বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে যখন প্রতিনিয়ত মধ্যযুগীয় বর্বরতায় বাংলাদেশের নিরীহ সাধারণ মানুষ খুন হচ্ছে, হচ্ছে নির্মমভাবে নির্যাতিত, সেই সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা নিন্দা না জানিয়ে, ভারতের ঘাতক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, সীমান্তে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। দুই দেশের পক্ষ থেকেই চোরাকারবারি, মাদক পাচার ও গরু চুরি হচ্ছে। এসব ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। শুধু আজই নয়, অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচারযোগ্য বিষয় নয়। এ নিয়ে রাষ্ট্র খুব বেশি চিন্তিত নয়। আর সব কাজ ফেলে রেখে শুধু এদিকে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন আছে বলেও আমরা মনে করি না। তিনি আরও বলেছেন, সীমান্ত হত্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এটা আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। রাষ্ট্র এতে উদ্বিগ্ন নয়।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যখন এই ধরনের কথা বলেছিলেন, হয়তো সেই একই সময়ে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে বিএসএফ পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছিল গরু ব্যবসায়ী রাশেদকে। সেই একই সময়ে রাজশাহী সীমান্তে ভারতীয় এই বাহিনীর গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হয় বাংলাদেশী কৃষক দুলাল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফের পৈশাচিক নির্যাতনে প্রায় পঙ্গু হয়ে যাওয়া হাবিবুর রহমানের আর্তনাদ বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই, ভারতীয়দের হাতে অত্যাচারিত ও অপহৃত বিজিবির হাবিলদার লুত্ফর রহমান রক্তাক্ত অবস্থায় মাথা নিচু করে ফিরে এসেছে দেশে। এছাড়া রয়েছে গত কয়েক বছরে বিএসএফের হাতে অসহায়ভাবে নিহত আরও এক হাজার বাংলাদেশীর লাশ। ক্যাম্পে আটকে রেখে, জঘন্যতম অত্যাচার করে, গুলি করে হত্যা করে যে ফেলানীর লাশ ৫ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছিল বিএসএফ, সেই ফেলানীর কবরের মাটি হয়তো এখনও ভালো করে শুকায়নি। তার আগেই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, শিষ্টাচার, মানবাধিকার সবকিছুকে পায়ে পিষে, নিজ দেশের জনগণের রক্ত হাতে নিয়ে, বিবেক, বুদ্ধি, দেশপ্রেম, সামগ্রিক সুস্থতা, শ্রেয়বোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব, রাষ্ট্র পরিচালনার শপথ ইত্যাদি সবকিছুকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, বিন্দুমাত্র আক্ষেপ না করে, মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ, ভারতীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জির চাইতে দশগুণ শক্ত ভাষায় বিএসএফের এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে নির্লজ্জ সাফাই গেয়েছেন। তার বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে বিএসএফের এই সম্পূর্ণ অবৈধ, অন্যায়, হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য এখন থেকে আর ভারতীয় কোনো মুখপাত্র লাগবে না। বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতার বলয়ে সৈয়দ আশরাফরা থাকতে বেহুদা তাদের কথা বলার আর দরকার কী? পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে এবং পরে ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের হাতে যখন অন্যায়ভাবে বাংলা বিহার উড়িষ্যার জনগণ নিগৃহীত হতেন, তখন এই হিংস্র ও কুটিল বণিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিরাজদ্দৌলা কিংবা মীর কাশিম উদ্যোগ নিলে, মীর জাফর, জগেশঠ কিংবা রায়দুর্লভরা দেশপ্রেম, জনহিতব্রত শিকায় তুলে কাণ্ডজ্ঞানহীন অন্ধের মতো লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে, জনসাধারণের বিরুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষ নিতেন। তাছাড়া ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উল্টো সিরাজদ্দৌলা ও মীর কশিমকেই ক্ষমতা থেকে উত্খাত করে নিষ্কণ্টক করেছিল নিজেদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার পথ। পরে সেই নিষ্কণ্টক পথ ধরেই ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করে।
বাংলাদেশের মানুষ যখন সরকারের দায়িত্বশীল পদে আসীন ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে আশা করছিল এইসব অন্যায় হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রতিবাদ কিংবা নিন্দা, আশা করছিল বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে বাংলাদেশের সীমান্ত আগলে রাখা এই ঘাতক শক্তির স্বরূপ উন্মোচন, আশা করছিল প্রতিকার, বিচার, সেই সময় তার ধারে-কাছে না গিয়ে সৈয়দ আশরাফের মতো উঁচু পদে আসীন একজন ব্যক্তি ভারতীয় বিএসএফের হত্যাকাণ্ডকেই দান করলেন বৈধতা। অবস্থান নিলেন নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে। এতে ভারত খুশি হয়েছে, কারণ তারা দাবি করে আসছিল তারা ক্রিমিনাল মারে। আমাদের মন্ত্রীও ভারতের ‘ক্রিমিনাল তত্ত্বকেই’ সমর্থন জোগালেন। সঙ্গত কারণেই সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের পর ঘৃণায় ধিক্কারে ফেটে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষ। আওয়ামী লীগের সুবুদ্ধিসম্পন্ন অংশ এমনকি অন্ধ সমর্থকরা পর্যন্ত হতবাক হয়ে গেছেন এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য শুনে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে সারাপৃথিবী এখন চেনে ‘মৃত্যু উপত্যকা’ হিসেবে। বাংলাদেশ যেন এখন ইসরাইলের হাতে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। সারাপৃথিবীতে একমাত্র গাজা সীমান্তে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ ইসরাইলি পশুদের হাতে যেভাবে প্রতিদিন শিকার হয় ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ, ঠিক তার মতো, ক্ষেত্রবিশেষে তার চাইতেও নির্মমতার সঙ্গে বাংলাদেশীদের হত্যা করে ভারতীয় বিএসএফ। পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এখন সোচ্চার। সোচ্চার ভারতেরও বিবেকসম্পন্ন মানুষ। অন্যদিকে নিজেদের সন্তানদের লাশ বুকে চেপে ঘৃণায় ক্ষোভে ফুঁসছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।
সৈয়দ আশরাফকে যারা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান হিসেবে জানেন, তারা আজ বাকরুদ্ধ। দেশের কোনায় কোনায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সৈয়দ আশরাফ কি সত্যি সত্যি বাংলাদেশের মন্ত্রী? তিনি কি সত্যি সত্যি ‘বাংলাদেশের নাগরিক’? আমরা সৈয়দ আশরাফের কথাকে বিচ্ছিন্ন কোনো বক্তব্য হিসেবে দেখতে চাই না। বরং এটাকে আমরা বর্তমান সরকারের ‘স্টান্ট’ হিসেবেই দেখছি। কারণ এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো পর্যায় থেকে এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা কোনো মন্তব্য আমরা পাইনি। পাইনি বলেই বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, নিজ জনগণকে যারা বিএসএফের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে চোরাচালানি বলে, যারা প্রতিকার করার বদলে হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন দেয়, যারা বিএসএফের নৃশংসতাকে বিচারযোগ্য মনে করেন না, যারা নিজ জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত নয়, যারা এই মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে স্বাভাবিক ঘটনা মনে করে, তাদের আর যাই হোক, বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ নেই। তাদের হাতে দেশের মানুষ যেমন নিরাপদ নয়, তেমনি নিরাপদ নয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও।
সংগ্রহণ - Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




