https://www.somewhereinblog.net/blog/belablog/30357500
গতকাল সোহানী আপুর নিবন্ধটা পড়ে নব্বুই দশকের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল! তখনো বোতলজাত পানি সেভাবে বাজার দখল করতে পারেনি। পলি ব্যাগে ২.৫০/ ৩টাকা করে পানি পাওয়া যেত দোকানে, বোতলের পানির থেকে দাম কম হওয়ায় সেগুলোর জনপ্রিয়তা ছিল বেশী- পরে সেটা ব্যান হয়ে যায়। বিশুদ্ধ পানির জন্য সদ্য বাজারে এসেছে বড় বড় জার ভর্তি পানি- বোর বড় বেকারি হোটেল মলগুলোতে খদ্দেরগুলোতে আকৃষ্ট করার জন্য সেই পানির কদর বাড়ছিল দিন দিন।
সবাই নাকি বিশুদ্ধ মিনারেল ওয়াটারের নাম করে ট্যাপের পানি ভরে দেয়। দেশটা একেবারে উচ্ছন্নে গেল! দেশের সব ব্যাবসায়ীরা দুটাকা লাভের জন্য নিজের নীতি আত্মা বিক্রি করে দিতে দ্বীধা করে না। এই নিয়ে আড্ডায় চরম বাহাস হয়। যুবক ছেলেগুলো সপ্ন দেখে সুযোগ পেলে রাতারাতি দেশটা পাল্টে ফেলার।
আড্ডার মিলন(ছদ্ম নাম) তুখোড় ছাত্র, দারুণ বুদ্ধিমান ও বাঁচাল। হাটা চলা শেখা থেকেই সপ্ন দেখছে বড় ব্যাবসায়ী হবে। ক্লাস এইট থেকেই নানা ব্যাবসার ধান্ধা করছে! কিন্তু সমস্যা একটা নেশায় জড়িয়ে পড়েছে- তাঁর সাথে আড্ডার আরো দু'চারজন জড়িয়ে ছিল। তবে এরা নিয়মিত নেশা করে না। এ হাত ও হাত করে কিছু পয়সা জমিয়ে আমিনবাজারের চিপায় গিয়ে বহু লুকিয়ে ছাপিয়ে দু বোতল ফেন্সিডিল এনে চারজনে ভাগ করে খায়। তবে গাঁজা-মাজা খায় মাঝে মধ্যে। ওই বয়সে একটু গাঁজা মদ কোন পোলাপাইন খায় না ঐসব কেউ ধরে না।
ওর গ্রুপে ছিল আর এক সুদর্শন গায়ক বন্ধু! তাঁর গানের সুরে আড্ডা মাতোয়ারা হয়ে যেত। আমরা সপ্ন দেখতাম নচিকেতার মত সেও কোন একদিন বড় কোন শিল্পী হবে।
দেশের এই দুরবস্থায় চার বন্ধু মিলে কেমনে কেমনে গোপনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তারা ব্যাবসায় নামবে। এভাবে মানুষকে ঠকানো যাবে। ব্যাবসার সাথে সাথে মানুষকে ভাল কিছু দিতে হবে। ব্যাবসায়ী সমাজে নতুন একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে যে দুর্নীতি না করে ভেজাল না দিয়ে ব্যাবসা করা যায়।
২২/২৩ বছরের ছেলে-পেলে বড় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কেনার সামর্থ নেই। ছোট যে করবে তাঁর পয়সা যোগার হবে কেমনে সেই ভাবনায় ঘুম হারাম। হাতে দুই'চারশ টাকা আসলেই ডাইল খাইতে মন চায়। তবুও ওরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ!
মিলনের বড় ভাই বুয়েটে পড়ে। স্বভাবতই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট! কিন্তু তাঁর ওই এক সমস্যা! সে একটু আপ গ্রেটেড ডাইল খোর! প্রতিদিন এক আদ বোতল ডাইল না হলে চলে না।
মিলন গিয়ে ধরল তাকে ভাইজান আমাদের একটা প্লান দেন? ক্যামনে একেবারে অল্প পয়সায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে আমরা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বানাইতে পারি?
ভাই তখন ঘোরে ছিল। ওকে স্বান্তনা দিয়ে বলল মিটিং এরেঞ্জ করতে।
পরের সপ্তাহে খুব গুরুগম্ভীর এক মিটিং হল। মিলনের ভাই ধরে নিয়ে এসেছিল তাঁর এক প্রিয় শিক্ষককে। তিনি নাকি ওয়াটার ট্রিট্মেন্ট প্লান্টের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ!
সেই ভদ্রলোক সারাদিন থেকে খাতা কলমে একে কিছুটা ব্যাবহারিক পরিক্ষা করে সবচেয়ে সহজতম 'পাতন' প্রক্রিয়ায় দেখালেন কিভাবে নোংড়া পানিকে একেবারে বিশুদ্ধ পানিতে রূপান্তর করা যায়!
একটা মরা ইদুরকে কয়েকদিন এক গামলা পানিতে চুবিয়ে রাখার পরে সেই পানি সিম্পল পাতন পদ্ধতিতে পরিশোধন করলে সেটা একেবারে বিশুদ্ধ হয়ে যায়!! অধ্যাপকের কথা শুনে ওরা সেটা দেখে এত হতবাক ও আশ্চর্য হয়ে গেল যে, এত ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে সিম্পলি কয়েকটা বড় বড় পাতিল কিনে ট্যাপের পানি ভরে ক্লোরিন আর ফিটকারি দিয়ে জাল দিয়ে সেটা ঠান্ডা করে জারে ভরে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিল।
বিনিয়োগ ভীষন কম! চারখানা পাতিল। চারটা বড় গ্যাসের চুলা। কয়েকটা জার আর জারের মুখ লাগানোর ম্যানুয়াল মেশিন। ব্যাস হয়ে গেল বিশুদ্ধ পানির কারখানা! ( এই কারখানা করতে গিয়েই তারা দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে গেল)
মার্কেটিং এ খুব বেশী কষ্ট করতে হয়নি। এলিফ্যান্ট রোডের কয়েকটা দোকানী ওদের স্মার্টনেস আর কথাবার্তায় পটে গেল! শুরু হল পরের সপ্তাহ থেকে পানি বেচা। বিকেল থেকে পানি ফোটানো। সারারাত পানি ঠান্ডা করা আর সকালে বোতলে ভরে একটা ভ্যান চালকের সাথে কন্ট্রাক্ট করে সাথে একজন বা দু'জন গিয়ে পানি সাপ্লাই করে আগের পাওনা নিয়ে আসা।
দেশ উদ্ধারের সপ্ন দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে। যে ব্যাবসা তাতে ডাইলের টাকা উঠতে কষ্ট হয়। এরপরেও আগের থেকে স্বচ্ছলতা এসেছে। দু' একদিন পর পর ডাইল খেতে পারে।
***
সেইদিন বেশ জমেছিল! প্রত্যেকে এক বোতল ডাইলের সাথে কড়া লিকারের খাড়া চামচের মিষ্টি চা( এমন চিনি যে চামচ খাড়ায় থাকে) এরপরে গাঁজা। পুরাই জোশ-মজমা, সাথে বাউল গানের আসর। ওইদিকে চার পাতিলে ক্লোরিন আর ফিটিকারির মিশ্রনে পানি ফুটছে।
আসর চলতে চলতেই ওরা চিত কাইত হয়ে ঘুমায় পড়ছে। মাঝরাতে একজন পেসাব করতে উঠে দেখে সারে সর্বনাশ!!
পানিতো সব শুকায়ে গেছে! তাড়াহুড়ো করে সবগুলোরে ঠ্যালা ধাক্কা দিয়ে ওঠাতেই সবার মাথায় হাত। কালকে পানি সাপ্লাই দিবে ক্যামনে???
অনেক ভেবে চিনতে সেই পানিতে সেদিন ট্যাপের পানি ঢেলে না ফুটিয়ে বোতলে ভরে সাপ্লাই দিয়ে আসা হল।
পরের দিন। ভ্যানে করে জার ভর্তি পানি নিয়ে গেছে দুই বন্ধু। নতুন পানি দিবে আর কালকের পাওনা টাকা ওঠাবে।
সর্বপ্রথম বেকারির মালিক তাদের কাছে ডেকে বলল, ভাই পানি আগেই দিয়েন না। বসেন কথা বলি ...
ওদের বসিয়ে তিনি কর্মচারি দিয়ে আশেপাশের দুই চাইরজন দোকানীকে ডেকে আনলেন।
কোর্ট মার্শাল বসল ওদের। গতকাল পানিতে কি মিশাইছিলেন? পানিতে গন্ধ ছিল-খাইতে তিতা লাগছিল আর যতজন লোক খাইছে সবার গাল, জিহ্বা গলা সব ছিল্যা গেছে!!
ওরা দুজন মাথা নিচু করে চুপ! তবে ভদ্র ঘরের ছেলে বলে মাইর খায় নাই। সেদিন আর জার টাকা কিছুই ফেরত পায়নি। ব্যাবসার ইতি ওখানেই। আহা কত সপ্ন ছিল; দেশউদ্ধার আর হোল না!!!!
* তথ্যগত ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। টেকনিক্যাল বিষয়গুলো শুনে লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫