করোনা মহামারীর প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম যে করোনা একটি গ্লোবাল বিপর্যয়। এটি ভীষণভাবে আত্মপরিচয় ভিত্তিক রাজনীতির ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। সেট দেখা গেল অচীরেই। চীন বা চৈনিক চেহারার মানুষরা নানান জায়গায় আক্রান্ত হওয়া শুরু করলেন। সামগ্রিকভাবে চীনকে এই বিশ্বের শত্রু হিসেবে গণ্য করা শুরু হল। বৈশ্বিক জনমানসে স্পষ্টতই এই ধরণের চিন্তার ঢেউ এখনো ফুরিয়ে যায়নি বরং আরো জোরদারই হচ্ছে। সেটার এক রকমের প্রতিকার হিসেবেই আলিবাবার জ্যাক মা ঘোষনা দিলেন বিভিন্ন দেশে বিপুল সংখ্যক মাস্ক, পি.পি.ই., টেস্ট কীট দেবার। চাইনীজ মিডিয়াতেও দেখা গেল “সব ঠিক হয়ে গেছে”। আবার ক’দিন পরেই করোনা আক্রান্ত ও নিহতের ভিন্ন সংখ্যা আসা শুরু হল। কোন দেশ, কোন সংস্কৃতি কীভাবে করোনা মোকাবিলা করেছে তা করোনা পরবর্তী রাজনীতির জন্য আবশ্যক হয়ে উঠবে।
জাতিঘৃণা একটি সচেতন ও সূক্ষভাবে নির্মিত রাজনীতি। ৯/১১ এর পর থেকে “মুসলমান পরিচয়” এই জাতিঘৃণা রাজনীতির নানান রুপ আমরা দেখতে পাই। দেশ দখল, সম্পদ হরণ, গণহত্যা ইত্যাদি সকল কাজে এর ব্যবহার হওয়া শুরু হয়। আর্ন্তজাতিকভাবে “মুসলমান পরিচয়” বহন করার আত্মশ্লাঘা তৈরির চেষ্টাও চলে। আবার চলে এই পরিচয় বহনের অতি উচ্ছাস। দুটোই পরস্পর সম্পর্কিত। মনে রাখতে হবে যে পুরোটাই নির্মিত এবং একটি আরেকটির প্রতিক্রিয়া।
আবার দেখার মত বিষয় হল, ২০০০ পরবর্তীতে যে বিশ্বের মত বাংলাদেশেও উগ্রবাদের যে উত্থান তা ভীতিকর। বিগত কয়েক দশকে জনপ্রিয় পরিসর কেন্দ্রীক, মানুষের ঘরে ঘরে যে “ইসলাম” ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা দরকার। মূল ধারার রাজনীতিতেও যে সাম্প্রতিক প্রভাব সেটিও মনে রাখা দরকার।
ব্লগার কোপানো, হলি আর্টিজানের পাশাপাশি জনপ্রিয় পরিসর কেন্দ্রীক যে “ইসলাম” তা নিয়ে কাজ খুব বেশি হয়নি বলেই মনে করি। সাম্প্রতিককালের যে “ওয়াজ” সংস্কৃতি চালু হয়েছে সেটিকে পূর্ববর্তী ইতিহাসের বাইরে দেখা বিপদজনক। ঘরে ঘরে জীবনের পথ প্রদর্শক হিসেবে এঁদের উত্থান ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘাটলে কেবল এঁদের ফ্যানাটিক অংশটুকুই দেখতে পান অনেকে। একদিকে যেমন বলা হচ্ছে “কোরানে মহামারীর কথা নাই”, তেমনি দেখা যাচ্ছে অনেকে ত্রাণ কর্মসূচী নিয়ে হাজির হচ্ছেন। কেন হচ্ছেন? অনেকে দাবী করেন কেবল ধর্ম ব্যবসা হিসেবে। আমি তা মনে করিনা। এটি একইসাথে রাজনৈতিক, মানবিক, অবশ্যই অর্থনৈতিক এবং আত্মপরিচয় কেন্দ্রীক ঘটনা। আর এই উচ্চাভীলাস টা বেশ বড়। ফলে এসব ট্রেন্ডের ভোঁতা বিশ্লেষণকারীরা আবার একটু ভাববেন দয়া করে।
২০০০ পরবর্তী দু দশকে গভীরতর নানান পরিবর্তন হয়েছে। সারা বিশ্বে “মুসলমান পরিচয়” ভীষণ সংকট এবং অপমানের সম্মৃক্ষীণ হয়েছে। আবার এটার স্থানীয় মোকাবিলার যে ম্যাকানিজম তাও ঠিকমত দাঁড়াতে পারেনি। একদিকে স্যাটেলাইট, একদিকে ইন্টারনেট, একদিকে শহরে মাইগ্রেশন, একদিকে গার্মেন্ট অর্থনীতি, একদিকে জনক-ঘোষক, একদিকে চেতনা, একদিকে মোবাইল, একদিকে মাদ্রাসা, একদিকে মোবাইল, এত ফেইসবুক এত এত মৌলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নব্য উদার নৈতিক অর্থনীতি তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে, পাল্টে দিয়েছে। এত পরিবর্তন ধারণের জন্য যে মন সে কোথায় যাবে? রবীন্দ্রনাথ? মোশাররফ করিম? আজহারি? মানুষ ধর্মে আশ্রয় খুঁজবে না?
রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা আছে, ডিমান্ড আছে, মোটিভেশনাল স্পীকারের নতুন ব্যবসাটা আছে, সুদূর রাজনৈতিক এবং বিশ্বাসগত অভিঘাত আছে। তাহলে এর ব্যাখ্যাকাররা শক্তিশালী হবেন না?
মজার বিষয় হল এই ব্যাখ্যাকাররাও মূলত নব্য উদার নৈতিক অর্থনীতির পন্থা ধরেই এগুচ্ছেন। ওয়াজ একটি বড় ব্যবসা যেমন, তেমনি সামাজিক প্রিচীং এর রাস্তা ও ক্ষমতাও বটে। অপনিয়ন লিডার। এই দেশে ভেন্টিলেটর পেতে হলেও তো অন্তত দুই লক্ষ লোকের লিডার হওয়া লাগে তাই না?
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল। আমার এক ভারতীয় বন্ধুর সাথে ঘন্টা তিনেকের আলাপে বারবারই উঠে আসছিল, তাঁর ভাষাতেই "আমি দেখেছি যে তারা ইমামের কথা শোনে, আমরা এতটা শুনিনা। কিন্তু ইমামরা কেন মহামারীর সময়ে নির্দেশনা দেন না?"
এর কোন একক উত্তর নেই। সেকুলারবাদী উত্তরও নেই। আমি জানিয়েছিলাম যে দেশের যে মাইনোরিটি তাকে তার নেতৃত্বের কৌশলে বেশি অনুগত দেখা যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবার জন্য এমনটা দেখতে পাবেনা তুমি। আবার এও বলেছিলাম, যে মেজোরিটিকেও এভাবেই দেখানো হয় যে মাইনোরিটি সবদিক দিয়েই খারাপ। এরা যুক্তি বোঝে না, নিজের ভালোটাও বোঝে না। এরা খারাপের খারাপ। আর ঠিক কয়েকদিন পরে দেখা গেল, ভারতীয় হসপিটালে সেবা পাচ্ছেন না মুলসমানরা। এটাকে প্রায় গণহত্যা বলে অরুন্ধতি অবিহিত করলেও, এর পাটাতন আগে থেকেই তৈরি হচ্ছিল। এই পাটাতন তৈরি দ্বি-পাক্ষিক। সরকারও চেয়েছে, নেতারাও চেয়েছে। বিপদে পড়েছে মানুষ।
আর্ন্তজাতিক মিডিয়া যে ব্রাম্মণবাড়িয়ার কেইস পিক করল, তাতে বাংলাদেশের মুসলমান মানেই উগ্র ইসলামিক জমায়েত" যা মানেনা কোন স্বাস্থ্য সচেতনতা, নাই অপরের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ, মুসলমান মাত্রই মানুষ নয় বরং পালে পালে পোকা, অতএব পরবর্তীতে এদের পরমাণু কীটনাশক দিয়ে নাশ করা ঠিকই আছে, হাসপাতালে চিকিৎসা না দেয়া ঠিকই আছে, এরা তো মানুষ না এই ন্যারেটিভ জোরালো করতেই ব্যবহৃত হইল। আর এদিকে স্থানীয় ছোট রাজনীতির মাসল দেখাইতে, সরকারের সাথে দর কষাকষী বাড়াইতে জানাযায় শো ডাউন করল খেলাফতে মজলিশ। বিশ্বাস তো ব্যবহৃত হইলই, ইসলামিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন্ও দেখানোর ট্রায়ালও হইল। করোনাতে মরবে মানুষ। করোনা পরবর্তী রাজনীতিতেও মরবে মানুষ। কোন মানুষ এরা?
দুই রাজনীতিতে ব্যবহৃত হল মুসলমান পরিচয়। এ যাত্রা করোনাতে মারা না গেলেও, মোটুমুটি নিশ্চিত যে করোনা পরবর্তী নতুন জাতিঘৃণায় চীনাদের চাইতেও মুসলমানের নাম সর্বাগ্রে রাখার এবং নিধনে এই রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ফলে সতর্ক হন এখন থেকে। “মুসলমান পরিচয়” এর জাতিঘৃণা রাজনীতির ফাঁদে পড়েন না।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:৪৭