
কেউ পছন্দ করুক বা না করুক আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিরপেক্ষভাবে কড়া কথা বলতে পছন্দ করি। এমন না যে আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যক্তি পূজা করি । তারপরও দেশের এত ঘটনাবহুল সময়ে পাক প্রধানমন্ত্রীর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমন একটি মন্তব্য করলো যা দেশের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে রীতিমতো আমার গাত্রদাহন শুরু হয়েছে । আমার মনে আছে মালদ্বীপের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে আপত্তিকর কিছু মন্তব্য করায় ভারতের মানুষ ডান-বাম-ধর্মীয়-বিরোধী দল সমূহ নির্বিশেষে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তাদের কাছে মালদ্বীপের প্রধানমন্ত্রীর এইসব অপমানমূলক মন্তব্য ব্যক্তি নয় বরং তাদের রাষ্ট্রের পবিত্রতম একটি পোষ্টের (প্রধানমন্ত্রীর আসন) প্রতি করা হয়েছে। আমার কাছে এখানেও তাই। পাক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গা সম্পর্কে বলেছেন, ‘যিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি অবশেষে তার করুণ পরিণতি ভোগ করেছেন।’

পাকিস্তানের ইতিহাস সবসময় এক তরফা ভাবে লিখা হয়েছে। পাকিস্তান তাদের নিজ জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের ঐ কালো অধ্যায় সম্পর্কে কিছু জানায় না ও জানালেও অস্পষ্ট একটি ধারণা দেওয়া হয় । সম্প্রতি ইমরান খানের আহবানে পাকিস্তানের জনগণ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পৈশাচিক কর্মকাণ্ড নিয়ে হামিদুর রহমান রিপোর্ট পড়া শুরু করেছে। আমি শিওর পাক প্রধানমন্ত্রী এই রিপোর্ট পড়েননি । হলে তিনি এ কথা বলতে পারতেন না।
প্রথম কথা পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন তথা পাকিস্তান ভাঙার জন্য বঙ্গবন্ধুকে কেন দায়ী করা হবে? বঙ্গবন্ধু একটি নির্বাচনে জিতেছেন। নিয়ম অনুসারে বঙ্গবন্ধুকে যদি ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়া হতো তিনি হতেন উভয় পাকিস্তানের প্রাইম মিনিস্টার। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতন রাজনীতিক মেরু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান শিফট হয়ে যেত। কিন্তু রুটি খেকো পেশী শক্তিতে নির্ভর করা নাক উঁচু মোটা বুদ্ধির পাকিস্তানিরা ভাতখেকো বাঙ্গালীদের ক্ষমতা দিতে চায়নি। ফলস্বরূপ পেশি শক্তিতে বিশ্বাসী আর্মি জেনারেলরা পূর্ব পাকিস্তানের যা করেছে তা ইতিহাসের রক্তাক্ত হরফে লেখা আছে। এ অবস্থায় কি স্বাধীনতার বিকল্প ছিল? দ্বিতীয় কথা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার জন্য পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের যোগসূত্র কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের প্রবর্তক বঙ্গবন্ধুকে বানিয়ে, মুক্তিযুদ্ধকে ধর্ম বানিয়ে দেশের মানুষকে যে অত্যাচার নিপীড়ন করা হয়েছে তার ক্ষোভ স্বরূপ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গা হয়েছে। এর জন্য দায়ী বঙ্গবন্ধুও না মুক্তিযুদ্ধও না। এর জন্য দায়ী তাঁকে নিপিড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা ব্যক্তিবর্গ।
এখানে স্পষ্ট করে বুঝতে হবে বঙ্গবন্ধুর দুইটি রূপ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী রূপ ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পরবর্তী রূপ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তীতে তিনি যতটা স্বমহিমায় উজ্জ্বল, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ততটাই অনুজ্জ্বল। স্বাধীনতার পূর্বে তার এই দুর্দান্ত নেতৃত্বের প্রতি জনগণের এতটাই আস্থা ছিল যে তার অনুপস্থিতিতেই দেশের জনগণ একটি দেশ স্বাধীন করে ফেলে। দেশের মানুষ তাকে ভালবাসতো, তিনিও দেশের মানুষকে ভালবাসতেন। তাঁকে যারা হত্যা করেছে তারাও তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় কান্না করেছিল (সূত্র - আমি মেজর ডালিম বলছি) । সমস্যা হলো ক্ষমতা। এ্যাবসুলেট ক্ষমতা এমন এক ভয়াবহ জিনিস যা যে কোন মানুষকে করাপটেট করে ফেলে। যে মানুষ ডেমোক্রেসির জন্য সারা জীবন যুদ্ধ করেছেন আর সেই তিনিই কিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বাকশাল গঠন করে সারা বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করলেন ! নিজেই নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছেন! আর্মিকে টেক্কা দেয়ার জন্য বানালেন রক্ষী বাহিনী। এই রক্ষী বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনী সেসময়ের ইতিহাসের পরতে পরতে আছে। এরকম অরাজক মুহূর্তে একটি অভ্যুত্থান খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলো যদি ইতিহাসের বিচারে পাপ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে তিনি তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন ১৫ই আগস্টের ম্যাসাকারে ।

দল অন্ধ হয়ে স্বীকার করুন বা না করুন বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নেতা। তিনি বাংলাদেশের জাতির জনক। খন্দকার মোস্তাক, জিয়াউর রহমান, এরশাদ কিংবা খালেদা জিয়া অনেক কিছু করলেও এই জাতির জনকের পোস্ট থেকে কেউ কখনো তাঁকে সরানোর চেস্টাও করেনি । আপনারা ফেসবুক যোদ্ধারাও সেই কাজটা করবেন না। ভারতকে গালি দিয়ে লাথি মেরে পাকিস্তানের কোলে শুয়ে পড়া অপরিপক্ক মস্তিষ্কের কাজ। এমতাবস্থায় জাতির জনকের বিরুদ্ধে এক জাতিভিমানী পাকিস্তানির এই রূপ মন্তব্যকে ব্যক্তি কেন্দ্রিক আঘাত বলে মনে করছি না। এটা দেশের একটি চিরস্থায়ী পোষ্টের প্রতি আঘাত । বর্তমান সরকারের উচিত এই সম্পর্কে একটি স্পষ্ট বার্তা পাকিস্তানকে দেওয়া। এই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে দিল্লির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে । ইসলামাবাদের দন্তহীন ছাগলের অভিযোগ কান পেতে শোনার জন্য নয়।
শান্তনু চৌধুরী শান্তু. এডভোকেট


অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


