somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ৮:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~আজ তাঁর জন্মদিন।
১৯৪৮ সনের প্রথম দিকে,তখনো পাসপোর্ট প্রথা প্রচলিত হয়নি। জনৈক যোগানন্দ গুপ্ত কার্যোপলক্ষে শিলং থেকে বাসে সিলেট যাচ্ছিলেন। বেলা প্রায় আড়াইটা নাগাদ-ডাউকী সীমান্তে পৌছেন। সেখানে তাঁর এক অতি পরিচিত কাস্টমস অফিসার আলাপ প্রসঙ্গে জানালেন যে,কর্তব্যের খাতিরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দু’জন খ্যাতিমান ব্যক্তিকে; এদের একজন ব্যবসায়ী এবং অপরজন বিখ্যাত পণ্ডিত ও সাংবাদিক- কর্তব্য হিসেবে যাত্রাপথে বাধা দিতে হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে বেশ কিছু পরিমাণ পানীয় দ্রব্য ছিলো। বাধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদ্বয় তখন ডাক বাঙলোতে বিশ্রাম করছিলন। “ আমি (যোগানন্দ গুপ্ত) আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় দেখি সেই খ্যাতি মান ব্যক্তিদ্বয় স্বয়ং সৈয়দ মুজতবা আলী এবং তাঁর বন্ধু,প্যারীমোহন মুখার্জী। দু’ জনই আমার পরিচিত। তাঁরা প্রাইভেট কারে সিলেট যাচ্ছেন। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় সৈয়দদা মনোরম ভঙ্গীতে সিলেটী সংলাপে আমার পরিচিত সেই কাস্টমস অফিসারকে বললেন,
“কিতা বা!-আর দরতায় নি?পেটো করি নিলাম।”
ডঃ আলীর মদ্যাসক্তি সম্পর্কে কিছ ,ঘটনা শোনা যায় -তার অনেকগুলোই বেশ মুখরোচক।
ব্যক্তি হিসেবে মুজতবা ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর বন্ধু,বাৎসল্য এবং স্নেহকোমল অর্ন্তলোক আমাদের আলোচনায় এসেছ। মদ্যাসক্তি সীমা লঙ্ঘন করলেও মুজতবার ভেতরকার অনিন্দ্যসুন্দর মানুষটির কোমল রূপকখনো বিনষ্ট হয়নি।
সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত প্রমথনাম বিশী -আলী সাহেবের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন বিদ্যার্থীদের মধ্যে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেছেন, তাঁদের মধ্যে ডঃ আলী শ্রীযুক্ত বিশীকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিলে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ন।
দিল্লীতে গ্রীষ্মের দ্বি-প্রহরে কোন এক বাড়ীতে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে শ্রী প্রমথনাথ বিশী এবং মুজতবা আলীও ছিলেন। নানারকম পানীয়ের মধ্যে প্রমথ বিশী ঘোলের শরবৎই পান করলেন। কেননা,পরিবেশিত অন্য কোন পানীয়ের প্রতি তাঁর আসক্তি ছিলো না। অভ্যাসও ছিলো না।
রাত্রিতে সেই বাড়ীতেই পুনরায় যখন পানীয় পরিবেশন করা হলো। প্রমথনাথ বিশী বলছেন; তখন শুধুমাত্র আমি যে গোঁড়া নই তা প্রমাণ করবার জন্য ঈষৎ বিয়ার পান করলাম। তাতে অবস্থার কোন ইতরবিশেষ আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন ঘরে প্রত্যাবর্তন করলাম এবং সৈয়দের কানে গেল আমি বিয়ার পান করেছি, সে আমার পা জড়িয়ে ছেলেমানুষের মতো হাঁউ মাউ করে কেঁদে উঠলো
বিশীদা-ওটা আর খাবেন না। আমি বললাম,‘ আরে না,মাত্র একদিন। ওতে কিছু হবে না।'
সৈয়দ বললে,-না,না। ওভাবেই ওগুলো নেশা ধরিয়ে দেয়। আমিও ওভাবেই ধরেছিলাম। আজ আমার অবস্থা দেখুন। না খেলে আমি থাকতে পারি না? আমি শেষ হয়ে গেলাম!!!

তাঁর জীবনের করুণ পরিণতি ভয়াবহ এবং ত্বরান্বিত করার পশ্চাতে মুখ্য কারণ মদ্যপানের তৃষ্ণা। মদই মুজতবা আলীকে গ্রাস করেছে। তাঁর পানাসক্তি প্রসঙ্গে তাঁর ভৃত্য শেখ দিলজান বলেছেন,“ ..সাহেব মদ্য একটু, বেশী মাত্রায় পান করতেন। অনেক সময় রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গেলেও মদ চাইতেন। ঘরে না থাকলে মধ্যরাত হলেও আমাকে দোকান থেকে মদ আনতে হতো। যখন কোলিকাতা থেকে সাহেবের বন্ধু-বান্ধবরা আসতেন তখন একটু বেশী মাত্রায় খেতেন এবং লেখার কাজকর্ম বন্ধ করে শুধু গল্প করতেন। ”
মদের এই ভয়াবহ গ্রাস থেকে আলী সাহেব নিজেকে আর কখনো রক্ষা করতে পারেননি। এবং সে — চেষ্টাও নির্লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে সৈয়দ মুজতবা আলী’র -গেলাস বন্ধুদের অবদানও কম ছিল না। এদের অনেকে অলী সাহেবের পয়সায় দিনের পর দিন মদ খেয়েছেন। আবার অনেকে স-বোতল স-বান্ধব হাজিরা দিতেন তাঁদের আকর্ষণ স্বয়ং মুজতবা আলী ।
ডঃ আলীর সঙ্গে শংকরের মানে দুই বাংলার জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক মনিশংকরের শেষ সাক্ষাৎ ৫ নং পাল রোডে।- তিনি নিজের ছোট্ট ঘরে বিছানার ওপরে আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। সামনে সেই পরিচিত হইস্কির বোতল। নিজের অসহায় কর্রুণ অবস্থার কথা অসঙ্কোচে এককালের প্রিয় শিষ্যের নিকট ব্যক্ত করেন;
-এখন মুজতবা আলী গলিতনখদন্ত-এখন লোকে তার লেখা দয়া করে পড়ে। তার মাথায় আর আইডিয়া আসতে চায় না।
‘ অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই যেন উচ্চারণ করেন,“ সংস্কৃতে একটা গল্প আছে। এক তৃষ্ণার্ত হাতি সরোবরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সামনে পাঁক থাকায় জলের ধারে যেতে পারছে না । একটা কাক কেমন নির্ভয়ে তরতর করে কাদার ওপর দিয়ে হেটে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে চলে গেল । আমি হচ্ছি ওই হাতি — আমার পাণ্ডিত্যই আমার শত্রু। সুতরাং ভ্রাতঃ , ... কখন হাতী হবার চেষ্টা কোরো না!!!!
৩ রা জুন,১৯৬৯। এডভোকেট অংশ কুমার চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছেন,
- আমি ... এখানে (১১ ডি,নাসিরউদ্দিন রোড )অন্তত:কয়েক মাসের জন্য ,চিকিৎসার স্বার্থে ডেরা পেতেছি। ড: আলী সম্ভবত: অল্পদিনের মধ্যেই বাড়ী পরিবর্তন করে ৫ নং পাল রোডে উঠে যান। এবং কোলকাতার শেষ দিন পর্যন্ত ডঃ আলী সেখানেই ছিলেন। (মরহুম )আবু সয়ীদ আইয়ুবও ছিলেন এ বাড়ীর অন্যতম ভাড়াটে। এ ঠিকানা থেকে '৬৯ —এর অক্টোবরে লেখা পত্র আমাদের হাতে রয়েছে । মুজতবা আলী 'সাইরো-সিস’( লিভার সিরোসিস) ভুগছিলেন। ১৯৭০ -এ ইউরোপে ভ্রমণের সময় এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর শ্রীযুক্ত দ্বারিকানাথ মিত্র তাঁকে সম্পূর্ণ নিজ ব্যয়ে প্রেসিডেন্সি নাসিং হোমে-দীর্ঘ তিন মাস রেখে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং আলী সাহেব সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে বাড়ী ফেরেন।
ত্যধিক পানাসক্তি ,অনিয়ম ,আর্থিক অনটন — সবকিছু মিলিয়ে আলী সাহেবের কোলকাতার শেষ দিনগুলো ছিলো অত্যন্ত করুণ,নির্মম -যদিও তিনি সর্বদা এদিকটা সংগোপনে,অন্যের অগোচরে রেখেছেন।
নিষ্ঠাবান ও রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান মুজতবা আলী ১৯২৯ সালে জার্মানি গেলে তাঁর এক শিক্ষক যুবা ছাত্রটিকে যে দুটো বিশেষ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছিলেন — 'সেখানকার তরুণী সম্প্রদায় হৃদয়বতী এবং পানীয় অতি সস্তা' -দুটো বস্তুই তরুণটিকে অকির্ষণ করেছিলো এবং আমত্যু সে -আকর্ষণে ভাটা পড়েনি। বরঞ্চ উত্তরোত্তর তৃষ্ণা বেড়েছে।
বাঙলার এক কালের দারুন নন্দিত লেখকের এই পরিণতি সম্পুর্ণ তার নিজেরই সৃষ্টি। শেষদিকে মুজতবার দেহ-মন দুই — ই ভেঙ্গে গিয়েছিলো। মমত্ব এবং অন্যান্য কারণে ও দেশ ত্যাগ করেননি। আবার ওখানকার কিছু ঘটনায় মানসিক চাঞ্চল্য তাঁকে স্বাভাবিক মানুষের ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করেছে অনেক সময়। মানসিক দিক থেকে এই প্রাণবান পুরষটি ছিলেন বড় অসুখী। অত্যন্ত একা একটা যন্ত্রণায় ছিলেন আজীবন কাতর।
সৈয়দ মুজতবা আলী ডায়েরীতে পুত্রদের উদ্দেশে কতগুলো পত্র লিখে গেছেন -বড় হয়ে তারা পড়বে, সে প্রত্যাশাতেই। প্রতিটি চিঠিতে সন্তান বৎসল পিতৃহৃদয়ের বুভুক্ষা ও আর্তি সপ্রকট।
-একটিতে লিখেছেন,
আজ সপ্তদশী। এখন আটটা বেজেছে। সপ্তদশীর চাঁদ কখন ওঠে ঠিক জানিনে। বাইরে অন্ধকারটা জমাট নয়। আকাশ যেন কোন ঘোরে রঙের চশমা পরে তাকিয়ে আছে। বাতাস যেন ভিজে কাঁথা পরে আমার চতুর্দিকে ঘোরাফেরা করছে ।... সমস্ত জীবন কাটলে। এই রকম একা বসে বসে।
আমাদের দু'জনের কথা এবং অন্যান্য- গৌরী আইয়ুব (২০১৩) তার বিশাল গ্রন্থে- আলী সাহেবকে নিয়ে আলাদা একটা পরিচ্ছেদ লিখেছেন;
সৈয়দ মুজতবা আলী বন্ধুবরেষু ~শিরোনামে। সেখানে বেশ পরিশীতল ভাষায় তিনি মুজতবা আলীর শেষের বেহড মাতাল হয়ে থাকার দিনগুলোর কথা স্মরণ করেছেন এভাবে। তবে শেষের এই দিনগুলোতে তার এতবেশী মদ্যপান করার পেছনে বিশেষ একটা কারন ও তিনি উল্লেখ করেছেন;
এই বাড়ির বৃদ্ধ মালিক এবং তাঁর স্ত্রীও ইহলোক ত্যাগ করেছেন আমাদের উপরের ফ্ল্যাটে থাকতেন কেবল সেই গৃহস্বামীর অকৃতদার কনিষ্ঠ পুত্র কচি। তিনিই মুজতবা সাহেবকে আবার তিনতলার ঘরে এনে প্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যাপারট সহজে ঘটেনি । কারণ কচির এই কাজটায় তার ভাইবােনেরা কেউ কেউ অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন । যাই হোক , মুজতবা সাহেব যে উপরের ঘরে এসে থাকতে শুরু করলেন। কিন্তু দেখা গেল যে মানুষটি ৫৬ সালে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আর যিনি ৭১ সালে ফিরে এলেন,তারা যেন আর একই মানুষ নন। ইতিমধ্যে দেশ পত্রিকা মারফৎ বাংলা সাহিত্যে তার স্থায়ী আসন বহুকাল ধরেই সংরক্ষিত হয়ে গিয়েছিল । দেশ পত্রিকায় নিয়মিত নানা লেখা বার হচ্ছিল বলে তার অনেকটা আর্থিক সমস্যারও সমাধান হয়েছিল। কোনও রকমে 'সেই লেখাটুকু লিখতেন,কিন্তু অবশিষ্ট সময়ে আগের মতো পড়াশুনা করার অভ্যাস আর রাখতে পারেননি। যোগ্য- অযোগ্য নানা ব্যক্তির সঙ্গে আড্ডা দিয়েই সময় কেটে যেত এবং পানের অভ্যাসও অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল। তাকে সংযত করার সাধ্য আমাদের কারও ছিল না। তার মানসিক বিষাদের কারণও যথেষ্ট ছিল ,সেকথাও অস্বীকার করা যাবে না। সারা একাত্তর সালটি তার পক্ষে সবচেয়ে কষ্টের কাল ছিল। তার স্ত্রী,পুত্র যে ঢাকাতেই রয়ে গিয়েছিলেন সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানের খান সেনাদের দৌরাত্ম্যের সব খবর পেয়েও মুখ বন্ধ করে থাকা ছাড়া তার উপায় ছিল না। এর জন্যও তার এখানে নানাজনের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছিল। স্বামী ভারতীয় এই অপরাধেই তার স্ত্রীর উপরে কত যে নিগ্রহ হতে পারত সেই সব কথা ভেবেই তিনি অন্য ভারতীয় মুসলিম ইনটেলেকচুয়ালদের মত সরাসরি বাংলাদেশে পাকিস্তানী বর্বরতার নিন্দা করতেও পারছিলেন না । আবার নীরবে সহ্য করাও বড় কঠিন ছিল । এ সময় বার বার অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন।

নে হয় নিজেকে ধ্বংস করাই ছিল মুজতবা আলীর শেষ জীবনের ব্রত !সকাল থেকে গভীর রাত অবধি চলত নিরলস বিরামহীন মদ্যপান। লেখার ক্ষমতাও গিয়েছিলো কমে। স্মৃতিশক্তির প্রবাদ বাক্যতুল্য ধার অনেকটা নিষ্প্রভ! আহারের প্রতিও বিমনা। এমনি অবস্থার প্রত্যক্ষদর্শী শ্রীযুক্ত গৌরী আইয়ুব আমাদের ধারণা হয়েছিলো যে একমাত্র তাঁর (মুজতবার )স্ত্রী বা সন্তানরাই তাকে এ ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারেন। আমরা মিসেস আলীকে অনুরোধও করেছিলাম তাঁকে ঢাকা নিয়ে যেতে । এতে আলী সাহেব আমাদের ওপর অত্যন্ত বিরক্তও হয়েছিলেন । তাঁকে বেপরোয়া জীবন থেকে রক্ষার জন্যেই আমরা মুজতবা সাহেবকে ঢাকা পাঠাতে চেয়েছিলাম । কিন্তু তিনি আমাদের কিছুটা ভুল বোঝেন। এবং অভিমান ভরে বলেছিলেন,’তোমরা আমাকে এ বাড়ী থেকে তাড়াতে চাইছো "কিন্তু শ্রীমতী গৌরী কথিত আলী সাহেবের উক্তি যে নিছক ‘অভিমান’।
১৯৭৩ এ পাল রোডে তাঁকে দেখে শ্রীঅমিতাভ চৌধুরীরও বিস্ময়ের অবধি থাকে না। প্রথম দেখা মুজতবার সঙ্গে আজকের সৈয়দদার সদৃশ্য কোথায়? কিছুদিন আগেই কোলকাতায় তিনি ~সেরিব্রাল থম্বোসিস এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। সদা সপ্রতিভ সুবেশী সৈয়দদা শুয়ে আছেন। দাড়ি কামানো হয়নি। ময়লা লুঙ্গি,গেঞ্জি পরিহিত। রীতিমতো একটা নোংড়া বিছানা ও পরিবেশে পড়ে আছেন । ... সৈয়দদা শুয়ে শুয়েই কথা বলছিলেন। তাঁর একটি হাত অসাড় হয়ে আসছিলো। সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, বিধিদত্ত আঙ্গুলগুলো আর বোধ হয় কাজে লাগাতে পারবো ন। কন্ঠে তাঁর বিষণ্ণতা। হঠাৎ তিনি বললেন,আমি যে এ অবস্থায় আছি, একথা কাউকে বলবে না। এমনকি কানাইকেও না। আমি চাইনে,কেউ এসে আমাকে সহানুভূতির নামে করুণা প্রদর্শন করুক।
নিঃসঙ্গ জীবনের দুঃখবোধটা যতদূর সম্ভব অলক্ষ্যেই রাখতে চেষ্টা করেছেন। শ্রীদ্বারিক মিত্রের ভাষায়,-কোলকাতায় মুজতবা আলীর শেষ দিনগুলো ছিলো দুর্বিষহ- অবর্ণনীয়্! প্রথমতঃ আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্য,তদুপরি অনাচারের পঙ্কিল আবর্তে তখন তিনি আকণ্ঠ নিমজ্জিত। শেষ বয়সে আলী সাহেব পূর্ব বঙ্গেই স্থায়ীভাবে বসবাস করার ইচ্ছে অন্ততঃ একসময় পোষন করতেন। -ভেবেছিলেন বাড়ী করবেন, জমি থাকবে,ধান ফলবে,মুরগী পুষবেন - ইত্যাদি ।
সৈয়দ মুজতবা আলীকে সবশেষ দর্শনের বর্ণনায় শ্রীযুক্ত গৌরকিশোর ঘোষ লিখেছেন ,... গত বছরেই (১৯৭৩ এ )শেষ সাক্ষাৎ। কোথায় সেই উজ্জল কান্তি। অবসন্ন পণ্ডর চেহারাটাকে একটা নকসী কাঁথায় ঢেকে রেখেছিলেন;
নকশী কথার মালা গেথে বরাবরই যেমন ঢেকে রাখতেন আপন স্বরূপ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি বলি কি; মৃত্যুতো কোন না কোনভাবে আসবেই। দুর্ঘটনা, রোগে শোকে, উসৃঙ্খল জীবনাচরণে বা অন্যকোনভাবে। হয়তো তিনি আর দশ/বিশ বছর আগে কোন দুর্ঘটনায় প্রান হারাতে পারতেন। বাংলা সাহিত্য যেটুকু তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে তাই-ই এখনো আমরা হজম করে উঠতে পারিনি। এটা ঠিক তাঁর আরো অনেক অনেক কিছু দেবার ক্ষমতা ছিল তবে তিনি এও বলেছিলেন;
~ আমি মা গঙ্গায় কোমর অব্দি ডুবিয়ে তাবা-তুলসী স্পর্শ করে, মাতায় কোরান শরীফ রেখে,যজ্ঞোপবীত উত্তোলন করে তথা ক্রুশিচহ্ন ভক্তিসহ স্পর্শ করে বলছি, বৌদ্ধদের ত্রি-শরণের দ্বিতীয় শরণ স্মরণ করে’ ধর্মং শরণং গচ্ছামি’ ধর্ম জানেন আমি ক-কখনো কস্মিনকালেও সজ্ঞানে অজ্ঞানে সাহিত্যিক হতে চাইনি।
সত্যিই তিনি যদি আদৌ লেখালেখি না-ই করতেন তাহলে? তাহলে মদ ও মদ্যপান নিয়ে লেখা তাঁর এই সরস প্রবন্ধটা বাংলা সাহিত্য ভীষণ মিস করত; ভাগ্যিস আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যেতেন-

হুশিয়ার আমরা মফস্বলের লোক। কলকাতা শহরে কি হয়,না হয় আমাদের পক্ষে খবর রাখা সম্ভবপর নয়। বয়েসও হয়েছে , ছেলেছোকরাদের মতিগতি, কাম -কারবারের সঠিক খবরও কানে এসে পৌছোয় না। মাস কয়েক পুর্বে পূর্ব-পাকিস্তানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানকার এক কাগজে পড়লম ইউনেস্কো নাকি কিছুদিন পবে পৃথিবীর বড় বড় শহরে মদ্যপান কোন বহরে বাড়ছে , তার একটা জরিপ নেন এবং ফলে একটি মারাত্মক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে ; সেটি এই পৃথিবীর বড় বড় শহরের যে কটাতে মদ্যপান ভয়ঙ্কররপে (ইন,এ্যান এলার্মিং ডিগ্রী )বেড়ে যাচ্ছে ,কলকাতা তার মধ্যে প্রধান স্থান ধরেন। বাঙালী সব দিক দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে , কিন্তু অন্তত একটা দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুন as we stand আমার উল্লাস বোধ করা উচিত ছিল,কিন্তু বহু চেষ্টা করেও পারলাম না ।
ঢাকার এক আমওলাকে যখন বলেছিলাম যে তার আম বড় ‘ছেডো’।
তখন সে একগাল হেসে দেমাক করে বলেছিল ,কিন্তু ,কত্তা ,আডি গলাইন,বরো আছে !'
সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে যাবার ‘আম ছোট ,আর মদ্যপানের 'আডিডা 'বড়ো এ - চিন্তাটা রসাল নয় কোন অর্থেই !

ফেরার মুখে কলকাতাতে ডেকে পাঠালুম দ্বিজেনকে। কলেজের ছোকরা - অর্থাৎ কলেজ যাওয়ার নাম করে কফি হৌস যায়,বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ;শুনেছি এদের মাথায় পেরেক পুঁতলে ‘ই’ হয়ে বেরোয়- মগজে এ্যাসন প্যাঁচ! তদুপরি আমার শাগরেদ!
তাকে আমার অধুনাল মাদকীয় জ্ঞানটুকু জানিয়ে বললাম,'আমি তো জানতুম ,ইন্ডিয়া শনৈঃ শনৈঃ ড্রাই হয়ে যাচ্ছে- এ আবার কি নতুন কথা শুনি? গুরুকে জ্ঞানদান করতে পারলে শিষ্য মাত্রই পুলকানভব করে - কাবেল, নাবালক যাই হোক না কেন।
ক্ষণতরেও চিন্তা না করে বললে, মদ্যপান কলকাতাতে কারা বাড়াচ্ছে। জানি নে ,তবে একটা কথা ঠিক ঠিক বলতে পারি ,কলেজের ছোকরাদের ভিতর ও জিনিসটা ভয়ঙ্কর বেড়ে যাচ্ছে; সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 'ভয়ঙ্কর,ভীষণ,দারুন কথাগুলো আমরা না ভেবেই বলে থাকি,কিন্তু ইউনেস্কো যখন-এলার্মিং 'নশব্দটি ব্যবহার করেছেন,তখন সঠিক ‘ভয়ঙ্করই’ বলতে চেয়েছেন। দ্বিজেন সেটা কনফার্ম করলে।
(কলেজের ছোকরারা আমার উপর সদয় থাকুন ;এটা আমার মত নয়,দ্বিজেনের।) সে বললে,এবারে যে মধুপরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি নি,তার কারণ আমি আদপেই মধুপুর যাই নি। যখন শুনলুম,ইয়াররা যাচ্ছেন বিয়ার পার্টি করতে সেখানে। ওদের চাপ ঠেকানো আমার পক্ষে অসম্ভব হত। এদিকে মায়ের পা ছুঁয়ে কিরে কেটেছি। মদ খাব না।
শ্রাদ্ধ তাহলে অনেকখানি গড়িয়েছে। সে সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে দেখি,মেলাই কলেজের ছেলেমেয়ে এসেছে।

মার ভাতিজীর ইয়ারী -বক্সিনী,বন্ধুবান্ধব। মাঝে - মধ্যে ওদের সঙ্গে বসলে ওরা খুশীই হয়। ইচ্ছে করেই ফুর্তি-ফার্তির দিকে কথার নল চালালাম। চোর ধরা পড়লো। অর্থাৎ মদ্যপানের কথা উঠল। সেদিন আমার বিস্তর জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছিল। একের অজ্ঞতা যে অন্যের জ্ঞান সঞ্চয়ের হেতু হতে পারে ,সে -কথা এতদিন জানতুম না।
এক গুণী -হঠাৎ বলে উঠলো,বিয়ারে আবার নেশা হয় !আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,-বলিস কি রে? ইয়োরোপের শতকরা ৮৫ জন লোক যখন নেশা করতে চায়,তখন তো বিয়ারই খায়। ওয়াইন খায় কটা লোক?
সে বাঁধা দিয়ে বললে ,-বিয়ারও তো ওয়াইন!!!!!

আমি আরো আশ্চর্য হয়ে বললাম ,-তওবা,তওবা !শুনলে গুনাহ হয়। ওয়াইনে কত পার্সেন্টেজ এলকহল ,আর বিয়ারে কত পার্সেন্ট , আর স্পিরিটে ?
-বাই উয়েইট অথবা ভলুম – দিশীটা,মানে ভদকার খুড়তুতো ভাই? তার হিসেব আন্ডার প্রুফ,অভার প্রুফ লিক্যোর
- মানে লিকার?
আমি প্রায় বাক্যহারা! লিক্যোর তো আবিষ্কার করেছে প্রধানতঃ ক্যাথলিক সাধু সন্ন্যাসীরা (মঙ্ক)। বেনিড্কটিন-
-সাধুসন্তরা আবিষ্কার করলেন,মদ !
পূর্বেই বলেছি ,সেদিন আমার বিস্তর জ্ঞানার্জন হয়েছিল। ওদের অজ্ঞতা থেকর। তারো পুর্বে বলা উচিত ছিল যে আমি মদ্যপানবিরোধী । তবে সরকার যে পদ্ধতিতে এগোচ্ছেন ,তার সঙ্গে আমার মতের মিল হয় না।
সে কথা আরেকদিন হবে। ঔষধার্থে ডাক্তাররা কখনো কখনো মদ দিয়ে থাকেন। ব্র্যান্ডির চেয়েও শ্যাম্পেন গিলিয়ে দিলে ভিরমি কাটে তাড়াতাড়ি । কিন্তু ব্র্যান্ডির চেয়ে শ্যাম্পেন খরচ বেশী পড়ে বলে কন্টিনেন্টের ভালো ভা্লো নার্সিংহোম ছাড়া অন্য কোথাও বড় একটা ব্যবহার করা হয় না । কৃত্রিম ক্ষুধা উদ্রেকের জন্যও শেরি বা পোর্ট ব্যবহৃত হয়। এ সব ব্যাপার সম্বন্ধে আমার হাঁ,না,কিছু বলার নেই।
তবে শীতের দেশে ব্র্যান্ডি না খেয়ে গুড়ের সঙ্গে কালো কফি খেলেও শরীর গরম হয় এবং প্রতিক্রিয়াও কম।
বহু ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং মুসলমান, কবরেজ –হেকিমের আদেশ সত্ত্বেও সুরাপান করেন নি, ভয়ঙ্কর একটা - কিছু ক্ষতি হতেও শুনি নি। মোদ্দা কথায় ফেরা যাক । বিয়ারে নেশা হয় না ,এর মত মারাত্মক ভুল আর কিছুই নেই। পুর্বেই বলেছি ,ইয়োরোপে শতকরা ৮৫ জন ল লোক বিয়ার খেয়েই নেশা করে ,মাতলামো করে। -
‘ওয়াইন’ বলতে যদিও সাধারণত মাদক বোঝায় ,তবে ,এর আসল অর্থ অঙুর পচিয়ে যে সুরা প্রস্তুত হয়,তারই নাম ওয়াইন। দ্রাক্ষাসব - এর শব্দের অনুবাদ (অবশ্য বাজারে যে - সব তথাকথিত দ্রাক্ষাসব আছে ,তার ভিতর কি বস্তু আছে আমার জানা নেই )। বিয়ারে ৪ থেকে ৬ পারসেন্ট এলকহল থাকে-বাদবাকি প্রায় সবটাই জল। নেশা হয় এই এলকহলেই। ওয়াইনের পার্সেন্টেজ দশ থেকে পনেরো। তবে ,বিয়ার খেয়েই নেশা করে বেশী লোক। ওয়াইন খান গুণীরা এবং ওয়াইন মানুষকে চিন্তাশীল ও অপেক্ষা কৃত বিমর্ষ করে তোলে।
পৃথিবীতে সব চেয়ে ভালো ওয়াইন হয় ফ্রান্সে । বোর্দো ( Bordeaux )অঞ্চলে তৈরী হাল্কা লাল রঙের এই ওয়াইনকে ইংরিজীতে বলা হয় ক্ল্যারেট। তাছাড়া আছে বার্গেণ্ডি এবং শ্যাম্পেন অঞ্চলের বিখ্যাত ওয়াইন । এসব ওয়াইন আঙুর পচিয়ে ফার্মেন্ট করার সময় যদি কার্বন ডায়োকসাইড বেরিয়ে না যেতে দেওয়া হয় ,তবে সেটাকে ‘সফেন ‘ওয়াইন (এফারভেসেণ্ট )বলা হয়। বোদো বাগেণ্ডি বুজবুজ করে না ,শ্যাম্পেন করে। শ্যাম্পেন খোলা মাত্রই তাই তার কক লাফ দিয়ে ছাতে ওঠে এবং তার বুদ্বুদ পেটের ইনটেসটিনাল ওয়ালে খোঁচা মারে বলে নেশা হয় তাড়াতাড়ি (ভিরমি কাটে তড়িঘড়ি )এবং স্টিল (অর্থাৎ -ফেনাহীন ' ) ওয়াইনের মত কিছুটা বিমর্ষ - বিমর্ষ সে তো করেই না উল্টে চিত্তাকাশে উড়ুক্কু– উড়ুক্কু ,ভাবটা হয় তাড়াতাড়ি ।

জার্মানীর বিখ্যাত ওয়াইন রাইন (ইংরিজীতে ‘হক’ )ও মোজেল। রাইন ওয়াইনের শ্যাম্পেনও হয়,তবে তাকে বলা হয় জেকট।
শ্যামেগনের(সামাগন-রুশীয়) তুলনায় জেকট নিকৃষ্ট। অথচ এই জেকট ফ্রান্সে বেঁচে হের ফন ‘রিবেনট্রপ’ প্রচুর পয়সা কামান।
হিটলার নিজে মদ খেতেন না,কিন্তু যখন শুনলেন রিবেনট্রপ শ্যাম্পেনের দেশে ওঁচা জেকট বিক্রি করতে পেরেছেন,তখন বিমোহিত হয়ে বললেন,যে ব্যক্তি জেকটের মত রদ্দি মাল ফ্রান্সে বেচতে পারে সে পয়লা নম্বরী সেলসম্যান। একে আমার চাই-এ আমার আইডিয়াজি ইংলণ্ডে বেঁচতে পারবে।
সবাই জানেন ,ইনি পরে হিটলারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন ও সর্বশেষে ন্যুরনবেগে ফাঁসীকাঠে ঝুঁলেছিলেন।
হাঙ্গেরির বিখ্যাত ওয়াইন ‘টকাই’ ও ইতালির ‘কিয়ান্তি’।
কাশ্মীরের আঙুর দিয়ে ভালো ওয়াইন হওয়ার কথা। তাই তৈরী করে চীন , জাপান,অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় চালান দেওয়ার আমি পক্ষপাতী। অবশ্য ওরা যদি কখনো ড্রাই হতে চায় ,তবে অন্য কথা । আপেল ফার্মেন্ট করে হয় সাইভার ,মধু ফার্মেন্ট করে হয় মীড (সংস্কৃত মধু- থেকেউ ‘মধ্বী’,গ্রীকে মেথু-মানে মদ,জর্মনে মেট - সব শব্দই সংস্কৃত মধু থেকে)
আমের রস ফার্মেন্ট করে খেতেন বিখ্যাত কবি গালিব।
আনারস ও কালোজাম পঁচিয়েও নাকি ভালো ওয়াইন হয়।


সাঁওতাল ,আদিবাসী ও বিস্তর পার্বত্য জাতি ভাত পচিয়ে বিয়ার বানিয়ে খায়;কিন্তু ফার্মেন্ট করার ভালো কায়দা জানে না বলে তিন সাড়ে তিনের(পার্সেন্ট) চেয়ে বেশী এলকহল -পচাইয়ে তুলতে পারে না। এদের সরল আত্মার সর্বনাশ করেছে ইংরেজ -চোলাই (ডেসটিলড ) ধান্যেশ্বরী কালী মার্কা এদের মধ্যে চালু করে। এই ‘ধানন্যবরী’ একেবারে সম্পূর্ণ বন্ধ না করা পর্যন্ত এদের উদ্ধার নেই।
জাপানীদের ‘মাকে’ মদ ভাতেরই পচাই , চীনাদের পচাই-চু’-য়ে কিঞ্চিৎ ভুট্টা মেশানো।
ভারতবর্ষের তাড়ি (ফার্মেন্টেজ খেজুর কিংবা তালের রস )বস্তুটিকে ওয়াইন পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে। পৃথিবীর তাবৎ মাদক দ্রব্যের ভিতর এই বস্তুটিই অনিষ্ট করে সব চেয়ে কম।
একমাত্র এই জিনিসটাই সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত কি না সে বিষয়ে আমার মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ আছে । তবে খাঁটি তাড়ি সচরাচর পাওয়া যায় না ; লোভী শুঁড়িরা তাড়ির সঙ্গে দিশী চোলাই মদ (ধ্যানেশ্বরী )মিশিয়ে তার এলকহল বাড়িয়ে বিক্রি করে।
মাতালরাও সচরাচর নির্বোধ হয়।
এতক্ষণ পচাই অর্থাৎ ফার্মেন্টেড বস্তু সম্বন্ধে বর্ণনা হচ্ছিল। এবারে ডেসটিলড বা চোলাই। চোলাই বস্তুর নাম স্পিরিটস-যদিও শব্দটি সর্বপ্রকার মাদক দ্রব্যের জন্যও ব্যবহার হয়।
আঙুর পচিয়ে ওয়াইন বানিয়ে সেটাকে বক যন্ত্র দিয়ে চোলাই করলে হয় ব্র্যান্ডি অর্থাৎ ব্র্যাণ্ড করা বা পোড়ানো হয়েছে। একমাত্র ফরাসী দেশের ব্র্যান্ডিকেই (তাও সব ব্র্যান্ডি নয় )বলা হয় কন্যাক (Cognac রুশ ‘কনিয়াক’)।
মল্ট বার্লিকে পঁচিয়ে হয় বিয়ার ;সেটাকে চোলাই করলে হয় হইস্কি । তাড়ি চোলাই করলে হয় এরেক (শব্দটা আসলে ‘আরক’ কিন্তু আরক অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয় বলেই এস্থলে এরেক প্রয়োগ করা হল)। সেটাকে দুবার চোলাই করে খেতেন বদ্ধ মাতাল বাদশা জাহাঙ্গীর। এরেকে ষাট পার্সেন্ট এলকহল হয় -ডবল ডেসটিল করলে আশী পর্যন্ত ওঠার কথা। সেইটে খেতেন নির্জলা !
আখের রস ফার্মেন্ট করার পর চোলাই করলে হয় –রাম’। সংস্কৃতে –‘গৌড়ী’ গুড় থেকে হয় বলে। জামেকার রাম বিশ্ববিখ্যাতি । কিন্তু ভারতীয় রাম,যদি সযত্নে তৈরী করে চালান দেওয়া হয় ,তবে জামেকাকে ঘায়েল করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব নয়।
রামে এত লাভ যে তারই ফলে চিনির কারবারীরা চিনি সস্তা দরে দিতে পারে। জাভার চিনি একদা এই কারণেই সস্তা ছিল।
জিন তৈরি হয় শস্য দিয়ে এবং পরে জেনিপার জামের সঙ্গে মেশানো হয়। খুশবাইটা ঐ জেনিপার থেকে আসে। এসব চোলাই করা স্পিরিটসে ৩৫ থেকে আরম্ভ করে ৮০ ভাগ এলকহল থাকে। হইস্কি ব্যাণ্ডির চেয়ে রামে এলকহল বেশী ,তার চেয়ে বেশী ডবল - চোলাই এরেকে এবং সব চেয়ে বেশী আবস্যাঁতে !তাই ওটাকে -সবুজ শয়তান’ বলা হয়। শুনেছি ,ও জিনিস বছর তিনেক নিয়মিত ভাবে খেলে মানুষ হয় পাগল হয়ে যায় ,না হয় আত্মহত্যা করে কিংবা ডেলিরিয়াম ট্রেমেনসে মারা যায়। ইয়োরোপের একাধিক দেশে এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। সচরাচর মানুষ এসব স্পিরিটস নির্জলা খায় না। হইস্কিতে যে পরিমাণ সোডা বা জল মেশানো হয় তাতে করে তার এলকহল ডাইলুটেড হয়ে শক্তি কমে যায়। ফলে এক গেলাস হইস্কি – সোডাতে যতখানি নেশা হয় ,দু’গেলাস বিয়ারে তাই হয় । অবশ্য নির্জলা হইস্কি যতখানি খেয়ে স্বাস্থ্যের সর্বনাশ করা যায়, বিয়ারে প্রচুর জল আছে বলে ততখানি পেটে ধরে না বলে খাওয়া যায় না। তবে অবশ্য কেউ যদি অতি ধীরে ধীরে হইস্কি খায় এবং অন্যজন সাততাড়াতাড়ি বিয়ার খায় তবে দ্বিতীয় জনেরই নেশা হবে আগে।
অতএব বিয়ারে নেশা হয় না ,এ বড় মারাত্মক ভুল ধারণা ভুবনবিখ্যাত ম্যুণিক বিয়ারে তো আছে কুল্লে তিন,সাড়ে তিন পারসেন্ট এলকহল। যারা রাস্তায় মাতলামো করে ,তারা তো ঐ খেয়েই করে।
এদেশে আরেকটা বিপদ আছে। আর সহজে পাওয়া যায় না বলে এদেশের অনেক ব্রাণ্ডিতেই আছে ডাইলুটেড এলকহল এবং তার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্র্যান্ডির সিনথেটিক সেন্ট অর্থাৎ আঙুরের রস এতে নেই। অনেক সরল লোক -সর্দি সারাবার জন্যে , কিংবা দুর্বল রোগীর ক্ষুধা বাড়াবার জন্য এই ব্র্যান্ডি খাইয়ে রোগীর ইষ্টের পরিবর্তে অনিষ্ট ডেকে আনেন। এ - বিষয়ে সকলেরই সাবধান হওয়া উচিত - বিশেষ করে যে সব লোক নিজে নিজের বা আত্মীয়স্বজনের ডাক্তারী করেন ।
ফ্রান্সে অত্যধিক মদ্যপান এমনি সমস্যাতে এসে দাঁড়িয়েছে যে ,তার একটা প্রতিবিধান করা বড়ই প্রয়োজন হয়ে উঠেছে । কিন্তু কেউই সাহস করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছেন । প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাঁদেজফ্রাঁস চেষ্টা করেছিলেন ; অনেকে বলেন প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান তিনি প্রধানত এবং গুহ্যত এই কারণে । আমেরিকা ও নরওয়েও চেষ্টা করেছিল সফল হয় নি। আবসাঁতের শোচনীয় পরিণাম সম্বন্ধে একটি ফরাসী গল্পের অনুবাদ করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর , নাম ‘সবুজ শয়তান’। বসুমতী গ্রন্থাবলী।
রাজা যদিও আইনের বাইরে তবু নরওয়ের রাজা একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন’
'দেখা যাচ্ছে , মদ না -খাওয়ার আইন একমাত্র আমিই মানি,আর সবাই তো শুনি বে -আইনী খেয়ে যাচ্ছে। '

বৈদিক,বৌদ্ধ ও গুপ্ত যুগে মাদকদ্রব্য সেবন করা হত ও জুয়াখেলার রেওয়াজ ছিল।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস শঙ্করাচার্য যে নব হিন্দু ধর্ম প্রচার করলেন সেই সময় থেকেই জনসাধারণে মদ্যপনি ও জুয়াখেলা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় (অবশ্য মুনি -ঋষিরা মাদক দ্রব্য ও ব্যসন বারণ করেছিলেন খন্টের পরেই )এবং পাঠান -মোগল যুগে রাজারাজড়া ও উজীর -বাদশারাই প্রধানত মাদক দ্রব্য সেবন করেছেন।
চরমে চরম মিশে বলেই বোধ হয় অনুন্নত সম্প্রদায় ও আদিবাসীরাও খেয়েছে। ভারতবর্ষ কোন অবিশ্বাস্য অলৌকিক পদ্ধতিতে এদেশে একদা মদ জুয়া প্রায় নির্মল করতে সক্ষম হয়েছিল সেটা আমি আবিষ্কার করতে পারি নি। পারলে আজ কাজে লাগানো যেত । ইংরেজ আমলে মদ্যপানের কিছুটা প্রচার হয় - মাইকেল ও শিশির ভাদুড়ী নীলকণ্ঠ হতে পারলে ভালো হত।
ঐ সময় ব্রাহ্মসমাজ ,বিবেকানন্দ ,অরবিন্দ ,রবীন্দ্রনাথ,গাঁধী যে জীবন ও আদর্শ সামনে ধরেন তার ফলে মদ্যপান প্রসার লাভ করতে পারে নি।
ইতিমধ্যে কলকারখানা হওয়ার দরুন চা -বাগানে জুট মিলে মদ ভয়ঙ্কর মতিতে দেখা দিল। মাঝিমাল্লারা অর্থাৎ সেলাররা মাতলামোর জন্য বিখ্যাত কিন্তু আশ্চর্য,ভারতীয় ও পাকিস্তানী খালাসীরা মদ খায় না। আমাদের সৈন্যবাহিনীতে যেটুকু মদ্যপান হয় তাও তুচ্ছ। কলকাতার শিখেদের দেখে কেউ যেন না ভাবেন যে,দিল্লী -অমৃতসরের সভ্রান্ত শিখরা মদ খান। ধর্মপ্রাণ শিখ মদ্যপানকে মুসলমানের চেয়েও বেশী ঘৃণা করেন ও বলেন, ইংরেজ শিখকে পল্টনে ঢুকিয়ে মদ খেতে শেখায়।
হিন্দু ,বৌদ্ধ ,জৈন ধর্ম ও ইসলামে মদ্যপান নিন্দিত - ইহুদী খৃষ্টান ও জরথুশ্রী ধর্মে পরিমিত মদ্যপানকে বরদাস্ত করা হয়েছে। এবং ঐ সব ধর্মের বহ ,প্রগতিশীল গুণী -জ্ঞানীরা অধুনা মদ্যপান বিরোধী। মদ্যপান এখনো এদেশে ভয়ঙ্কর রুপে দেখা দেয় নি ,কিন্তু আগের থেকে সাবধান হওয়া ভালো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
~কেন এত মদ খান আপনি কোন এক শুভানুধ্যায়ীর এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন এই বাগ্মী রসিক পণ্ডিত;
আমার মনটা ভুতের মত । তাকে সর্বক্ষণ কাজ না দিলে সে আমার ঘাড় মটকাতে চায়। তখন তাকে মদ খাইয়ে মাতাল করে দিই।

তবুও শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে পানীয়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অবশ্যম্ভাবী’এই ভণ্ডামিকে তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
মদ্যপান করলে ভাল লেখা বেরয় এ কথা আমি বিশ্বাস করিনে।
মেঘনাদ কাব্য রচনার সময় মাইকেল ক্লান্তি দুর করার জন্য অল্প খেতেন, শেষের দিকে যখন মাত্রা বেড়ে গেল, তখন দু-চারপাতা লেখার পরেই বেএক্তেয়ার হয়ে ঢলে পড়তেন-তার গ্রন্থাবলী সেইসব অসমাপ্ত লেখায় ভর্তি। এবং এর চেয়েও বড় কথা আমি মাইকেল নই। একখানা মেঘনাদ লিখুন; তারপর না হয় মদ খেয়ে লিভার পচান কেউ আপত্তি করবেনা।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
(লেখায় কিছু কাট ছাঁট, শব্দাবলী সংযোজন বিয়োজন করা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত যে কোন ভুল ভ্রান্তির জন্য সব দায়ভার লেখকের।)

#স্যার সৈয়দ মুজতবা আলীকে নিয়ে কোন প্রসংগ আসলেই আমার সর্বপ্রথম যার কথা মনে আসে- তিনি একসময়ের জনপ্রিয় ব্লগার সুপ্রিয় রেজোওয়ানা’র কথা। তাঁর সাথে আমার কলম বন্ধুত্বের শুরু মুজতবা আলীর সুত্র ধরে। আমরা দু’জনই ছিলাম তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত। বেশ কিছুদিন দু’জনের মধ্যে মেইল-ম্যাসেজ চালাচালি হয়েছিল যার মুল এবং একমাত্র বিষয়বস্তু ছিল সৈয়দ সাহেব। ~একদিন উনিও হারিয়ে গেলেন, আমিও ভুলে গেলাম। বহুদিন আগে তাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি -১৭ ই জুন, ২০১৪এর পরে তার ব্লগ বাড়ি থেকে তিনি উধাও!! তিনি এক্কেবারে হারিয়ে গেলেন। এই লেখাটা তাঁকে উতসর্গ করছি; তিনি যেখানেই থাকেন যেন ভাল থাকেন সুস্থ্য থাকেন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যদ্যপি আমার গুরু - নামে শ্রদ্ধেয় আহমেদ ছফার একটা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আছে- সেটার দ্বারা অনুপ্রাণিত নয়।

লেখা সুত্রঃ
সৈয়দ মুজতবা আলীঃ জীবন কথা- স্যার নুরুর রহমান খান
সৈয়দ মুজতবা আলীর 'রচনাবলী'।
আমাদের দুজনের কথা এবং অন্যান্য- গৌরী আইয়ুব
ভবঘুরে ও অন্যান্য সহ বিভিন্ন সুত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:১৩
২৯টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×