আগের পর্বের জন্যঃ Click This Link
আলকাশ প্রথম পর্বঃ Click This Link
আমি থমকে দাড়িয়ে ফিরে ওদের দিকে চাইলাম। ওরা দুজন দ্রুত খুব কাছে এগিয়ে এসে অত্যান্ত বিনীত ও ভদ্র ভাবে আমার কাছে সাহায্য প্রত্যাশা করল‘তুমি কি বলতে পার এই বাসার নম্বরটা কত?’
প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটা বাড়ির রাস্তা-মুখী দেয়ালে বড় বড় হরফে নাম্বার লেখা থাকত। আমি যেখানে দাড়িয়ে আছি সেখানটা অন্ধকারচ্ছন্ন! উচু উচু দালানগুলো চাঁদটাকে আড়াল করে দাড়িয়ে আছে। ছ্যাতা ধরা ছাইরঙ্গা কংক্রিটের দেয়ালে ঝাপসা হয়ে আসা অক্ষরগুলো এই আলোতে ওদের চোখে না পরারই কথা।
এ বাড়িটার নম্বর আগে থেকেই জানি তবু কনফার্ম হওয়ার জন্য ডানদিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে মাথাটা সামান্য উচু করে চোখ তুলে চাইতেই...তারপর কিছু মনে নেই!
চেতনা ফিরে পাবার পর কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না কেন আমি পথের ধুলোতে শুয়ে আছি? মাথাটা একদম ফাঁকা হয়ে আছে! একবার ভাবলাম মনে হয় সপ্ন দেখছি- হ্যা সপ্নই তো না হলে শরীরটাকে এত বেশী হালকা মনে হচ্ছে কেন? দু'হাত মেলে দাড়ালেই বুঝি আকাশে উড়ে যাব। বেশতো ..তাড়া হুড়ো কর উঠে দাড়াতে গিয়েই মাথাটা ঘুরে গেল পরক্ষনেই আবার জ্ঞান হারিয়ে ধরনীতে লুটিয়ে পড়লাম।
ফের জ্ঞান ফিরে আসলে- ধীরে ধীরে দেয়াল ধরে উঠে দাড়ালাম। পা-দুটো যেন পাথরের মত ভারী হয়ে গেছে,কিছুতেই সামনে এগুতে পারছিনা। অগত্যা সেভাবেই দেয়াল ধরে দাড়িয়ে থেকে ভাবতে বসলাম,আমি এখানে কেন?কোত্থেকে আসছিলাম?কোথাইবা যাচ্ছিলাম?এভাবে রাস্তার উপর শুয়ে ছিলাম কিজন্য?কোন প্রশ্নেরই সদুত্তর পেলামনা!মস্তিস্কের একটা অংশ হয়তো সে সময়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল।
বেশ খানিক্ষন বাদে আবছা আবছা মনে পড়ল,বাস স্টপেজ। আমি রাস্তা দিয়ে হেটে আসছি গান গাইতে গাইতে,এখানে আসার পর দুটো ছেলে সামনে দাড়িয়ে এই বাড়িটার নাম্বার জিজ্ঞেস করছিল? ওরা কি আমাকে আঘাত করেছিল? যদি করেই থাকে তাহলে ব্যাথা নেই কেন? আমি কোথায় যাচ্ছিলাম?
বাসায় কি?
বাসা কোন দিকে?’বেশ কিছুক্ষন স্মৃতি হাতড়ে এদিক ওদিক ঘোলা চোখে তাকিয়ে অবশেষে বাসার পথ আবিস্কার করলাম। অনেক কস্টে কিছুটা পথ দেয়াল ধরে আর কিছুটা গাছের ডাল আকড়ে ধরে শরিরটাকে টেনে নিয়ে গেলাম আমাদের ফ্লাটের দরজার কাছে। কর্লিং বেল চাপতেই আন্দ্রে (লারিসার ছোট ভাই)এসে দরজা খুলল। করিডোরের উজ্জল আলোয় আমার যেন চোখ ঝলসে দিল।
-স্তো উস্তাবোই?(তোমার কি হয়েছে?) আন্দ্রের আর্ত চিৎকারে আমি চোখ তুলে চেয়ে দেখি,সে বিস্ফোরিত সপ্রশ্ন নেত্রে আমার দিকে চেয়ে আছে।
তার চাহনী দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম,ম্লান হেসে জিজ্ঞস করলাম
-কেন? কই নাতো কিছু হয়নি। আমার শুধু খুব ঘুম পাচ্ছে!
-লারিসা,মইন,মাম্মা,পাপা তাড়াতাড়ি এস দ্যাখ মিশু’র কি হয়েছে?’ প্রচন্ড চিৎকারে সে বাড়ি মাথায় তুলল।
সঙ্গে সঙ্গে মইন,লারিসা আর ওর বাবা মা ঘুম চোখে দৌড়ে এল,আমাকে দেখে মুহুর্তকাল থমকে দাড়িয়ে একসাথে আর্তনাদ করে উঠল
-আঃ ঈশ্বর আমার!তোমার এ দশা কেন? কি করে এমন হল?
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি নির্বাক হয়ে গেলাম! তখনও বুঝে উঠতে পারিনি আমার কি হয়েছে?
তড়িঘড়ি করে আন্দ্রে আর মইন আমাকে চ্যাংদোলা করে শোবার ঘরে ডিভানে নিয়ে বসাল।
লারিসা দৌড়ে গিয়ে একটা গামলা এনে আমার মুখের সামনে ধরল। মাথা নিচু করে আমি গামলার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম। আমার নাক মুখ দিয়ে গল গল করে বেরুচ্ছে উষ্ণ টাটকা রক্ত! কে যেন আমার চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিতে লাগল,কয়েক মিনিটেই রক্ত মাখা পানিতে গামলা ভরে গেল।
লারিসার বাবা ততক্ষনে ‘স্কোরা পামোঝ—এ’(দ্রুত সাহায্যকারী)ফোন করেছে। মিনিট পনেরর মধ্যেই ওরা এম্বুলেন্স নিয়ে চলে এল।এ্যাস্বুলেন্সে তুলে নেয়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে লারিসার সেকি কান্না! যেন শেষ বিদায় জানাচ্ছে। সেই অবস্থায় উল্টো আমি তাকে সান্তনা দিলাম।
গাড়ির মধ্যে স্ট্রেচারে শুয়ে মইনকে জিজ্ঞেস করলাম
-ক’টা বাজে?ও জানাল,
-পৌনে চারটা।
তার মানে আমি দুই—ঘন্টারও বেশী সময় ওখানে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম!
হাসপাতালের অপারেশন টেবিলে শোয়ানোর পরে স্বভাবতই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।কি এমন হয়েছে যে,অপারেশন করতে হবে?
তবে ম্যালা জখম হলেও আঘাত তেমন মারাত্মক ছিলনা।শুধু ঠোটের নিচে চারখানা সেলাই,বাম কপালে দুইখানা আর নাকের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় সেখানে বিশাল এক গজ ঢুকিয়ে প্লাস্টার করে দিল।
সেই দুর্ঘটনা দীর্ঘ প্রায় তিন সপ্তাহ আমাকে বিছানায় ফেলে রাখল। লারিসা ওর মা আর আন্দ্রের সেবা, ওর বাবার উদ্বেগ, আর মইনের সহচার্য ওদের প্রতি আমার ঋনের বোঝা শুধু ভারি-ই করেছে।
বোকাসোকা ‘রোন্দ্রে’ সারাক্ষন আশে পাশে ঘুর ঘুর করে- আর আমার খাটের কাছে এসে কি যেন গন্ধ শুঁকে। আমার সাথে চোখাচোখি হলে বেশ করুন চোখে তাকিয়ে থাকে।ভাবখানা এমন যে, আমার শরিরের ঘ্রানে বলে অতিচেনা কিন্তু চেহারায় মেলেনা।
নাকটা আমার ফুলে- উল্টিয়ে রাখা কোলা ব্যাঙ হয়ে গেছে। ঠোটের ভিতরে তিনটে সেলাই। খাওয়াতো দুরের কথা-পানি পানে ও কষ্ট হয়! কপালের ক্ষত মারাত্মক নয়-কিন্তু সারা মাথায় ব্যাথা।
বিছানায় শুয়ে আমার তখন দেশের প্রিয়জনদের কথা আর লিয়েনার কথা খুব বেশি মনে পড়ত! আশ্চর্য- সপ্তাখানেক চলে গেল লিয়েনা এসে দেখা তো দুরের কথা একবার ফোন ও করেনি। এর মাঝে কত পরিচিত অপরিচিত জন আসল। এমনকি এ বাড়ির অন্য দু’চারজন প্রতিবেশীও আমাকে দেখতে এসেছে। সিভেতা মাঝে মধ্যে এসে আসে পাশে ঘুর ঘুর করে। ও জানে ওর সাথে আমার প্রেম ভালবাসা নেই, হবেওনা কখনো। তারপরেও আন্তরিকতার টানে আসে। দু’একবার হাত ধরে চেহারায় দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে বসে থেকেছে।
আমি তখন স্বর্গের অপ্সরার প্রেমে মত্ত- মর্ত্যের নারির আহ্ববানে সাড়া দেই কেমনে?
অষ্টম দিন আমাকে চরম আবাক করে দিয়ে লিয়েনার আগমন।বা-হাতে একগোছা ফুল আর অন্য হাতে টার প্রিয় কুকুর ‘গোল্দি’।
আমার হাত ধরে আছে তখন সিভেতা। ওকে ঘনিষ্ঠ ভাবে বসতে দেখে মুচকি হেসে ‘
-কেমন আছো? বলে উল্টো দিকে ঘুরল। রোগীকে দেখতে এসে কুশলাদি ভাল করে জিজ্ঞেস না করে লারিসার সাথে সে পিয়ানোর রুমে বসে গল্প জুড়ে দিল।
সিভেতা'র সঙ্গ তখন আমার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছিল। মেয়েটা আর আসবার সময় পায়নি! আর আসবেই যখন এত হাত ধরে ন্যাকামোর কি আছে? আমি নিমিষে ভুলে গেলাম তার এত দিনের সহচর্য! আজকে সে ও যেন নাছোড় বান্দা।আমার এত স্বাদ আর আহ্বলাদে বপন করা ভালবাসার বীজ অঙ্কুরিত হতে আর দিবেনা হয়তো।
লিয়েনা সেদিন আর বেশিক্ষন থাকেনি। আমার অসুস্থ শরিরের নড়বরে হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে চুড়ে দিয়ে সে বিদায় নিল অল্পক্ষন বাদেই।
সেদিন থেকে আমার রোগ-শোক আরো বেশি বেড়ে গেল! সিভেতাকে দেখলেই আমি ভয় পেতাম। ভাবতাম সে ফের আমার হাত ধরলেই মনে হয় লিয়েনা এসে দরজায় দাড়াবে।
মইন মাঝে মধ্যেই বিকেল হলেই সেজে গুজে বাইরে যায়- ফেরে অনেক রাতে, মদ খেয়ে চুর হয়ে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না, হাসে শুধু। বলে কাম শেষ হলে জানাব। আপনি আগে সুস্থ হন।
ওর হাবে ভাবে বলে দেয়; এটা নারী ঘটিত কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু কি এমন লারিসা এমনকি আমাকেও গোপন করছে?
বিছানায় শুয়েই ফোন পেলাম; বড় ভাই ফোন করেছে। কানাডা থেকে। দীর্ঘ ছয় মাস বাদে তার সাথে কথা হল। আমাকে ফোনে পেয়েই সে বকা ঝকা শুরু করে দিল!
দীর্ঘ এই ছয়মাস আমি নিজের প্রতি অভিমান রাগে ও ঘৃনায় আত্মীয় পরিজনের সাথে একদম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কেঊ জানেই না আমি কোথায় আছি। একদম নিরুদ্দেশ করে ফেলেছিলাম নিজেকে। বাড়ির সাবাই কি পরিমান দুঃশ্চিন্তা আর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে সে নিয়ে আমার কোন বিকার ছিল না। নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারলেই যেন তখন বাঁচি।
রাশিয়ায় তখন যোগাযোগ চাট্টিখানি কথা না। অন্য দেশ থেকে এক সপ্তা ডায়াল ঘোরালে একবার সংযোগ মেলে কি না মেলে। চিঠি যেতে মাস খানেক লাগে- তারপরে যদি সঠিক ঠিকানা থাকে। বড় ভাই আমার কোন খোঁজ না পেয়ে তার কোন এক বন্ধুর নাকি ভাই মস্কোতে থাকে- তাকে ধরেছে। সে মাস খানেক খোঁজ খবর নিয়ে লারিসার বাসার ফোন নম্বর নিয়ে ভাই-কে দিয়েছে।
আমি আমার দুর্ঘটনার কথা গোপন করলাম । সে আমার দুরবস্থার কথা শুনে একচোট ঝেড়ে নিল। টাকা গেলে আমার গেছে- তোর এত ভাবাভাবির দরকার কি। তোর সেমিস্টার ফি কত- আর কোন ঠিকানায় টাকা পাঠাতে হবে বল? আমি সামনের সপ্তাহেই টাকা পাঠিয়ে দিব।
বড় ভায়ের ভালবাসা আর আন্তরিকতায় সিক্ত হয়ে আমার চোখের কোনে জলের ধারা। এতদিন পরে নিজেকে অপরাধী মনে হল।
তবে অন্যদেশ থেকে রাশিয়ায় টাকা পাঠানো তখন চাট্টিখানি কথা নয়। সে টাকা আসতে কয়েক মাস লেগেছিল। এর থেকে কানাডায় হেটে গিয়ে নিয়ে আসলেও মনে হয় ভাল হত...
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:২১