ভুমিকাঃবয়স্ক বা বৃদ্ধ মানুষ নাকি সমাজের বোঝা! উন্নত দেশগুলো নাকি সচেতন ভাবে করোনা’র মত PENDEMIC ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে এদেরকে সমুলে বিনাশ করতে চাইছে।এটা সত্য হোক বা মিথ্যা এই ভাইরাসে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত বা মৃত্যুর তালিকার শীর্ষে এইসব বয়স্ক বা বৃদ্ধ মানুষেরাই! পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া সেইসব মানুষদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। এরা যৌবনে এই সমাজ এই পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে- তাদের এই চরম দুঃসময়ে আমরা তাদের কাছে থাকতে পারিনি- সাহস যোগাতে পারিনি,ভেবেছি এইসব আপদ বিদায় হওয়া শ্রেয়। আমরা ভাবি এই পৃথিবী শিশু আর যুবকদের শুধু- বৃদ্ধ যারা,যাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে,তারা থাকলেই কি আর চলে গেলেই কি! আসলেই কি তাই? তাদের কি কোন প্রয়োজন নেই এই পৃথিবীর?
লিয়েভ নিকোলাভিচ তলস্তয়ের বা এল এন তলস্তয় বা লিও টলস্টয়-এর সংগৃহীত অনেক ঈসপের গল্প আমরা শুনেছি; মহান এই লেখক শুধু সাহিত্য, উপন্যাস আর ঈসপের গল্পই রচনা করেননি তিনি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে গেছেন সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রচুর উপকথা বা লোকগাথা!
৫০ এর দশকে 'রাদুগা' প্রকাশনী থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন কোনা থেকে সংগৃহীত লোকগাথা, উপকথা, রুপকথা মিলিয়ে ‘গোরা ছামোসভেতভ’ (гора самоцветов-Mountain of gems-রত্নের পাহাড়)নামে сказки народов (folk tales –গাঁও গেরামের গল্প)-এর একটা সংকলন বের করেছিল ( মুল গল্পের বইগুলো ছিল; রাশিয়ান লোক কাহিনী, জর্জিয়ান লোক গল্প, মালদোভিয়ান ও ইউক্রেনীয় লোক কাহিনী)। এত ভিন্নধর্মী বিশাল কলেবরের লোক-কাহিনী বা গাঁও-গেরামের গল্প আর কোন দেশের আছে কিনা আমার জানা নেই। ‘গোরা ছামোসভেতভ’ এ মোট ৪৮ খানা গল্প আছে। এর কিছু বাংলায় অনুবাদ হয়েছে- কিছু হয়নি। আমি চেষ্টা করছি পুরো বইটা অনুবাদ করতে।
যেখানে তলস্তয়ের মত মহান লেখকের হাত আছে সেটা নিশ্চিতভাবে অতি উত্তম কিছু হবে সেটা নিশ্চিত- তবু আমি অনেক কিছু লেখায় কাটছাট করেছি সংযোজন বিয়োজন করেছি; আমাদের দেশের পাঠকদের পাঠ উপযোগী করার জন্য। পাঠকরা আমার সেই দুঃসাহস ও দুষ্কর্মকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করছি।
পুরো বইয়ের এই লেখাটা আমার বেশ পছন্দের মুলত; গল্পের মর্যা লিটির জন্য। возраст мудрость বা Age is Wisdom- এর বাংলা মানানসই শিরোনাম আমি খুঁজে পাইনি। পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞতা- কোন শব্দই মনঃপুত হয়নি।
দয়া করে কেউ যদি গল্পটার শিরোনামের ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা করেন তো কৃতার্থ হব।
----------------------------------------------------------------------------------------------AGE IS WISDOM
একজন প্রচন্ড ক্ষমতাবান ও স্বেচ্ছাচারী রাজাকে নিয়ে এ গল্প যার ডাক নাম ছিল ‘সানাদ খান’।
পুরোনো কোন কিছুই তার বেশীদিন ভাল লাগত না। বছরের পর বছর একই রাজ্যে থাকতে থাকতে সে হাঁপিয়ে উঠছিল। একবার তার ইচ্ছে হল সব প্রজা পাইক-বরকন্দাজ মন্ত্রী-শাস্ত্রীদের নিয়ে দেশ বিদেশ ভ্রমন করার। তখন কার দিনে বাহন বলতে ছিল ঘোড়া কিংবা হাতি। রাস্তাও ছিল বেশ বিপদসঙ্কুল! এত চড়াই উৎড়াই পাহাড় নদী পাড়ি দেয়াতো সবার কম্মো না - তাই তিনি স্থির করলেন শুধু শক্ত সামর্থ যুবারাই তার সাথী হবে। বাকী সব অসমর্থ বৃদ্ধ রোগীদের হত্যা করতে হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। রাজ্যের সবখানে ঢেড়া বাজিয়ে প্রচার করা হোল রাজার নির্দেশ। রাজার রাগ ছিল সবচেয়ে বেশী বৃদ্ধদের উপর। তার ধারনা এরা সবাই শুধু বসে বসে অন্ন ধ্বংস করছে –কারো কোন কাজে আসছে না,অতএব এদেরকেই হত্যা কর সবার আগে। নির্দেশ অমান্যকারীকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে বলে ঘোষনা দেয়া হোল।
রাজার এই সিদ্ধান্তে চারিদিকে ভীষন শোরগোল পড়ে গেল। প্রজারা রাজার এ অমানবিক ঘোষনায় ভীষন কষ্ট পেলেও ছিল নিরুপায়। রাজার আদেশ অমান্য করার মত দুঃসাহস তাদের ছিলনা।
সবপ্রজারা রাজার নির্দেশ মেনে নিতে বাধ্য হলেও একমাত্র সাহসী যুবক জাইরান আদেশ অমান্য করে তার বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করল না।
সে তার পিতাকে বলল,
- আমি তোমাকে বিশাল এক চামড়ার থলেতে লুকিয়ে সানাদ খান ও তার সৈন্যদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যাব তারা যেখানে যায় ।
-যদি ধরা পড়ে যাও?’ বৃদ্ধ ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।
-তেমন কিছু ঘটলে তখন দেখা যাবে। এখন এই নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
কিছূদিন বাদে সানাদ খান তার দলবদল আর পশুর পাল নিয়ে উত্তরের বহুদুরের দুর্গম পথে রওনা হল।
জাইরান তার বৃদ্ধ পিতাকে একটা চামড়ার থলেতে পুরে ঘোড়ার পিঠে চেপে তাদের সাথে চলল। কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পেলনা থলের মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা বুড়ো মানুষ। সারাদিন নিজেকে দেয়া খাবারের কিছূ অংশ জমিয়ে রেখে জাইরান গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন চুপি চুপি থলে থেকে তার বাবাকে বের করে খেতে দেয়।
বহু বহুদুর ভ্রমনের পর সানাদ খানের নির্দেশে তারা অবশেষে ক্যাম্প গাড়ল তিনদিকে পাহাড়ে ঘেরা ছবির মত সুন্দর এক সাগর পাড়ে।
একদিন রাজার এক বিশ্বস্ত সহচর হাওয়া খাচ্ছিল। আচমকা সাগরের উচু পাড় থেকে তার নজরে এল, সাগরের গভীর তলদেশে অদ্ভুত উজ্জল কৌতুহলী একটা কিছু চমকাচ্ছে। কৌতুহলী হয়ে আরো কাছে গিয়ে বেশ খানিক্ষন নিরিক্ষন করে তার নজরে এল কিম্ভুত আকৃতির বড়সড় এক সোনার পেয়ালা পড়ে আছে সাগরের তলদেশে।
এটা নিঃশ্চই রাজার সম্পত্তি। সে ভাবল, তাহলে সবার আগে রাজাকেই এই খবরটা জানাতে হয়।
রাজার কানে চেরাগের খবর পৌছুতেই রাজা ভীষন উৎফুল হয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের আদেশ করলেন, পেয়ালাটা এক্ষুনি তার চাই। যেমন করে হোক সেটা তুলে নিয়ে এস।
কিন্তু কেউই সাহস করছিলনা সাগরের অত গভীর থেকে পেয়ালাটা তুলে আনতে। রাজা আদেশ দিল সাগরে ডুব দিতে কেউ রাজী না হলে সবাইকে এক এক করে সাগরে ছুড়ে ফেল।
যেই কথা সেই কাজ-রাজার সহচরেরা তাবু থেকে লোকদের ধরে ধরে এনে স্বেচ্ছায় রাজী না হলে ছুড়ে ফেলতে লাগল সাগরে। কিন্তু সোনার পেয়ালা উদ্ধার তো দুরের কথা যে একবার সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ল- সে আর ফিরে এলনা।
এমনি করে সানাদ খানের বহুলোক সাগরে ডুবো চোরা পাহাড়ে আঘাত পেয়ে ডুবে মারা পড়।
কিন্তু সানাদ খানের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সোনার পেয়ালাটা তার চাই ই চাই।এমনকি সবার জীবনের বিনিময়ে হলেও চাই।
অবশেষে একদিন জাইরেনের ডাক পড়ল। রাজার শাস্ত্রীরা এসে বলে গেল সোনার পেয়ালাটা উদ্ধারের জন্য কাল সকালে ওকে সাগরে ঝাঁপ দিতে হবে। স্বেচ্ছায় যেতে না চাইলে জোর করে নিয়ে যাবে।
জাইরেন ভাবল,আর রক্ষে নেই এইবারই তাকে মরতে হবে গভীর রাতে পিতাকে চুপিচুপি থলে থেকে বের করে বলল, তার সেই সম্ভাব্য শোচনীয় পরিনতির কথা;
- বাবা,আজই হয়তো আমাদের শেষ দেখা! আমাদের দু’জনকেই মরতে হবে ।
- কেন তুমি এরকম বলছ? কি হয়েছে?
জাইরেন সোনার কাপ উদ্ধারের ঘটনা বিস্তারিত বর্নণা করে বলল ,
- এবার এসেছে আমার সমন। মৃত্য অবধারিত আমার। আর আমারে মৃত্যুর পরে সানাদ খানের সৈন্যরা তোমাকে খুঁজে পেয়ে মেরে ফেলবে।
বৃদ্ধ বেশ মনোযোগ দিয়ে তার ছেলে মুখথেকে পুরো ঘটনাটা শুনল।
- এই ভাবে যদি চলতে থাকে বাবা। তাহলে শুধু আমি তুমি না,এরাজ্যের সবাই একসময় সাগরে ডুবে মারা পড়বে। কিন্তু সোনার পেয়ালার খোঁজ কেউ কখনোই পাবে না।’বৃদ্ধ বলল।
- সাগরের তলদেশে কোন কোন পেয়ালা নেই। চাঁদের আলোয় ভাল করে চেয়ে দেখ সাগর পারের সেই উঁচু পাহাড়ের চুড়োর দিকে। কাপটা আসলে ওখানেই। তোমরা সাগরে যা দেখছ ওটা শুধুমাত্র সেই কাপের প্রতিচ্ছবি ।
জাইরেন বিস্ময়ে হতবাক!
- আরে তইতো। ইস্ রাজ্যের বাকী লোকেরা কি বোকা! সাগরের তলদেশ থেকে সোনার পেয়ালা কিভাবে চমকাবে? অত গভীরেতো সুর্যের আলো গিয়েই পৌছায় না!’ সে বাপের কাছে পরামর্শ চাইল,
- এখন তাহলে আমি কি করব বাবা?
- পাহাড় বেয়ে চুড়া থেকে সেই পেয়ালাটা এনে রাজাকে দাও।’ বৃদ্ধ দম নিয়ে একটু স্মিত হেসে বলল,
সোনার পেয়ালা’টা কোথায় আছে এটা বের করা খুব একটা কঠিন কাজ না। কিন্তু পাহাড়ের চুড়ো থেকে ওটাকে নামিয়ে আনা খুব কঠিন। তুমি তাকিয়ে দেখ কত উঁচু আর খাড়া ওই পাহাড়। ওই পাহাড় বেয়ে চুড়ো থেকে পেয়ালাটা নামিয়ে আনা তোমার দ্বারা অসম্ভব। এর থেকে এক কাজ কর -দেখতে পাচ্ছ কত গাংচিল ডিম পাড়ার জন্য বাসা বেধেছে ওই পাহাড়ের শিখরে। তুমি প্রথমে যতটুকু সম্ভব পাহাড় বেয়ে ওই পেয়ালার কাছে গিয়ে পৌছুবে -তারপর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করবে তোমায় দেখে পালিয়ে যাওয়া পাখিদের নীড়ে ফিরে আসার জন্য। কতকগুলো পাখি একখানে হলেই আচমকা দিবে চিৎকার- ভয় পাওয়া পাখিদের ডানার ঝাঁপটায় চুড়ো থেকে গড়িয়ে পড়বে তোমাদের ওই কাঙ্খিত সোনার পেয়ালা। তবে সাবধান একটু এদিক ওদিক হলেই কিন্তু চিরতরে সাগরের গভীরে হারিয়ে যাবে ওটা।
বৃদ্ধ পিতার পরামর্শে জাইরন পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল। কিন্তু যত কঠিন ভেবে ছিল তার থেকে অনেক বেশী কষ্টসাধ্য ও ভয়ঙ্কর এ পাহাড়ে বেয়ে উপরে ওঠা। হাঁচড় পাঁচড় করে উঠতে যেয়ে ধারালো পাথরের আঘাতে শরির হল ক্ষত বিক্ষত। যেখানে জীবনই ছিল সংশয়ের মুখে সেখানে কষ্ট হলেও সামান্য কাটা ছেড়াকে জাইরন বিন্দুমাত্র আমলে না এনে দ্বীগুন উদ্যোমে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকল। বৃদ্ধের আশংকাকে সত্যি প্রমিনিত করেই সে পেয়ালা থেকে হাত পঞ্চাশেক দুরে থাকতেই থেমে যেত বাধ্য হর এখানে পাহাড়টা খুব বেশী খাড়া হয়ে উল্টোদিকে কিছুটা বেঁকে গেছে,অতএব অপেক্ষা করা ছাড়া গতান্তর নেই। অপেক্ষা করতে হবে পাখিদের নীড়ে ফেরার জন্য। সে ভাগ্যবান যে সামান্য সময় পরেই পাখির দল তাদের বাসায় ফিরতে শুরু করল।
পাখির জমায়েতটা জমে উঠতেই সে আচমকা ভীষন জোড়ে চিৎকার করে উঠল। এমন বিকট চিৎকারে পাখির দল ভয় পেয়ে দিগি¦দিক্ জ্ঞান শুন্য হয়ে ছুটোছুটি করতে যেয়ে অস্থির ডানার ঝাপটায় চুড়ো থেকে গড়িয়ে পড়ল রাজার সেই পরম কাঙ্খিত সোনার পেয়ালা। সৌভাগ্যক্রমে সেটা গড়িয়ে আসছির তার দিকেই। হাতের নাগালে আসতেই সে খপ্ করে ধরে ফেলল সেটা।
জাইরন পেয়ালাটা সযত্নে রাজার দরবারে পেশ করলে রাজা চরম পুলকিত হলেও দারুন বিস্মিত হল।
- তুমি কিভাবে বুঝলে যে সোনার পেয়ালাটা ওই পাহাড়ের চুড়োয় আছে? আর বুঝলেও ওখান থেকে এটা কি কৌশলে নিয়ে এলে?
জাইরন প্রতিউত্তরে পাহাড় বেয়ে পেয়ালা উদ্ধারের ঘটনাটা সবিস্তারে বর্ণনা করে,বেশ বিনয়ের সাথে বলল,
- মহারাজ এক দৈব শক্তি এসে গতরাতে আমাকে কৌশলটা বাতলে দিয়ে গেছে।
সানাদ খান জাইরানের কথা বিশ্বাস করলেন কিনা বোঝা গেলনা। তবে তিনি আর কোন প্রশ্ন নাকরে ওকে বিদায় দিলেন ।
কিছুদিন পরেই রাজা তার দলবলকে আদেশ করলেন তাবু গোটাতে। ফের শুরু হল অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যাত্রা।
মাঠ ঘাট নদী পাহাড় পেরিয়ে অবশেষে তারা এসে পৌছুল এক উষর মরু প্রান্তে। সুর্যের প্রচন্ড উত্তাপে ধরাধাম যেন জলন্ত চুল্লি,কোথাও সবুজ পাতা বা ঘাসের চিহ্ন মাত্র নেই! সানাদ খান তার দলবল আর পশুর পাল নিয়ে পড়লেন মহা বিপদে -একফোটা পানিও নেই কোথাও! প্রচন্ড তৃষ্ণায় কাহিল হয়ে পড়ল সবাই। রাজা তার সহচরদের আদেশ করলেন, যে করেই হোক পানি যোগাড় কর না হলে যে মারা পড়বে সবাই। রাজার হুকুম পাওয়া মাত্র শত শত অশ্বারোহী সৈন্য মরুভুমি তন্ন তন্ন করে খুজেও একফোঁটা পানির সন্ধান দিতে পারলনা - শুধু মরিচিকার পিছনে ঘোরাই সার হল। কেউ কেউ চিরতরে হারিয়ে গেল সেই বিশাল ভয়ঙ্কর মরুভুমির বুকে ।
জাইরান সেদিন রাতেও চুপি চুপি এসে তার বাবাকে এসে বলল,
-এখন আমাদের কি হবে বাবা? আমরাতো সবাই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় এই মরুভুমিতেই মারা পড়ব,সাথে সাথে এই পশুর পাল-ও।
প্রতিউত্তরে তার বৃদ্ধ বাবা বলল,ভয় পেওনা! বছর তিনেক বয়েসী একটা বাছুর ছেড়ে দিয়ে তার দিকে খুব কাছ থেকে নজর রাখ। যেখানে সে দাড়িয়ে মাটির গন্ধ শুকতে শুরু করবে,সেই খানে অবশ্যই খনন করবে।”
জাইরেন তার বাবার কথামত তিন বছর বয়েসী একটা বাছুরকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে নজর রেখে দারুন বিস্ময়ের সাথে সেটা কি যেন খুঁজে ফিরছে একখান থেকে অন্যখানে। কিছুদুর যেতেই আচমকা থমকে দাড়িয়ে মাটির গন্ধ শুকতে শুরু করল। সে উল্লসিত হয়ে দৌড়ে তাবুতে ফিরে এসে সবাইকে ডেকে বলল,তোমরা ওখানকার মাটি খুঁড়লেই পানি মিলবে।
সোনার কাপ খুজে এনে দেয়ায় জাইরেনের উপর এমনিতেই সবার বেশ আস্থা ছিল। তার কথায় কেউ দ্বী-মত না করে তক্ষুনি সবাই মিলে সেখানে গিয়ে খুড়তে শুরু করল।
অল্প কিছুক্ষন খুড়তেই মটির নীচ থেকে উদ্গীরিত হল স্বচ্ছ ঠান্ডা পানির প্রস্রবন! আঃ কি আনন্দ তখন চারপাশে।
রাজার কানে এখবর পৌছুতে দেরী হলনা। তার তাবুতে তদন্ডেই ডাক পড়ল জাইরানের। জাইরান যেতেই রাজা প্রশ্ন করলেন’ তুমি কিভাবে বুঝলে এই উষর মরুভুমির ঠিক ওইখানটাতে পানি আছে?
প্রতিউত্তরে জাইরান বলল,কোন দৈবিক নির্দেশনায় আমি জেনেছি ,হুজুর।’
সানাদ খান এবারও কিছু না বলে তাকে যেতে বললেন।
প্রান ভরে পানি পান করল সবাই। প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশী-ই। আহা কেন পান করবেনা,কতদিন ধরে তৃষ্ণার্ত ওরা। পরদিন সকালেই তাবু গুটিয়ে ফের শুরু হল ভ্রমন। দিনের পর দিন বহু পথ হাটার পরে অবশেষে মরুভুমি শেষ হল।
মরুভুমি পেরিয়ে কিছুদুর এগুতেই নয়ানাভিরাম তৃনভুমি দেখে রাজার আদেশে সবাই নতুন করে তাবু ফেলল সেখানে।
তখন শীত সমাগত। রাশিয়ার শীত বড় ভয়াবহ। শীতের আগে চলে অবিরাম বর্ষন। ধীরে ধীরে সেই তরল ধারাগুলো বরফ কনা হয়ে ঝরে পড়ে । দিনের আকাশ পরিস্কারই ছিল । রাতে আচমকা শুরু হল বৃষ্টি,সেই সাথে তুমুল ঝড়ো হাওয়া! ঝড় বৃষ্টির দাপটে শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওদের শিবিরের অরক্ষিত আগুন মুহুর্তেই নিভে গেল। তখনকার সময়েতো দেয়াশলাই ছিল না,পাথরে পাথরে ঠুকে বা শুকনো কাঠে ছোট্ট ফুটো করে তার ভিতরে আরেকটা গোলাকার কাঠ বা বাশের দন্ড ঢুকিয়ে দু’হাতের তালূর সাহায্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে আগুল ধরাতো।
ঝড় বৃষ্টিতে মুহুর্তই সবকিছূ ভিজে একাকার। ফের আগুন জ্বালানোর মত কোন সরঞ্জামই তাদের শুকনো নেই । ওদিকে শীতের প্রকোপে যেন হাড় জমে যাছে।
ঠিক সেই মুহুর্তে কেউ একজন এসে খবর দিল দুর পাহাড়ের মাথায় ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত ওখানে গেলে আগুন মিলবে।
রাজা তক্ষুনি হুকুম দিলেন যে করেই আগুন নিয়ে আস। শুধু রাজার হুকুম না জান বাঁচানোর তাগিদেই তখুনি কয়েকজন পড়িমড়ি করে ছুটল আগুনের উৎস’র সন্ধানে। বহু কষ্টে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠেই খুশীতে সবার মুখ ঝলমল করে উঠল । অনতিদুরেই এক শিকারী বিশাল এক পাইন গাছের নীচে বসে আগুন জ্বেলে তাপ পোহাচ্ছে। শিকারীকে অনুরোধ করে সবাই মিলে তার থেকে প্রজ্জলিত একটা কাঠের টুকরো নিয়ে শিবিরে ফিরে আসতে গিয়েই পড়ল মহা বিপদে। ঝড়ো হাওয়ার দাপটে সামান্য পথ এগুতেই সেটা নিভে গেল। কি আর করার সবাই ফিরে গেল আবার সেই শিকারীর কাছে আগুনের প্রত্যাশায়। শিকারীও বিমুখ করলনা তাদের। কিন্তু সমস্যাতো অন্যখানে -একটু এগুতেই আগুন নিভে যায়।তারা বহু চেষ্টা করেও ক্যাম্পে আগুন নিয়ে আসতে পারলনা।
অবশেষে সানাদের দরবারে ফিরে এসে তাদের এই অপারগতার কথা জানাতেই সানাদ খান ভয়ানক ক্রুদ্ধ হলেন। যে করেই হোক আগুন তার চাই চাই। নির্দেশ দিলেন এক এক করে সবাইকে পাঠাতে। আগুন নিয়ে ফিরে আসতে নার পারলে তাদেরকে হত্যা করা হবে।
রাজা বলে কথা! সানাদের নির্দেশ তখুনি পালন করা হল।
যে যায় আর ফিরে আসে না। সবারই একই অবস্থা। কিছুদুর আসতেই আগুন নিভে যায়। সানাদের সৈন্যের হাতে মরার থেকে পালিয়ে যাওয়া ভাল। এই ভেবে একবার যে গেল সে আর ফিরে এলনা।
সবার মত এক সময় জাইরেনের ডাক পড়ল। সে এবার বেশ ভীত হয়ে চুপি চুপি তার বাবার কাছে এস করুন কন্ঠে বলল’ এবার হয়তো মরতেই হবে। কি করে সম্ভব এই ঝড়ের দিনে পাহাড়ের চুড়া থেকে গাছের ডালে করে আগুন নিয়ে আসা?’ জিজ্ঞেস করল।
‘সম্ভব।’
সে দারুন বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল ‘কি করে?’
‘কখনই কাঠের টুকরো বা শুকনো ডাল নিয়ে যাবে না আগুন আনতে। ওটা শুধু ছাই আর ধোঁয়া-ই দিবে। বৃষিটর ছাট আর ঝড়ো বাতাসের তোপে আগুন নিভবেই। সাথে করে বড়সড় একটা পাত্র নিয়ে যাও। ওর মধ্যে ঠেসে ভরবে আগুন জালানোর শুকনো কয়লা। এই দুর্যোগের দিনে তুমি এ ভিন্ন অন্য কোন উপায়ে এখানে আগুন আনতে পারবেনা।
জাইরেন তার বাবা যেভাবে বলেছিল ঠিক সেই উপায়ে সফলতার সাথে পাহাড় থেকে আগুন নিয়ে এল ক্যাস্পে। সে আগুনে হল ক্যাম্প ফায়ার। সবাই মনের সুখে তাপ পোহাল। আর উনুন জ্বালিয়ে হল স্বুসাদু রান্না।
এবারও সানাদ খানের কানে এখবর যেতেই তিনি জাইরেনকে ডেকে পাঠালেন। তার রাজদরবার নামক বড়সড় তাবুতে।
জাইরেন আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,তুমি কিভাবে জানলে অমনি করে খুব সহজেই আগুন আনা যাবে ?’
প্রতিউত্তরে জাইরেন কিছু না বলে চুপ করে রইল।
সানাদ খান গর্জে উঠলেন ‘কথা বলছ না কেন?’
‘কেননা আমি আমি যা করেছি তার সন্মন্ধে আগেভাগে কিছুই জানতামনা।’
‘তাহলে কি করে করলে? কিভাবে?’
তার মুর্হুমুহু জেরার মুখে জাইরেন অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হল। এসবই বলেছে তার বৃদ্ধ বাপ। সে শুধু তারই আদেশ মত কাজ করেছে।
‘কোথায় তোমার বাবা?’
‘আমি তাকে সারা রাস্তা একটা বড় চামড়ার থলেতে করে বয়ে এনেছি।’
সানাদ খান তার সহচর দের আদেশ করলেন সেই বৃদ্ধকে এখানে এনে হাজির করার জন্য। সেই সাথে তিনি ঘোষনা করলেন ‘আমি আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ বাতিল করছি। বৃদ্ধরা কোন দেশ বা দেশের মানুষের বোঝা নয়।’বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে।একটা দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে যেমন প্রয়োজন যুবকদের উদ্দীপনা অমিত সাহস আর অফুরন্ত শক্তি - তেমনি প্রয়োজন বৃদ্ধদের অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধি।
ওঁকে লুকিয়ে রাখার দরকার নেই। তাকে ঘুরতে দাও সবার মত খোলা প্রান্তরে।’
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১৭