আগের পর্বের জন্যঃ Click This Link
কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না সৌম্য- শুধু খানিক বাদে ওর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেল!
কথা শেষ হবার আগেই আমি এসে শুয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলাম। বেশ সময় বাদে রেনেতা আমার পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। একটু অপেক্ষা- এই মাত্র ঘুম ভাঙল এমন ভঙ্গী করে তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম!
অনুভুতিহীন শীতল একটা শরীর! বুকের কাছে কান পেতে ধীরগতির হৃদস্পন্দনে আমি বিস্মিত হলাম। সে জেগে আছে এখনো। কিন্তু তাঁর শরিরকে আমি জাগাতে পারছি না। শীতল ঠোটজোড়া আমার উষ্ণতার আহ্বান উপেক্ষা করে পিছলে সরে গেল।
তবে কি যা ভেবেছি তাই? ও কার সাথে কথা বলছিল? কেন এভাবে ফিঁসফিসিয়ে গভীর রাতে কথা বলল? এমন ফুঁপিয়ে কান্নার তারপর-ই বা কি? অনেকগুলো প্রশ্ন- এর উত্তর খুঁজতে হবে আমাকে।
ইচ্ছে করেই বেশ কিছুক্ষন ওকে শারিরিক অত্যাচার করলাম। কিন্তু তেমন কোন সাড়া না পেয়ে একসময় সব চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম!
সকালে ফের সব ঠিক ঠাক। আগের মতই সব কিছু। রেনেতা উচ্ছল উদ্দীপ্ত। আমার প্রতি তাঁর ভালবাসা আন্তরিকতা কোনটারই ঘাটতি নেই। আজ সেই পিচ্চি অকসানাও এসেছিল। সারাক্ষন উরু উরু ভাব ওর-একখানে স্থির বসে থাকে না। মাগনিতোলায়( টেপ রেকর্ডারে) কোন একটা গান বাজলেই ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে। ওর কর্মকান্ড দেখে আমরা হাসতে হাসতে মরি।
এদিনও গভীর রাতে রেনেতা অতি আলগোছে আমার পাশ থেকে উঠে গেল! খানিক বাদে আমিও! ফের ফিস ফিস করে তাঁর টেলিফোনে আলাপন! আমিও অতি সংগোপনে আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলাম। সব না বুঝতে পারলেও দু-একটা শব্দ ভেঙ্গে ভেঙ্গে কানে এল;
-আমি কি ক-র-ব? ... তুমিই বল? ...। আমি আর পারছি না- তুমি চলে আস
কথা শেষে ফের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ!!
বুঝলাম আমার পাখি উড়ে গেছে। আমার ধারনা মনে হয় সত্যি হতে যাচ্ছে! ভয়ানক মাথা গরম হয়ে গেল।
ফের ও আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লে – শরিরে হাত দিয়ে ভীষণ শীতলতা অনুভব করলাম! ভয়ঙ্কর ক্ষোভে- রাগে আমি যেন হিতাহিত জ্ঞান হারালাম। ঠোট কামড়ে রক্তাক্ত করে দিলাম- সারা বুক জুড়ে কালশিটে দাগ। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সে একবার উঃ শব্দ করল না। এ যেন শবদেহ!
ফের দিনের বেলায় সব ফের ঠিক। অপরাধবোধ যেন আমার অস্তিত্বজুড়ে- আমি চোখ তুলে ওর দিকে তাকাতেই পারছিনা। নিজেকে অসভ্য জন্তু মনে হচ্ছে।
তৃতীয় রাত্রে আমি ডেসপারেট! আজ একটা ফয়সালা করেই ছাড়ব।
কথার মাঝেই ঠিক ওর ঘাড়ের কাছে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়ালাম। কথায় মগ্ন ছিল বলে খানিক্ষন সে বুঝতে পারেনি।কিন্তু দুটো বাক্য কানে যেতেই আমি যা বোঝার বুঝে গেছি!
হঠাত পিছনে ঘুরে আমাকে দেখেই ভুত দেখার মত চমকে উঠল সে- হাত থেকে রিসিভার পড়ে গেল। ভয়ানক ঝড়ের গতিতে এক দৌড়ে চলে গেল রান্না ঘরের দিকে।
রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকাতেই ওপাশে থেকে ভেসে আসল রনি ভাইয়ের আতঙ্কিত কন্ঠ। আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। আলতো করে রিসিভারখানা ক্যাডেলে রেখে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম রান্নাঘরের দিকে।
রান্নাঘরের ছোট্ট এক চিলতে বারান্দার এক কোনে রেলিং ধরে ফুলে ফুলে কাঁদছে!
আমি ধীর পদক্ষেপে আগিয়ে গিয়ে তাঁর কাঁধে আলতো করে হাত রাখতেই সে ঘুরে আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল!
এতখানিক ড্রামার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম! ওদিকে সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বারবার বলছে, ইয়া নি ভেনাবাদ- ইয়া নি ভেনাবাদ, প্রস্তিইচে মিনিয়া( আমি দোষী নই, আমি দোষী নই, ক্ষমা কর আমাকে)! বেশ কিছুক্ষন আমি চুপচাপ তাকে কাদতে দিলাম- তারপর হাতটা ছাড়িয়ে রান্নাঘরের খাবারের চেয়ারে নিয়ে বসালাম। ঘরে কোন আলো নেই। বারান্দার মৃদু আলোয় আবছা দেখছি দু’জন দু’জনকে।
সে একটু ধাতস্ত হলে ছোট্ট গেলাসে একটু সোক(জুস) ঢেলে এগিয়ে দিয়ে শুধালাম ক্যাম্নে কি হোল?
আমি এখান থেকে চলে যাবার পড়ে রনি ভাই আর সজল প্রায় নিয়মিত আসত। প্রতিদিনই বাবার জন্য মদ,মায়ের জন্য কিছু একটা গিফট, মাংস, মাখন, সালামি, চকোলেট, ফুল কিছু একটা আনত। মাঝে মধ্যেই কোন একটা উৎসবের বাহানা করে তাদেরকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে যেত। প্রথম প্রথম বাবা মা সহ সবাই , ধীরে ধীরে ওরা শুধু তিন বোন। তারপরে রেনেতাকে একা।
একদিন ওর বাবা মায়ের সাথে কি সলা পরামর্শ করে সে আর সজল বিছানা পত্তর নিয়ে হাজির। তারা বড় হল রুমটাতে থাকতে শুরু করল। ওর মায়ের কড়া নির্দেশে আমাকে বিষয়টা কেউ জানায়নি।
এখানে মুল গেমটা খেলে সজল। আমি মস্কো যাবার পর থেকেই সে রেনেতাকে বোঝাতে শুরু করে, আমি চাল চুলোহীন কপর্দক শুন্য চরিত্রহীন একটা ছেলে। সুযোগের অপেক্ষায় আছি অন্য দেশে ভেগে যাবার। উজ্জ্বল জার্মানীতে চলে যাওয়াতে ওর জন্য সুবিধে হয়েছিল পারফেক্ট উদাহরনের। ভারোনিকা এর জলন্ত প্রমান! সৌম্যও ঠিক এমনটাই করবে।
সজলের ভাষাগত দক্ষতা একদম ছিলনা। কিছু একটা না বোঝাতে পারলে এলিনার সাহায্য নিয়েছে। তাঁর অনুবাদকারী হিসেবে এলিনা বেশ দক্ষতার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে।
ওদিকে রনি যে ক্রুতোই (ধনবান) মানুষ এটাতো সচক্ষে দেখছে সবাই। ওর মায়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি একসময় একপ্রকার বাধ্য করেছেন রেনেতাকে রনির সাথে মিশতে।
স্বভাবতই মহিলা চেয়েছেন তাঁর কন্যা ও তাদের পরিবারের আর্থিক নিঃশ্চয়তা।
সজলের সহযোগিতায় ওর অভিভাবককে বোঝানো হয়েছে; রনি ব্যবাসা করে এখানেই থেকে যাবে। এই পরিবারের ভাল-মন্দ ও যে কোন দেখভালের দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিবে।
এই আক্রার বাজারে এমন ভাল পাত্র কোথায় মিলবে আর।
রেনেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার সাথে কি ফিজিক্যাল রিলেশান হয়েছে ওর?
সে কোন উত্তর না দিয়ে চুপ চাপ মাথা ঝুকিয়ে বসে রইল। আমার বোঝার আর কিছু বাকি রইল না।
আমার মাথায় একটা বিষয় ঢুকছে না, এই রুশ ভুমে এত মেয়ে থাকতে সে কেন রেনেতাকে বেছে নিল? মস্কোর এতদিনের ব্যাবসা, পরিচিতি ছেড়ে কেন সে এখানে সেটেল হতে চাইছে? তাঁর মত লোক বিয়ে করে সেটেল হতে চাইলে এর থেকে অনেক সুন্দরী মেয়ে, আর ভাল পরিবার পাবেন। এখানে তাঁর অনেক বদনাম হবে জেনে কেন তিনি এতটা হলেন???
তর্ক, মৌনতা, ভাবাবেগ, স্বগোক্তি আর চোখের জলে কেটে গেল পুরো রাত।
ভোরে আমি বড় রুমটার একটা ডিভানে গিয়ে শুয়ে পড়লাম!
সেদিন দুপুরের ফ্লাইটে রনি ভাই চলে আসলেন ওডেসাতে- গাট্টি বোঁচকা নিয়ে সরাসরি রেনেতাদের বাসায়।
এসে অব্দি আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না। হাই হ্যালো ছাড়া কথা আর বেশীদুর আগায়নি। শুরুটা তিনিই করবেন, কথা হয়তো গুছিয়ে নিচ্ছেন। রেনেতা যথা সম্ভব আমাদের দু’জনের থেকেই দূরে থাকছে।
রেনেতাকে হারিয়ে যতটা আমি কষ্ট পাচ্ছি তাঁর থেকে কষ্ট হচ্ছে রনি ভায়ের এহেন কর্মকান্ডে!
রাশিয়ায় এসে অব্দি তাকে আমি আপন বড় ভায়ের মত জানছি। তিনিও আমাকে যথেষ্ঠ আদর করেন-যে কাজটা তিনি করেছেন সেটা ভয়ানক কিছু নয় কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে ইথিক্স-এর।
আমি নির্ভার ও নিশ্চিত রেনেতা আমার থেকে দূরে সরে গেছে। তবুও রনি ভাইকে শুনিয়ে, চড়া গলায় রেনেতাকে বার বার ডেকে আনছি। বেশ সু পরিকল্পিতভাবে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে রেনেতাকে জড়িয়ে ধরছি- চুমু খাচ্ছি!
তিনি বারবার অন্যদিকে চেয়ে থেকে না দেখার ভান করছেন।
শেষমেষ কথা হল, ডাইনিং টেবিলে বসে- বিকেলের দিকে। রেড ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতে শুরু করলেন তিনিই।
তাঁর কর্মকান্ডে বড় লজ্জিত তিনি। কেমন করে কি হয়ে গেল বুঝতেই পারছেন না নাকি তিনি।
রাশিয়ায় কত সুন্দরী মেয়ে, তোমার জন্য এমন দু’চারখানা যোগার করা কোন ব্যাপারই নয়! মোদ্দা বিষয় হচ্ছে; তাকে যেন ক্ষমা করে দেই আর ববি বা তাঁর পরিচিত অন্য কারো সাথে এ বিষয়টা নিয়ে ডিটেল আলোচনায় যেন না যাই।
সে-তো আমারই ভাবি হচ্ছে। ভাবির নামে বদনাম হলে সেটা কারো জন্যই সুখকর নয়।বুকের কষ্ট চেপে রেখে আমি বেশ হাসিমুখে বিষয়টা নিলাম। তাদের অভিনন্দন জানালাম ভবিষ্যত সুখী জীবনের জন্য। তবে সেদিন বিকেলেই আমার ব্যাগ পত্র নিয়ে রেনেতাদের বাসা থেকে বেরিয়ে সুমনের ওখানে গিয়ে উঠলাম। রনি ভাই,রেনেতা, তাতিয়ানা ওর বাবা সহ সবাই কম বেশী বাঁধা দেবার চেষ্টা করেছিল- আজকে রাতটা অন্তত থেকে যেতে আব্দার করেছিল।
কিন্তু গোয়ার্তুমি ভর করেছে আমার মস্তিষ্কে তখন। আমাকে রোখে কার সাধ্যি!
প্রথম খন্ড শেষ
পরের পর্বের জন্যঃ Click This Link
প্রথম পর্বের জন্যঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ১১:১৩