প্রথম যখন রিজভীর সাথে আমার পরিচয় হলো ---- মহল্লার মদ্ধে আমি ছিলাম সবচেয়ে বখে যাওয়া ছেলে। লোকজন আড়ালে আমাকে নষ্ট ছেলে বলেই ডাকতো। রিজভী একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো আমাদের পাড়ায়। রিজভী ছিল আমার দেখা একজন ভিন্ন প্রকৃতি মানুষ, সে আমাকে ভয়ও করতনা, ঘৃণাও করতনা--আমার বখাটে জীবনে এ এক দুর্লভ চরিত্র। রিজভী চরিত্রগতভাবে সাহিত্যিকদের মতোই ম্রৃদুভাষী কিন্তু কারও সাথে জমে উঠলে ওর সাথে পাল্লা দেয়া অতিশয় কঠিন কাজ। আমাদের আড্ডার বিষয়বস্তুও ছিল বইচিত্রময়; ওর সাথে আমার সময় কাটতো এক অন্য-অদেখা পৃথিবীতে যার সাথে বাস্তবতার মিল কদাচিত। সে যাহোক,......রিজভীর সমস্যা ছিলো একটাই.........অস্বাভাবিক “শর্ট মেমারি”। ও কিছুতেই দিন তারিখ মনে রাখতে পারত না; যেমন ধরুন যে সে আমাকে পুরান ঢাকার কাবাব খাওয়াবে বলে কথা দিয়ে শুক্রবারের পরিবর্তে বিষ্যুদবারেই রেস্টূরেন্টে যেয়ে বসে ছিলো ঘন্টা চারেক আর তারপর এসে আমার পিন্ডি উদ্ধার করল......।
ঘটনার শুরু অনেক পরে............তাই চলুন টপকে যাই কয়েক বছর। রিজভী স্ক্ললারশিপ নিয়ে আমেরিকা চলে গেলো উচ্চতর পড়াশোনার খাতিরে। অনেকদিন দেখা হয়নি কারন যা হয় আর কি.........সে আর দেশে ফেরেনি। দেখা হবার নতুন সম্ভাবনা হলো বছর পাঁচেক পরে যখন আমার কপালে লেগে গেলো “অপি অয়ান”.........আম্রিকা বসবাসের সুবর্ন সুযোগ............তাছাড়া দেশেও কিছু কেস ঝুলছিল............তো ভাবলাম, এই বেলা পালা। নিউইয়র্কের অড জব করতে করতে দু-বছর কেটে গেলো চোখের পলকে, না কেটে উপায়ই বা কি? ফুরসত কোথায় সময়ের হিসেব রাখার। একদিন সন্ধায় এক্সপেন্সিভ একটা মল ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম.........মনে মনে তৃপ্ত হচ্ছিলাম নামী-দামী ব্র্যান্ডের জিন্সের প্যান্ট গুলো কাছ থেকে ছুয়ে দেখতে পেরে.........কেনার মতো ক্ষমতা তখনও অনেক দূরে। “May I help u sir?”.............বাংলা একসেন্ট শুনে তাকিয়ে দেখি রিজভী.........আমার শ্বাস রোধ হবার যোগার..................সেই রিজভী, আমার পুরোনো বন্ধু। রিজভী এখানে ম্যানেজারের চাকরী করে ভালই কামাচ্ছে। এক কথা দু কথায় আবারও শুরু হলো পুরোনো বন্ধুত্বের চর্চা। প্রায় উইকেন্ডেই আমাদের দেখা হতে লাগলো............আমাদের দ্বিতীয় টার্মের বন্ধুত্বটা যেন আরও বেশী পরিপক্ক।
একদিন সন্ধায় রিজভী আমাকে তার বাসায় ডাকলো তার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে বলে। ও বিয়ে করেছে, বন্ধু পত্নীর সাথে পরিচয় হওয়াটাওতো কর্তব্য, ভাবলাম ভালোই হলো একবার ঘুরে আসা যাক। কাজের পরে একসাথে চলে গেলাম জার্সি সিটি, নিউজার্সি, রিজভীর এপার্টমেন্টে। রিজভী আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি একটু জড়সড় হয়ে গেলাম রিজভীর এপার্টমেন্টের ইন্টেরিওরের প্রাবল্যে......সে এক এলাহী কারবার। বিশাল সাইজের ফ্লাটস্ক্রীন টিভি, নরম পেলব মখমল সোফা, কার্পেটে পা ডূবে যায় ইঞ্চি খানেক। রিজভীর স্ত্রী তামান্না বসে ছিল ডায়নিং টেবিলে; আমি তামান্নাকে দেখে ক্ষীন কন্ঠে সালাম দিলাম হাত তুলে। তামান্নার চোখ কেমন সরু হয়ে গেলো.........তাহলে কি সে জানতোনা যে আমার আসার কথা? রিজভীকি তাকে কিছু না বলেই আমাকে নিয়ে এসেছে? সালামের উত্তরে তামান্নার হালকা মাথার ঝাকুনি আমাকে নিমেষেই এপার্টমেন্টের জানালা ভেদ করে অই দূরের হাইঅয়ের উপর ছুড়ে ফেলে দিল। কিন্তু সমস্যা হলো ফিজিকালি আমাকে তার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। রিজভীর এতটা খামখেয়ালীপনা আমার মোটেই পছন্দ হলোনা............অথচ দেখুন, সে এমন একটা ভাব করছিল যেন ওর বাড়িতে আমার নিত্য-নৈমিত্তিক যাতায়াত। খেতে বসে টুক-টাক কথা হতে থাকলো এবং হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম রিজভী স্ত্রী রিজভী চেয়ে কয়েক কাঠি উপরে ভেসে বেড়ায়। যা হোক, কিছুক্ষনের মদ্ধেই তামান্না আমাকে সহজ করে নিলো এবং চলে আসবার সময় আবারো বেড়াতে যেতে নিমন্ত্রন করল.........!!! এরপর তামান্নার সাথে আমার আরও কয়েকবার দেখা হয়েছিল রিজভীর বাসায় যাবার সুবাদে এবং এক ধরনের চালিয়ে যাবার মতো সম্পর্কও গড়ে উঠে।
এর কিছুদিন পরে, রিজভী এসে উপস্থিত আমার কাজের জায়গায়। ওকে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছিল.........তাড়াহুড়ো করে ব্রেক নিয়ে ওকে সাথে করে রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসলাম। কিছুক্ষন দুজনেই চুপচাপ। মিনিট পাঁচেক পরে রিজভী আমাকে জিজ্ঞেস করল,
“বলতো আমাদের বিয়ে হয়েছে কতদিন?”
“বছর খানেক হবে হয়তো” আমি বললাম
“বছর খানেক নয়, গতকাল ঠিক পুরো এক বছর হয়েছে।“
“বেশতো।“
“তামান্নাকে নিয়ে মুভিতে যাব বলে দু-সপ্তাহ আগে টিকেট কেটে রেখেছিলাম অথচ কাল আমি একদম ভুলে গেছি--এমনকি...... ওকে ম্যারেজ ডে তে উইশ করার কথাও মনে হয়নি।“
“ভাবী কি তোমাকে কিছু বলেছে?”
রিজভী কেবল মাথা নেড়েছিল। আমি আর কিছু জিজ্ঞাস করিনি। তামান্না অতি রুপসী নারী, বলতে পারেন ডানাকাটা পরী। কিন্তু, ডানাকাটা পরী যদি কদাচিত তার ডানা খুলে বেড়িয়ে আসে সে নিশ্চয়ই কিছু শুভকর হবে বলে ঠাওর হয়না।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০০৮ ভোর ৫:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




