somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুশ'কারতুসকা'

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ৯:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত দুইমাসে ভাতের চেহারা দেখিনি। ডাল চচ্চড়ি ভর্তা আর মাছের ঝোল তো স্বপ্নকেও পাশ কাটিয়ে যায়।ক্যান্টিনে বিশাল দেহী রাশিয়ান বাবুর্চি বেকুব মিশার(আমরা ডাকতাম তাকে মদনা বলে) কাপুস্তা;পাতা-কপির ঝোল।আহা!সেকি স্বাদ ক্যান্টিনে ঢোকার মুখে দোতলার সিঁড়িতে দাড়িয়েই যার মৌ মৌ বোটকা গন্ধে আমাদের গা গুলোতো।
কাটলেট সেদ্ধ-মাংসের কিমা নুন ঝাল ছাড়া দলা পাকিয়ে সেদ্ধ করে ভুট্টার আটার গোলায় ডুবানো সে সুস্বাদু খাবার খানি একবারই চেখেছিলাম।
গুলাইশ-আলুকে সেদ্ধ করে মেশিনে চটকানো। একটা প্লেটে এক চামচ গুলাইশ ঢেলে চামচের পেটটা দিয়ে একটুখানি চাপ দিয়ে একটা গর্তের মত বানিয়ে সেখানে একহাতা সেই কাটলেটের সালুন- স্যরি ঝোল!
হুমম! সত্যিকারে সবচেয়ে এখনো স্বাদের খাবার ছিল বটে সেইখানে আর সেটা হল সিদ্ধ ডিম। সিদ্ধ ডিম দেখে যে সকাল বিকাল জিভ দিয়ে লালা ঝড়তে পারে তা আগে বুঝিনি।প্রায় তিনমাস আমি শুধু সেইটে খেয়েই বেঁচে ছিলাম।আজ থাক এই প্যাঁচাল-রসনা বিষয়ে না হয় অন্য একদিন বলব।
ভাষা বুঝিনা। ওদের যে বলব একটু লঙ্কার গুড়ো হোক সেটা লাল সাদা কিংবা কালো মিশিয়ে একটু ভেজে কিংবা পুড়িয়ে দিতে সেটাও বলতে পারিনা।তখন আমাদের গণ্ডিতে রাশিয়ার সেই ছোট্ট শহরটাতে ইংরেজি বুঝনে-ওয়ালা মাত্র দুইজন পণ্ডিত ছিল- দুজনেই আবার মহিলা। তন্মধ্যে তাতিয়ানা পাবলানা যিনি ছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টাল হেড তার ঝানু পন্ডিতপনার সামনে আমরা আমরা ইংরেজী বোল খুলতে ভয় পেতাম।অন্যজনও আমাদের মহামান্য শিক্ষিকা লারিসা আলেকজান্দ্রা। ভয়ঙ্কর সুন্দরী সেই মহিলাকে একটা ইংরেজি শব্দ বুঝাতে গিয়ে মাথার ঘাম যেন-পায়ের তালু স্পর্শ করত।
সারাদিন মিশা'র হাতের বিস্বাদ খাবার খেয়ে দেশী খাবারের কল্পনায় রাতভর জাবর কাটি।
রাশিয়ায় তখন শীতকাল। ভর দুপুরেও যেখানে পরিবেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন।বিদেশী ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ পঞ্চম তলায় কর্তৃপক্ষ কোন রান্না ঘরের এন্তেজাম করেনি। ভেবেছিলেন হয়ত বিদেশে পড়তে সব নবাব কিংবা শেখের পুত্ররা আসছেন তাদের কি আর নিজে রেঁধে খাওয়ার মত জঘন্য মনোবৃত্তি হবে?
চারতলায় রুশ ছেলেমেয়েরা সন্ধে হলেই হল্লা করে রান্না করে আর আমরা উপরে ওঠার সিঁড়ির মুখের দরজা খান দিয়ে জিরাফের মত গলা বাড়িয়ে জুল জুল চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।আহারে আমরা যদি এমন করে রেঁধে খেতে পারতাম?
কোথায় বাজার-কোথায় হাট? কিস্যু চিনিনা।এসেছি পনের দিনও হয়নি।হোস্টেল থেকে দু'শ কদম দুরে ভার্সিটি আর দেড়’শ কদম দুরে ক্যান্টিন।আমাদের দৌড় সর্বোচ্চ সামনের ওই রাস্তাখানা পেরিয়ে টেলিফোন একচেঞ্জ পর্যন্ত। মাইনাস তিরিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে এর থেকে বেশিদূর যাওয়াটা দুঃসাহসিক অভিযানের মত ছিল।
অবশেষে কয়েকজন তরুণ একদিন পরিকল্পনা করলাম সেই দুঃসাহসিক অভিযানের।
হাটতে হাটতে যাব সোজা এক রাস্তা ধরে- কোন মতেই ডাইনে বায়ে নয়।দুচার মাইলের মধ্যে কোথাও না কোথাও দেখা মিলবেই আমাদের প্রত্যাশিত বাজারের। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে ফিরে আসব সেই পথ ধরে। হোস্টেলের চারতলায় গিয়ে রুশ ছাত্রছাত্রীদের হাতে পায়ে ধরে একখানা ফ্রাইপ্যান নিয়ে আলু ভেজে খেলেও শান্তি।
ঢাউস বাঙলা টু রুশ ডিকশনারি ঘেঁটে বের করলাম মাত্র দুখানি শব্দ,একটা তেল যার রুশ প্রতিশব্দ ‘মাসলা’ আরেকখানা আলু যেটা লেখা আছে ‘কারতোফিল’। আজকের মত এ দুটোই থাক, একবার বাজার চিনে গেল তখন তখন না হয় স্বাদ পাল্টানো যাবে।লেখাটা তখনো ভাল করে শিখিনি। ডিকশনারিতে যেমন করে লেখা ছিল তেমনি করে লিখলাম একটা সাদা কাগজে।
লটবহর ঘেতে যতগুলো গরম জামা কাপড় ছিল সব কখানা গায়ে চড়ালাম। মোজা পড়লাম দুই জোড়া। অবশেষে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বীর দর্পে এগিয়ে চললাম আমরা তিন দুঃসাহসী অভিযাত্রী।
বরফ মাড়িয়ে হাটছিতো হাঁটছিই। হাত পা ঠাণ্ডায় প্রায় অসাড় হয়ে গেল,তবু বাজারের দেখা নেই।চারিদিকে শুধু কংক্রিট পাথরের চারকোনা উঁচু উঁচু দালান কোঠা-ট্রিপিক্যালি রুশ স্টাইলের।
হতাশ ফিরে আসবার তোড়জোড় করছি যখন ঠিক তক্ষুনি দেখতে পেলাম তেমনি একখানা অট্টালিকা থেকে ভারি দরজা ঠেলে বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে আসছেন এক রুশ বৃদ্ধা।খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম সবাই! শীতের তীব্রতা আর ক্লান্তির কথা ভুলে একসাথে দৌড়ে গেলাম সেই বাড়ির দিকে।
ভিতরে ঢুকে চোখ ছানাবড়া। বাইরে থেকে এতটুকু বোঝার উপায় নেই-এ দেখি বেশ বড় সড় শপিং মল। দেখতে আমাদের এখনকার আঘোরা কিংবা নন্দনের মত কিন্তু কোন ট্রলি নেই –হাত দিয়েও কোন কিছু নেবার উপায় নেই।
কাউন্টারের ওপাশে বিক্রেতা রমণী-গন ক্রেতার ফরমায়েশ অনুযায়ী দ্রব্য গুলো প্যাকেট-জাত করে টাকা পয়সা গুনে নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে।টাকা পয়সা হিসেব করার কৌশল তেমনি আদ্যিকালের। আমি বাপের জন্মে এমন ক্যালকুলেটর দেখিনি। কয়েকখানা লোহার দণ্ডের মাঝে গোল গোল কাঠের ঘুটি গুলো দ্রুত হাতে ডাইনে বায়ে চালান করে কি যে হিসেব করছে আল্লা মালুম!
ত্রস্ত পায়ে দুরু দুরু বুকে এগিয়ে গেলাম এক বিক্রেতা রমণীর কাছে।
মহিলা আমাদের দেখেই একগাল হেসে কলকলিয়ে বলল, স্দ্রাস্তেবিচে রিবিয়েতা!
প্রতিউত্তরে আমরাও সমস্বরে বললাম,স্দ্রাস্তেবিচে!
বলুন আপনাদের কিভাবে সাহায্য করতে পারি?(পুরোটা বুঝি নাই। শুধু পামাগিচ মানে যে সাহায্য এইটুকু বুঝেছিলাম।)
প্রতিউত্তরে এবার কিছু বলব যে জানি ছাই। খেই না পেয়ে চিরকুটখানা বাড়িয়ে ধরলাম তার চোখের সামনে;
মহিলা ততক্ষণে বুঝে গেছেন আমাদের ভাষার দৌড়! একটা কাগজের ঠোঙ্গায় এক দলা মাখন মেপে ঘুটি নেড়ে হিসেব করে কাগজে টাকার অঙ্ক লিখে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কারতোফিল লেখাটায় আঙ্গুলের পরশ বুলিয়ে চেহারায় দুঃখ দুঃখ ভাব এনে মাথা নেড়ে বললেন, 'এতা নিয়েতো!'
তার মানে নেই! হায় হায় কি বলে আলুর দেশ রাশিয়ার বাজারে আলু নেই-এইটে কেমন করে হয়।ইতি উতি চোখ বুলিয়ে মহার্ঘ্য আলুর দেখা না পেয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আমরা বেরিয়ে এলাম।
তিনজনের ছ’খানা দস্তানা পরা হাতে তখন মাত্র-একটা প্যাকেটে মোড়া আধা কেজি মাখনের ডেলা। এইটে নিয়ে কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা।
প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে কেতরে কেতরে হেটে আসছি হোস্টেল অভিমুখে।পথের শেষে এসে হোস্টেলের মুখে আমাদের মহিলা 'আখরান'(হোস্টেলের গার্ড) এর সাথে দেখা।মোটাসোটা গড়নের সেই প্রায় বৃদ্ধা মহিলা তার ন’দশ বছরের ফুটফুটে নাতনীকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে।
আমাদের দেখে বরাবরের মত হেসে মমতা জড়ানো কণ্ঠে কি যেন বললেন?
প্রতিউত্তরে সম্ভাষণ জানাতে গিয়ে আমরা তখন কেঁদে ফেলি আরকি! মনে হল মায়ের দেখা পেয়েছি। কাঁদো স্বরে ভিন ভাষায় আলতু ফালতু বকে শেষমেশ দেখালাম তাকে চিরকুটখানা। মহিলা আবার চোখে কম দেখেন। কাগজখানা বাড়িয়ে দিলেন তার নাতনীর দিকে। বাচ্চা মেয়েটা চোখ বুলিয়ে একটু হেসে বুড়ির কানে কানে কি যেন বলল।বুড়িও কাগজখানা আমাদের দিকে ফিরিয়ে দিতে দিতে হাসতে হাসতে যা বললেন,তা বুঝেছি অনেকদিন বাদে।
'কারতোফিল' মানে আলু তবে একবচন। রুশরা 'কারতোফিল 'বলতে বোঝে আলু ভাজা বা পটেটো তখন-আর কাচা গোল গোল আস্ত আলু কিনতে গেলে বলতে হয় ‘কারতুসকা’!!!
এটা বুঝেছি তখন যখন আমরা সব খাওয়া শিখে গেছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০২১ সকাল ৮:২৮
৩০টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×