somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্লগ, ব্লগার ও সমকালীন রাজনীতি।

০২ রা মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :






সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন ঘটনা প্রবাহের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে ফেইসবুক। এই ফেইসবুকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অপশন হচ্ছে ব্যবহার কারীর রাজনৈতিক পরিচয়। বাংলাদেশের তরুন প্রজন্ম যাদের উপর স্বাভাবিক ভাবে অর্পিত হবে আগামী দিনের বাংলাদেশের সকল দায়িত্ব , তাদের ফেইসবুক একাউন্টের পলিটিক্যাল ভিউ অংশে গেলেই আৎকে উঠতে হয়। অধিকাংশ ইউজার লিখে রাখেন ' আই হেট পলিটক্স অথবা ডো নট লাইক !

কিন্তু কেন? রাজনীতি কি কোন নিষিদ্ধ দর্শন বা অপতৎপরতা? প্লেটো, এরিষ্টটল, ম্যাকিয়াভ্যালির নিরলস পরিশ্রম ও জ্ঞানের সাধনা যে রাজনীতির সাথে মিশে আছে স্বগৌরবে, যে রাজনীতির উৎকর্ষতা জন্ম দিয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রনীতি, যে রাজনীতি সারা বিশ্বে জন্ম দিয়েছে সুশৃংখল ও সভ্য জাতিরাষ্ট্র, সে রাজনীতি বংঙ্গ মুল্লুকে এসে কেন শ্রীহিন হয়ে মানুষের ঘৃণা পেল?

আজকে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, তার জন্মইতো আগা গোড়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। তাহলে সে দেশের তরুন প্রজন্ম কেন রাজনীতি কে ঘৃণা করে কিংবা নিজের একটা রাজনৈতিক আদর্শের পরিচয় দিতে লজ্জা ও সংকোচ বোধ করে। কেন আজকের দিনের অভিভাবকেরা নিজের সন্তান কে রাজনীতির বলয় থেকে দুরে রাখতে পারাটাকে বিজয় হিসেবে দেখে?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বিস্তর আলোচনায় না গিয়ে গত চার দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাস্তব ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালেই যথেষ্ট। এখানে রাজনীতির নামে চলেছে সিংহাসন কেন্দ্রিক মল্লযুদ্ধ। এই মল্লযুদ্ধে বিভক্ত হয়েছে জাতি। ভুলুন্ঠিত হয়েছে জাতীয় স্বার্থ, ও নাগরিক নিরাপত্তা। রাজনীতির নামে দলীয় লেজুর বৃত্তির সন্ত্রাসে বার বার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে একের পর এক শিক্ষাঙ্গন। রাজনীতির খোলসে অধিপত্যবাদ বা শোষনুন্মুখ চেতনা মাথা ছড়া দিয়ে উঠেছে। মোটকথা পলিটিক্স অব হেজমনির খ্প্পরে পড়ে এখানে রাজনীতি তার জনকল্যানমুখী রূপ পরিগ্রহ করে এক ভয়াল রূপে আবির্ভুত হয়েছে। এই কারণে সমকালীন রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশের কূলীন সমাজ ও সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ ও সামাজিক বিবমিষা জন্ম নিয়েছে। আমাদের তরুন প্রজন্মের মনে যে রাজনীতি বিমূখতা এটা তারই প্রতিফলন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারুণ্যের রাজনীতি বিমূখতা জাতি বা রাষ্ট্রের জন্য কতটা কল্যানকর? মোটেই কল্যানকর নয় । বরং অশনি সংকেত। কেননা রাজনীতি না থাকলে সমাজে স্বৈরাচার কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্টির অনুপ্রবেশ ঘটে। সমাজ হয় অস্থীর ও ভারসাম্যহীন। নাগরিকদের রাজনীতি বিমূখতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্বৃত্তায়ন কে প্রশ্রয় দেয়। মীর মোশারফ হোসেনের বিখ্যাত গ্রন্থ বিষাদ সিন্ধু বলা হয়েছে " যে রাজা রাজনীতির অধীন নয় সে রাজা স্বেচ্ছাচারী" - রাজাকে রাজনীতির অধীন করতে হলে দেশের নাগরিকদেরকে আগে রাজনীতি চর্চা করতে হবে। তিনিই হয়ে উঠেন সফল রাষ্ট্র নায়ক যার আছে নেতৃত্বের গুনাবলী। আর রাজনীতি হচ্ছে নেতৃত্বের গুনাবলী অর্জনের পাঠশালা। কাজেই আমাদের তরুন সমাজ কে রাজনীতি বিমূখতা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তার আগে রাজনীতি কে ফিরিয়ে আনতে হবে তার সঠিক ট্র্যকে। কোন না কোন জায়গা থেকে শুরু করতে হবে ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা।

আশার কথা এই যে বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ব্লগার নামে যে কমিউনিটির সৃষ্টি হয়েছে, তাদের হাত ধরে শুরু হয়েছে ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা। ব্লগারদের অনেকেই এখন দল ও মতের লেজুড় বৃত্তির উর্ধে উঠে রাষ্ট্রিয় স্বার্থে কথা বলছে। নানা সামাজিক অনিয়ম ও অব্যাবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরছে তাদের লিখালিখির মাধ্যমে। দেশ ও জাতির ইতিহাস, কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে সবাই কে সচেতন করে তোলার স্বেচ্ছ্বা দায়িত্ব নিয়েছেন অনেক ব্লগার। David D. Perlmutter-এর ব্লগ-বিষয়ক বই Blogwars এর উৎসর্গপত্রে লিখা হয়েছে, "To bloggers, who boldly go where many of us could only dream of going before." সত্যই তাই। সত্য ও নিগুঢ় সমাজ বাস্তবতাকে তুলে ধরার এক দুঃসাহসী অভিযানের অভিযাত্রী হচ্ছেন বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের ব্লগারেরা।

ব্লগ মুলত সমাজ সচেতন শিক্ষিত মানুষের চিন্তাভবনা তুলে ধরার এক ব্যাতিক্রমি উপস্থাপনা। রাষ্ট, সরকার, শাষন ব্যবস্থা ও সামাজিক অভিযোজন নিয়ে সাধারণ মানুষ সবসময় ভাবে। বাংলাদেশে নিকট অতীতে মানুষের সেসব ভাবনার গুলো বৃহত্তর পরিমন্ডলে তুলে ধরার কোন মাধ্যম ছিলনা । অধিকিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত মিডিয়া নুয়াম চমস্কির বিখ্যাত প্রপাগান্ডা মডেলের বাইরে নয়। এই অবকাঠামোগত ও মালিকানাগত দ্বন্ধে মিডিয়াগুলো সাধারণ জনগনের মতামত কে সেই অর্থে স্পেস দিতে সক্ষম হয়নি। ফলে সাধারন মানুষের মতামত বা ভাবনার কোন অর্থবহ রেজাল্ট ছিলনা। বর্তমানে ব্লগ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অংশগ্রহনের জন্য উন্মুখ চিন্তাশীল মানুষের সামনে মতামত প্রকাশের উদার দিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছে। ব্লগ বা ব্লস্ফিয়ারের উৎকর্ষতার মাধ্যমে ব্লগারেরা তাদের নিজস্ব ভাবনা গুলো ছড়িয়ে দিতে পারছে সারা বিশ্বময়। একেকজেনর ভাবনা হাজার হাজার লোক পড়ছে, শেয়ার করছে, অনেকে মতামত -পাল্টা মতামত দিচ্ছে। এভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রত্যেকের ভাবনা ও আইডিয়া। শক্তিশালী হয়ে উঠছে জনমত। চর্চিত হচ্ছে গনতান্ত্রিক চেতনা।
বৃহত্তর জনগনের অংশগ্রহন ছাড়া গনতন্ত্র অর্থহীন। ব্লগের কল্যানে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগনের পরোক্ষ কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় অংশগ্রহনের পথ কিছুটা সুগম হয়ে উঠেছে। এতে করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকেরা যেমন জবাবদিহিতার সন্মুখীন হচ্ছেন তেমনি সাধারণ শ্রেনী পেশার মানুষও তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতেন হয়ে উঠছে। ব্লগের মাধ্যমে ইন্টারনেটের এ্যানোনিমাস সুবিধা গ্রহন করে অনেক জটিল ও কনফিডেন্সিয়াল রাজনৈতিক ইস্যু নিয়েও কথা বলছে। ব্লগারেরা সাদা কে সাদা এবং কালো কে কালো বলার সাহসীকতা দেখাচ্ছে। মুক্তচিন্তার অভিঘাতে রাজনীতি ফিরে পাচ্ছে তার প্রাণ। সাম্প্রতিক কালে যুদ্ধাপরাধের বিচার, বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীর নির্মম হত্যাকান্ড, শিক্ষক পরিমলের অসভ্যতা, রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলা, কিশোর রাজন হত্যাকান্ড, শিশু জিহাদের মর্মান্তিক মৃত্যু সহ নানা ইস্যুতে ব্লগারদের সোচ্চার অবস্থান ছিল, যার অনেগুলো ইতিবাচক পরিণতি পেয়েছে। মোটকথা , ব্লগ ও ব্লগারদের হাত ধরে একটা ইতিবাচক রাজনীতির স্রোতধারায় ফিরে আসছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।



তবে যতটুকু অর্জন সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুব নগন্য। বাংলাদেশের ক্ষমতার বলয়ে আবর্তিত পুরা রাজনৈতিক ও সামাজিক সিষ্টেম কে খোলনলচে পাল্টে একটা নতুন দিনের সূচনা করতে হলে ব্লগ ও ব্লগারদের কে আরো দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে। টোটাল জনগোষ্টিকে রাজনীতি সচেতন এবং আপন রাষ্ট্র ও জাতিস্বত্তা সম্পর্কে সচেতন অধুনিক মননশীল নাগরিক করে তোলাই হবে ব্লগারদের চুড়ান্ত লক্ষ্য। ব্লগারদের নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ অবশ্যই থাকবে। কিন্তু গনতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা এবং বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়ীক বাংলাদেশ গঠনের প্রশ্নে ব্লগারদের কে একি প্লাটফর্মে অবস্থান নিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের পূর্ব পুরুষদের যে আত্ম বিসর্জন তার পেছনে গনতন্ত্র , বাক স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়ীকতা ছিল অন্যতম দাবি। বাংলাদেশে ইন্টারনেট এখনও সকল মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেনি। যতটুকু ইন্টেরনেট মানুষ পেয়েছে তাতে ব্লগারদের যে অর্জন তাতে চোখ বুঝে আশা করা যায় যে ইন্টারনেটর সুলভতা বাড়ার সাথে বাড়বে ব্লগারদের অর্জন। নিজেদের কাজের গুনে সকল অপবাদ কে ছাপিয়ে ব্লগারেরা হয়ে উঠবে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি ও মুক্তির দূত। কল্যানমুখী ব্লগারদের হাত ধরেই একদিন ইতিবাচক রূপে বদলে যাবে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি। শেষ করবো David D. Perlmutter-এর উক্তি দিয়ে "But I claim that one fact is certain: Blogs have changed and will change our politics and our world."

দৈনিক ইত্তেফাক
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:১২
৯৩টি মন্তব্য ৭৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×