শুনে খুশী হলেনত । যান এখন ঘুমাতে যান, ফজরের আজান দিবে একটু পরে ।
কয়টা বাজে, কতক্ষন সময় গেছে, কিছুই খেয়াল নেই শানুর, সে ঘোর লাগা ভাব নিয়ে শুনে যাচ্ছিল । মেয়েটি থেমে যাওয়ায় সে বাস্তবে ফিরে এল । বাড়িওয়ালির অশরীরি মেয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে । ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি লেগেই আছে ।
অনেকক্ষন সিগারেট ধরানোর কথা ভুলে গিয়েছিল সে । একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তোমার গল্ল শুনলাম ভাল কথা, কিন্তু তুমি ছাদ হতে পরে মারা গেছ এমনি এমনি এটা আমি বিশ্বাস করিনা । কি হয়েছিল যে তুমি আত্মহত্যা করেছিলে ।
শানু তাকিয়ে আছে, মেয়েটির চেহারা হঠাত কেমন যেন মলিন হয়ে গেল । লম্বা সময় ধরে গল্প শুনতে শুনতে শানু কখন যে আপনি থেকে হঠাত করে তুমি তে চলে এসেছে তা দুজনের কেউই খেয়াল করে নাই ।
পরক্ষনেই সে বলল, অনেক কথা বলেছি, এইবার ঘুমান, আপনার না সকালে অফিস আছে । আমি চললাম ।
শানু কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটি নাই হয়ে গেল । বিছানা থেকে নেমে ছাদে আসল সে, চারদিকে হেঁটে ঘুরল, না মেয়েটির কোন অস্তিত্ত্বই নাই কোনদিকে ।
আকশ ফর্সা হয়ে গেছে । একটু পরেই সূর্য উঠবে । মনে হয়না আজকে আর সে অফিসে যেতে পারবে । মোবাইলটা সাইলেন্ট করে বিছানায় গেল ঘুমানোর জন্য ।
চোখ বন্ধ করতেই পুরোনো সে লেবু পাতার ঘ্রান নাকে এল তার । চোখ খুলে চারিদিকে তাকিয়েও সে কিছু দেখলোনা । বন্ধ দরজা আর জানালার দিকে , কখনো রুমের এই দিকে ঐ দিকে সে তাকাতে থাকল, কোথাও মেয়েটিকে দেখতে পেলনা ।
এইভাবে একসময় ঘুমিয়েও পড়ল সে । খাটের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি, মাথা ঘুরালে হয়ত দেখতে পেত সে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×