চল্লিশে নাকি চালসে আর বয়স পঞ্চাশে আসলে হয় পানসে। হ্যাঁ খানিকটা পানসে হয় বটে কিন্তু এই সময়টা অভিজ্ঞতার ভারে পরিপূর্ণ হয়। মানুষ জীবনের ফাঁক ঝোঁক জেনে ফেলে। প্রথম যৌবনের প্রেমটাকে নেহায়েত শিশুসুলভ ফ্যান্টাসি মনে হয়। ছেলেবেলা কিংবা স্কুলের বন্ধুগুলো দূরে যেতে যেতে এতদূরে চলে যায় যে, কোন একদিন ‘বন্ধুর জন্য জান হাজির ছিল’ সে কথাগুলোকে তখন ফাঁকা বুলি মনে হয়। বাস্তবতা আর বাস্তবতার নিষ্পেষণে মানুষ এই বয়সে এসে যৌবন আর কৈশোরের সব আবেগ ভাবাবেগ হারিয়ে ফেলে। চারপাশের সবাইকে মনে হয় ছিদ্রান্বেষী আর স্বার্থপর। এসবের সাথে তাল মিলিয়ে বড় মনেরমানুষেরাও শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে।
আহ্ কৈশোর আর যৌবনের বন্ধুত্ব! কি দুর্দান্ত দিলখোলা বন্ধনহীন সম্পর্কটাই না ছিল সেই সময়ে।
বেশ কদিন ধরে একটা গান শুনছিলাম – ওটিটি প্লাটফর্মের একটা ওয়েব সিরিজের; আধুনিক ছেলে-পেলেদের মনের ভাব প্রকাশ-পেয়েছে দারুণভাবে কিন্তু বন্ধুত্বের অর্থ সেই আদ্যিকালের পুরনোই রয়ে গেছে;
লাগলে বলিস,
জায়গায় বসে আওয়াজ দিস।
কলিজাটা ছিঁড়ে তোকে দেবো
লবণ মাখিয়ে নিস।
একা লাগলে বলিস,
মনে মনে আমার নামটা নিস,
তোর মুড অন করে দেবো,
একটা ট্রিট দিয়ে দিস।
উড়ি একসাথে মিলে মিশে-উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে
চল বন্ধু চল- চল বন্ধু চল- চল বন্ধু…. চল
একসময় কলিজাটা ছিঁড়ে দেবার জন্য যেই বন্ধুরা ছিল আজ তারা কোথায় হারিয়ে গেছে। বাস্তবিক জীবনের চাপে ভুলে গেছে সেই বন্ধুত্বের ভাবাবেগ। আমিও পালটে গেছি অনেক। তবুও এখন শুধু হারানোর সময়; বন্ধুদের চিরদিনের জন্য হারানোর সময়, সময় এতদিন ধরে তৈরি করা কিংবা এমনি এমনি হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলোর চির বিচ্ছেদের- কোন একসময় সবাইকে ছেড়ে আমার চির প্রস্থান।
এই বয়সে এসে নতুন করে অকৃত্রিম বন্ধু পাবার আর সুযোগ নেই, প্রায় সব সম্পর্কগুলো পোশাকি। এখন এঁর কেউ কারো কলিজা ছিঁড়ে দিতে রাজী নয়। যার যার কলিজা সংরক্ষণে সে সে ব্যস্ত।
ব্লগ আর ফেসবুকের কিছু সম্পর্ক তবু ফেলনা নয়। বহুদূরের এই মানুষগুলো কখনো নিকটজন আর আপনজন থেকেও অনেক আপন হয়ে যায়। আমি আষ্টেপৃষ্ঠে এই সম্পর্কগুলোর সাথে জড়িয়ে থাকতে চাই। ভাবি; ব্যক্তিগত স্বার্থ, অর্থ, যশ কিংবা সামান্য নিজের লাভের জন্য কত মানুষকেই না কষ্ট দিয়েছে, কতদিনের সম্পর্কগুলো এক টোকায় ভেঙ্গে ফেলেছি। অনেক হয়েছে আর নয়। জীবনের সব ভুলগুলো এবার শুধরে নেব। সামান্য একটা সৌহার্দপূর্ণ কথায় ২০ বছরের ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক জোড়া লেগে যায়। সেই সামান্য ব্যাপারটাকে কেন আমরা সামনে আনতে চাইনা? অল্প একটু ব্যক্তি স্বার্থের জন্য হুলস্থূল গণ্ডগোল বাঁধিয়ে ফেলি। কখনো নিজের জন্য কখনো অন্য কারো জন্য।
আসুন নিজে পাল্টাই- অন্যকে পালটে যেতে উদ্বুদ্ধ করি।
যদিও প্রবাদ আছে;
ইজ্জত যায় না ধুইলে
খাইছলত যায় না মইলে।
ভাবছি সব পালটে নিব কিন্তু খাইছলত বড্ড বেশী যন্ত্রণা দেয়- আমাকে আমার বিশুদ্ধ ভাবনায় থাকতে দেয় না।
আজ থেকে প্রায় ২২ বছর আগের লেখা ‘তিন চাকায় বাঁধা জীবনে’র এই গল্পগুলোর সাথে। আমি এই বয়সে এসে উপলব্ধি-বোধের কিছু কথা শেয়ার করব। এবার চলুন মুল গল্পে। না গল্প নয় সত্য কাহিনী; সালঃ ১৯৯৮
***
আগে আমি বৃদ্ধ রিক্সা চালকদের রিক্সায় পারতপক্ষে উঠতাম না। কারন; আমার বাবার বয়সী একজন বৃদ্ধ-লোক তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্যাডেল চাপবে আর আমার মত সুস্থ সবল একজন লোক নিষ্কর্মার মত তার রিক্সায় বসে থেকে চার পাশের দৃশ্য উপভোগ করবে ব্যাপারটা আমার কাছে নিতান্তই অমানবিক মনে হত। তাছাড়া বয়স্ক রিকশাচালকরা একটু বদমেজাজি হয়।
পরে ভাবলাম ..কেন সে এই বয়সে রিক্সা নিয়ে পথে নেমেছে ? নিশ্চয়ই সখের বশে নয়। তবে কেন? কারণটা কারোই অজানা নয়।
প্রথমত: আমি না চড়লেও কেউ না কেউ তো তার রিক্সায় চড়বে ।
দ্বীতিয়তঃ আমার মত প্রত্যেকেই যদি মানবিকতার খাতিরে তার রিক্সায় না চড়ে তবে তার সেই প্রধান উদ্দেশ্য(উপার্জন) সফল হবে কি ভাবে। আর বদ মেজাজ। ওই বয়সে শুধু পেটের দায়ে যারা প্রখর রোদ আর মুষল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে গতর খেটে উপার্জন করে তাদের শরীর ও মন ক্ষণে ক্ষণে বিদ্রোহ করাই স্বাভাবিক ।
একদিন কাঠ ফাঁটা রোদে আমি রিক্সায় হুট টেনে বসে অন্য মনষ্ক হয়ে কি যেন ভাবছিলাম। হঠাৎ রিক্সার গতি খুব মন্থর হয়ে যাওয়াতে চোখে বিরক্তি নিয়ে চালকের দিকে তাকিয়ে রূঢ় ভাষায় কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেলাম।
প্রথম দিকে আমি তাকে ভাল করে লক্ষ্য করিনি তবে এখন খেয়াল করলাম যে চালকটি ছিল যথেষ্ট বয়স্ক । তার সারা শরীর দিয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে মাঝে মাঝে সে এক হাতদিয়ে হ্যান্ডলটা ধরে অন্য হাতে রাখা ত্যানার মত ভেজা গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে। একহাতে রাখা রিক্সার হ্যান্ডল টা তখন তির তির করে কাঁপছিল।
আমি অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য তাড়াতাড়ি হুট চেপে ধরলাম। তার অবস্থা দেখে আমার কিছুটা করুণা হল। কিছু না বলে বিরক্ত মুখে বসে রইলাম…
কিছুক্ষণ এভাবে চালানোর পরে রাস্তার পাশ ঘেঁষে একটা গাছের নিচে রিক্সাটা দাড় করাল। আমি ভাবলাম আহা বেচারা হয়তো খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে একটু বিশ্রাম নিক। সে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে রিক্সা থেকে নেমেই কোমড় থেকে লুঙ্গির গিট খুলে একটা ঔষুধ বের করল। সেটাকে দুভাগ করে একভাগ জ্বিহ্বার নিচে পুরে দিয়ে কিছুক্ষন ঝিম মেরে বসে রইল। ( তখন এই ওষুধটা সন্মন্ধে ধারনা ছিল না)
মিনিট পাঁচেক হয়তো এভাবে ছিল ,তার পর আবার উঠে দাড়াল। দাঁড়াল রিকসা টাকে টেনে নিয়ে চলল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ঠিক আগের মত সাবলীল ভাবে।
ব্যাপারটা স্বভাবতই আমাকে একটু আশ্চর্য ও কৌতূহলী করল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি জন্যে সে ঔষধ খেল?।
সে অনেকটা অনিচ্ছাকৃত ভাবে বলল,'এমনিই।'
যথাসময়ে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছানোর পর প্রশ্নটা তাকে আবার করলাম। তার আকস্মিক অসুস্থতার কারন। যদিও তার এই বয়সে অসুস্থ থাকাই স্বাভাবিক কিন্তু সামান্য একটু ঔষধ খাওয়ার পরক্ষণেই সুস্থাবস্থায় ফিরে আসার কারনটা জানার জন্যই তাকে প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করলাম।
সে মাথাটা নিচু করে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল তারপর মুখ উঠিয়ে আমার দিকে ছলছল চোখে চেয়ে বলল ,’কয়দিন আগে আমার হার্ট এ্যাটাক হইছিল— ডাক্তার আমারে ওই অষুধটা দিছে। কইছে যদি আবার ওই রকম খারাপ লাগে তাইলে সঙ্গে সঙ্গে যেন ওই অষুধটা খাই। আপনারে নিয়া আসার সময় আমার ওইরকম লাগতেছিল। ’ এইটুকু বলেই সে থামল।
তার প্রতি আমি যথেষ্ট সমবেদনা অনুভব করেছিলাম তখন- তার সন্মন্ধে আরো কিছু জানতে চেয়েছিলাম প্রতিউত্তরে সে যা বলেছিল তার সারাংশ তুলে দিলাম;
‘ঢাকায় এসেছে সে বছর খানেক তার পুরো পরিবার সহ । কিছুকাল আগেও সে ছিল গ্রামের একজন অবস্থাপন্ন কৃষক- গ্রামে যাকে গেরস্ত বলে। নিজের জমি তো ছিলই প্রচুর জমি সে বর্গাতেও চাষ করত। ফসল যা পেত তা থেকে খেয়ে পরে উদ্বৃত্ত্বই থেকে যেত। পরিবার বলতে সে আর তার তিনটি মেয়ে কোন ছেলে নেই। দিন বেশ চলে যাচ্ছিল। হঠৎ নদীর ভাঙ্গন তাকে সর্বস্বান্ত করে দিল গ্রাস করে নিল তার সব জমি। এ অবস্থা শুধু তারই নয় আরো অনেকেরই হয়েছিল। জমির স্বল্পতার জন্য যেসব জমি সে বর্গায় চাষ করত সেগুলি তাদের মালিকরাই চাষ করতে শুরু করল। তাছাড়া হঠাৎ তার পরিস্থিতি অবনতির জন্য সে শারীরিক ও মানসিক ভাবে খুব ভেঙ্গে পরেছিল অনেকদিন শয্যাশায়ী ছিল। তার চিকিৎসা ও সংসার খরচ চালাতে গিয়ে গচ্ছিত যেটুকু সম্পদ ছিল সেটাও বিক্রি করতে হোল। বড় মেয়ের বয়স ছিল আঠার। দেখতে হয়তো সুন্দরীই ছিল। তার দরিদ্রতা ও অসুস্থতার সুযোগে তাদেরই গ্রামের প্রভাবশালী এক ব্যক্তির বখাটে ছেলে ও তার সাঙ্গ পাঙ্গরা মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে । প্রিয় কন্যার হঠাৎ অন্তর্ধানে সে তখন পাগলপ্রায় । অসুস্থ শরীরে চারিদিকে আতি পাতি করে তার মেয়েকে খুঁজতে থাকে। খুঁজে সে পায় ঠিকই কিন্তু জীবিত নয় মৃত।
ধর্ষণ ও অত্যাচারের অসংখ্য চিহ্ন গায়ে নিয়ে সে পড়েছিল একটা ডোবার ধারে।
এটুকু বলে রিক্সা চালকটি তার ঘাড়ের গামছা দিয়ে চোখ মুছল। পরক্ষণেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’ থাকনা ভাইজান কি হবে এইসব শুইন্যা, সবই আমার কপালের দোষ।’
আমি তাকে অনুরোধ করলাম বাকীটুকু বলার জন্য। কিছুই হয়তো করতে পারব না, তবুও ..
’অভাবের তাড়নায় ও নিজের অক্ষমতার ক্ষোভে লজ্জায় গ্রামে থাকাটাই তার কাছে দুর্বিসহ হয়ে উঠল। তার এক শুভাকাঙ্ক্ষীর অনুপ্রেরণায় বসত বাড়িটাও বেঁচে দিয়ে সব দায় শোধ করে বাকী কিছু পুঁজি নিয়ে পুরো পরিবার সহ ঢাকায় আসে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোন চাকরি না পেয়ে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগে অবশেষে রিক্সা চালনাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে কিন্তু অনভ্যাস বয়স আর অতিরিক্ত শারীরিক ধকল সহ্য করতে না পেরে সে আবার শয্যাশায়ী হয়। আর হার্ট এ্যাটাকটাও হয় তখুনি।এবারের অসুস্থতা তাকে একেবারে কপর্দকশূন্য করে দিল।
তার বউ ও মেয়েদের অন্যান্য বস্তিবাসী প্ররোচিত করল,প্রলোভন দেখাল অন্যের বাসায় ঝিয়ের অথবা গার্মেন্টসের চাকরীর।
কিন্তু সে বেঁচে থাকতে তার বউ বাচ্চাদের এই পরিণতি দেখতে পারবে না।
ডাক্তারের নিষেধ ও অন্য সবার অনুনয়-অনূরোধ উপেক্ষা করে সে আবার রিক্সা নিয়ে রাস্তায় নেমেছে।’
কথা প্রসঙ্গে সে আমায় জানাল, ’প্রথমে আমার প্রশ্নে র দায়সারা উত্তর দিয়েছিল প্যাসেঞ্জার হারানোর ভয়ে!
প্রত্যেকেরই জীবনে নিজস্ব কিছু গল্প থাকে যেমন আছে এই সকল হত-দরিদ্র রিক্সা চালকদেরও। ক’জনের খবরই আমরা রাখি।
এই লোকটি ভাগ্যের বিড়ম্বনা ও চরম দারিদ্র্যতার জন্যই বাধ্য হয়েছে রিক্সা চালাতে।
আমাদের ঢাকা শহরে কয়েক লাখো রিক্সা চালকের মধ্যে খুঁজলে এমন অনেককেই পাওয়া যাবে এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বয়স্ক অসুস্থ লোকটির পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার মানসিক দৃঢ়তা আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করেছিল।
***
আগের পর্বঃ
এক শৌখিন রিকশা চালকের গল্প