মানব সভ্যতা দুর্দমনীয় গতিতে এগিয়ে যাবার পেছনে চোখের গুরুত্ব অপরিসীম; এটা কে না জানে? চোখ না থাকলে আমদের সভ্যতা এতদুর এগিয়ে আসা-তো দুরের কথা আমরা অনেক আগেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিতভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম। হোমোসেপিয়েন্সদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে জটিল গঠন চোখ আর মগজের। কিন্তু আমাদের মত চোখ তো আমাদের কাছাকাছি প্রাইমেট শিম্পাঞ্জি ওরাং ওটাং বোনোবোসদের আছে- তবে ওদের চোখ আর আমাদের চোখের মধ্যে পার্থক্য কি? কি বিশেষ পার্থক্য ওদের চাহনীতে, ওদের দেখায়, ওদের ইশারায়- আর আমাদের মধ্যে? এই পার্থক্য ব্যাপক; মানুষের চোখের একটা বিশেষ ও ব্যাপক বিস্তৃত একটা ভাষা আছে, যে ভাষা প্রায় সারা পৃথিবীর মানুষের প্রায় একই রকম- যাকে বলা যায় মহাবিশ্বের মানব জাতির যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে সহজতম ও প্রাকৃতিক মাধ্যম। শারিরিক ভাষার মধ্যে এই ভাষাটা অনন্য।
প্রথমে নীচের ছবিটা একটু লক্ষ্য করুন;
~ আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রাইমেট বোনোবোস আর আমাদের চোখের পার্থক্য লক্ষ্য করুন।
আমাদের চোখ ফ্লাট, ওদের গর্তে ঢোকানো, ভ্রু-র (আই-ব্রো) হাড়টা সামনে আগানো বারান্দার মত করে সূর্যরস্মি থেকে চোখকে রক্ষা করার জন্য যেমনটা ছিল নিয়ানডার্থালের। কিন্তু আমাদের নেই, আমাদের আইব্রো সহ হাড়টা অনেক ফ্লাট হয়ে গেছে চোখটা স্পষ্টভাবে দেখার জন্য ও চোখের ভাষা পড়ার জন্য, চোখের মনি বা আইবলের পাশে আমাদের সাদা অংশের জন্য আইবল স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের কাছাকাছি কোন প্রাইমেটের আইবলের পাশের অংশ সাদা নয়। (*ব্যতিক্রম কোন উদাহরণ নয়)
~ চোখ ও আই-ব্রোর গঠন হোমোসেপিয়েন্স থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আর এক বিলুপ্ত প্রজাতি নিয়ানডার্থাল।
গবেষণায় দেখা গেছে যে একজন ব্যক্তির মস্তিষ্কে যে তথ্যগুলি রিলে হয়, তার মধ্যে ৮৭ শতাংশ আসে চোখের মাধ্যমে, ৯ শতাংশ কানের মাধ্যমে এবং ৪ শতাংশ অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। অতএব ভাষায় চোখ একটা বড় ফ্যাক্টর।
চোখের ভাষাকে কোনভাবেই আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না। তবে সুবিধা সেখানে কোন বর্ণ নেই, ব্যাকারণ, বানান আর ভাষার মারপ্যাচ।
চোখের সংস্পর্শ ঘটে যখন দুটি মানুষ বা প্রাণী একই সময়ে একে অপরের চোখের দিকে তাকায়। মানুষের মধ্যে,
চোখের যোগাযোগ একটি অমৌখিক যোগাযোগের একটি রূপ যা সামাজিক আচরণের উপর একটি দুর্দান্ত প্রভাব ফেলতে পারে। চোখের যোগাযোগের রীতিনীতি, অর্থ ও গুরুত্ব সমাজ, নিউরোটাইপ,ধর্ম ভেদে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে।
চোখের যোগাযোগের অধ্যয়নকে কখনও কখনও ‘ওকুলেসিক্স’(চোখের নড়াচড়া, আচরণ, দৃষ্টিশক্তি এবং চোখের সাথে সম্পর্কিত অমৌখিক যোগাযোগের অধ্যয়ন।) বলা হয়।
সামাজিক অর্থ
চোখের যোগাযোগ ও মুখের অভিব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এবং মানসিক তথ্য প্রদান করে। আমরা, সাধারনত সচেতনভাবে তা না করে, চোখ এবং মুখে ইতিবাচক বা নেতিবাচক মেজাজের লক্ষণগুলি সন্ধান করি।কিছু সময়, চোখের সাথে চোখের মিলন শক্তিশালী আবেগ জাগিয়ে তোলে। চোখের যোগাযোগ সামাজিক কথোপকথনের সময় কিছু শক্তিশালী আবেগ প্রকাশ করে। একটি গোষ্ঠীতে, যদি চোখের সংস্পর্শে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত না হয়, তবে সেই ব্যক্তিটি সেই গোষ্ঠী বা গ্রুপ থেকে বাদ বোধ করতে পারে; অন্যদিকে, দীর্ঘসময় চোখের যোগাযোগ কাউকে বলতে পারে যে, আপনি তাদের কী বলতে চান বা কী বলতে আগ্রহী।
চোখের যোগাযোগ ফ্লার্টিংয়েরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে এটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অন্যের আগ্রহের গুরুত্ব পরিমাপ করা যেতে পারে।
প্রভাব
পিতা-মাতা-সন্তান
১৯৮৫ সালের একটি সমীক্ষায় বলে হয়েছে যে "৩ মাস বয়সী শিশুরা অন্যদের চাক্ষুষ দৃষ্টির বস্তু হওয়ার জন্য তুলনামূলকভাবে সংবেদনশীল।" ৩ থেকে ৬ মাস বয়সী শিশুদের উপর ১৯৯৬ সালের একটি কানাডিয়ান গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে চোখের যোগাযোগ সরানো হলে শিশুদের হাসি কমে যায়। নিউরোসায়েন্সের একটি জার্নাল থেকে প্রকাশিত ব্রিটিশ গবেষণায় দেখা গেছে যে, শিশুদের মুখ শনাক্তকরণ সরাসরি দৃষ্টিশক্তি দ্বারা সহজতর হয়। অন্যান্য সাম্প্রতিক গবেষণা নিশ্চিত করেছে যে, প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি দৃষ্টি শিশুদের উপর প্রভাব ফেলে। প্রথম বছরে, শিশুরা দ্রুত শিখে যে, অন্যদের চাক্ষুষ আচরণ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে। শিশুরা তাদের পারস্পরিক দৃষ্টিতে নিযুক্ত মুখের দিকে তাকাতে পছন্দ করে এবং অল্প বয়স থেকেই, সুস্থ শিশুরা সরাসরি দৃষ্টিশক্তির উন্নত স্নায়বিক প্রক্রিয়া দেখায়।
চোখের বিদ্বেষ এবং মানসিক প্রক্রিয়াকরণ
* মানুষ কারো কথা শোনার সময় মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দরকারী তথ্য পায়, মুখের দিকে তাকানোর প্রক্রিয়াটি মানসিকভাবে দাবি করে এবং তথ্য সঠিকভাবে মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াকরণ করে। অতএব, মানসিকভাবে চাহিদাপূর্ণ বিশেষ কিছু মনোনিবেশ এবং প্রক্রিয়া করার চেষ্টা করার সময় মুখের দিকে তাকানোর প্রয়োজন হতে পারে। ডোহার্টি-স্নেডনের মতে,তবে একটি ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকানো সম্ভবত বোঝার অভাব নির্দেশ করে।
* স্টার্লিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত।
চোখ যখন লেখার ভাষায়ঃ
মেইতি সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানে চোখ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে রয়েছে মেইতি নৃত্য (জাগোইস), মেইতি উত্সব, মেইতি লোককাহিনী, মেইতি লোককাহিনী, মেইতি ইতিহাস, মেইতি ভাষা, মেইতি সাহিত্য, মেইতি পুরাণ, মেইতি প্রবাদ, ঐতিহ্যবাহী মেইতি। ধর্ম (সানমাহিজম), মেইতি লিখন পদ্ধতি ইত্যাদি।
মেইতি, আনুষ্ঠানিকভাবে মণিপুরী নামে পরিচিত, উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি তিব্বত-বর্মন ভাষা। এটি মণিপুরের সরকারী ভাষা এবং লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা এবং ভারতের একটি সরকারী ভাষাতি মেইতি হল ভারতে সবচেয়ে বেশি কথ্য তিব্বতি-বর্মন ভাষা এবং অসমীয়া ও বাংলার পরে উত্তর-পূর্ব ভারতে তৃতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ভারতে ১.৭৬ মিলিয়ন স্থানীয় মেইতি ভাষাভাষী রয়েছে। তাদের অধিকাংশ মণিপুর রাজ্যে বাস করে। প্রতিবেশী ভারতের রাজ্যগুলিতে এভাষাভাষি ছোট সম্প্রদায় রয়েছে, যেমন আসাম, ত্রিপুরা নাগাল্যান্ড, এছাড়াও প্রতিবেশী মায়ানমার এবং বাংলাদেশে ছোট গোষ্ঠী এই ভাষায় কথা বলে।
~প্রাচীন মেইতি অক্ষর মিত এর অর্থ "চোখ"। চোখের আদলে এমন চারটে বর্ণ এসেছে।
ঐতিহ্যগত মেইতি লেখার পদ্ধতিতে চারটি অক্ষর রয়েছে, চোখের সাথে সম্পর্কিত। অক্ষর 'মিত' মানুষের চোখের প্রতীক, এবং এর অক্ষর নাম "মিত" নিজেই মেইতি ভাষায় "চোখ"। এটির একটি অতিরিক্ত বর্ণ রয়েছে, যা "মিত লোনসাম" নামে পরিচিত। "পা" অক্ষরটি মানুষের চোখের পাপড়ির প্রতীক, এবং এর অক্ষর নাম "পা" নিজেই মেইতি "চোখের পাপড়ি"। এটি "পা লোনসুম' নামে পরিচিত অক্ষরের একটি অতিরিক্ত রূপ রয়েছে।
হিন্দি এবং কাশ্মীরির পরে ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল ভাষার মধ্যে মেইতি এবং গুজরাটি তৃতীয় স্থান দখল করে আছে।
মেইতি একটি উন্নত সাহিত্য ভাষা, যা সাহিত্য একাডেমি, ভারতের ন্যাশনাল একাডেমি অফ লেটারস দ্বারা স্বীকৃত।
***
অনেক সংস্কৃতিতে, যেমন পূর্ব এশিয়া ও নাইজেরিয়াতে, প্রভাবশালী ব্যক্তিকে চোখে চোখ রাখা অসম্মানজনক, কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতিতে এটিকে "চোখে চোখ" হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এবং ব্যক্তিকে খারাপভাবে বিচার করা হয় কারণ "তারা আমার চোখের দিকে তাকাবে না"; রেফারেন্স যেমন "চোখে চোখ" একজন ব্যক্তির অপ্রকাশিত অভিপ্রায় বা চিন্তার বিষয়ে সন্দেহের উল্লেখ করতে পারে। তবুও, কথোপকথনে অন্য অংশগ্রহণকারীর অবিচ্ছিন্ন চোখের যোগাযোগের চাওয়াকে প্রায়শই পশ্চিমা সংস্কৃতিতেও অনেকের কাছে অবাধ্য বা বিভ্রান্তিকর হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে, সম্ভবত সহজাত বা অবচেতন স্তরে।
ঐতিহ্যগত ইসলামী ধর্মতত্ত্বে, পাপপূর্ণ সংবেদনশীল ক্ষুধা এবং আকাঙ্ক্ষা এড়াতে অন্য লোকেদের দিকে তাকালে সাধারণত দৃষ্টি নিচু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অত্যধিক চোখের সংস্পর্শ বা "তাকানো"কে কখনও কখনও অসভ্য, অনুপযুক্ত বা এমনকি অসম্মানজনক হিসাবেও বর্ণনা করা হয়, বিশেষ করে যুবক এবং প্রবীণ বা শিশু এবং তাদের পিতামাতার মধ্যে এবং তাই বয়স্কদের সাথে কথা বলার সময় দৃষ্টি নিচু করাকে সম্মান এবং শ্রদ্ধার চিহ্ন হিসাবে দেখা হয়। . তা সত্ত্বেও, এই বিষয়ে প্রকৃত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুশীলন ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। নারীদের দিকে পুরুষের পুরুষের দিকে নারীদের তাকানোর বিশেষ বিধান দেয়া আছে। সম্ভবত তাকানো বা দৃষ্টির বিষয়ে সবচেয়ে বেশী ধর্মীয় বিধান ইসলামেই দেয়া হয়েছে।
জাপানি শিশুদের স্কুলে তাদের শিক্ষকের অ্যাডামের আপেল বা টাই নট অঞ্চলের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শেখানো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে, জাপানিরা যখন সম্মানের অঙ্গভঙ্গি হিসাবে উচ্চতর ব্যক্তির সাথে কথা বলে তাদের চোখ অবনত করে কথা বলে।।
সংসদীয় পদ্ধতির কিছু সংস্থা কথা বলার সময় সদস্যদের মধ্যে চোখের যোগাযোগ নিষিদ্ধ করে।
ক্লিনিকাল বিবরণ
মনোরোগবিদ্যা এবং ক্লিনিকাল সাইকোলজি অনুশীলনে ক্লিনিকাল মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে, মানসিক অবস্থা পরীক্ষার অংশ হিসাবে, চিকিত্সক চোখের যোগাযোগের সূচনা, ফ্রিকোয়েন্সি এবং গুণমান বর্ণনা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, রোগী চোখের যোগাযোগ শুরু করে, ঠিক ঠাক সাড়া দেয়, চোখের মনি স্থির রাখতে পারে কি না বা বা দৃষ্টি এড়িয়ে যায় কিনা তা ডাক্তার নোট করতে পারেন। চিকিত্সক চোখের যোগাযোগ অস্বাভাবিকভাবে তীব্র বা ফাঁকা কিনা, বা রোগীর ঝলক, নিচের দিকে তাকায় বা ঘন ঘন একপাশে তাকায় কিনা তাও খেয়াল করতে পারে।
অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে
চোখের যোগাযোগ অ-মানব প্রাণী এবং মানুষ এবং অ-মানব প্রাণীর মধ্যে মিথস্ক্রিয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে।
কুকুর সহ অনেক প্রজাতির প্রাণী প্রায়শই চোখের যোগাযোগকে হুমকি হিসেবে মনে করে। কুকুরের কামড় প্রতিরোধ করার জন্য অনেক বিষয় অজানা তবু কুকুরের সাথে সরাসরি চোখের যোগাযোগ এড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়।*চোখের যোগাযোগ বজায় রাখলে ছোট বাচ্চাদের কুকুরের আক্রমণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
* দ্য নিউজিল্যান্ড মেডিকেল জার্নালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে।
অন্যদিকে, একটি কুকুর এবং তার মালিকের মধ্যে বেশী চোখের যোগাযোগ অক্সিটোসিনের নিঃসরণকে [বাড়ে বা হ্রাস করে?], যা নিউরোমডুলেটর –মূলত মাতৃ-শিশুর বন্ধনে ভূমিকার জন্য পরিচিত।
হাইকারদের সাধারণত ভালুকদের মুখোমুখি হলে সরাসরি চোখের যোগাযোগ এড়াতে পরামর্শ দেওয়া হয়, যেহেতু ভালুক চোখের যোগাযোগকে হুমকি হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারে, যদিও কিছু সূত্র চোখের যোগাযোগ বজায় রাখার পরামর্শ দেয়া হয়।
প্রাইমেটরা, চোখের যোগাযোগকে বিশেষভাবে আক্রমণাত্মক হিসাবে দেখে ।চিড়িয়াখানায় তাদের দিকে মানুষের তাকানো উত্তেজিত আচরণকে প্ররোচিত করতে পারে। শিম্পাঞ্জিরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লড়াইয়ে আগ্রাসনের সংকেত দিতে চোখের যোগাযোগ ব্যবহার করে। সামাজিকভাবে বঞ্চিত প্রাইমেটদের মধ্যে চোখের যোগাযোগ কম। রটারডাম চিড়িয়াখানায় ২০০৭ সালের একটি ঘটনা চোখের যোগাযোগের সাথে যুক্ত বলে করা হয়: একটি গরিলা সেই প্রদর্শনী থেকে পালিয়ে যায় ও একজন মহিলাকে আহত করে যে তাকে অনেক্ষন ধরে তাঁকে দেখেছিল এবং দীর্ঘক্ষণ চোখের যোগাযোগ করেছিল। এই ঘটনার পরে দর্শনার্থীদের পরে বিশেষ চশমা দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা কোন প্রাইমেটদের সাথে আর দৃষ্টি বিনিময় না করতে পারে।
***
আপনি কি ভেবে দেখেছেন, চোখের একটিমাত্র ভাষা বা ইঙ্গিত আপনার জীবন পাল্টে দিতে পারে? শুধু একবারের দৃষ্টি বিনিময়, একটা চাহনী, একটা পলক চিরস্থায়ী প্রেমের জন্য যথেষ্ঠ। ঠিক তেমনি একটা ঘৃনার বা হিংসার দৃষ্টি কারো তরে চির বিরূপ হবার জন্য যথেষ্ঠ।
দুটো চোখ কত শত ভাষা বলে। যেখানে কোন বর্ডারের বাধা নেই, ভাষা, বর্ণ ব্যাকারণ নেই, ধর্ম নেই, জাতীয়তা নেই। আমাদের দুটো চোখ শুধু দৃষ্টির জন্য নয়; এর সাথে জড়িয়ে আছে প্রকৃতির সবচেয়ে আদিম ভাষা আর বিশেষ স্পেসিসের যোগাযোগের ইউনিক পন্থা।
ইশারার ভাষা শরিরের ভাষা হয়তো পাল্টে যেতে পারে কিন্তু চোখের ভাষা পৃথিবীর সব বর্ন জাতিকে যেন একই সুতোয় বেঁধে ফেলে। জানিয়ে দেয় আমরা সবাই হোমোসেপিয়েন্স- আধুনিক মানব।
আপনি নিশ্চয়ই প্রায়শই ভাবেন আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষটা আসলে কি ভাবছেন, সে যা বলছে সেটা তাঁর আসল ভাবনা? অনাদিকাল থেকেই মানুষ- অন্য মানুষের মন পরার চেষ্টা করে যাচ্ছে।আজ অবধি, আমরা এখনও অন্য মানুষের মন পড়তে পারিনি, তবে আমরা দেহের ভাষা সম্পর্কে কয়েকটি সাধারণ নিয়ম অধ্যয়ন করে মানুষের চিন্তাভাবনার প্রভাব সম্পর্কে একটি যুক্তিসঙ্গত ধারণা পেতে পারি।
বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অনেকদিন ধরেই আছে। কারো হাতের ভঙ্গি, শরীরের সাধারণ নড়াচড়া, স্বরধ্বনি, মড্যুলেশন এবং কণ্ঠের পরিবর্তন, তারা যা বলছে বলার সম্যে মুখের ভঙ্গী ও নড়াচড়া দেখে আপনি তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন।' তবে অনেক লোক সফলভাবে তাদের হাত, শব্দ এবং শরীরের ভাষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা সঠিকভাবে পড়া কঠিন করে তোলে।
আমাদের এমন একটি বৈশিষ্ট্য আছে যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না; এটা আমাদের চোখের আন্দোলন। যখন আমাদের একটি নীল হাতি কল্পনা করতে বলা হয়, আমরা ডানদিকে তাকাই। আমরা এমন কিছুর একটি দর্শন তৈরি করি যা আমরা দেখিনি।
বিপরীতভাবে, যখন আমাদের কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসার কিছু কল্পনা করতে বলা হয়, অতীতের ঘটনা হিসেবে মনে রাখার জন্য বাম দিকে তাকাই।
আমাদের প্রিয় সঙ্গীত মনে রাখতে বলা হলে, আমরা বাম দিকে তাকাই। যখন আমাদেরকে পশমের স্পর্শের অনুভূতি কল্পনা করতে বলা হয়, তখন আমরা বাম দিকে তাকাই এবং যখন আমাদের এমন একটি আবেগ তৈরি করতে বলা হয় যা আমরা আগে কখনো অনুভব করিনি, তখন আমরা ডান দিকে তাকাই।
মানুষের চোখ নিয়ে নিজের অজান্তেই আমরা কতই না আলোচনা করি;
~কি দারুণ রোমান্টিক চাহনী তাঁর!
~কি কুটিল ভয়ঙ্কর দৃষ্টি রে বাবা- যেন চোখ দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলবে!
~লোকটার চাহনী ভাল না- আমার দিকে কেমন কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল।
~দেখার মত চোখ তাঁর বেশ বড় ভাসা ভাসা চোখ।
~মেয়েটার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় প্রেমে পড়ে যাই।
~তাঁর চোখের মধ্যে অন্য রকম এক ধরণের ব্যক্তিত্ব আছে।
~এক ঝলক চাহনীতেই বুঝলাম সে কি বলতে চাইল?
~কেমন ঢুলু ঢুলু মাতালের মত চাহনী তাঁর।
~চোখের মনি দেখেছিস? যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
~কি বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ তাঁর।
~একটা মাত্র তীর্যক চাহনীতে সে আমাকে ঘায়েল করে ফেলেছে।
এমন হাজার হাজার কথা চোখ নিয়ে বলি। শুধু চোখ দিয়ে পুরো একটা মানুষকে আমরা যাচাই করে ফেলি। আশ্চর্য নয় কি!
তরুণ প্রেমীরা যারা একে অপরের চোখে গভীরভাবে তাকায় তারা অজান্তেই পিউপিল বা চোখের তারার প্রসারণ খোঁজে; প্রত্যেকে অন্যের চোখার তারার প্রসারণে উত্তেজিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে পুরুষদের যখন পর্নোগ্রাফিক ছবি দেখানো হয়, তখন তাদের পিউপিল স্বাভাবিক আকারের প্রায় তিনগুণ প্রসারিত হতে পারে। যখন একই ফিল্মগুলি মহিলাদের দেখানো হয়, তখন তাদের পিউপিলের প্রসারণ পুরুষদের দ্বারা রেকর্ড করা থেকেও বেশি হয়, কিন্তু বরাবরই দাবী করা হয় যে, মেয়েরা পুরুষদের থেকে পর্নোগ্রাফি দেখে কম উদ্দীপ্ত হয়।
একটা বিশেষ নিবন্ধঃ
পাখি বোঝে মানুষের ভাষা;
বলা হয়ে থাকে, চোখ হচ্ছে মনের দরজা৷ একজন মানুষের অনুভুতি ও ইচ্ছার অভিব্যক্তি আয়নার মতো ফুটে ওঠে তার দৃষ্টিতে৷একজন মানুষ অন্যের দিকে তাকালে দ্বিতীয়জন বুঝতে পারে তার চোখের ভাষা৷ সে অনুযায়ী তার আচরণও বদলে যায়৷ কিন্তু মানুষ বাদে অন্য কোনো প্রাণীর বেলায় কি এমনটি ঘটে ?
নতুন এক গবেষণার ফলাফলে জানা গেছে, পাখিরা মানুষের চোখের ভাষা বুঝতে পারে৷ কোনো মানুষ পাখির দিকে তাকালে সে টের পায়, মানুষটি তাকে দেখছে৷ সে অনুযায়ী পাখিটি সাড়াও দিয়ে থাকে৷ ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেথান জে ইমেরি এবং অগাস্ট এম.পি.ফন বায়ার্ন নামে দু'গবেষক পরীক্ষা করে দেখেছেন, কাক প্রজাতিরই দোসর জ্যাকড বা দাঁড়কাক মানুষের চোখের দৃষ্টি দেখে তার ব্যাপারে ওই মানুষটির অনুভুতি বুঝতে পারে৷ মানুষের চোখের ভাষা বোঝার ব্যাপারে তারা খুবই স্পর্শকাতর৷ নেথান ইমেরি ও অগাস্ট ফন বায়ার্নেরর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জ্যাকড জাতের দাঁড়কাকের বেলায় দেখা গেছে, প্রিয় কোনো খাবার দেওয়া হলে ব্যক্তিটি পরিচিত হলে পাখিটি ভয় পায় না৷ পরিচিত ওই ব্যক্তি যদি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে জ্যাকড নিজেকে আরও নিরাপদ মনে করে৷ সেই ব্যক্তিটি সরাসরি খাবারের দিকে তাকালে তার আচরণ বদলে যায়৷ তবে ভয় পেলেও প্রিয় খাবার ছেড়ে সরে যেতে তার একটু সময় লাগে৷ কিন্তু খাবার দেওয়া ব্যক্তি অপরিচিত হলে এবং সে সরাসরি ওই খাবারের দিকে তাকালে পাখির মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়৷
গবেষকেরা জানান, পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মানুষ যে আকার-ইঙ্গিত করে, তারও কিছু ব্যবহার করতে সক্ষম এই দাঁড়কাক৷ যেমন, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় চোখ ফেরানো, বা নির্দিষ্ট কিছুর দিকে ইঙ্গিত করা৷ মানুষের দৃষ্টির আভাস থেকে পাখি তার লুকিয়ে রাখা খাবারও খুঁজে নিতে পারে৷ মানুষের দৃষ্টি বুঝে নেয়ার ক্ষমতা অবশ্য পশু পাখিদের মধ্যে বিরল৷ সেদিক থেকে জ্যাকড ব্যতিক্রমই বলতে হবে৷ গবেষকেরা মনে করেন, মানুষের চোখের ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে জ্যাকড জাতের দাঁড়কাকের ব্যতিক্রমী চোখও বেশ কাজ দেয়৷ গড়পড়তা পাখির চেয়ে তাদের চোখের মণি অন্য রকম৷ পাখিটির গভীর কালো চোখের মণির চারপাশে রয়েছে রুপালি আভাযুক্ত সাদা আইরিস৷ এর সঙ্গে মানুষের চোখের গঠনেরও বেশ মিল রয়েছে৷ এ কারণে মানুষের চোখের আকার-ইঙ্গিত তারা ভালো বুঝতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ (- এই অংশটুকুর সুত্রঃ ডয়েস ভেল)
১ম পর্ব শেষ
মানুষ কেন অনন্য-এর আগের পর্বগুলোঃ
মানুষ কেন অনন্য? পর্ব~১
মানুষ কেন অনন্য? পর্ব~২
মানুষ কেন অনন্য? পর্ব~৩
মানুষ কেন অনন্য? পর্ব~৪
মানুষ কেন অনন্য? পর্ব~৫
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬