প্রথমেই সাবেক আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক ও বেলজিয়াম প্রবাসী জনৈক আইন বিশেষজ্ঞের মধ্যকার ফাঁস হওয়া কথোপকথন থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি টেনে এবং পরবর্তিতে হ্যাকিং জনিত সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে মিডিয়ার আলোচনা ও সমালোচনা নিয়ে কিছু বলতে চাই।
“রায়ের জন্য গবর্নমেন্ট গ্যাছে পাগল হইয়া, তারা একটা রায় চায়।”
“সাঈদীর জাজমেন্টের একটা রাফ স্কেচ তৈরী করা হয়ছে স্ট্রাকচারটা কি হতে পারে, হয়তোবা কাল আমি স্ট্রাকচারটা আপনাকে পাঠাবো। জাস্ট টু দেখার জন্য। এটাকে আমরা রিয়েলি, এই স্ট্রাকচারটা এমনভাবে করেছি আমরা, তাতে খুব বেশি কষ্ট হবেনা আপনার।”
“শোনেন, আমি একটা জিনিস মনে করি। যেডা আমার ব্যক্তিগত মতামত যে, সম্ভব হইলে গোলাম আযম ফার্স্ট, সাঈদী সেকেন্ড, কাদের মোল্লা থার্ড। আর যদি তা প্রবলেম হয়, তাইলে সাঈদী ফার্স্ট, গোলাম আযম সেকেন্ড, কাদের মোল্লা থার্ডই থাক। কেননা সাঈদীর কেসটা ডিফারেন্ট। এই সাঈদীর কেসটার লগে আইনের সম্পর্ক খুব বেশি না। এডা আমাদের দেশি দরবারের মতোই।”
তর্কের খাতিরে স্টিকি পোস্টে দেওয়া আইসিএসএফ এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ধরে নিলাম উপরোক্ত কথোপকথনে এমন কোনো কিছুই নেই যা এই বিচার প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা বা গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং এও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে তা সংশ্লিষ্ট বিচারকের ঋজুতা, নিরপেক্ষতা এবং মানসম্মত বিচারের প্রতি সংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতাকেই মূর্ত করেছে। কিন্তু বিচারপতি নিজামুলের পদত্যাগের কারণ হিসাবে আপনাদের অভিমত “এটিকে একটি বিতর্কিত পরিস্থিতিতে বিচার প্রক্রিয়াকে সব ধরণের প্রশ্নের উর্ধ্বে রাখার প্রয়াস হিসেবে দেখতে হবে” এর সাথে একমত হওয়া কি স্ব বিরোধীতার নামান্তর নয়? উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিচারপতি সাহেবের অবস্থান যদি অসৎ প্রবণ না হয়ে থাকে তবে কেন পরিস্থিতিকে বিতর্কিত অভিহিত করা হয়েছে আপনাদের ভাষ্যে? আর কেনই বা তাকে এর উর্দ্ধে উঠার জন্য পদত্যাগ করতে হয়েছে? তার মানে কি দাঁড়ালোনা তিনি একটি বিতর্কিত পরিস্থিতি তৈরী করে গেছেন এবং নিজেকে এর উর্দ্ধে রেখে সটকে পড়েছেন? কিন্তু সেই বিতর্কিত পরিস্থিতি কী তা নিয়ে জনগনের কৌতূহল থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আমরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই। এটা আমাদের প্রাণের দাবী। এক্ষেত্রে আমরা অভিযুক্তদের কে তো আর ক্রসফায়ারে বিনা বিচারে মারছি না। আবার রাস্তায় ফেলে গনধুলায় ও দিচ্ছিনা। আমরা এই বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেখিয়ে বিচারের মাধ্যমে এদের কর্মফলের ব্যাপারটির একটা ন্যায়সঙ্গত সূরাহা করতে চাচ্ছি। সেই সাথে বিশ্ববাসীর কাছে বিচারের আদ্যপান্ত স্বচ্ছতা ও জবাব্দিহিতা নিশ্চিত করতে ট্রাইবুনালের আগে আন্তর্জাতিক ট্যাগ ও লাগিয়ে দিয়েছি (যদিও আন্তর্জাতিক আইন ও আইনজীবিদের সাথে এর কোন সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করতে পারিনি)। তবে কেন একজন বিচারপতিকে বাইরের একজন আইন বিশেষজ্ঞকে এভাবে বলতে হবে সরকার রায়ের জন্য পাগল হইয়া গ্যাছে?
বিচারকের স্বাভাবিক কার্যক্রমের উপর সরকারের প্রভাব কত বেশী মাত্রায় হলে তার মুখ দিয়ে “পাগল” শব্দটা বেরিয়ে আসতে পারে। এখন যদি ট্রাইবুনালের উপর সরকারের এই ধরণের অযাচিত হস্তক্ষেপকে (যা নিঃসন্দেহে ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হকের মুখঃনিসৃত বানী থেকে প্রমানিত) আমরা আপনাদের বর্ণিত ঐ বিতর্কিত পরিস্থিতি হিসাবে ধরে নিই তবে বিচারপতির পদত্যাগই এর একমাত্র সমাধান নয়। বিচারকাজে সরকারের পক্ষ থেকে যে আর অযাচিত হস্তক্ষেপ হচ্ছেনা সেই বিষয়টিরও নিশ্চয়তা থাকতে হবে। নতুবা পুরো বিচার প্রক্রিয়াকে কেউ বিতর্কিত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বললে শুধু যুদ্ধাপরাধীর পক্ষ শক্তি অভিহিত করে তাদেরকে গালা গালি দিয়ে কোন লাভ হবেনা। আজকে আমার দেশ বা ইকোনোমিস্ট বলতেছে। কালকে যে বিবিসি, সিএনএন বা আলজাজিরা বলবেনা তার তো গ্যারান্টি নেই। আর এদের সাথে তাল মিলিয়ে ইউরোপ, আমেরিকার প্রভাবশালী দেশ গুলো বা মিডল ইস্টের মুসলিম দেশগুলো যদি বলতে শুরু করে তখন কি করবেন? সবাইকে কি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসাবে গন্য করবেন? না অপপ্রচারে কান না পেতে সবাইকে কানে তুলা গুজে চলাফেরার পরামর্শ দিবেন?
কোন বিচারককে একটা বিচারের রায়ের রাফ স্কেচ বাইরের অন্য কোন আইন বিশেষজ্ঞ তৈরী করে দেয়ার বৈধতা নিয়ে কারও মনে যদি খটকা লাগে তাহলে তাকে কি বলবেন? ভালোভাবে আইন জানার পরামর্শ দিবেন? কিন্তু সে যদি টেলিভিশনের টকশো বা অন্য কোন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারে যে বিষয়টার বৈধতা নিয়ে আইনে গন্ডমূর্খ এই হৃদয়ে যে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে সেই একই বিষয়ে রাষ্ট্রের অনেক তুখোড় আইনজীবির মনের অবস্থাও একই তখন? এগুলোই যদি আইসিএসএফ বর্ণিত নিজামুল হকের পদত্যাগের পেছনের ঐ বিতর্কিত পরিস্থিতিতি হিসাবে কেউ ধরে নেয় তবে তার পদত্যাগই কি সব সমস্যার সমাধান করবে? কিন্তু যেখানে একটা স্বাধীন বিচারকার্যের মধ্যে যিনি বিদেশ ভূঁইয়ে থেকে স্কাইপি বা ইমেইলের মাধ্যমে অনেকটা পরকীয়া স্টাইলে নোংরামীর বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেন সেখানে তাকে আইনের পান্ডত্যে এক্সক্লুসিভ ও অপরিহার্য গন্য করে বিষ প্রশমনে শুধু হুইসেল ব্লোয়ারকে ধরে শাস্তি দেওয়ায় কি যথোপযুক্ত? নাকি নিজামুল হক সাহেব এই বিষের দংশনে (নিজের পদমর্যাদা ও নির্লজ্জ কর্মকান্ড হেতু সৃষ্ট বিবেকের তাড়নায়) আত্মহত্যার (পদত্যাগের) মাধ্যমে ট্রাইবুনালের বিচারকের আসন থেকে নিজের অপমৃত্যুর ঘোষণা দিয়ে বিচার কাজে তার ও জিয়াউদ্দীনের অবৈধ সংস্রবের একটা প্রায়শ্চিত্য করে গেছেন।
এখন যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়ার দলের কেউ যদি বিচারের রায়ের আগ মুহূর্তে বিস্ফোরিত স্কাইপি বোমার ধোঁয়ায় বিচারের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে ঐ জিয়াউদ্দীনের নোংরা হস্তক্ষেপের ঝাঁঝালো গন্ধ পাই এবং সেটার তীব্র গন্ধে বিচারকের অপমৃত্যু হতে দেখে ও সেইসাথে এসব ঘটনা দ্বারা তাড়িত কিছু ব্যক্তিদের বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে লাফালাফি করার শব্দ শুনে থাকে তাকে কি বলবেন? এখন শুধু কানে নয়, নাকেও তুলা গুজে দেন। এই তো?
বিচারের রায়ের জন্য সরকার যদি পাগলই হয়ে থাকে এবং নিজামুলের ফাঁস হওয়া কথোপকথন যদি সত্যই হয়ে থাকে তবে পুরো বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হবেই। অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে কারও কন্ঠ চেপে ধরে বা আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এটা রোধ করা সম্ভব নয়। আবার ফাঁসের নায়ক হুইসেল ব্লোয়ারদের ধরে আটকে রেখেও যে সম্ভব নয় তা উইকিলিক্সের জনক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ভালোভাবেই বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তবে যেটি সম্ভব সেটি হলো এই ইস্যুটাকে স্রেফ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার না করে বিচার কার্যকে তার আপন গতিতে চলতে দেওয়া। কিন্তু বর্তমান সরকারের মন্ত্রী এমপিগণ যেভাবে প্রতিদিন রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চে দলীয় অনুগতদের উজ্জীবিত করতে কার কার কতদিনের মধ্যে ফাঁসী হতে যাচ্ছে তার ফিরিস্তি তুলে ধরছে তাতে করে তাদের মনোভাব ফুটিয়ে তুলতে নিজামুল হকের “পাগল হইয়া গ্যাছে” বাক্যাংশ ব্যাবহারের যথোপযুক্ততাকেই শুধু প্রতীয়মান করছে না বরং এই বিচারের ভবিষ্যত যে পদ্মা সেতুর নির্মাণের মতোই ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে সে আশঙ্কাও তুলে ধরছে বললে একেবারে অমূলক হবেনা।
পদ্মা সেতুর প্রসঙ্গটা আনার উদ্দেশ্য এটা নিয়ে কোন দূর্নীতি হয়নি মর্মে সরকারের মাসের পর মাস আওড়ানো অনেক সুন্দর সুন্দর চটকদার বুলি উপভোগ করলেও সেই দূর্নীতির কালো চশমা দিয়েই এখন একদিকে যেমন গ্রেফতারকৃত আমলাদের দেখা যাচ্ছে আরেকদিকে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কারো কারো মামলা থেকে অব্যাহতির অভিযোগের গুঞ্জনও শুনতে হচ্ছ এবং সেইসাথে ফলশ্রুতিতে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন এখনো একটা বিমূর্ত বিষয় হিসাবেই রয়ে গেছে এ জন্য। সরকারের রাজনৈতিক প্রভাবের এই অশুভ শক্তির ঝাপটা যদি শেয়ার বাজারের দূর্নীতিবাজ, রেলের কালো বিড়াল, ডেসটিনির অর্থ লুটপাটকারী, সাগর রুনীর প্রকৃত হত্যাকারী, বিশ্বজিৎ এর হত্যাকারী, রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় সদ্য মুক্ত ফাঁসীর আসামী, কিংবা হলমার্ক কেলেঙ্কারীর মূল হোতাদের লোম স্পর্শ করে এখন যদি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের দরজায় ধাক্কা দেই আর সেজন্য যদি বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তবে সেক্ষেত্রে শুধু অপপ্রচারে গা না ভাসানোর অনুরোধ কিংবা মানবাধিকারের বিবেচনায় ন্যায় বিচারের পক্ষে বলিষ্ঠদের যুদ্ধাপরাধীর সপক্ষ শক্তি বিবেচনা করেই কিন্তু বিচার কাজ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবেনা। আর এই চরম সত্যটা বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রভাবের আশীর্বাদ পুষ্টদের নিষ্কলঙ্ক তবিয়ত দেখে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের ন্যায় বিচার বঞ্চিতদের মুখচ্ছবি কল্পনা করলেই সহজে উপলব্ধি করা যায়।