বিলু মিয়াঁ-র মন খুব খারাপ। ক্লাস থেকে ইংলিশ স্যার তাকে বার করে দিয়েছেন আজ।
ছোট গ্রামের ছোট হাইস্কুল, সব ক্লাসেই একটা করে সেকশন। টিনের চাল দেওয়া ছোট স্কুলবাড়ি। কিন্তু খেলার মাঠ বেজায় বড়। মাঠের ধারে বিরাট এক দিঘী, ধার দিয়ে নারকেল-গাছের সারি।
ক্লাস সিক্সের বিলু মিয়াঁ কিছুক্ষন হাঁ করে ক্লাস-রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে মনের দুঃখে দিঘীর ধারে এসে বসে। মনে তার অবিচার পাবার ক্ষোভ, অপমানের জ্বালা। কি এমন অন্যায় করেছিল সে?
স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, "ঘুড়ি কে ইংলিশে কি বলে?"
বিলু মিয়াঁ-র সপ্রতিভ উত্তর , "কাইট!!"
"যদি বলি লাল ঘুড়ি?"
সঙ্গে সঙ্গে বিলুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিকেল বেলা মাঠের ধারে অন্য পাড়ার ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, ঘুড়ি-র লড়াই লেগেছে, একটা লাল ঘুড়ি-এ সঙ্গে কালো ঘুড়ি-র লড়াই..., লাল ঘুড়ি-র ছেঁড়া হাফ-প্যান্ট পরা মালিক প্রানপনে সুতো টানছে...।
"কিরে ? কি হল? লাল ঘুড়ি কে কি বলবি ইংলিশে?"
বিলু হঠাৎ চমকে উঠে চোখ গোল-গোল করে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘"স্যার, কাইট-কাইট, ফাইট-ফাইট, কাটাকাটি ফাইট!!"’
সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের মধ্যে বাকি ছেলেদের হাসির রোল ওঠে ! তারপর সেই সমবেত হাস্যকে থামাবার জন্য স্যারের চিৎকার, "গেট আউট ! গেট আউট অফ মাই ক্লাস, আই সে ! মজা করা হচ্ছে পড়াবার সময়?"
আর কি করা যাবে? সব কটা ঘরে পড়ানো চলছে, বাইরে শুধু দু-একটা ঘুঘু পাখির ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছেনা।
দিঘীর পানি শান্ত শীতল,
নিজের-ই কথা কয়
মনে আজ দুঃখ কেবল,
কে তার ভাগ নেয়?
বিলু-র মন ঘুরে বেড়ায় পানির তলায় মাছেদের সাথে- তাদের সাথে সুখ-দুঃখের কথা হয়, তারপর ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় গাছের ডালে পাখির বাসায়, যেখানে মাছরাঙ্গা মা তার ছানাদের খাওয়ানোর জন্য ধরে আনে ছোট ছোট মাছ। গাছের ডাল থেকে আবার নেমে আসে দিঘীতে ভেসে বেড়ানো হাঁসেদের ডানায়, তারপরেই সে কিছুক্ষন মাঠে চরা গরুদের গলায় ঘন্টা হয়ে দোলে, হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি-তে ছাগল ছানার পিছন পিছন দৌড়ায়। পূব আকাশে দেখা দেয় হালকা রামধনু।
এই ভাবেই এক সময় আকাশে সন্ধ্যা নামে, চাঁদ ওঠে। দূরের মসজিদের আজানের শব্দ বাতাসে ভাসে।
চাঁদ উঠল আকাশে,
ফুল ফুটল বাতাসে;
গরুর পাল ঘরে ফেরে,
সূর্য গেল অস্তাচলে।
বিলু মিয়াঁর চোখে ক্লান্তি, পেটে জ্বলে আগুন। বাসায় নিশ্চই এতক্ষনে বন্ধুরা স্কুলের গল্প শুনিয়ে সারা। আজ আম্মার কাছে কি করে মুখ দেখায় সে? আম্মা তাকে মারেও না বকেও না। কিন্তু কিছু সে কিছু গোলমাল করে এলে আম্মার দুঃখী মুখের দিকে তাকালে বিলুর বুকটা কষ্টে ফেটে যায়। বড় ভাল মানুষ যে বিলুর আম্মা। দিঘীর ধারে বসেই বিলু চলে যায় ঘুমের দেশে।
বিলু মিয়াঁ পৌঁছে যায় এক মজার দেশে। আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠে সোনালী রোদ্দুর, গাঢ় নীল আকাশে সাদা-সাদা ছেঁড়া মেঘ, আকাশ ভর্তি লাল-কালো ঘুড়ি। সেই ঘুড়ি উৎসবের মাঠের মধ্যে দিয়ে বিলু মিয়াঁ এক লাল ঘুড়ির পিছনে ছোটে। লাল ঘুড়ি আর এক কালো ঘুড়ির মধ্য লাগে ভীষন লড়াই। লাল ঘুড়ির সুতো কেটে গিয়ে সে লাট খেতে খেতে বিলু মিয়াঁ-র দুহাতের মধ্যে আলতো ভাবে নেমে আসে। বিলু মিয়াঁ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সেই ঘুড়ির মধ্যে চমৎকার মুখ-চোখ আঁকা।
ঘুড়ি বলে ওঠে, "বল তো আমি কে?"
বিলু বলে, "আরে ! তুমি হলে তো সেই লাল ঘুড়ি!"
"না না, হলনা। ইংলিশে বল।"
"তুমি তাহলে রেড কাইট!"
আকাশ থেকে সবকটা ঘুড়ি সমস্বরে হাসতে হাসতে একসাথে কলকলিয়ে বলে ওঠে, ‘"কাইট-কাইট, ফাইট-ফাইট, কাটাকাটি ফাইট!!’"
দূর থেকে শিয়ালের ডাক আর গ্রামের লোকেদের চিৎকারে বিলুর ঘুম যখন ভাঙ্গে চাঁদ তখন মাঝ আকাশে। চারিদিক ধুয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায় । সবার মাঝ থেকে আম্মার ডাক শোনা যাচ্ছে, "বিলু, ও আমার বিলু রে....!!"
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ১০:২৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




