এ ঘর থেকে গ্লাস ভাঙার শব্দ পেলাম । বুঝলাম, অনু আবারও রাগ করেছে । বিশ বছরের সংসার জীবনে আমি ওকে যতটুকু চিনি তা বোধহয় ও নিজেকেও চেনে না।
টেবিলে বসে স্কুলের পরীক্ষার খাতা দেখছি। আমি জানি অনু একটু পরেই আমার চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়াবে, বলবে, একটু সরিও তো বলতে পার !
আমিও বাধ্য ছেলের মত ওকে সরি বলি প্রতি বার। পুরুষদের জন্মই হয় সরি বলার জন্যে ।
অবশ্য আজকের অভিমানের একটু কারণ আছে বৈকি।
আজ আমাদের একমাত্র ছেলে অন্তুর জন্মদিন। আঠারোতে পা রাখল সে।
অনু সারাদিন খেটে খুটে ছেলের জন্যে কয়েক পদের রান্না করেছিল। কিন্তু ছেলে হঠাৎ সন্ধ্যায় এসে দুম করে বলে বসল, মা আজ রাতের ডিনারটা বাইরে করব।
অনু কিছুই বলল না। শুধু বলল, তোমার ক্লাসের নিতুর সাথে বুঝি ?
আমার ছেলে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সুইট মামনি . . .তুমি বুঝলে কি করে ?
অনু মুথ গোমড়া করে বলল, যাচ্ছ যাও । বেশি রাত কোর না । বুঝলে ?
আমি এ ঘরে ছিলাম । ছেলে এসে আমায় এসে জড়িয়ে ধরে বলল, বাবুন. . .আজ ওকে প্রপোজ করব।
ছেলের সাথে আমার সম্পর্কটা ওর বন্ধুর মত । এই নিয়ে ওর মায়ের অভিযোগের অন্ত নেই।
বলি অন্তুর বাবা একটি শক্ত হও। ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । সে খেয়াল আছে ?
আমি শুধু মাথা নাড়াই।
আমি অন্তুর দিকে তাকাই ।
ওয়াও গ্রেট। এই না হলে আমার ছেলে ! তা শোন কিভাবে প্রপোজ করবি কিছু ভেবেছিস ?
বাবা, ওর চকলেট খুব প্রিয়, সাথে কিছু পার্পল কালারের অর্কিড , কেমন হবে বলতো।
আমি হাসলাম, ভালোই হবে। ওকে যা তোর দেরী হয়ে যাচ্ছে। তোর মাকে আমি সামলাবো।
অন্তু হাঁটু গেড়ে আমার কোলে হাত রেখে বলল, ইউ আর গ্রেট বাবুন । মাযে কেন এমন !
তোর মা ও তোকে ভালোবাসে হাদারাম। বেশি ভালোবাসে তো তাই তার মাঝে হারানোর ভয়টা বেশি।
অন্তু চলে যাওয়ার পর থেকেই বাসন কোসন পরার শব্দ হতে লাগল রান্নাঘরে।
আমি অপেক্ষা করছিলাম অনুর কথা শোনার জন্যে। একটু পরেই শুরু হল অনুর অমৃত বাক্য।
যেমন বাপ তেমন ছেলে। মাগো মা ! বাপের সাথে নিজের ভালোবাসার কথা কেউ বলে জন্মেও দেখিনি। কালে কালে আরও কত কি দেখব।
আমার বাবা হলে অমন ছেলেকে ঝেটিয়ে বাড়ি থেকে বের করত।
আমি এ ঘর থেকে হো হো করে হেসে উঠলাম।
অনু আর রান্নাঘরেও থাকতে পারল না। জেদের চোটে দৌঁড়ে আসল।
বলি হাসছ কেন?
একেতো বাপ ছেলে মিলে গুটুর গুটুর ফুসুর ফাসুর আর এখন হাসাহাসি !
আমি চেয়ার থেকে উঠে অনুর কাঁধে হাত রাখলাম, বললাম , অনু , খুব মন খারাপ তোমার আজ ।
অনু আর পারল না। হু হু করে আমার বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠল।
আমি অনুর মাথায় হাত রেখে বললাম, তোমার পাগলামি কবে থামবে বলতো ?
আমি জানি তুমি ওকে অনেক ভালোবাসো।ওর জন্মদিন তাই আজ অনেক কিছু রান্নাও করেছ । কিন্তু তোমারতো এও মনে রাখতে হবে, অন্তু বড় হচ্ছে । ওর মতামতকে সম্মান দেওয়াটা কিন্তু আমাদেরও কর্তব্য। তাই না?
অনু চোখ মুছে, আমার দিকে তাকায়। বাধ্য মেয়ের মত বলে, আমি কেন তোমার মত বুঝি না ? কেন তোমার মত পৃথিবীটাকে দেখতে পারি না ? বলতে পারবে ? বিশ বছর সংসার করেও তোমায় চিনতে পারলাম না।
আমি অনুর চোখে চোখ রেখে বললাম, তুমি তোমার মত বলেই আমি তোমাকে
ভালোবাসি । অনু আবার কান্না শুরু করল। আমি জানি এটা ভালোবাসার কান্না ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




