ইলিশ সংস্কৃতি
অনেক বাঙালি হিন্দু পরিবার বিভিন্ন পূজার শুভ দিনে জোড়া ইলিশ বা দুইটি ইলিশ মাছ কেনেন। সরস্বতী পূজা ও লক্ষ্মী পূজায় জোড়া ইলিশ কেনা খুব শুভ লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু এই প্রথা পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) ও বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দুদের মাঝে প্রচলিত আছে। তাদের অনেকে লক্ষ্মী দেবীকে ইলিশ মাছ উৎসর্গ করেন। অনেকেই ইলিশ উৎসর্গ ছাড়া পূজাকে অসম্পূর্ণ মনে করেন।
অন্ধ্র প্রদেশে, এই উক্তিটি "পুস্তেলু আম্মি আইইন পুলাসা টিনোচ্চু" এর অর্থ এরকম "আপনার মঙ্গলসূত্র বিক্রি করে হলেও পলাশ(পুলাসা) / ইলিশ খাওয়া উত্তম'।
আগের পর্বের লিঙ্কঃ ইলিশনামা~১
বাংলায় ইলিশ বিবাহের সময় তাতওয়া উপহার হিসাবেও ব্যবহৃত হত। গায়ে হলুদ তত্ত্বের সময় বরের পরিবার কনের পরিবারকে একজোড়া ইলিশ উপহার দেযয়র রীতি ছিল( মূলত হিন্দু সমাজে)। যাইহোক, ইলিশের ঘাটতির কারণে, আজকাল পশ্চিমবঙ্গে রুই মাছ দেয়ার সংস্কৃতি প্রচলিত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে এই ঐতিহ্য এখনো অব্যাহত রয়েছে। আমার এক হিন্দু দাদা বলেছেন, অতি গরিবেরা ‘জোড়া পুঁটি মাছ’ দিয়েও নাকি এ কর্ম সারেন!
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে, একটি বিখ্যাত থালা, যা ভাজা ইলিশ মাছের সাথে থাকে স্বুসাদু 'খিচুড়ি। আহা 'খিচুড়ি-ইলিশ' সাথে যদি থাকে শুকনো লঙ্কা- কি অমৃত! এটি বর্ষাকালে সমস্ত বাঙালিদের ইলিশ মাস হিসাবে পরিচিত। উভয়বঙ্গেই ইলিশকে মাছের 'রাণী' বলা হয়। আর এদিকে "ইলিশ'কে বাংলাদেশে জাতীয় মাছ হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছেই।
এই মাছটিকে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের গোদাবরী জেলাগুলিতে ‘পুলাসা’ (পলাশ বা পুলাশ'ও বলা হয়) বলা হয়। পুলাসা বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের মধ্যে সীমিত সময়ের জন্য নদীতে উঠে আসে, যখন গোদাবরী নদীতে বন্যা (কর্দমাক্ত) প্রবাহ থাকে। তখন মাছটির চাহিদা এত বেশী থাকে যে, মাঝে মধ্যে প্রতি কিলো ১০০ ডলারেও বিক্রি হয়।
গোদাবরী নদীর ইলিশে অন্ধ্র প্রদেশের একটা একটা বিখ্যাত 'পুলাসা' রেসিপি দেখে আসি;
‘পল্লো মাচি’ নামে পরিচিত ইলিশ মাছ সিন্ধি রান্নার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, সেখানে ইলিশ রান্নার অসংখ্য পদ্ধতি প্রচলিত আছে। সিন্ধিরা পছন্দের মশলা দিয়ে পল্লোচেলি মাখিয়ে ডুবো তেলে ভেজে নেয়, কেউ কেউ পেঁয়াজ এবং আলু দিয়ে চমৎকার একটা মাছেরঝোল খায় নেকে আবার ইলিশ বারবিউয়েলে রান্না করে যাকে সিন্ধি ভাষায় "আানি" বলা হয় তাদের অতিপ্রিয় একটা ইলিশের পদ একটা।ভাজা মাছের পাশাপাশি এদের রসনায় পাল্লার ফিশ ফিললেটও যুক্ত হয়। অনেকের ধারনা ইলিশ শুধু বাঙ্গালীদের প্রিয় মাছ- আদপে কিন্তু তা নয় মোটেও। বাঙ্গালীদের থেকে সিন্ধিরা মোটেও ইলিশ কম পছন্দ করে না।
চট করে দেখে নিন সিন্ধি পাল্লা বা পল্লোমাচি (ইলিশমাছ) রেসিপি;
কলকাতার বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের সেই সুদিনে খাবার দ্বারা উদযাপিত হত। ইস্টবেঙ্গল যখন জিতত তখন তাদের ভক্তদের বাড়িতে ইলিশ ভোজ হত। একইভাবে, মোহনবাগান জিতলে সমর্থকেরা চিংড়ির থালা রান্না করত।
ফরিদপুর, মাদারিপুর, ঢাকা, বিক্রমপুর জেলায় আবার আরেক রীতি! সরস্বতী পুজোর দিন, ইলিশ কিনে প্রথমেই বাড়িতে ঢোকানো যাবে না! মাছের রানিকে আগে প্রদীপ জ্বালিয়ে, সিঁদুর মাখিয়ে, উলু দিয়ে বরণ করতে হবে! তারপর তিনি ঢুকবেন হেঁশেলে। তবে, এদিন কিন্তু ইলিশের ঝোল,ঝাল, অম্বল রাঁধলে চলবে না! শুধু নুন, হলুদ আর গোলমরিচ দিয়ে বানানো হবে ইলিশের ঝোল! আর মাছের আঁশগুলো ঘরের মধ্যে প্রধান যে খুঁটি রয়েছে, তাঁর গোড়ায় পুঁততে হবে! অনেকে আবার ধানের গোলার নীচে গর্ত করেও আঁশ পুঁতে রাখেন। এতে নাকি ভবিষ্যতে টাকার বৃষ্টি হবে!
সরস্বতী পূজায় জোড়া ইলিশের সেই আঁশের গল্পঃ
জোড়া ইলিশ আঁশ মাহাত্ম্য
“জোড়া ইলিশ এসে গেছে গো , গিন্নি মায়েরা কে কোথায় আছো শিগগিরই আসো”
চাকর দিনুর ডাকে হুলুস্থুল পরে গেলো মুখার্জি বাড়িতে । বরিশাল জেলার বিরমহল গ্রামের এক প্রান্তে বিশাল দালান বাড়ি তার সামনেই জোড়া পুকুর । সিংহ ফটক পেরিয়ে ঠাকুর দালানে প্রবেশ করার আগেই বা দিকে কাছারি ঘর, তার ঠিক পিছনে কুলদেবতার মন্দির । দেবী মনসার নিত্য পূজা হয় সেখানে।এক কালে জমিদারির রমরমা থাকলেও বর্তমানে সেই জৌলুশ আর নেই।কালের নিয়মে এসব অতীত তবুও বছরে দুবার পুরোনো এই জমিদার বাড়িতে হৈ হৈ কান্ড শুরু হয়।
একবার মনোসপুজোর সময় আর একবার বাগদেবীর আরাধনার সময়। মাঘ মাসে শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বেশ বড় করেই দেবী সরস্বতীর পুজোয় হয় মুখার্জি বাড়িতে। বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকেই এই চল হয়ে আসছে।বাড়ির ছোটো থেকে বড়ো সারাবছর ধরে এই দুটো দিনের জন্যই অপেক্ষা করে থাকে। বাঙাল বাড়ির সরস্বতী পুজো আর ইলিশ দুটোই যেনো সমার্থক।
শুক্লা চতুর্থীর দিন বিকেলে বাজার থেকে জোড়া মাছ কিনে আনতে হয়। বাড়ির সধবা বধূরা বরণ ডালা সাজিয়ে অপেক্ষা করে যুগল ইলিশের আগমনের। বরণ ডালায় থাকে নানা বিধ উপাচার। নতুন মাটির প্রদীপ যেটা এই পুজো উপলক্ষেই বানানো হয় আর থাকে কাঁচা হলুদ,পান, সুপারি, কাঠালি কলা, ধান ,দূর্বা, সিঁদুর মাখানো আমের পল্লব। শঙ্খ ধ্বনি আর উলু সহযোগে বরণ পর্ব শেষ হওয়ার পর নতুন একটি মঙ্গল কুলোর উপর ইলিশ দুটিকে রেখে গঙ্গাজল স্নাত আমের পল্লব দিয়ে স্নান করিয়ে গৃহে প্রবেশ করানো হয়। জমিদারি ঠাট বাট কালের গর্ভে তলিয়ে গেলেও পুজোর প্রতিটি আচার সাবেকিয়ানার সাথে পালন করে চলতো মুখার্জি পরিবার। জীবন যাপনে কিছুটা আধুনিকতা ও নতুনত্বের ছোঁয়া পড়তে শুরু করলেও প্রথাপালনে সেই প্রভাব কখনো পড়েনি।
সরস্বতী পুজোয় বাঙালদের প্রচলিত রীতির থেকে কিছু ব্যতিক্রমী নিয়ম আদিকাল থেকেই চালু ছিলো এই বাড়িতে। ইলিশের আগমনের দিন থেকে পুজোর ঘট ভাসানের দিন পর্যন্ত বাড়িতে আর অন্য কোনো আমিষ রান্না হয় না। পাঁচ পদের লোভনীয় ইলিশ থাকে দুই দিনের খাদ্য তালিকায়। এই পুজোতেই যেন শুরু হযে যায় সারা বছরের ইলিশ ভোজের সূচনা। যুগল মাছের গৃহ প্রবেশের পর সেই মাছ কাটতে বসেন বাড়ির কর্তারা।
সারাবছর গিন্নিরা রান্না ঘরের কাজকর্ম দক্ষ হাতে সামাল দিলেও এই একটি দিন মাছ কাটার দায়িত্ব এসে পড়ে বাড়ির পুরুষ দের। তবে এটাও বিরমহলের মুখার্জি বাড়ির প্রথারই একটা অঙ্গ। পুজোর জন্য তোলা থাকে শান দেওয়া বটি। বাড়ির বড় কর্তা আর মেজ কর্তা স্নান করে সাদা ধুতি পরে তবেই মাছে হাত দেন। এটাও পড়ুন: অরন্ধন বা রান্নাপুজো জোড়া ইলিশ কাটার সময় সারা বাড়িতে যেন হটাৎ শোরগোল ,প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। রান্না ঘরে দুই কর্তা কে ঘিরে গোল হয়ে জড়ো হয় বাড়ির সব সদস্য।
প্রথমেই সযত্নে ইলিশের গা থেকে আঁশ ছাড়ানো হয়। তারপর বড় কাঁসার বাটিতে সেই আঁশ রাখা হয়। কে কটা আঁশ নিতে পারে এই নিয়ে মোটামুটি হুড়োহুড়ি লেগে যেত বাড়ির ছোটো দের মধ্যে। জোড়া ইলিশ এর এই আঁশ কে সুখ সমৃদ্ধি ধন সম্পদের প্রতীক রূপে দেখা হত। টাকা জমানোর সিন্দুকে,বাক্সে, থলিতে,ঘটে সর্বত্র মাছের আঁশও রাখা হত। এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো যে এই আঁশ রাখলে মা লক্ষী তুষ্ট হবেন অর্থাৎ সর্বদা সচ্ছলতা বিরাজ করবে এই সংসারে। এর পরেই পাঁচ রকম পদের রান্না হত এই জোড়া ইলিশ দিয়ে।
সরস্বতী পুজোর দিন দেবীকে ভোগ দেওয়া হবে মস্তক পোলাও দিয়ে। অর্থাৎ পোলাও তে ইলিশের মাথা থাকা আবশ্যক। পুজোর আগের দিন থেকে বিসর্জনের দিন অবধি বাড়ি থাকত ইলিশময়।এই মাছ নিয়ে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন নিয়ম প্রচলিত আছে। তবে রীতি ও ঐতিহ্য ভেদে কোনো কোনো বনেদী বাড়িতে তার ব্যতিক্রম ও আছে বই কি। তবুও সরস্বতী পুজো মানেই ঘরে আগমন ঘটবে জোড়া ইলিশের। সেই ইলিশকে ঘিরে চলত সকলের মধ্যে নানা ব্যস্ততা ,নতুন নতুন পদ তৈরির প্রতিযোগিতা। কোন বাড়ি কোন নতুন পদ রেঁধে তাক লাগিয়ে দিলো সেটা নিয়ে গ্রামে বেশ চর্চার বিষয় হয়ে ওঠত।
পূর্ববঙ্গের সেকেলে বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক মানুষের কাছেই এই ইলিশের গল্প শোনা যায়। আমার পরিবারের কিছু বংশধর পূর্ব বঙ্গে থাকার সুবাদে তাদের কাছেই এই কাহিনী শোনা। শুধু সেকালে নয় একালেও বহু বাঙাল বাড়িতে আজ ও এই প্রথা পালিত হয়ে আসছে।আধুনিক কালে যৌথ পরিবার ভেঙে হয়েছে একক পরিবার তাই পূর্বের সমস্ত আচার রীতি মেনে পুজো করতে না পারলেও শুধু নিয়ম রক্ষার্থে অনেক ঘরেই শ্রী পঞ্চমীর সরস্বতী পুজোর দিন ইলিশমাছ রান্না হয়। ( * লেখকের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি- সুত্রঃ লাফালাফি ডট কম থেকে)
সরস্বতী পুজায় ইলিশ বরনের গীতঃ—
ইলিশ মাছে কাটে বউ
ধার নাই বটি দিয়া
ইলিশ মাছ রান্দে বউ
কচু বেগুন দিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৭