গ্রীস্মের এক বিকেল আঠার তলায় রেলিঙ ছাড়া, কোমর উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বারান্দায় আমরা তিন বন্ধু দাড়িয়ে দাড়িয়ে গুলতানি মারছি। কোন কাম কিংবা আকাম না থাকলে এরকম মাঝে মধ্যেই দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করি।
আকাশ ছোয়া বেশ পুরনো এপার্টমেন্টটার সামনে বেশ বড় একটা লন। বাগান নয় কিন্তু বাগানের আদলে গড়া সেই জায়গাটুকুতে এলোমেলো ভাবে ছড়ানো কয়েকটা কাঠের পিঠ হেলান দেয়া বেঞ্চি।ওডেসা শহরটা বেশী বড় না হলেও বেশ গোছানো ছিমছাম-প্রচুর গাছ-গাছালিতে ভরপুর। গ্রীস্মের এই সময়টা দারুন। রাত দশটাতেও এখনো বিকেল-কিংবা সন্ধ্যাও বলা যায়।
নীচের সেই বেঞ্চির একখানা দখল করে আমাদের সংখ্যার সাথে সাদৃশ্য রেখে ঠিক তিনজন রুশ উর্ব্বশী গাল গল্পে মেতে উঠেছে। দুইজন সম বয়সী আর বাকিজন ছোটখাট গড়নের। বয়স এত দুর থেকে অনুমান করা কষ্ট।
তাদের গল্পের বিষয়বস্তু জানা সম্ভব না হলেও –মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হাসির শব্দে মনে হচ্ছে মজার কোন গল্প হচ্ছে।
তবে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে-গল্পের ফাঁকে ফাকে তারা তিনজনই ঘাড় উঁচু করে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে।
এদিকে আমরা এমন সুযোগ মিস করতে চাইনা কোনমতেই। আমি চোখ ঈশারা করে বললাম,
-দোস্ত চল যাই। বন্ধুর আমার মন মরা ভাব তখনো যায়নি। প্রচলিত প্রেম ভালবাসার প্রতি তার টান উঠে গেছে। আমি ভয়ে ভয়ে আছি কবে আবার সে সাধু-সন্ত হয়ে না যায়। তাহলে আমার কি হবে? আমি যে অনাথ হয়ে যাব!
সে যেতে চায় না। বলে,
-তোর এত সখ লাগে তুই গিয়ে কথা বল।
আমি বললাম, -তিনজনকে আমি একা কেমনে সামলাব?
অনেক বাৎচিতের পরে ইমোশনাল কালোপত্র(ব্লাকমেইল) দিয়ে/করে তাকে রাজী করালাম!
কিছুক্ষন চোখাচোখি করে আচমকা নড়বড়ে লিফট বেয়ে নেমে গেলাম নীচে। লাজ-শরমের বালাই তেমন ছিলনা তখন। ভাষাগত সমস্যার কারনে উজ্জ্বল যেতে কুন্ঠা বোধ করে, ববির মন খারাপ- কয়েকদিন উপবাসে যাবে!
অগত্যা আমি এগিয়ে গিয়ে সব'চে সুন্দরী মেয়েটার মুখোমুখি দাড়িয়ে হেসে বললাম,কেমন আছো?
মেয়েটা একটু হকচকিয়ে গেলেও হেসে ফেলল পরক্ষনেই,
-এইতো ভাল। কি নাম তোমার?
-আমি সৌম্য! আর ওরা আমার দু বন্ধু ববি আর উজ্জল। তোমার নাম কি?
-রেনেতা। আর ও হচ্ছে (তার পাশে দাড়ানো একটু লাজুক চেহারার হৃষ্টপুষ্ট গড়নের লাল কোকড়া চুলের মেয়েটাকে ইশারা করে বলল)ভারোনিকা,আর এই পিচ্চিটা’র(দারুন ফিগারের ছোটখাট গড়নের কালো চুলের বুদ্ধিদীপ্ত চোখের মেয়াটার দিকে চেয়ে হেসে বলল)এই পাশের এপার্টমেন্টে থাকে ‘অকসানা’।
কত সহজেই পরিচয় পর্ব শেষ! নিজের স্মার্টনেসে আমি নিজেই বিমোহিত। রাশিয়ান মেয়েদের এজন্যই এত ভাল লাগে আমার। কোন ভনিতা নেই।নতুন কারো সাথে পরিচয় হতে কোন দ্বীধা নেই। ভাল লাগলে সরাসরি বলে দিবে ‘ভালবাসে’। তবে প্রতিটা প্রক্রিয়ারই সমান ও বিপরিত প্রক্রিয়া যেমন থাকে ঠিক এখানে সেই সুত্রের ব্যতিক্রম নেই। শুরু যেমন হয় ঝড়ের গতিতে শেষটাও তেমন না হলেও দমকা হাওয়ার মত মিলিয়ে যায়।
যাহোক ফিরে আসি সেই প্রসঙ্গে;এই ভাবে গাল গল্পে হাসি-তামাশায় চলল কিছুক্ষন। দিন অনেক হয়ে গেছে (রাত প্রায় এগারটা তখন কিন্তু দিনের আলো মিলিয়ে যায়নি তখনো- তাই রাত অনেক হয়ে গেছে বলি কিভাবে)বাড়ি ফিরতে হবে। আমাদের দিন-রাতে কখনোই তাড়া নেই। বিশেষ একটা মিশনে এসেছি যা ভ্রমনেরই ভিন্নরুপ-তাই বেকারই বলা চলে। কিন্তু ওদের যেতে হবে। বিদায় নেবার আগে সিনেমা দেখার নিমন্ত্রন করলাম। যার সাথে প্রথম পরিচয় সেই-ই এদের লিডার মনে হল। সে হেসে সম্মতি জানাতেই বাকি সবাই ঘাড় হেঁলিয়ে সম্মতি দিল।
পরদিন বিকেলের মুভি দেখার ইচ্ছে সবার। নিজের রুমে ফিরে আড্ডায় বসলাম।ওরা তিনজন আবার আমারাও তিনজন মিলে গেছে বেশ কিন্তু সমস্যা হলকে কার সাথে জুটি বাধবে। কাল তো জোড়ায় জোড়ায় বসতে হবে। আমি আগ বাড়িয়ে কথা বলেছিলাম বলেই হয়তো আমার দু-বন্ধু দয়াপরবশতঃ হয়ে যার সাথে পরিচয়ের শুরু মানেই সেই সুন্দরী রেনেতাকে আমার সঙ্গী নির্বাচন করল। আর হৃষ্ট-পুষ্ট ভারোনিকাকে বেছে নিল আমার হৃদয়বান বন্ধু উজ্জল। আর আমাদের মধ্যে সুদর্শন ববি বাচ্চাটাকে নিল নেহায়েৎ করুনা করে-আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে।
পরদিন বিকেলে ফের মিলিত হলাম। পিচ্চিটা একটু দেরি করছিল বলে রেনেতা গেল তার বাসায় ডাকতে। খানিক বাদেই ফিরে আসল ওকে নিয়ে। শর্টস আর টি শার্টে ওকে আরো বেশী ছোট মনে হচ্ছিল। যাই হোক ববি তাকে খপ করে বগল দাবা করে নিয়ে হেটে চলল- সেও কিছু বলল না, যেন কত দিনের পরিচিত এই রকম হাসতে হাসতে এগিয়ে চলল। রেনেতা সরাসরি আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,চল যাই। ভাবটা এমন আমাদের ভাগাভাগি যেন ওদের সাথে যুক্তি করে হয়েছে। ক্যামনে ক্যামনে যুগল সাজান হয়ে গেল। সবার মনেই চরম ফূর্তি ফুর্তি ভাব।
এই ভাবে চলল প্রণয়ের প্রথম পর্ব। প্রথমে সময় বেধে সামনের লনে কিংবা পার্কে। কিছুদিন বাদে ওরাই চলে আসত লিফটে করে সরাসরি আমাদের বারান্দায়। বারান্দাটা ঘরের বাইরে কমন। সেখানে দাড়াতে কোন সমস্যা নেই। গল্প চলে গভীর রাত অব্দি- মাঝে মধ্যে এ ও গিয়ে বাসায় দেখা করে আসে।
ববির সাথে অকসানার জমল না বেশিদিন। দুজনের মানসিকতা আর গঠন গড়নের পার্থক্য অনেক-তাছাড়া অকসানা প্রচন্ড দুরন্ত,ববি হিমসিম খেয়ে যায় তাকে সামলাতে।
আঠার মত জোড়া বেধে গেল উজ্জলের সাথে ভারোনিকার’। ফাঁক পেলেই এখান থেকে ভেগে যায়। মোটামুটি তখন থাকি শুধু একেলা আমি আর রেনেতা। কত গল্প কত গুজুর গুজুর ফুঁসুর ফাঁসুর আর হাসি ঠাট্টা মজায় কেটে যায় দিন...
অবশেষে একদিন রেনেতা তাঁর বাসায় নিয়ে তার পরিবারের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। তাদের আউট ডোরের কমন বারান্দাতেই আড্ডা দেই বেশ কিছুদিন হল কিন্তু ওদের কারো সাথে এর আগে দেখা পর্যন্ত হয়নি।
এতবড় রুশ উক্রাইনান কিংবা মলদোভিয়ান পরিবারের সাথে এর আগে পরে আমার পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি।
বাসাতো নয় যেন কচিকাঁচার আসর। সাকুল্যে ওরা তিন বোন আর এক ভাই! রেনেতা সবার বড়। প্রথম পরিচয়েই ওরা বেশ আন্তরিকতার সাথে আমাকে গ্রহন করল। ধর্মটা ওদের কাছে তুচ্ছ ব্যাপার,তামাটে গায়ের রঙের আলাদা বিশেষত্ব আছে আর বিদেশী মানেই ওদের মনন মানসিকথায় গেথে গেছে যে, আর যাই হোক এরা পয়সাওয়ালা। এমন ধনবান(!) ছেলের সাথে মেয়ের একটা হিল্লে হলে মন্দ নয়!
আসলে ওরা তখন বড্ড বেশী সরল ছিল- না হলে আমাদের বিশ্বাস করে!
সেই ভর দুপুরে ওর বাবার মুখে মদের গন্ধ! আধ মাতাল ভদ্রলোক বিছানায় হেলান দিয়েই পরিচয় পর্ব সেরে নিলেন।রুশ ভাষার উপর আমার দখল মারাত্মক! বেশীর ভাগ-ই ভুল ভাল শব্দ বলি। ব্যাকারনের ধারে কাছ দিয়ে যাই না। রুশীয়রা যেমন গাঁব গাঁব করে কথা বলে আমরা শূধু সেটুকুই অনুকরনের চেষ্টা করি।
ওর বাবা মায়ের কাছে আমাকে একা ফেলে রেনেতা উধাও। বোঝা গেল বাবাকে সে বেশ ভয় পায়। এমন পরিপূর্ন পরিবার তখন বিরল ছিল রাশিয়ায়। ওর বাবা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ হলেও বেশ রসিক-মা চটপটে কিন্তু বোঝা দুস্কর। মহিলা মোটেই সহজ নয়। পরিচয়ের প্রথমেই আমার সব হাড়ির খবর নিতে চাইলেন তিনি। এমনিতে ভাষাগত সমস্যা তাঁর উপরে কঠিন সব প্রশ্ন, আমিতো ঘাবড়ে গেলাম ভীষণ! তবে ওর বাবার হস্তক্ষেপে খানিকটা সহজ হলাম। বুঝলেন আমি গ্যাড়াকলে আটকে গেছি তাই আমার প্রশ্নের উত্তর অর্ধেক উনি দিয়ে মহিলাকে নিবৃত করেন পুলিশি জেরা থেকে।
তবে এটুকু বোঝলাম যে, ভদ্রমহিলা খুব বেশী খুশী হতে পারেননি আমার উত্তরে।
রেনেতা দরজার বাইরেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল...
আমাকে দেখেই সে কি হাসি!
আগের পর্বঃ Click This Link
পরের পর্বের জন্যঃ Click This Link