আলকাশ সপ্তম পর্বঃ Click This Link
আলকাশ প্রথম পর্বঃ Click This Link
ইদানীং অবশ্য লতিফের সাথে মইনের ঘনিষ্ঠতা চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। আমি লতিফকে অপছন্দ করি বলে-সে আমাকে বাসায় রেখে 'জরুরী কাজ আছে' বলে বেড়িয়ে গিয়ে লতিফের ডেরায় যায়।
ওদিকে লারিসার কুঞ্চিত কপাল ধীরে ধীরে প্রশস্ত হচ্ছে। মইনের সাথে গল্প করার সময় -ঠোটের কোনে কখনো সখনো এক চিলতে হাসিও দেখা যায়।
দু'জনে দু'জনার মুখের ভাষা না হোক শারীরিক অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করে।আমিও ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছি নিজেকে।গল্পের মাঝে হুট হাট করে উঠে পড়ি নানান অজুহাতে। ওদেরকে একা ছেড়ে দিই কিছুক্ষণ -পরস্পরের বোঝাপড়া হবে ভেবে।
সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ লারিসার ছোট ভাই আন্দ্রে যাকে সবাই আদর করে ডাকত আন্দ্রেউসকা বলে। সে আর তার বন্ধু মিশা সারাক্ষণ আমাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করত। তাদের মূলত আকর্ষণ ছিল সিগারেট আর ওয়াইনের প্রতি। মইনও সেটা বুঝে দু-চার শলাকা সিগারেট আর ওয়াইন ভেট দিয়ে তাদেরকে অতি সহজেই বশ করেছিল। এর বিনিময়ে মইন ওদের বিনে পয়সার গোয়েন্দা হিসেবে নিযুক্ত করল। লারিসার অতীতের সব কর্মকাণ্ড আর বর্তমান দিনলিপি নিয়ে অতি সন্তর্পণে মইনকে অবহিত করত।
ব্যাপারটা আমার পছন্দ ছিল না বলে, ওরা যথা সম্ভব আমাকে এড়িয়ে চলত।
তবে আন্দ্রকে আমি খুব আদর করতাম-সেও আমায় বেশ মান্য করত। আন্দ্রে একটু বেকুব টাইপের হলেও মিশা খুব চতুর ছেলে। আন্দ্রেকে সামনে ঠেলে কাজের বিনিময়ে সে তার সবটুকু উসুল করে নিত। মিশার কাজিন সিভেতা(সিভিয়েতা) লারিসার বাল্য বন্ধু। প্রতিবেশী হবার সুবাদে লারিসাদের বাসায় ছিল তার অবাধ যাতায়াত।
সুন্দরী একহারা গড়ন-অপছন্দ হবার কোন কারণ নেই। আমাদের সাথে শুধু পরিচয়টুকু হয়েছিল ব্যাস!- লারিসা কেন যেত তার আগমনে খুব বেশী খুশী হত না। আমাদেরকে এড়িয়ে আন্দ্রের ঘরেই গল্পগুজব করত।
মইনের সাথে ওর একটু ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই একদিন কি ভেবে সে খুব আগ্রহভরেই আমাদের রুমে সিভেতাকে এনে আমার সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিল। সে পরিচয় পর্বে অন্য কিছুর আভাস ছিলঃ 'মিশু শোন ওর কোন ছেলে বন্ধু নেই।' লারিসার এই কথাটা খট করে বাধল আমার কানে। ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। মনে মনে আমি উৎফুল্ল -যাক নিঃসঙ্গতা ঘুচবে এবার! তবে বিপত্তি হল অন্য-খানে-সিভেতা ঠাণ্ডা টাইপের মেয়ে; কথাবার্তা ভীষণ রকম কম বলে। যা-ই জিজ্ঞেস করি শুধু হু হা করে আর মেটে হাসি দেয়।একা একা গল্প আর কাঁহাতক চালানো যায়। আমার ধারনা ও আমার ভাষা ভাল করে বুঝতে পারছিল না -স্বভাবতই প্রথম দিনেই আমার আগ্রহ উদ্দীপনায় খানিকটা ভাটা পড়ল।
তবে লারিসা কি যেন সব বলেছে আমাকে নিয়ে ওর কাছে কে জানে? প্রথম থেকেই সে মেয়ে এমন মোহিত হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিল যেন আমি কোন 'প্রেদমেদ অবঝানিয়ে' হার্টথ্রব সেলেব্রিটি। মনে হচ্ছিল আমি দু ছত্র প্রণয় আলাপ করলেই সে ভালবাসার নৌকার পাল তোলে! ঠিক যেন জ্বলন্ত মোমবাতির মাথায় গলে যাওয়া মোমটুকু পড়ার অপেক্ষায়...
এমন নিরস মেয়ের আর যাই হোক সাথে ভাব-ভালবাসা হয়না। আর আমি ‘এরেঞ্জ লভে’ প্রস্তুত না! তবুও লারিসার অতি আগ্রহ আর নিজের ভবিষ্যৎ নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে ওর সাথেই আপাতত জড়ালাম। রুশীয় প্রেমের ভবিষ্যৎ নিয়ে অত-বেশী শঙ্কিত হবার কিছু নেই- আমাদের বাঙ্গালীয়ানা প্রেম চলে শুধু দাবি দাওয়া উত্থাপন-ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, হাজারো শর্ত আর কিরা কসম কেটে। এসবের বালাই ওখানে নেই বিশেষ। ওরা বেশীরভাগ-ক্ষেত্রেই বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশী উদ্বিগ্ন নয়। ছেলেদের হার বেশী হলেও প্রণয় আলাপে দু-পক্ষই বেশ আবেগ-ভরে দরদ দিয়ে মিথ্যে কথা বলে(ব্যতিক্রম উদাহরণ নয়)।শারীরিক সম্পর্কের পরে ওখানে কেউ নাকের জলে চোখের জলে এক করে বলে না; আমিতো সবকিছু তোমাকে দিয়ে দিয়েছি-এখন আমার কি হবে?
০৯
আন্দ্রেউসকা এবার আঠারতে পা দিবে। আঠার মানে, যৌবন প্রাপ্তির বয়স। বড়দের কাতারে কাধ মেলানোর সুযোগ। অন্য অভিজাত পরিবারে কি নিয়ম আমার জানা নেই, কিন্তু এদের এখানে নিয়মটা খানিকটা কড়া। আঠারোর আগে মুরুব্বিজন সম্মুখে মদ্যপান নিষিদ্ধ! সেই মতে আন্দ্রে এতদিন বড় বিপাকে ছিল-আমাদের দেয়া মদ আমাদের সামনেই খেত লুকিয়ে-চুড়িয়ে! আন্দ্রের আঠারোর জন্মদিন নাকি ধুম-ধাম করে হবে। লারিসাদের বাসার সবাই সেই নিয়ে ভীষণ ব্যাতি-ব্যাস্ত।
এই ধুম-ধামের পিছনের মাষ্টার মাইন্ড আমাদের মইন ভাই। তিনিই সবাইকে উস্কে দিয়েছেন। আন্দ্রেকে বলেছেন, কুছ পরোয়া নেহী-সব কুছ হোগা ধুম ধাম সে!’ বেকুব আন্দ্রে কথা না বুঝে ফ্যাক ফ্যাল করে আমার দিকে তাকায়। আমি মইনকে জিজ্ঞেস করি। এটা কি হিন্দি না উর্দু? লতিফের সংস্পর্শে থেকে আপনার দেখি মাথা গেছে!
মইন হেসে বলল, কি করব এই ব্যাটা রোমানিয়ান, ইংরেজী, বাংলা কিস্যু বোঝে না। তাই উর্দু বললেই কি অন্য ভাষায় বললেই, বোঝাবেন তো আপনি।
কথা ঠিক! আমিই বোঝালাম আন্দ্রেকে। আন্দ্রের খুশীতে তখন পাগল দশা! সে দৌড়ে গেল মিশাকে ডাকতে, আর ফিরে এল সাথে করে একটা কুকুর ছানা নিয়ে। কুকুর ছানাটা একদম ছানা নয়, একটু ডাঙ্গর হয়েছে। কে যেন, মনের দুঃখে ওকে গিফট করেছে! এমন বেকুব কুত্তা আমি জীবনে দেখি নাই। চোখ ঘুরিয়ে লেজ নেড়ে এক জায়গা-ই চড়কির মত ঘোরে। আর দরজায় কেঊ আসলে দরজার সামনে ঘেউ ঘেঊ না করে- দৌড়ে গিয়ে টেবিল চেয়ার যা পায় তার নীচে লুকিয়ে পড়ে, থাবার মাঝে মুখ লুকিয়ে; কেউ কেউ করে!
কুকুর নিয়ে সারা বাসায় হুল স্থুল। আন্দ্রে লজ্জা পেয়ে সেটাকে যত ট্রেনিং দেয়, পর মুহূর্তেই পিচ্চিটা তা ভুলে যায়! সেদিন-ই তার নামকরন হল ‘রোন্দ্রে’ সংক্ষেপে ‘রো’। মইন-ই তার নামকরনে হোতা। আন্দ্রের ভাই রোন্দ্রে। আন্দ্রে ভীষণ লজ্জা পেলেও বাকি সবাই চরম মজা পেল। পিঠাপিঠি বড় বোন এই নিয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে বেশ ঠাট্টা মস্করা করছে দেখে মইন খুশীতে বগল বাজাতে লাগল।
তার নাম- এই রকম মার্কেট পাবে(তার ভাষায়) সে ভাবে নাই।
ছোট খাট একটা গেস্টের লিস্ট হল; আন্দ্রের বন্ধু আছে এক মিশা। মইন আর আমার কমন দু’তিনজন বন্ধু আর লারিসার গোটা দুই বান্ধবী ব্যাস! ঘরোয়া অনুষ্ঠান, এর থেকে বেশী লোকের স্থান সংকুলান হবে না।
লারিসার বান্ধবী সিভেতা আসবেই- সে এখন প্রতিদিনই বার কতক এ বাড়িতে চক্কর দেয়। তার সাথে আমার ভাব ভালবাসা হয়েছে কিনা বোঝা মুশকিল। কাছে পিঠে আসলেও তার আশ্চর্যজনক নীরবতা, নিস্পৃহতা আর ক্যাব্লার মত মেটে হাসি দেখে আবেগ মরে যায়!
সিভেতা ছাড়া আর কাকে বলা হোল, সে প্রশ্ন করলে লারিসা মুচকি এড়িয়ে যায়। মইনের চরম আগ্রহ সেটা আগে ভাগে জানার। সে চায় লারিসার গোটা দশেক বান্ধবী অন্তত আসুক সেই অনুষ্ঠানে। কিন্তু গোটা দশেক বান্ধবী থাকতে হবেতো। আমাকে খোচায়, কাকে কাকে বলেছে জিগান না? আমি জিজ্ঞেস করলে লারিসা বলে’ পাসমাত্রিম’ (দেখা যাবে)।
রুশীয় অনুষ্ঠানে খাবার থেকে ভিন্ন স্বাদের বাহারী লেবেলের মদ,বিয়ার,শ্যম্পেন, লিকার,কনিয়াক, ওয়াইন থাকে মুল আকর্ষণের কেন্দ্রে। তাছাড়া এবার-ই প্রথম আন্দ্রে মদ খাবে সবার সম্মুখে, ভাবি শ্যালকের জন্য জান লড়িয়ে দিল মইন মদ যোগাড়ে!
মুল অনুষ্ঠানের দিন দুপুরেই লারিসা আমাকে ডেকে চুপি চুপি বলল, ব্রাত(ভাই) তোমাকে ছোট্ট একটা উপকার করতে হবে?
কি করতে হবে বলো সিসত্রা(বোন)?
সে একটু লাজুক নেত্রে হেসে বলল, আমার এক বান্ধবী আসবে। কয়েক বছর দেশের বাইরে ছিল- রাস্তা ঘাট ভাল চেনে না। ওকে কি একটু বাস স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে আসবে?
লারিসার হাসি বলে অন্য কিছু। আমি বললাম, আমরাতো কেউ কাউকে কোনদিন দেখিনি-সে আমাকে চিনবে কেমনে আর আমিই বা তাকে?
ওকে তুমি দেখলেই চিনবে। এখানেতো আর আর গন্ডা গন্ডা সুন্দরী মেয়ে নামে না। ওর হাভ ভাব পোষাকই অন্যরকম। আর তোমাকে দেখেই সে এক লহমায় চিনে নিবে, এ তল্লাটে দু’জন বিদেশীর-ই বাস।
তার কথা মনে ধরল। এরপরে নাকি সুন্দরী-তথাস্তু!
বিকেল পাচটা থেকে বাসস্ট্যন্ডে দাঁড়িয়ে আছি।এখানে একটাই রুট থাকায় বাস আসে কালে-ভদ্রে! ‘উলিতসা ফ্লরিওর’ ফুলের রাস্তা। যেমন নাম তেমন-ই নয়নাভিরাম এ রাস্তার ধার! গ্রীষ্মের এই উজ্জ্বল বিকেলে অতি আগ্রহ নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি অচেনা সুন্দরী এক রমণীর।
অবশেষে তিনি আসলেন। বাসের দররজায় তার আগমনে, গ্রীষ্মের মনোরম এই উজ্জ্বল বিকেলটার উজ্জলতা যেন শতগুন বেড়ে গেল। প্রথম দেখায় আমার মনে হোল তোমার-ই অপেক্ষায় আমি জনম জনম ধরে ছিলাম! সিড়িতে পা রাখবার আগে সে একবার, কালো ডাগর ‘পাখির নীড়ের মত চোখ’তুলে তাকিয়ে আমার অস্তিত্ব কনফার্ম করে নিল। আর আমি অস্ফুট স্বরে বললাম; ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’?
আপাতত শেষ- চাইলে পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন
পরের পর্বের জন্যঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:১৯