কয়েকদিন আগে জামাত শিবির প্রতিহত করতে আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মখা আলমগীর নিজকন্ঠে প্রকাশ্যে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা কর্মীকে রাজপথে নামতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। নির্দেশ পালনে অনীহা প্রকাশ করে যুব লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি তখন এর বিরোধীতা করে বলেছিলেন এটা যুবলীগের কাজ নয়। প্রতিহত করার দায়িত্ব পুলিশের। তারপরেও মন্ত্রীসাহেব ছাত্রলীগ সহ তাদেরকে পুলিশের পাশাপাশি কাজ করতে বলেছেন। এখন ছাত্রলীগ যুবলীগ আমাদের মাননীয় মন্ত্রীর হুকুম পালন করছে। মন্ত্রীর নির্দেশ ও বিরোধীদলের আজকের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের রাজপথে আবিষ্কারের মধ্যকার যোগসূত্রটা বিতর্কের খাতিরে কাকতালীয় ধরলেও তাদের হাতে নিরীহ পথচারী বিশ্বজিতের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পেছনে মন্ত্রীর ঐ নির্দেশের প্রভাবের ব্যাপারে কি বলবেন? অস্বীকার করবেন? পাশ কাটিয়ে যাবেন?
বাস্তবতা হলো সত্যকে ছাইচাপা দেওয়া অনেক কঠিন। প্রত্যেকে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখুন আপনা আপনিই এর উত্তর পেয়ে যাবেন। আর না পেলে সন্তানহারা বিশ্বজিতের মা বাবা ভাই বোনের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া প্রতিটি অশ্রুবিন্দুই সেই উত্তর দিয়ে দিবে। ধর্ম নিরপেক্ষতার আকর্ষনীয় মোড়কে বেষ্টিত বিবেকের ধ্বজাধারীদের হাতে নিহত সংখ্যালঘু বিশ্বজিতের আত্মা কখনোই আপনাকে ঐ জিজ্ঞাসার জবাব না দিয়ে ছাড়বেনা।
আমরা বিগত চার বছর ধরেই দেখছি সরকারের বিভিন্ন নেতা নেত্রী দিনে দিনে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটিকে কীভাবে দানবের চরিত্রে রূপায়নের ভূমিকা পালন করেছেন। আর এটা করেছেন কখনো বা নীরব থেকে তাদের সকল জঘন্য কর্মকান্ড না দেখার ভান করে আবার কখনো বা শান্তিপ্রিয় জনগনের দেশের স্বাধীনতার আবেগ অনুভূতিকে ব্ল্যাকমেইল করে জামায়াত শিবির নিধনের স্লোগানের নামে। আজ ছাত্র লীগের নাম উচ্চারন করলেই শান্তিপ্রিয় জনগনের মানসপটে ভেসে উঠে ধারালো অস্ত্র নিয়ে নিজেদের মধ্যে বর্বর যুগের গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো হত্যার মহোৎসবে লিপ্ত একদল হায়েনার প্রতিচ্ছবি বা প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র উচিয়ে এবং পুলিশ বেষ্টিত হয়ে প্রতিপক্ষের দিকে ধাবমান আইনের উর্দ্ধে অবস্থানকারী একদল সুপার হিউম্যান। একের পর এক অপরাধে লিপ্ত এসব ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের বিচার না করে এবং আইনের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে তাদের হাতে সংঘটিত এসব অপকর্মের রাজনৈতিক রূপ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের বার বার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা থেকে জনগনের মধ্যে এ ধারণার উদ্রেগ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজে যে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হয়ে অনেকটা অভিমান করে তাদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন সেই ছাত্রলীগকে মন্ত্রীসাহেব রাজপথে নামার নির্দেশ দিবেন জামায়াত শিবির নিধনে আর সেই কার্য সম্পাদনে প্রত্যাশিত লাশের মাঝে দু একটি বিশ্বজিতের লাশ দেখবেন না তা কি হয়! মানুষের টার্গেট কি কখনো এতটা নির্ভূল হয়! পৈশাচিক কায়দায় প্রকাশ্যে বিশ্বজিতকে হত্যার ঘটনা প্রত্যক্ষ আর মন্ত্রীসাহেবের নির্দেশের মাহাত্ম একসাথে উপলব্ধি করলে আতঙ্কে আৎকে উঠবেনা এমন মানুষ বর্তমানে একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে।
একশত ভাগ শুদ্ধতা নিয়ে কখনো কোন বৃহৎ কর্ম সম্পাদিত হয়না। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রেই এর পরিধি ও বিশালতা বৃদ্ধির সাথে সাথে অনিচ্ছাকৃত ভুলের পরিমান ও বাড়তে থাকে। এটা মানুষের অতি প্রাকৃতিক মানবীয় দূর্বলতা। বরঞ্চ এসব ছোট খাট ভুলের খতিয়ান মুল কাজে কারও সক্রিয় অংশগ্রহনের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করার প্রচেষ্টারই ইংগিত দেয়।
আর তাই সম্প্রতি মন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ যুবলীগ ঠিক এই কাজটিই করে যাচ্ছে। বিশ্বজিতকে পরাধমে পাঠিয়ে মূল কর্ম সম্পাদনে তাদের অনিচ্ছাকৃত ভুলের একটা বার্তা দিয়ে মন্ত্রীকে যেন রাজপথের কর্মতৎপরতায় তাদের নিষ্ঠা আর আনুগত্যের প্রমাণ দেখিয়ে দিলেন অক্ষরে অক্ষরে, হাতে কলমে। এক্ষেত্রে টার্গেট নির্ণয়ে ছাত্রলীগ যুবলীগের এরকম উল্টাপাল্টা করে ফেলার ঘটনা আমাদের মহামান্য নির্দেশ দাতারা প্রত্যাশা না করলেও আগামী নির্বাচন কেন্দ্রিক জটিলতায় বিরোধী দলের মোকাবেলায় পুলিশের সাথে সাথে ছাত্রলীগ যুবলীগের তৎপরতা ও সক্ষমতার এ ঝাঁঝ দেখে যার পর নাই তারা আবিভূত!
বিশ্বজৎ না হয়ে টার্গেট টা যদি জামায়াত শিবির হতো তাহলে না হয় মৌনতা অবলম্বন করে কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বার্থ বিবেচনাকে সার্বজনীন ঢাল হিসাবে ব্যাবহার করে ব্যাপারটাকে হালকা করা যেত। কিন্তু তাই বলে এত্ত বড় ভুল!!! হাজার হলেও একদিকে সংখ্যালঘু এবং নিজেদের ভোট ব্যাংক আবার আরেক দিকে নিরপরাধ পথচারী! ছাত্রলীগ যুবলীগ কে মাঠে নামিয়ে উৎফুল্ল জনগোষ্ঠির কিছু অংশ ঘটনাটিকে এভাবে মূল্যায়ন করলে আমরা অবাক হবোনা। সমাজের সকল স্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকে পাশ কাটিয়ে অপশাসন বিস্তৃতির এরূপ জঘন্য বিকৃত রুচির চিন্তা যে অনেকে করেন না তা এধরনের ঘটনার পূনরাবৃত্তিই বলে দেয়।
ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার অদুর্দমনীয় প্রবণতা থেকে সরকারীদল কর্তৃক বিরোধীদের কে দমন করতে এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার উদাহরণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আকাশে যে কালো মেঘের ঘনঘটা ডেকে এনেছে না জানি সেই কালো মেঘ আরো পুঞ্জিভূত হয়ে টর্নেডোর রূপ ধারণ করে শান্তিপ্রিয় জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়!
বর্তমানের রাজনৈতিক হানাহানি সে আশংকাকেই বৃদ্ধি করে চলেছে। এটা প্রশমনে আমাদের বুদ্ধিজীবি সমাজ ও দ্বিধা বিভক্ত। একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের কাল্পনিক উত্থানে ভীত সন্ত্রস্ত এসব বুদ্ধিজীবিরা কয়েকটি বিশ্বজিৎ এর লাশের বিনিময়ে তাদেরকে দমনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে দেওয়া আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর এই স্বঘোষিত লাইসেন্স কেড়ে নেওয়ার পক্ষপাতি নয়। ঘটনার আকস্মিকতায় তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে তো তাই মনে হয়। কারো অনৈতিক কর্মকান্ডকে তান্ডব আর কারও একই ধরণের নৃশংসতাকে বিক্ষোভ বলে চালিয়ে এসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবি মহল এই লাইসেন্সের বৈধতা দিয়ে থাকে। লিখে পত্রিকার পাতা ভরে ফেলে পৈশাচিক ঘটনাগুলোর কাদেরটা গ্রহনযোগ্য আর কাদেরটা অগ্রহনযোগ্য।
পরিশেষে দুঃখের সাথে বলতে হয় সমাজের নৈতিক অবক্ষয় যদি এত উপরের শ্রেনী থেকে হয়ে থাকে তাহলে এসব কর্মকাণ্ড কখনোই বন্ধ করা সম্ভব হবেনা এবং সেক্ষেত্রে আমাদের মতো আমজনতার জন্য হয়তো এরকম শত শত বিশ্বজিৎ হয়ে ইহধাম ত্যাগ করে স্বর্গে যাওয়ার প্রাক প্রস্তুতি নিয়ে থাকাটাই শ্রেয় হবে।