বাঙ্গালীদের কাছে গুজব ও গজব দুটো যে একই জিনিস তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম । টাকা তোলার জন্য ব্যাংকের সামনে বিশাল সর্প সদৃশ লাইনে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই বিরক্ত হয়ে আশেপাশে মানুষের সাথে কথা বলা শুরু করেছি । কিছুক্ষণ পর অবাক হয়ে গেলাম । একাধিক লোকের ধারণা সামনে দুর্ভিক্ষ আসতেছে । কিছুদিন পর ব্যাংক নাও থাকতে পারে বা ব্যাংকের টাকা শেষ হয়ে যেতে পারে । তাই টাকা তুলে ফেলতে শুরু করেছে। এখন সবাই মিলে ব্যাংক থেকে টাকা তোলা শুরু করলে কি হতে পারে তা তাদের ফার্স্ট পার্সন এর সুরে বুঝানোর চেষ্টা করলাম -
এই আধুনিক অর্থনীতি পুরোটাই বিশ্বাসে উপর দাড়িয়ে । আমি বিশ্বাস করি বলে 'সে' আছে । আমি বিশ্বাস না করলে 'সে' নাই । বিষয়টা গল্পের ছলে ব্যাখ্যা করছি ।
.
ধরেন চট্টগ্রাম মহানগরীতে 'আদার ব্যাপারী'র একটি ব্যাংক আছে । এই মহানগরীতে এক ইঞ্জিনিয়ারের বসবাস । যিনি সদ্য গত হওয়া পিতার সম্পত্তি হতে উত্তরাধিকার সুত্রে ১ কোটি টাকা পেয়েছেন । যা তিনি 'আদার ব্যাপারী'র ব্যাংকে জমা রেখেছেন । এমন সময় নোয়াখালী হতে 'বদরুল' নামে এক লোক চট্টগ্রাম এলেন ফেসবুকীয় ভালোবাসার টানে । মেয়ে চৌধুরী সাহেবের একমাত্র কন্যা । কন্যাকে পেতে চৌধুরী সাহেব শর্ত দিলেন তাকে বছর খানিকের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এখন বেচারা 'বদরুল' ভালোবাসার টানে ব্যবসা করতে বসলেন । ঠিক করলেন দ্রুত সাফল্য পেতে জাহাজের ব্যবসায় নামবেন ।
.
সমস্যা হল তার টাকা নেই । বদরুল গেলো 'আদার ব্যাপারী'র ব্যাংকের কাছে জাহাজের খবর দিয়ে লোন নিতে । সে বহু কষ্টে ভুকচুক দিয়ে ব্যাংককে বুঝালো যে এই জাহাজ থেকে বহু টাকা লাভ আসবে । ব্যাংক বদরুলকে ১ কোটি টাকা লোন দিলো ।
.
বদরুল এই টাকাটা এক ইঞ্জিনিয়ারকে দিলেন জাহাজ বানানোর জন্য । কোন ইঞ্জিনিয়ার ? সেই ইঞ্জিনিয়ার যে 'আদার ব্যাপারী'র ব্যাংকে ১ কোটি টাকা জমা দিয়েছিল । এখন সে ইঞ্জিনিয়ার ১ কোটি টাকা তার একাউন্টে জমা দিলো পরবর্তীতে লোহা সহ আনুসাঙ্গিক জিনিস কেনার জন্য ।
.
খেয়াল করে দেখেন ইঞ্জিনিয়ারের জমা দেওয়া টাকাই আবার তার কাছে ফেরত এসেছে । ব্যাংক তার হিসাবে দেখাচ্ছে তার একাউন্টে জমা আছে ২ কোটি টাকা । কিন্তু মূল ক্যাশ টাকা কিন্তু ঐ ১ কোটি টাকাই রয়ে গেছে । খেলা এখানে শেষ না । ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার কাজের মাঝামাঝি এসে বদরুলকে আরো ১ কোটি টাকার বিল ধরিয়ে বললেন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরো কাজ শেষ হতে আরো ১ কোটি টাকা লাগবে । এখন কি আর করা বদরুলকে আবার দৌড়াতে হলো ব্যাংকের কাছে । ব্যাংক আবার আরো ১ কোটি টাকা লোন দিলো । যা বদরুল ইঞ্জিনিয়ারকে দিলেন । ইঞ্জিনিয়ার তা আবার সেই ব্যাংকে জমা রাখলেন ।
.
এখন কাগজের কলমে হিসেবে দেখা যাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ৩ কোটি টাকা জমা আছে । শুরু তার জমা দেওয়া ১ কোটি ও পরবর্তীতে বদরুলের জমা দেওয়া ২ কোটি । এই কাজ আমেরিকার ব্যাংকিং সিস্টেমে ১০ বার করা যায় তবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমে কতবার করা যায় তা আমার জানা নেই। মোট কথা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একাউন্টে ৩ কোটি , ৪ কোটি বা ১০ কোটি টাকা দেখানো জন্য ব্যাংকের ভোল্টে ১০ কোটি টাকা ক্যাশ থাকার দরকার নেই । ঐ ১ কোটি টাকা ক্যাশ থাকলেই হবে ।
.
সমস্যাটা কখন লাগবে জানেন ? ধরেন গুজব উঠলো মায়ানমারের সাথে যুদ্ধ লাগবে বা দুর্ভিক্ষের কারণে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে ইত্যাদি । তাই ব্যাংকে যার যত টাকা আছে দ্রুত তুলে নিতে হবে। ব্যাস । সবাই এই গুজবে বিশ্বাস করে টাকা তুলতে ব্যাংকে গেলো । কিন্তু ব্যাংক সবার টাকা ফেরত দিতে পারবে না । আরে ভাই থাকলে তো দিবো ।
.
অনেককে 'ইটস এ ওয়ান্ডারফুল লাইফ' নামে বিখ্যাত মুভিটা দেখেছেন । ওখানে দেখায় নায়কের ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে শুনে সবাই টাকা তুলতে চলে এসেছে । কিন্তু টাকা তো নেই । সে তার ক্লাইন্টকে বুঝাতে পারে না সে টাকা ছাপানোর মেশিন না । সে একটা সিস্টেম মাত্র ।
.
বিশ্ব অর্থনীতিতে এই সিস্টেমটা গড়ে উঠেছে বিশ্বাসের উপর । 'আদার ব্যাপারী'র ব্যাংক বিশ্বাস করেন , বদরুলের জাহাজ চালু হলে সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা আসবে এবং আস্তে আস্তে সুদে আসলে টাকা শোধ হবে । বদরুল তার চৌধুরী সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করবে । অথচ এই জাহাজ এখনো পানির স্পর্শও পায়নি। তার আগেই সবাই ঝুঁকি নিতে রাজি হয়েছে ।
.
এই ব্যাপারটাকে আমরা বলি 'CREDIT' যা ল্যাটিন শব্দ 'CREDO' থেকে এসেছে । যার অর্থ - I TRUST YOU । এই বিশ্বাসটা যতটা না একজন মানুষের উপর আরেকজনের । তার বেশি একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের উপর । দুই পক্ষই এই ভবিষ্যতের উপর বিশ্বাস করে বলেই এই গোটা সিস্টেমটা কাজ করতেছে । এই বিশ্বাসটুকু না থাকলে পুরো সিস্টেম ধ্বসে পড়বে । আমাদের আধুনিক সভ্যতা ফিরে যাবে সেই মধ্যযুগে।
.
প্রকৃতপক্ষে ব্যাংক আমাদের টাকা ধার দেয় না বা টাকা জমা নেয় না। আমরা লেনদেন করি স্বপ্নের । আর আমরা এই স্বপ্ন বেচাকেনা করেই আধুনিক সভ্যতা গড়ে তুলি । :-)
.
আর হ্যাঁ। লাইনে বহুক্ষণ দাড়ানোর পর বহু ফ্রি লেকচার শেষে জানা গেলো ব্যাংকের টাকা শেষ । তাই যারা টাকা জমা দিতে এসেছে তাদের এগিয়ে আসতে বললো । এ মাথা থেকে ও মাথা দেখলাম । কোথাও কেউ নেই । অতএব খালিহাতে ব্যাংক থেকে ফেরত আসতে হলো । আব্বু জানালো আমি কোন কাজের না । আব্বুকে আবার বুঝাতে বসলাম ।
.
শান্তনু চৌধুরী শান্তু
.
কৃতজ্ঞতায় - Brief History of Humankind
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০২০ রাত ১১:২৪