আগের পর্বের জন্য: Click This Link
হাজারীবাগ
১৯৪০ এর দশকে এক ব্যবসায়ী আর.পি. শাহা কর্তৃক নারায়ণগঞ্জে বাংলাদেশের প্রথম ট্যানারি স্থাপন করা হয়েছিল। ট্যানারিটি পরে(১৯৪৫ সালে দিকে- মতান্তর আছে, কোথাও বলা হয়েছে দেশ বিভাগের আগে কোথাও পরে)ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৬৫ সালে ঢাকায় ৩০ টি ট্যানারি ছিল। ১৯৭০ এর দশকে এই শিল্পটির উল্লেখযোগ্য বিকাশ হয়েছিল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অবাঙালি ট্যানারিরা তাদের মালিকানাধীন প্রায় ৩০ টি ট্যানারি ইউনিট ছেড়ে চলে যায়। যুদ্ধের পরে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ সরকার ৩০ টি ট্যানারি অধিগ্রহণ করেছিল।বাংলাদেশের নতুন সরকার এই ইউনিটগুলির পরিচালনা একটি সদ্য গঠিত ট্যানারি কর্পোরেশনকে ন্যস্ত করেছিল, যা তাদের চূড়ান্ত উৎপাদন ইউনিটগুলিতে রূপান্তর করবে বলে আশা করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে, কর্পোরেশন অভিজ্ঞতার অভাবে এবং দুর্নীতিমূলক আচরণগুলি সহ অন্যান্য কারণে এই উদ্দেশ্যটি সম্পাদন করে নি।
পরে সরকার ট্যানারি কর্পোরেশন ত্যাগ করে এবং এই ট্যানারিগুলির বেশিরভাগ ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প কর্পোরেশনকে (বিসিআইসি) হস্তান্তর করে। এর মধ্যে তিনটি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে দেওয়া হয়েছিল। উভয় কর্তৃপক্ষই ট্যানারিগুলি পরিচালনা করতে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৮২ সালে,সরকার এটির পুনঃর্নিয়োগের নীতি অনুসরণ করে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে স্থানান্তরিত করে,যা কিছু উদ্যোগী বাঙালিকে এই শিল্পে কম বা অভিজ্ঞতা না থাকায় ব্লু ওয়েট চামড়া উৎপাদন শুরু করে।
(তবে এখানে সূচনা হয়েছিল, এলাকা ভিত্তিক দ্বন্দ্বের! যা পরবর্তীতে চামড়া শিল্পের অগ্রগতিকে অনেকটা ব্যাহত করে।বরাবরই চামড়া শিল্পের দক্ষ অদক্ষ মুল কারিগরেরা ছিল কুমিল্লা নোয়াখালী অঞ্চলের। যেহেতু সব অবাঙ্গালি মালিক ও চামড়া শিল্পের সাথে জড়িত কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন অভিজ্ঞ অবাঙ্গালীরাও এক সাথে চলে যায় সেহেতু এই শিল্পে বেশ বড় একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল- সেটা পূরণ করা সেভাবে আর কখনোই সম্ভব হয়নি। সরকার যখন ১৯৮২ সালে চামড়া শিল্প চালাতে ব্যর্থ হয়ে বেসরকারী উদ্যোক্তা দের হাতে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়- তখন এর জোর দাবিদার ছিল কুমিল্লা নোয়াখালী অঞ্চলের সেই গ্রুপটি কিন্তু যেহেতু হাজারীবাগের অবস্থান পুরানা ঢাকার খুব কাছেই- সেহেতু পুরনো ঢাকার স্থানীয় অধিবাসীরা এসবের অধিকার নেবার জোর প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু কারিগরি-জ্ঞানের অভাবের জন্য তারা সফলকাম হয়নি। তারা শুধু কাঁচা চামড়ার বৃহৎ আড়ত ‘পোস্তা’র অধিকার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু কুমিল্লা নোয়াখালীর এই গ্রুপকে কখনোই তারা সুনজরে দেখেনি। সে সাথে কুমিল্লা নোয়াখালীর গ্রুপ ও পুরনো ঢাকার লোকদের সাথে দুরুত্ব বজায় রেখেছে। আজও হাজারীবাগে গেলে শুনতে পাবেন সেই দ্বন্দ্বের কথা( শুধুমাত্র বে ট্যানারির মালিক ছিলেন শরিয়তপুরের লোক)।
ঢাকাইয়া রা এখনো বলে’ আব্বে হালায় নোয়াখালীর মানুছ বড় বড় বিতাল আর খবিছ। ওই হালাগো সাথে ব্যাবছা করন যাইব না।‘ তেমনি নোয়াখালীর লোকও ওদের কটু কথা করতে ছাড়ে না।
এই দ্বন্দ্বে এক সময়ে , নাসিরুদ্দিন পিন্টু সহ পুরনো ঢাকার কিছু সন্ত্রাসী চেষ্টা করেছিল কিছু ট্যানারি দখল করার। যদিও সফলকাম হয়নি তবে এদের অত্যাচারে অনেক ভাল ব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এটা একটা কারণ বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়া শিল্পের অধঃপতনের জন্য।)
এর পর থেকে হাজারীবাগ ট্যানারি ব্যবসায় গতি পেয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের আগে ট্যানারিগুলির সংখ্যা বেড়ে প্রায় ২০০ হয়েছে।
সময়ের সাথে সাথে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প অঞ্চলটি ছোট ও বড় ট্যানারি কারখানার ২৭০ টিরও বেশি বেড়েছে।যা শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ট্যানারি দিয়ে ভরা জায়গায় পরিণত হয় বঙ্গভঙ্গের আগে (১৯৪৭।) পূর্ববঙ্গের প্রায় সমস্ত কাঁচা চামড়া পশ্চিমবঙ্গ,বিশেষত কলকাতায় রফতানি করা হত এবং সেখানে প্রক্রিয়াজাত করা হত।
এরপরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারি শিল্পের বিকাশ মূলত ভারত থেকে বাস্তু-চ্যুত হয়ে পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি সংস্থার সহায়ক সংস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশ বিভাগের পরে শুরু হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানিং শিল্প এবং চামড়া রফতানি মূলত অবাঙালি মানুষের হাতে ছিল। কয়েকটি ট্যানিং ইউনিট অবশ্য বাঙালি উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল তবে তা কুটির শিল্প ধরণের ছিল এবং তারা মূলত দেশীয় বাজারের জন্য চামড়া প্রক্রিয়াজাত করত। বেশিরভাগ অবাঙালি ট্যানারিগুলি ব্লু-ওয়েট প্রক্রিয়াজাত করে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেরণ করত এবং সেখানে এটি মুল প্রক্রিয়াকরণ( ফিনিশড লেদার) শেষে বিভিন্ন ভোক্তা পণ্য তৈরির জন্য সেটা ব্যবহৃত হত। ১৯৬০ সাল অবধি পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারিগুলি কাঁচা চামড়াগুলি লবণ প্রয়োগ করে এবং তারপর এটি রোদে শুকানোর প্রক্রিয়া করত এবং এইভাবে তৈরি হওয়া উপাদানটি ‘লেটু’ নামে পরিচিত ছিল।
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ
২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ২০৬টি ট্যানারি ইউনিট ছিল( মতান্তরে ২২০)এবং তারা স্থানীয়ভাবে পাওয়া কাঁচা চামড়া ব্যবহার করে। এর মধ্যে ১১৪ টি বৃহত্তর এবং মাঝারি ইউনিট (স্থানীয় মান অনুসারে) এবং শিল্প অধিদপ্তরে নিবন্ধিত রয়েছে। অন্যরা বেশিরভাগ ছোট এবং কুটির শিল্প ধরণের এবং সরকারের নিবন্ধে নেই। ট্যানারি শিল্পের সম্ভাব্য দিক বিবেচনা করে, ৩৫ টি ট্যানারিগুলি আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করেছিল।এই ট্যানারিগুলি আমাদের কাঁচা চামড়ার ৬০% আন্তর্জাতিক মানের রূপান্তরে সক্ষম ছিল। প্রায় ১৯০ টি ট্যানারি ইউনিট ঢকার হাজারীবাগে ট্যানারি এস্টেট নামে পরিচিত মাত্র একর জমিতে অবস্থিত। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের রেকর্ড অনুসারে ট্যানিং শিল্পে প্রায় ৬০০০০ শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে(এর মধ্যে ৬০ শতাংশ অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন এবং তাদের মালিকদের দেওয়া কোনও পরিচয়পত্রও নেই।)। এছাড়াও বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় শতাধিক যোগ্য প্রযুক্তিবিদ রয়েছেন যারা বিভিন্ন ট্যানারিতে কাজ করছেন। ট্যানারি শিল্পে এখন পর্যন্ত মোট মূলধন বিনিয়োগ করা হয়েছে ২.৫ বিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে সরকার / ব্যাংক ফিনান্স প্রায় ১.২ বিলিয়ন টাকা। কাঁচা চামড়া সংগ্রহ এবং ট্যানারি ইউনিটে তা পৌঁছে দেয়ার প্রক্রিয়াতে প্রায় ১৫০০ ব্যক্তি জড়িত। ট্যানারি শিল্পে ব্যবহারের জন্য প্রায় ১০০ টি প্রতিষ্ঠান কেমিক্যাল আমদানি করে।
বাংলাদেশ প্রায় ২০০-২২০ মিলিয়ন বর্গফুট কাঁচা চামড়া উৎপাদন করে, যার প্রায় ৮৫% ক্রাস্ট এবং ফিনিশড আকারে রফতানি করা হয়। বাকি চামড়া দেশীয় বাজারের জন্য চামড়া-জাত পণ্য উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয়। চামড়া বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রফতানি আইটেম। তবে এই খাত থেকে রফতানি আয় অতীতের কোনও পূর্বাভাসের সাথেই মিল রাখতে পারেনি। যেহেতু চামড়ার উৎপাদন ও সরবরাহ গবাদিপশুর প্রাপ্যতা এবং মাংসের চাহিদার উপর নির্ভরশীল,তাই অল্প সময়ে চামড়ার মোট সরবরাহ বাড়ানো যায় না,তাই এই খাত থেকে আয় বাড়ানোর একমাত্র উপায় উচ্চ উৎপাদন এবং রফতানি।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার চামড়ার জন্য মূল্য খুব বেশী ওঠানামা করে,তাই এর রফতানি আয়েরও তারতম্য হয়। ২০০১ অবধি এই খাত থেকে বার্ষিক রফতানি আয় এক বিলিয়ন টাকার নিচে ছিল।তবে ২০০৮-০৯ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়া-জাত পণ্য রফতানি থেকে বার্ষিক আয় বেড়ে .৩৮১মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের কয়েকটি নামী ট্যানারি হলেন ঢাকা লেদার, অ্যাপেক্স ট্যানারি, লেক্সকো, করিম লেদার, সমতা ট্যানারি, বে ট্যানারি,রিলায়েন্স, কালাম ব্রাদার্স, আল মদিনা, মিল্লাত, প্রগতি, আনোয়ার,আমিন,ক্রিসেন্ট লেদার ইত্যাদি.
ঢাকার বাইরে যশোর ও খুলনায় আছে আকিজ ট্যানারি ও সুপার এক্স।
চামড়া শিল্পের বিকাশের চরম সময়ে সরকার ভাল অথচ ভুল(!)* এটা পরে প্রমাণিত হয়েছে* সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯০ সালে ব্লু ওয়েট চামড়া বন্ধ করে দেয়ার ফলে কাঁচা চামড়ার দাম কমতে শুরু করে।যদিও এই ধারাটা প্রথমে বোঝা যায়নি। কেননা ফিনিশড লেদার ও লেদার প্রোডাক্ট রপ্তানি দিন দিন বাড়ছিল। সেই সাথে দেশীয় বাজারেও চামড়া-জাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
ব্লু ওয়েট চামড়া শুধু দেশীয় উৎপাদিত চামড়া থেকেই তৈরি হত না। কাঁচা চামড়া আমদানি ক্রেও ব্লু ওয়েট করে রপ্তানি করা হত। ভয়ঙ্কর পরিবেশ দূষণের সূচনা তখন থেকেই। বিদেশি কিছু স্বার্থান্বেষী ক্রেতা( যেই কাজটা প্রথমে করেছে ভারত পরে পাকিস্তান সেই ধারাতেই) বাংলাদেশকে বানাতে চেয়েছিল দুষিত আবর্জনার ভাগার। সারা বিশ্ব থেকে কাঁচা চামড়া এনে এখানকার পরিবেশ দূষণ করে সেটা নিয়ে তারা ফিনিশড করে চড়া দামে বিক্রি করবে। এমনকি সেই চামড়াই কয়েকগুণ দামে আমাদের কিনে এনে প্রোডাক্ট তৈরি করে রপ্তানি করতে হত। বিদেশী ক্রেতা বাধ্য করত আমাদের সেই চামড়া কেনার জন্য।
সরকারি মহল এটা বুঝতে পেরে আগ-পিছু না ভেবে হুট করে ব্লু ওয়েট চামড়া রপ্তানি বন্ধ করে দিল।
ব্লু ওয়েট চামড়া প্রসেসিং ইউনিট
কিন্তু খেলা শুরু হোল অন্য খানে। ওদের পক্ষ হয়ে পরিবেশে রক্ষার ধোঁয়া তুলে মাঠে নামল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করল- কি হচ্ছে বাংলাদেশে। কিভাবে ভয়ঙ্কর দূষণের স্বীকার হচ্ছে আমাদের নদ নদী আর পরিবেশ( বিষয়টা সত্যি আমি স্বীকার করছি কিন্তু উদ্দেশ্যটা ভিন্ন)। তারা ইউরোপ থেকে অন্যান্য দেশকে বোঝাল দূষণ কন্ট্রোলে না না আন পর্যন্ত বাংলাদেশের চামড়া দিয়ে পণ্য কেনা যাবেনা। তখন জাপান সহ কিছু দেশ বাদে অনেকেই তাদের সাথে তাল মেলাল।ইউরোপিয়ান বায়াররা ঘোষণা দিল বাংলাদেশী চামড়া দিয়ে তারা তৈরি কোন মাল নিবে না।তারা ফের বাধ্য করল তাদের সিলেক্টেড পার্টি থেকে চড়া দামে চামড়া নিয়ে অথবা বায়ারদের পাঠানো চামড়া দিয়ে প্রোডাক্ট তৈরি করার জন্য।পরবর্তীতে কিন্তু ভিয়েতনাম ও চায়না বাংলাদেশ থেকে ফিনিসড লেদার নিয়ে মাল বানিয়ে ইউরোপে পাঠায়- সেটা নিয়ে কেউ কথা বলছে না।
এই ভাবে শুরু হল চামড়া বাজারে ধ্বস!
কিন্তু স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা বাড়তে থাকল। সেই সাথে জাপান ও অন্য কিছু দেশ অন্য সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চামড়া-জাত পণ্য নিতে থাকল বাংলাদেশ থেকে।
হাজারীবাগে শুধু ট্যানারি নয় এর সাথে জড়িত ছিল হাজারো ছোট বড় কারখানা আর শ্রমিকরা। শ্রমিকদের একটা বড় অংশ ছিল ভাসমান- যারা চুক্তিভিত্তিক কাজ করত। এছাড়া ছিল প্রচুর কুলি, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি চালক,আর কিছু অভিজ্ঞ কারিগর। সেখানে ছিল শতাধিক কেমিক্যালের দোকান, আড়তদার, ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্তভোগী ব্যবসায়ীদের অফিস। মাথানি, চামড়ার ছাট, হাড় গোর, শিং এর অনেক ফ্যাক্টরি। এছাড়া চামড়ার লাইনিং, ভেড়ি, কিপস( মহিষের চামড়া থেকে তৈরি পুরু, শক্ত কিছুটা হলদেটে গোলাপি রঙের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উৎপাদিত চামড়া, যা দিয়ে স্যান্ডেল বা জুতার সোল, ট্রে এসব কাজে ব্যবহৃত হয়। এই চামড়া পানিতে ভেজালে বেশ মোলায়েম হয়ে যায় ডাইসে প্রেশার দিয়ে শুকালে যেকোনো আকার ধারণ করে। কিছু জিপ্পো লাইটারের বক্স,হ্যান্ড-কাফের শক্ত থলে সহ অন্যান্য কিছু এই পদ্ধতিতে তৈরি হয়।কিপসে ইচ্ছা মত রঙ ও বার্নিশ করা যায়), মহিষের চামড়া প্রক্রিয়াজাতের বিভিন্ন অতি ক্ষুদ্র ফ্যাক্টরি ছিল।
মহিষের চামড়া দিয়ে বানানো হ্যান্ডকাফ পাউচ(মেড ইন বাংলাদেশ)
এই ফ্যাক্টরিগুলো মূলত বড় ফ্যাক্টরির খুব ধারে কাছে হত কেননা ব্লু ওয়েট, ক্রাস্ট, ফিনিশিং, ডায়িং, বার্নিশিং, প্লেটিং সহ বিভিন্ন কাজে এই সব ফ্যাক্টরির সহযোগিতার দরকার হত। কোন কোন ফ্যাক্টরি রোজ বা ঘণ্টার ভিত্তিতে মেশিন বা ফ্লোর ভাড়া দিত। এছাড়া ত্রুটির কারণে বাতিল কাঁচা চামড়া, লাইনিং, স্প্লিট , টুকরো চামড়া,স্টক লট, টি আর( টেকনিক্যাল রিজেক্টঃ A-D Grade 1, E-H Grade 2,এর পরের ধাপের চামড়াকে বলা হয় টি আর)ও পুরনো চামড়া প্রসেস করে অনেকেই স্থানীয় বাজারে বিক্রি করত।হাজারীবাগে এই সব কর্মকাণ্ড এখনো চলমান তবে সীমিত আকারে।
এছাড়া সব ফ্যাক্টরিতে সব ধরনের মেশিন ছিল না। কিংবা প্রক্রিজাতকরনের সময়ে কোন মেশিন সাময়িকভাবে নষ্ট হয়ে গেলে অন্য কোন ফ্যাক্টরির সহযোগিতা দরকার হত।
একটা বড় ট্যানারি বিশাল ব্যাপার- বিরাট তার কর্মযজ্ঞ। কেউ বে ,এপেক্স বা এধরনের বড় ট্যানারিতে না গেলে বুঝতে পারবেন না কি বড় মাপের কর্মকাণ্ড চলে ওখানে। যশোরের সুপার লেদার নামে একটা ট্যানারির জায়গার পরিমাণ ৩০ একর প্রায়!
• উপরে যে ছবিটা দিলাম; সাভারে অবস্থিত বেশ নামকরা একটা ট্যানারির ক্ষুদ্র অংশের চিত্র। ফটোগ্রাফি-শেরজা তপন।
এছাড়া ছিল পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল প্রচুর ছোট ও মাঝারি চামড়া-জাত পণ্যের কারখানা। যারা মূলত বড় ফ্যাক্টরির টি আর,স্টক লট সহ স্থানীয় ফড়িয়া ও ছোট কারখানার মালিকদের কাছ থেকে চামড়া নিয়ে বিভিন্ন চামড়া-জাত সামগ্রী তৈরি করে বাজারজাত করত। এদের আবার কেউ কেউ রপ্তানির সাথেও জড়িত ছিল।পাশাপাশি বড় বড় ট্যানারির ও কিছু নিজস্ব ফ্যাক্টরি ছিল,যেগুলো মূলত রপ্তানি করত। পরে এদের কেউ কেউ লোকাল ব্রান্ড হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করে। যেমন;বে ফুট ওয়্যার,এপেক্স(ওদের তখন তেজগাঁও তেও ফ্যাক্টরি ছিল-এখন ঢাকার বাইরে),ওরিয়ন, ক্রিসেন্ট লেদার।
হাজারীবাগের খুব কাছেই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কাঁচা চামড়ার আড়ত ‘পোস্তা’। যেখান থেকে প্রতিদিন হাজার থেকে লক্ষ কাঁচা চামড়া আনা নেয়া হত।
তার অনতিদূরেই বংশালের সুরিটোলা- মালিটোলা। যেটা চামড়া ও অ-চামড়া-জাত পণ্যের সবচেয়ে বড় এক্সেসরিজ মার্কেট। সেই সাথে সেখানে সব ধরনের কেমিক্যাল,সুতা,চামড়ার উপযোগ,সোলের বিভিন্ন অংশ, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চামড়া,লেসকো লাইনিং স্প্লিট,কিপস,ভেড়ি’র পাইকারি ও খুচরা বাজার। পুরোটাই একটা সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের সাথে যুক্ত ছিল।
কিন্তু সরকার শুধুমাত্র হাজারীবাগ থেকে সাভারে শুধুমাত্র ট্যানারিগুলো স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে এই পুরো চেইনটা ভেঙ্গে দিয়ে-দেশের চামড়ার বাজার অস্থিতিশীল করে দিল।
প্রথম থেকেই অনেকে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ভাষা তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি কখনোই...
*মুক্ত আলোচনা সবার জন্যই উন্মুক্ত! যে কেউ পরামর্শ দিতে পারেন?
পরের পর্বের জন্যঃ Click This Link
মুল প্রবন্ধঃ শেরজা তপন
০৭ আগষ্ট,২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:১৮