আমি বরাবরই রম্য সাহিত্যের বেশ ভক্ত! সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব রম্য সাহিত্যের যে পোকাটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন সেটা মগজে চিরস্থায়ী বসতবাড়ি গড়ে ফেলেছে।
২০০১ সালের বইমেলা; আমি এক স্টল থেকে আরেক স্টলে রম্য গল্প বা সাহিত্যের বই খুঁজছি। আর যাই হোক রম্য সাহিত্যে আমরা ভীষণ দরিদ্র, এটা সাহিত্য পড়ুয়া বাঙালি মাত্রই স্বীকার করবেন।
অনেক স্টলেই বাংলা সাহিত্যের সেরা হাসির গল্প, সেরা রম্য গল্প এই টাইপের বই পাচ্ছিলাম কিন্তু কোন লেখকের(আগে থেকে পড়িনি এমন) একক বই মিলছিল না। অনেক ঘুরে প্রথমে কিনলাম লোটা-কম্বল খ্যাত বিখ্যাত সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বাংলা সাহিত্যের সেরা ১০০ রম্য গল্পের সংকলন’। খানিক বাদে ঐতিহ্যের স্টলে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা দুইখানা বইয়ের দিকে নজর গেল। রম্য গল্পসমগ্র;১ও ২। বেশ আগ্রহ ভরে হাতে নিয়ে লেখকের নাম দেখে ভীষণভাবে দমে গেলাম।‘ আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন’;ইঁনাকে আমি বরাবর শিশু সাহিত্যিক হিসেবেই জানতাম। ভেবেছিলাম তাঁর রম্য গল্প মনে হয় শিশুতোষ কিছু হবে।
কিন্তু স্টলে দাঁড়িয়ে প্রথম বইয়ের প্রথম গল্প পড়ে আমি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলাম। মনে মনে এমন গল্পের বই আমি খুঁজছিলাম। তিনখানা বই একসাথে কিনে বগলদাবা করে বাসায় এনে আর তর সইলো না।
প্রথম পর্ব পড়ে আমি বিমোহিত! এগুলো রম্য গল্প নয়, রম্য কাহিনি।লেখকের বহু-দেশ ভ্রমণ আর বিচিত্র জীবনের সত্য কাহিনি নিয়ে মজলিসি আলোচনা দারুণ রম্য ঢঙে। যেন মুজতবা আলীর ছায়া, কিন্তু একটু অন্যরকম!
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের বেশিরভাগ গল্পই দুর্দান্ত! একবার পড়লে মনে গেঁথে যায়। তৃতীয় পর্বটা(পরে বেরিয়েছে) তেমন মান সম্পন্ন নয়। মনে হলো ফরমায়েশি লেখা বা লিখতে হয় তাই লেখা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
তাঁর রম্য গল্প সমগ্রের দুয়েকটা গল্পের সার সংক্ষেপ না বললে যাদেরতাঁর লেখার সাথে পরিচয় নেই তাদের তাঁর লেখা সন্মন্ধে ধারনা পেতে কষ্ট হবে। যেমন:‘সর্দার কাল্লে খাঁ’
পাকিস্তানের বালাকোটের কাগানের অদূরে সাইফুল মুলক লেক ভ্রমণের রোম হর্ষক রম্য গল্প;
ভয়ঙ্কর পাহাড়ি পথে গাড়ি চালানোর আগে ভীষণ তেজী পুরুষ খুররম খান শর্ত দিলেন, সাহেব লোগ, পথে কথাবার্তা বলতে পারবেনা একদম। ওতে আমার মনোযোগ নষ্ট হবে গাড়ি চালাতে গিয়ে। গাড়ি যদি খাঁড়া রাস্তায় আটকে যায় বা পাশের খাদে পড়ে যেতে শুরু করে তবে লাফ মেরে নেমে পড়বে চোখের পলকে। আর যদি গাড়ি থেকে মুহূর্তে নেমে পড়তে না পার তব জোরে জোরে কালেমা পড়বে-
তোতলাতে থাকলাম আমি, কালেমা পড়ব কেন খাঁ সাহেব?
‘কালেমা না পড়ে মউত কবুল করবে নাকি?’
সাইফুল মুলকের সেই দুর্দান্ত সৌন্দর্যমন্ডিত হ্রদের ধারে নাকি জেনানাদের যাওয়া নিষেধ! কেননা এই দুর্গম দুস্তর পথ পাড়ি দেবার মত গুর্দার জোর নাকি ওদের নেই।প্রথমে কথাটায় খটকা লাগলেও খানিক বাদে গল্পের শেষে এসে হাসতেই থাকবেন।
সেখানে ক্যাম্প খাটিয়ে সর্দার কাল্লে খাঁ নামে দুররানি গোত্রের মহাপরাক্রমশালী এক দলপতি একাই এক দুম্বা কেটে নিজ হাতে রান্নার তোড়জোড় করছেন।
তাকে দেখেই বোঝা যায় চরম রাগী তেজী ও দুর্ধর্ষ মানুষ তিনি।
একসময় কথায় কথায় জানা গেল তিনি এখানে এসেছেন বাড়ি থেকে একরকম পালিয়ে। গিন্নীর অত্যাচার থেকে রেহাই পাবার জন্য।
পাহাড়ি লোক তো পাহাড়েই আসবো? করাচী বা লাহোরে গেলে স্বাস্থ্য টিকবে কি করে পাঠানের? কত গরমি আর ধুলাবালি ওসব যায়গায়। মুখে মৃদু হাসি সরদারের।।আর বুঢঢির হাত থে রক্ষা পেতে হলে এর থে নিরাপদ যায়গা আর কোথায় মিলবে। জেনানাদের সাইফুল মুলক হ্রদে আসা নিষেধ। তাকে এখান থেকে সে কোনমতেই পাকড়াও করে নিয়ে যেতে পারবে না!!’
কাজল ও কবিতাঃ
~ঘুম আসেনা। প্রেমের কবিতাটা পেটের ভিতরে খামচাতে থাকে কাঁকড়া বিছার মত। মাঝ রাতে বিড়ালের মত নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে যাই। অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছই বাথরুমে।
মুঠোয় আমার অন্ধকারে হাতড়ে নেয়া কাগজ ও কলম। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে বাতি জ্বালাই।দেড় দুই ঘণ্টা পরে যখন বেড়িয়ে আসি, বুক পেট হাল্কা আমার, প্রসব শেষের পরিতৃপ্তি চোখে মুখে। কাজলকে নিয়ে একটা অনবদ্য প্রেমের কবিতা লিখে ফেলেছি। প্রতি পংক্তি জুড়ে ওর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সরস বর্ণনা~
উৎসাহের আতিশয্যে কবিতাটা ভোর না হতেই মেলে ধরি কাজলের চোখের সামনে। চায়ে দুধ মেশাচ্ছিল ও। মেজাজটা বেশ ঠাণ্ডা- রাতে ভাল ঘুমোতে পেরে।
‘পড়ে দেখ কাজল, একটা দারুণ কবিতা লিখেছি রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে। শিরোনামটা দেখ? 'ওগো কাজল কালো মেয়ে’
আমার হাত থেকে বাজপাখির বেগে ছিনিয়ে নিলো কাগজটা। চোখ বুলোলো কি বুলোলোনা কাজল। ছিঁড়ে কুটি কুটি করে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে।
তার ধারণা হয়েছিল পাশের বাসার নাসিমাকে নিয়ে লিখেছে এ কবিতাখাঁনা!!এর পর বেশ খানিক্ষণ অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ...
চায়ের পেয়ালাটা ঠাস করে রেখে দেয় টেবিলের উপর, ফের যদি কবিতা লিখেছ শয়তানিকে নিয়ে, গলায় আমি দড়ি দেবো বুঝলে?
বহু ঘটন অঘটন শেষে, কবি বলছে,
কাজল ও কবিতা দুটো চলেনা একসঙ্গে। একটাকে ত্যাগ করেছি আমি। বলতে পার কোনটাকে ছেড়েছি আমি?
হাবসীর বউ~ গল্পে;
‘কালো এক পুরুষের করুন রসের আখ্যান। প্রথমে একজন কালো মানুষের ভয়ঙ্কর কষ্টের গল্প;
নতুন বিয়ে করা সুন্দরী বউঃ
বাসর রাতেই সেতারের সব কটা তার ছিড়ে গেলো । নাক সিঁটকে সরে গিয়ে খাটের প্রান্তে বসে রেশমা , আমাকে আপাদমস্তক দেখে ফিরে ফিরে। বলে , তোমার পূর্বপুরুষরা নিশ্চয়ই আফ্রিকা থেকে এসেছে এদেশে । কোন সওদাগর বোধ হয় লোহার শেকলে বেঁধে এনেছে নিগ্রোগুলোকে। এদেশের হাটে বেঁচে দিয়েছে দাসদাসী হিসেবে।
পরের কথাগুলো আরো কষ্টের;
‘ আমার কাছ থেকে সন্তান নেবে না ও। কোনদিন নেবেনা। বলে , তোমার ছেলেমেয়ে তোমার মত— তোমার বাবা চাচা ভাই বোনের মতই কালো কুচ্ছিরি হবে । হাবসীর ঘরে হাবসী । কুৎসিত সন্তানের মা বলে পরিচয় দিতে পারব না আমি মরলেও । সরো সরো , বৈঠকখানার চৌকিতে গিয়ে শোও । থেমে বলে আলতাফ!
এরপর বেশ কয়েকবছর পরের কথা- তাঁর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন তাঁর সেই কলিগ যার কাছে কষ্টের গল্প করেছিল আলতাফ;
আলতাফের ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে বেরিয়ে আসে যয়নবুন্নেসা। লম্বা ঘোমটার নীচে মুখখানা আংশিক দেখে আঁতকে ওঠে মকবুল । কি ভয়ঙ্কর কালো রে মহিলা ! কয়লার খনি থেকে বেরিয়ে এসেছ বুঝি এই মাত্র। হাতের নখগুলো পর্যন্ত অসম্ভব রকম কালো। একটু থেমেই ভেতরে চলে যায় যয়নব। পানি জোকের রং কালো ঠোটের পেছনে দাঁতগুলোই যা সাদা ।
‘তোমার ভাবীর রং ময়লা হলে কি হবে , মানুষটা বড় ভালো । কোন দেমাগ নেই , সারাদিন খাটে , এমন খেদমত করে আমার যে— এ বিয়েতে এততো সুখী যে আমি , ভাবতেও পারবে না । '
ওপরতলার ব্যাপার স্যাপারে’ বাড়ির কাজের লোককে হাত করে ধনবানের গৃহিণীর নষ্টামিআর তাদের সরস আলোচনা।
হ্যাপি হ্যাপি জন্মদিনে; থাইল্যান্ডের তাজমহল হোটেলের মালিক নবাব আলী আর তার সুন্দরী থাই বউ ডেঙ্গী’র চরম প্রফেশনাল আচরণ আর শেষে এসে দারুণ এক সারপ্রাইজে ধরাশায়ী লেখক।
তার অনন্য এক রস গল্প ' ফেইথফুল' এ, ওয়াশিংটনের পুলিশ একাডেমিতে সহপাঠী এক থাই রাজপুত্রের চানমানের গল্প। একাডেমীর সেরা সুন্দরীরা তার একটু সান্নিধ্য পাবার জন্য পাগল অথচ সে কারো দিকে ফিরেও তাকায় না।
অথচ সে প্রতি উইকেন্ডে চলে যায় অন্য শহরে গণিকালয়ে ফুর্তি করতে।
অবশেষে জানা যায় তার বউকে আসার সময়ে কসম কেটে কথা দিয়েছিল সে কোন শিক্ষিত মার্জিত নারীর সঙ্গে মিশবে না। তাহলে ভালবাসার বাঁধনে জড়িয়ে যেতে পারে। ক্ষণিকের আমোদের জন্য সে যা খুশি করতে পারে তার কোন আপত্তি নেই।
সব শেষে তার সহজ স্বীকারোক্তি; 'আই ডিড নট বিকাম আনফেইথফুল টূ মাই সুইট লাভিং ওয়াইফ।‘
লায়লার প্রত্যাবর্তন, দাওয়াই সহ অনেক গল্পের পরতে পরতে কি দুর্দান্ত-ভাবে,নারীর মন, সাজগোজ আর দৈহিক সৌন্দর্য তিনি নিখুঁত বর্ণনা করেছেন। পুরুষের আকাঙ্ক্ষা, নারীদের প্রতি দুর্বলতা, মানসিক চাপ আর শিল্পীমনের সুনিপুণ কারুকাজ খচিত হয়েছে লেখার পরতে পরতে।
আজ এটুকুই থাক বাকি গল্প নিয়ে আলোচনা অন্য একদিন করব খন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
অন্য সব কিছু বাদ দিলেও শুধু রম্য গল্প সমগ্রে'র প্রথম দুটো পর্বই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রম্য গল্পকার হিসেবে দাপটের সাথে তাঁর অবস্থান থাকার কথা।
শুধু কি রম্য মৌলিক শিশু সাহিত্যে সুকুমার রায়ের পরে তাঁকে টেক্কা দেবার মত আর কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না। তার প্রকাশিত শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ ১১টি। শিশু-কিশোর গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা ২০টি। একসময় শিশু-কিশোরদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন!
তাঁর দুর্ভাগ্য যে, তিনি সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই সম্ভবত দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। ফার্স্ট বয় হতে পারেননি কখনো। কাজী নজরুল ইসলামের পরে বাংলা ভাষায় তিনি সবচেয়ে বেশী 'নাত' লিখেছেন। এখানেও তিনি দ্বিতীয়।
ভেবে দেখুন এই লেখকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নারিন্দা লেন’ বেরিয়েছিল ১৯৮১ সালে।এরপরে মাত্র ১৭-১৮ বছর তিনি লেখালেখি করেছিলেন।এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ তিনটি,উপন্যাস ২০টি, গল্পগ্রন্থ ৩০টি, শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ ১১টি, শিশু-কিশোর গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা ২০টি ও ইতিহাস ঐতিহ্য ও জীবনী-গ্রন্থ পাঁচটি। এর পরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর অগন্থিত লেখার সংখ্যা অগণিত। স্বাধীনতাপূর্ব ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখা উপন্যাস ও কবিতা, ভুতের গল্প, ধর্ম বিষয়ক লেখা থেকে শুরু করে সাহিত্যের সব শাখাতেই বিচরণ ছিল তাঁর।
আশির দশকে তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসের পাঠকপ্রিয়তা তাকে অনেক বেশি জনপ্রিয় করেছিল। তাঁরলেখার মূল উপজীব্য ছিল গ্রাম বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ গাঁথা জীবনের বাস্তব গল্প, শহুরে জীবনের বাস্তবতা ও তার আশপাশের চরিত্র।
ছোটগল্প লেখায় ছিলেন পারদর্শী। তাঁর ছোটগল্প পড়া শুরু করলে পাঠক ছেড়ে উঠতেই চাইবে না। বিশেষ করে রবীন্দ্র পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে ছোটগল্প রচনায় যেসকল সাহিত্যিক বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি ইসলামী শিশু সাহিত্যও রচনা করেছেন। যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে। এছাড়া, তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় গীতিকার। নজরুল পরবর্তী প্রসিদ্ধ নাত লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
কি গল্প,কিউপন্যাস কিংবা ছড়া বা কিশোর সাহিত্য; সর্বত্র ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। বিশেষ করে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী।তাঁর ছড়া ছিলো হাস্যরসে ভরা। গাছগাছালি ও পাখপাখালি নিয়ে মজার মজার কবিতা আর রোমাঞ্চে ঠাসা রহস্য আর গোয়েন্দা কাহিনি যা পাঠক মহলে আজও সমাদৃত। আরও লিখেছেন হালকা মজাদার অসংখ্য হাসির গল্প। গা ছমছম করা বিভিন্ন অভিযানের কাহিনি। লিখেছেন মিষ্টি মজাদার ছড়া। তার ছড়ার মূল উপজীব্য ছিল গ্রামবাংলার রূপ আর সমসাময়িক সব ছোটখাটো ঘটনার জীবন্ত বর্ণনা। ছোটগল্প লেখায় মুসলেহউদ্দিন ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর ছোটগল্প পড়া শুরু করলে পাঠক একটানা না পড়ে উঠতেই পারত না।ছোট গল্পগুলোর মধ্যে ছিল মোপাসীয় চমক। ‘পুরুষ’ তার অন্যতম ছোট গল্প। এ দেশের শ্রমজীবী মানুষ এবং তাদের ওপর নানাবিধ নির্যাতন ও নিপীড়নের সত্য কথন বর্ণনাই ছিল তাঁরসাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয়।
বেশ অন্তর্মুখী, সল্পবাক, ভীষণ মুডি এই মানুষটা কখনোই পাদ-প্রদীপের আলোয় আসতে চাননি। আমি জানিনা ঘটা করে কোন পত্রিকায় বা মিডিয়াতে তাঁর কোন সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে কি-না কিংবা তাঁর জীবিকা ও সাহিত্য জীবন নিয়ে কোন বড় লেখা প্রকাশ হয়েছে কিনা? অন্তর্জালের দুনিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো লেখাই পেলামনা!!!
২০০২ সালের সেপ্টেম্বরের এই দিনে তিনি যেদিন ইহলোক ত্যাগ করলেন, তার পরদিন ‘প্রথম আলো’র পেছনের পাতার এক কোণে চার লাইন লিখেছিল মাত্র। আমি সেদিন চরম আপসেট হয়েছিলাম!
কেন তিনি বাংলা সাহিত্যে ব্রাত্য? কোনো সাহিত্য সভায় তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন নিয়ে একটা আলোচনা সভারও আয়োজন হয় না কেন?
এটা ঠিক, তাঁর প্রফেশনের কারণে সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বাধ্য হয়ে দূরে থাকতে হোতো। ইচ্ছে করলেই কোনো সাহিত্য সভা বা বইমেলায় মোড়ক উন্মোচন করতে পারতেন না। কবি সাহিত্যিকদের সাথে বাইরে বসে আড্ডা দেয়ার উপায় ছিলনা। তার আশেপাশে ঘেঁষতেই অনেকে ভয় পেত। সে কারণেই হয়তো সাহিত্য সভায় তিনি হয়েছিলেন ব্রাত্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন কিছুদিন শিক্ষকতা শেষে ১৯৫৭ সালে তিনি তৎকালীন সিএসপি পরীক্ষায় (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং তিনি বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার প্রথম সিএসপি অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
~কর্মজীবনে খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) লেকচারার, বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর (বিলুপ্ত) মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত আইজিপি এবং বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প সংস্থার চেয়ারম্যানহিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর নেন।
আবু খায়ের মুসলেহউদ্দিনের নিজের লেখা ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ থেকে তাঁর জন্মের গল্পটা শুনে নিই;
~নানাদের গ্রামের নাম লৎসার। কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানার ছোট্ট গ্রাম। একটু দূরে গ্রাম ঘেঁষে একটি আঁকাবাঁকা খাল। ডাকাতিয়া নদী থেকে খালটি এসেছে। এই খাল দিয়ে কত নৌকা যেত দূর গ্রাম গঞ্জে। কোষা নৌকার বাঁকা ছৈ এর নীচে টুং টাং চুড়ি বাজিয়ে বউ-ঝিরা নাইওর যেত বাপের বাড়ি। আমরা, আমার মা এবং আমার ছোট ভাই-বোনেরাও নানাবাড়ি আসতাম আশ্বিন -কার্তিক মাসে। তখন মাঠের পানি কমতে শুরু করেছে। কোনাকুনি মাঠ দিয়ে নৌকা চলতে পারত না ঘন সবুজ ধানের বাঁধা ঠেলে। জেলেরা খালে ভেসালের জাল ফেলে মাছ ধরত। রুই, কাতলা, চাপিলা, বোয়াল, কালিবাউস ,আরো কত মাছের ভারে জাল টেনে ওঠাতে পারেনা ওরা। খালে বাঁধ দিয়েছে বাঁশের ফালি দিয়ে, সেখানটায় চাই পেতে চিংড়ি, বেলে, বাইন, আর মেনি মাছ ধরছে দিনভর। খাল জুড়ে তখন শাপলা ফুলের ছড়াছড়ি। পাতার ফাঁকে ফাঁকে গোল গোল শালুক ভাসছে।পানকৌড়ি ডুবিয়ে ছোট মাছ ধরছে নৌকার কাছাকাছি। দারুণ ভাল লাগতো মামাবাড়ি যেতে যেতে অত্তো সব মজা দেখতে।
জন্ম আমার নানা বাড়িতে । ১৯৩৪ সালের ২০শে এপ্রিল। সেদিন ছিল সোমবার, খুব ভোরে উঠে গেছেন নানা। আরবি, ফার্সি এবং উর্দুর নামকরা পণ্ডিত; ধর্মপ্রাণ সাধু পুরুষ।
ফজরের নামাজের পরে জায়নামাজে বসে সুখবরের অপেক্ষা করছেন।ঊষার আলো ছড়িয়ে পড়েছে পূব আকাশে। নানী নকশিকাঁথা পেঁচিয়ে নানার কোলে তুলে দিলেন সদ্য ভূমিষ্ঠ নাতিকে। আর তখখুনি হাতের পাতায় তুলে মোনাজাত করলেন নানা, যেন আমি শেখ সাদির মত সাধক কবি হই বড় হয়ে। নানার সে প্রার্থনা আংশিক সত্য হয়েছে বোধ হয়। সাধক না হলেও আমি কবি হয়েছি। অবশ্য, আমি শেখ সাদির মতো বিশ্ববিখ্যাত কবি নই। বাংলাদেশের সাধারণ কবি।
শেখ সাদির আসল নাম মুসলেহউদ্দিন। সে নামে নামকরণ করলেন নানা - আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন। তিনি আমাকে সাদি বলে ডাকতেন। সময়ের সাথে সাথে সে নামটি চাপা পড়ে গেছে।
তার পিতার নাম অধ্যাপক মাও: আবদুল আউয়াল ও মাতার নাম হাফসা খাতুন।পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মুসলেহউদ্দীন ছিলেন বড়।
পিতা অধ্যাপক মাওলানা আব্দুল আউয়াল ছিলেন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার প্রথম এম.এ (প্রথম মাস্টার্স পাশ)। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ ১৯৩৬ এবং কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে এম এ প্রথম শ্রেণী। তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরে তৎকালীন পাকিস্তান কলেজ এর প্রথম বাঙালি মুসলিম প্রিন্সিপাল। ১৯৫০ সালে যখন মুসলেহউদ্দীন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন তখন তিনি কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বড় হন তিনি এবং ভাইবোনকেও তৈরি করেন মানুষ হিসেবে।
তিনি কি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আন্ডার রেটেড বা অবমূল্যায়িত লেখক নন? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি নিশ্চিতভাবে তিনি তাঁর যোগ্য মূল্যায়ন পাননি।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
শিক্ষিত এবং মহা-শিক্ষিত যে কেউ আমি পেশায় ডাক্তার শুনে চোখ কপালে তুলে বলেন, ডাক্তার হয়েও আপনি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন! তারপর পিঠ চাপড়ানির ভঙ্গিতে বলেন, বাহ! বাহ!ভালো! বেশ ভালো!ভাবখানা এমন যে, লেখক বা কবি শুধু লেখক-কবিই হবেন। তাদের আর কোনও পেশা থাকবে না। অথবা সাহিত্য বোধহয় কেবলমাত্র সাহিত্যের ছাত্র-শিক্ষকদের কাজ। এখন আর আগের মতো বিরক্তি প্রকাশ করি না। শুধু বলি, এই দেশে লেখালেখির উপার্জন দিয়ে কারো পক্ষে ভদ্রস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব হয় না। তাই লেখক-কবিদের একটা কোনো পেশা থাকে। কেউ শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ আইনজীবী, কেউ জজ, কেউ ঠিকাদার, কেউ প্রকাশক, কেউ এনজিও-কর্মী, কেউ পুলিশ, কেউ সামরিক অফিসার, কেউ আমলা...
পেশায় আমলা লেখক-কবিদের নিয়ে আবার খোদ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেই নানারকম মানসিক জটিলতার পরিচয় পাওয়া যায়। ক্ষোভ প্রকাশও দেখা যায়। এই জিনিসটা আমাকে অবাক করে। কখনো বিরক্তিও উৎপাদন করে। অন্য পেশার লোক কবি-সাহিত্যিক হতে পারলে আমলারা কেন হতে পারবেন না? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তো আমলাই ছিলেন। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। আ ক ম জাকারিয়া ছিলেন। আবদুস শাকুরও। সমর পাল অগ্রগণ্য ইতিহাস-চর্চায়। ভুঁইয়া শফিকুল ইসলাম, মোস্তফা মহিউদ্দীন, শহীদুল জহির আমলা ছিলেন। এটা কি কারো মনে আছে? কামাল চৌধুরী, আসাদ মান্নান, মোহাম্মদ সাদিক তো ছাত্রজীবন থেকেই কবি। পরে আমলা হয়েছেন জীবিকানির্বাহের জন্যই। মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক আছেন। রহমান হেনরী আছেন, নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর আছেন। মাসউদুল হক, জাকির জাফরানও আছেন। অনেক প্রতিশ্রুতিময় কবিত্বশক্তি নিয়ে এসেছেন ইমতিয়াজ মাহমুদ। আছেন আরো কেউ কেউ।
পুলিশে চাকরি করা রহমান শেলী আছেন। আছেন আরো কেউ কেউ। ছিলেন আবু ইসহাক। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা লিখছেন। কাজী রাফি তো সবসময় লেখার মধ্যেই থাকেন। আছেন আহমেদ আব্বাস। খোশরোজ সামাদ। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা তখনই বাঁধে যখন কেউ আমলা হিসাবে ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে নিজের গৌণ ও অক্ষম লেখা অন্যদের গেলানোর চেষ্টা করেন। পুরস্কারের জন্য লবিং করেন এবং করান। তা এই ধরনের সুযোগ তো অন্য পেশার লোকেরাও নিতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেই তিনি বুদ্ধিজীবীতার দাবিদার হয়ে পড়েন। বাংলা একাডেমির চাকুরেরা চাকুরিসূত্রেই কবিত্ব ও লেখকত্বের অধিকার পেয়ে যান। সেইসাথে সাহিত্যের অভিভাবকত্বও।
মেধাধর আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের সাহিত্যচর্চা শুরু স্কুল জীবনে দেয়াল পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তাঁর অনেক লেখা জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমদিকে সমাজের শ্রমজীবী মানুষ এবং তাদের উপর নানাবিধ নির্যাতন ও নিপীড়নের সত্য-কথন বর্ণনাই ছিল তাঁর সাহিত্যকর্মের মূল উপজীব্য বিষয়।
আবু রূশদ। জুন ১৮, ২০২০ (সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও সাংবাদিক। বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদকঃ অন্য দিগন্ত।)
যত দিন দৈনিক পত্রিকায় কাজ করেছি তত দিন কখনো পুলিশ নিয়ে কোনো রিপোর্ট করিনি বা করতে হয়নি। কারণ, ওটা আমার সাবজেক্ট ছিল না। এছাড়া পুলিশ নিয়ে নেতিবাচক ধারণাই ছিল বেশি। নানা কাহিনী শুনতাম কলিগদের কাছে। জীবনে একবারই শুধু একজন পুলিশ অফিসারের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তিনি ছিলেন আমার পিতার বয়সী। মরহুম আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন। বাংলাদেশ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজি, অতিরিক্ত আইজি ছিলেন। তাঁর আরেকটা বড় পরিচয় হলো তিনি একজন প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। চাকরিকালে তদানীন্তন পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সুপরিচিত ছিলেন ডাকসাঁইটে কর্মকর্তা হিসেবে । তাঁর লেখনীতে জাদু ছিল। তাঁর লেখা কোনো গল্প বা বই একবার শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যেত না।
নব্বইয়ের দশকে তখন দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও কয়েকটি সাপ্তাহিক,পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতাম। ওর মধ্যে একটি ছিল পাক্ষিক পালাবদল। পালাবদলের এক অনুষ্ঠানে আমি বসেছিলাম আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের সাথে। একবার খাবার টেবিলে তার ঠিক পাশেই বসেছি আমি। তিনি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নানা প্রশ্ন করছেন। তার কাছে বিস্ময়কর ছিল কেউ সেনাবাহিনীর অফিসার থেকে সাংবাদিক হয় কিভাবে? অত্যন্ত রাশভারী কিন্তু অমায়িক।
সম্ভবত এযাবতকালে আবুল খাঁয়ের মুসলেহউদ্দিনকে নিয়ে একটা মাত্র ফিচার খানিকটা ভিন্ন রকম তথ্য দিয়ে একটু বড় কলেবরে প্রকাশ করেছিল দৈনিক ইত্তেফাক ২১ জুন,২০১৭ সালে ‘তাঁদের কি মনে রেখেছি?’ শিরোনামে। শেষের অংশটুকু একটু এদিক ওদিক করে যেটা আমি হুবুহু তুলে ধরছি;
বিশেষ রচনা-দৈনিক ইত্তেফাক
ফরিদ আহমেদ- কর্ণধার; সময় প্রকাশনা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ সংস্থা দুটির নাম সেই শহরের লোকজনের কাছে পরিচিত ছিল, কিন্তু দেশের বাইরের শহরগুলো এ সম্পর্কে খুব একটা জানত না। বাংলাদেশ পুলিশ সারা দেশের পুলিশের কার্যক্রম পরিচালনা করত। থানায় থানায় পুলিশের জন্য আলাদা পোশাকের প্রচলনও হয়নি। পুলিশের কেন্দ্রীয় অফিস ঢাকায়। কেন্দ্রের পুলিশ যে রঙের পোশাক পরেন সারা দেশের পুলিশের পরিধানের পোশাকের রংও তা-ই। পুলিশের বড় একজন কর্মকর্তা আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন। দেশের বিভিন্ন থানায় দায়িত্ব পালন করেছেন। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। বড় পুলিশ অফিসারের পাশাপাশি তাঁর আর একটি পরিচয় আছে—তিনি একজন লেখক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। তরুণ বয়সে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন এবং এই অভিজ্ঞতার একটি অংশ ঢেলে দিচ্ছেন সাহিত্যে। চোর, ডাকাত, খুনি, অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের খুব ভালো করে কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। তাদের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসা—এগুলোই মুসলেহউদ্দিন সাহেবের লেখার মূল উপজীব্য ছিল।
হোসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের শেষের দিক। পুলিশের গুরুত্ব দেশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর দেশে আর্মির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে শুনেছিলাম। তবে গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শেষ বছর দুটিতে এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের ব্যস্ততা সবাই দেখেছে। ওই আন্দোলনের সময়টা খুব ভালো করেই উপলব্ধি করেছিলাম। কিছুটা উপভোগও করতাম। ঢাকার আজিমপুরের শেখ সাহেব বাজারে তখন আমার প্রেস কাম প্রকাশনা অফিস। হরতাল-অবরোধের কারণে অনেক ফ্রি সময় কাটত আড্ডা দিয়ে। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ওই এলাকা থেকে পরদিনের আন্দোলনের পরিকল্পনাগুলো শুনতাম। আবার নিজের প্রকাশনা নিয়েও পরিকল্পনা করতাম। এক-দু বছর হলো ‘সময় প্রকাশন’ যাত্রা শুরু করেছে। কোন কোন লেখকের বই প্রকাশ করা উচিত সে-রকম একটি সংক্ষিপ্ত তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকায় আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন নামটাও আছে। তখন তিনি বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহা-পরিচালক। বসেন সচিবালয়ে বাংলাদেশ পুলিশের সদর দপ্তরে। সেই সময়ে আমার লেখক শিকারে সহযোগী শিকারি ছিলেন শিশু-সাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম। কী কারণে যেন এই অ্যাডভেঞ্চারে আমীরুল আমাকে সঙ্গ দিলো না বা দিতে পারল না। পরিচিতদের কাছ থেকে মুসলেহউদ্দিন সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলাম। কেউ কেউ বেশ ভীতিমূলক কথাবার্তাও বললেন। একজন একটি গল্পও শোনালেন। গল্পর মূল উৎস একটি দৈনিক পত্রিকার একজন সাহিত্য সম্পাদক। একদিন তিনি টেবিলের ওপর অনেকটা উপুড় হয়ে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন। হঠাৎ বিকট শব্দে চমকে গেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন পাশে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন খাকি পোশাকের এক পুলিশ সদস্য। কোমরে গোঁজা পিস্তল। এই সদস্য মেঝেতে জোরে বুটের বাড়ি দিয়ে সম্পাদক সাহেবকে সেল্যুট ঠুকেছেন। আর এই শব্দেই চমকে গিয়ে সম্পাদক সাহেব কিছুটা ভয়ও পেয়েছেন। পুলিশ সদস্যের দিকে তাকাতেই সম্পাদক সাহেবের দিকে একটি খাম এগিয়ে ধরলেন তিনি। খাম খুলে দেখেন একটা গল্প। তখনকার মতো ড্রয়ারে রেখে দিলেন। দু দিন পর আবারও জোরে বুটের শব্দ। ‘স্যারের লেখাটা কবে ছাপা হবে?’ বুটের শব্দের ভয়ে লেখা ছাপা হয়ে গেল। তবে তখনকার বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য বিভাগ-সহ ঈদসংখ্যাতেও তাঁর লেখা বেশ গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হতো।
আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। বই বের করতে চাই বললাম। অল্প কিছু কথাবার্তার পরই তিনি আরেক দিন আসতে বললেন। সেদিন একটা আস্ত উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হাতে ধরিয়ে দিলেন। নতুন ব্যবসা, পুঁজি কম বিধায় কর্মচারীও কম। তার ওপর সচিবালয়ে পাঠানোর মতো উপযুক্ত কাউকে না পেয়ে আমি নিজেই যেতাম। প্রধান ফটকে গিয়ে আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের নাম বললেই এক সেল্যুট ঠুকে ভেতরে নিয়ে যেত। পরিপাটি রুমের এক কোণে বেতের ফলস মুভিং পার্টিশন দিয়ে আড়াল করা স্থানে বসার স্থান। সোফায় গা এলিয়ে বসতাম। ঝকঝকে কাপ-পিরিচে চা-বিস্কুট আসত। চা পান করতে করতেই কখনও লেখক এসে আমার সঙ্গে চা পানে যোগ দিতেন। অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে কখনও দেরি হতো। কিন্তু দেখা করতেন। প্রকাশককে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি ভালো লাগত। আমি তখন খুবই তরুণ এবং নতুন প্রকাশক। ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ বইমেলায় সময় প্রকাশন থেকে আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের লেখা উপন্যাস ‘অসতী’ বের হলো। নতুন বই নিয়ে তাঁর অফিসে যাবার পর মিষ্টি এনে খাওয়ালেন। খুব আস্তে করে শুধু বললেন, ‘বইটা ভালোই হয়েছে। ফন্টটা আর একটু ভালো হলে ভালো হতো।’
আরও অন্তত এক দশক আগে থেকে এই লেখকের বই বের হচ্ছে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও অর্ধ শতক ছাড়িয়ে গেছে। পাঠক ও লেখক-মহলে একটি ভালো পরিচিতি আছে। কোনো কোনো বই ভালো বিক্রি হয়েছে। একসময় তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে আসীন হয়ে অবসরে যান।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
এরপরের বিষয়টা বেশ ধোঁয়াশা! আচমকাই তিনি সাহিত্য অঙ্গনে পদচারনা বন্ধ করে দেন। অনেকেই আশা করেছিলেন যে, অবসর জীবনে গিয়ে তিনি হাতখুলে নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখালেখি শুরু করবেন, কিন্তু হলো উল্টো! তিনি একেবারেই লেখালেখি বন্ধ করে নিজেকে আড়ালে সরিয়ে নিলেন।এর পরও আরও অনেক বছর তিনি দেশেই ছিলেন কিন্তু সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর উপস্থিতি ছিল না। অনেকে বলতেন তিনি ইচ্ছা করেই নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ বলতেন অসম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার জন্য পরিবার আত্মীয়দের থেকেও নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। তবে তখনকার লেখকদের সঙ্গে খুব একটা ওঠা-বসা তাঁর ছিল না। হয়তো বা নিজেদের সার্কেলেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন নিজেকে। আস্তে আস্তে আমাদের স্মৃতি থেকেও মুছে যেতে লাগলেন আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন।
নিরবে নিভৃতে চলে গেলেন একদিন- ভাল করে জানলও না কেউ। কেন তার এই অভিমানী নির্বাসন-কেউ জানবেনা কোনদিন।
এখনকার পাঠক কেউ কি পড়েছেন তাঁর বই? নতুন প্রজন্মের প্রকাশকরা ক’জনাই বা জানেন তাঁর নাম?
আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন ২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মাত্র ৬৮ বছর বয়সে ঢাকার ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে ইন্তেকাল করেন। তাকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
তিনি তাঁরসাহিত্যকর্মের জন্য আসাফউদ্দৌলা রেজা স্মৃতিসাহিত্য পুরস্কার,কবি আবুল হাসান স্মৃতিসাহিত্য পুরস্কার, কবি জসীমউদ্দীন স্মৃতিসাহিত্য পুরস্কার,ফরিদপুর পৌরসভা সাহিত্য পুরস্কার ও সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
জনপ্রিয় এই কথাশিল্পী কখনই পুরস্কার পাওয়ার জন্য সাহিত্যচর্চা করেননি বরং তিনি লিখেছেন আমাদের বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য।
-------------------------------------------------
অর্ন্তজাল দুনিয়াতে আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের একটা মাত্রই ছবি পাওয়া যায়, তাও ঝাঁপসা চেহারা প্রায় চেনা যায়না। সবচেয়ে আবাক করা মত বিষয় অভিনেতা আবুল খায়েরের নাম দিয়ে খোঁজ দিলেও সেই ছবিখানাই মেলে। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার যে, আমি অনেক খুঁজেও উইকি'র ইংরেজী ভার্সানে তার দু লাইনের জীবনী পাইনি( বাংলায় একটুখানি আছে)- আফসোস বড়ই আফসোস!!
অর্ন্তজালের একমাত্র ছবি
এটা সম্ভবত তার ছোট বেলার ছবি। অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছি।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ ব্লগার মোস্তাফিজুর রহমান তমাল!