ফিতের রং-টি বোধহয় লাল কিংবা গুঢ় লাল হয়ে থাকবে। গোধুলীর মিশেল অন্ধকারে সঠিক রঙ্গত্ব নির্নয় মানস বুদ্ধিতে নিতান্তই কষ্টসাধ্য। রইসুলের বয়সটা যদি একষট্টি না হয়ে একত্রিশ হতো তাতেও কোনো হেরফের হতো বলে মনে হয় না। কিন্তু প্রকৃতির এমন প্রাচুর্যপুর্ণ বসুধাবক্ষে দাঁড়িয়েও সামান্য একটা মানবসৃষ্ট ফিতে কেন তার দৃষ্টি কাড়লো? ফিতেটা কি বড়বেশী বিসদৃশ এখানে? সভ্যতাকে কিছুটা পাশ কাটিয়ে এই স্থানটিতে কেবলি অসভ্যজাতি যথা পাহাড়ীদের বসবাস, যেখানে ভুমি ফুঁড়ে উঠেছে ঢাউশ মাটির চাঁই আর প্রস্তর খন্ড এমনকি কিছু বড় পাহাড়ও। সেই প্রস্তরসমুহের একপার্শ্বে বসা রইসুল, যার জাগতিক ক্লান্তিতে বিশ্বাস ছিলনা কিন্ত অতিজাগতিক কোনো ক্লান্তির স্রোতে আজ এক আকাশ নীরবতার সন্ধানি। রইসুলের হঠাত চোখ পড়ে একটা ফিতের উপর; অভিজ্ঞতা ও যুক্তিবাদীতার অভাবে সর্প বলেও ভ্রম হতে পারতো কিন্ত এই রইসুলের তার কোন অভাব নেই। রইসুল গোটা বিশেক দেশ ঘুরেছেন পড়াশোনা, সেমিনার ও ভ্রমনের তাগিদে, আধুনিক বিশ্ব তাকে খুব বেশী মোহিত করেনি কিন্তু গনিতের আদ্যোপান্ত যথা হায়ার ক্যালকুলাস, জিওমেট্রি অথবা কালাবধি অসমাধানকৃত গনিতকেন্দ্রিক সমস্যা তার মনকে টেনেছে আর যে কিছুর চেয়েই বেশী। এমনকি নারীর চেয়েও? যে নারীছায়া রহস্য কালো শিরিশের কাঠের মতো? যে শিরিশে স্পর্শের চেয়ে দুরত্বটাই আকিঁবুকি করে দেয় এক চির গানিতিক সমস্যা? হয়তো হ্যা, কিন্ত এই ফিতেটির নারী সংশ্লিষ্টতাইকি রইসুলের মনে তার রেখাপাতের কারন? হতে পারে, বয়স হলোতো-দেখা হলো-পাওয়া হলো সেই নারী যাকে সে পনেরো বছর বয়স থেকে কামনা করেছিল একদিন যার বুকের ভেতরে ঘামবর্ণজলে মিশেল করে দেবে চাঁদের বিষ, যে বিষের বেদনা আরও একজন বহন করবে তারই মতো আজীবন।
তেলে আর জলে মেশেনা যেমন মেশেনা চাঁদচুর্নকনা সকল ঘামজলে; প্রথম চেষ্টাতেই শিউলী আঁতকে উঠেছিল। চটুল ভংগীতে বলেছিল, তোমার সবকথা আমি বুঝিনা বাবা, আমি চাই একটা ভালোবাসার ঘর, যে ঘরে তুমি আমি আর আমাদের ভালোবাসার সন্তানের বসবাস। তুমি কাজ শেষে সন্ধায় বাড়ী ফিরবে তারপর দুজনে বসব বাড়ীর লনে, চা খাবো গল্প করব। তারপর রাত্রিতে টগরকে নিয়ে বসবে পড়াশোনা করাতে আর আমি যাবো রান্নায়।
টগর?
আমাদের প্রথম ছেলের নাম হবে টগর।
তাই হবে।
রইসুল জাগতিক নিয়ম অস্বীকার করে দীর্ঘদিনের রোদে জলে যাওয়া, বৃর্ষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া এবং ধুলোর স্তরে ধুলিসার ফিতেটি হাতে তুলে নেয় এবং হাত বুলোতে থাকে ফিতেটির গায়ে। নাইলনের ফিতেগুলো সহজে পচেনা বড় জোর সময়ের সাথে সাথে আঁশগুলো এলিয়ে দেয় নারকেলের ছোবড়ার মতো। আচ্ছা, যদি কোন উঠতি যুবতির কেশপাশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এ ধুসর ফিতেটি তো তার চুলের গন্ধ কেমন ছিলো? আকাশ কাঁদানো মেঘের মতো নাকি কালো জলের চিকন তরংগের মতো যেমন শিমলাপাড়ার ঘর লাগোয়া পুকুরে প্রায়স ঘটে থাকে ভর দুপুরে? কোন পাহাড়ী মেয়ে যে তার ঘনকালো চোখের যাদুতে উত্তাল যুবকটির প্রাণ হরন করতে দ্বিধা করেনি কিংবা রইসুলের নিজের কন্যার মতোই খুব চঞ্চলা কেউ? ফারিহা বড় হচ্ছে, কিশোরী থেকে নারী, তুলনামুলক বিচারে বিবাহযোগ্যা কন্যা। আর দুবছর, মাস্টার্স শেষ হলে চলে যাবে স্বামীর ঘরে তার বড় বোনটির মতো। ফারিহা বাবাকে ভালোবাসে সংসারের আর যে কেউয়ের চেয়েই বেশী আর বাবার সর্বোচ্চ ভালোবাসাটিও আদায় করতে ছাড়ে না। হায়! এভাবেই একটা জীবন কেটে যায় আদান প্রদানে আর গোধুলীলগ্নে অসীমশুন্যতা এসে গ্রাস করে চলে। এখন, পাহাড়ের চুড়োগুলোতেই কেবল একটুখানি গোধুলী অবশিষ্ট আর ম্লান অন্ধকার ক্রমশঃ ঘন হতে শুরু করেছে। হাতের ফিতেটির কালো রংটিই কেবল উপলব্ধি করা যেতে পারে এই আলোতে, মৃত কালো ফিতে। আচ্ছা শিউলী কি কখনও ফিতে বেঁধেছে তার চুলে? বিয়ের পর থেকেইতো তার চুল ছোট হয়ে গেলো আধুনিকাদের মতো, বাঁধার মতো যথেষ্ট চুলতো তার থাকার কথা নয়। কেমোথেরাপী তার চুল গুলোকে নষ্টও করে দিল একদম-সেই রুপ কথার শনচুলো ডাইনীর মতো। অথচ শিউলী ঝড়ে গেলোনা, অফুরন্ত প্রান শক্তিতে বেঁচে রইল এবং বাঁচবেও বহুদিন হয়তোবা। ধীরে ধীরে চাঁদ উঠে, অন্ধকার খোলাসা হতে থাকে, পাথরের ভিতর থেকে গোপন অন্ধকার চিরে জোত্স্নালোক প্রতিফলিত হয় চকচকে বালুকনায়। রইসুল তার পৌঢ় হাত রাখে খসখসে প্রস্তরের উপর। অন্যহাতে কিলবিল করে কালো ফিতে। যে জোত্স্নার বিষ সে নারী দেহে রোপন করার আকাঙ্খা করেছিল, আজ সেই বিষ একান্তই তাকে পুড়িয়ে দেয় তীব্র দহন পিপাসায়। এ বিষ-যন্ত্রনা কেবলি একের, ভাগ বুঝি হয়না এক জীবনে যেমন শিউলীও পারেনি তার সুগন্ধের ভাগীদার করতে কোন এক রইসুলকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০০৮ দুপুর ১:০৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




