somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"প্রলাপ" (একটি মিশরীয় গল্পের অনুবাদ)

০১ লা নভেম্বর, ২০১০ সকাল ৭:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৮৮ তে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত মিশরীয় লেখক নাজীব মাহফুয়। ”প্রলাপ” নাজীবের একটি ছোটগল্প।


প্রলাপ
নাজীব মাহফুজ

ভোর হতে আর দেরী নেই,এখনই দেখা যাবে পূবাকাশে আলোর রেখা আর তার আগাম ঘোষনা দিচ্ছে একটি মোরগ। নীরব নিস্তব্ধ একটি ঘর যেটি যন্ত্রণা কাতর আর্তনাদ আর মুমূর্ষ কষ্টের একটি স্থান। একটি তরুনী সেখানে শয্যাগত যার মুখটি হলুদ বিবর্ণ আর ওষ্ঠ ও গন্ডদেশ শুষ্ক মলিন। দূর্বল ক্ষীনকায়া মেয়েটির যৌবন রোগের প্রকোপে ভগ্নপ্রায়। তার কাছেই শুয়ে আছে এক যুবক,নিদ্রাহীনতায় তার চোখ ভারী হয়ে উঠেছে কিন্তু দুশ্চিন্তায় সে চোখের পাতাকে একত্রিত করতেও পারে না। সে একবার তাকায় রুগ্নমেয়েটির দিকে আবার দেখে দোলনায় শোয়া নবজাত শিশুটির দিকে। পরম মমতায় আদ্র হয়ে ওঠে তার শুষ্ক চোখ।সে অন্তর দিয়ে শুভ কামনা করে “হে আল্লাহ এই হতভাগ্য মা কে রক্ষা কর আর ভালো রাখো আমাদের এই পবিত্র শিশুটিকে।

যুবকটি অত্যন্ত নম্রভদ্র স্বভাবের। মায়া মমতায় তার হৃদয় পরিপূর্ণ। শৈশবে তাকে ডাকা হতো “ঘরমুখো ছেলে” বলে। কারন বাড়ীতে থাকতেই সে বেশী পছন্দ করত। সে সবরকম সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকত। আর সমবয়সীদের মতো মিটিং মিছিলেও অংশগ্রহন করত না।কারনে অকারনে সে বাড়ীতে ফিরতে চাইতো। সে দিন কাটাতো বাগানে কমলা আর লেবুর গাছের পরিচর্যা করে অথবা ছাদে মুরগী ও কবুতরের লালন পালনে। বৃহস্পতিবারে সে তার বোনের সাথে খেলাধূলা করত এবং সিনেমা দেখতে যেত। সেনাবাহিনীতে যেদিন সে প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পেল সেদিন থেকেই বিয়ের জন্য চিন্তা ভাবনা শুরু করেছিলো। তাই সে বিয়ের মোহর ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার জন্য টাকা জমাতে থাকে। যেমন করত বিগত প্রজন্মের পুরুষেরা। বিদ্যালয় ত্যাগ করার মাত্র দুই বছরের মধ্যেই সে বিয়ে করে। তার এই দ্রুত বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতে কেউ বিস্মিত হয়নি কারন ছোটবেলা থেকেই সে ছিলো পুরোপুরি গৃহী এবং ধীরস্থির প্রকৃতির। কিন্তু সে হতভাগ্য, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই তার একটি সন্তান হয় আর তার স্ত্রী তখন থেকেই কঠিন জ্বরে আক্রান্ত। এতে ছন্দপতন ঘটে তার সুখের সংসারে । এই প্রথম সে বুঝতে পারে অসুখের ভয়াবহ যন্ত্রণা,উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা। সে সবরকম চিকিৎসা পদ্ধতি তে সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছে। এই চিকিৎসার জন্য সে অকাতরে অর্থব্যয় করেছে এমনকি তার মূল্যবান ব¯ত্তগুলো,প্রিয় প্রাণীগুলোও বিক্রি করতে দ্বিধাবোধ করেনি। তার রেডিও এবং স্বর্ণের ঘড়ি সবকিছুই সে হারিয়েছে।যদি সম্ভব হতো তবে তার শেষরক্তবিন্দুর বিনিময়ে হলেও তার স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলতো। সে ছুটি নিয়ে ছিল তার চাকুরী থেকে তার স্ত্রীর সেবা করার জন্য। সে ডাক্তারদের হাজারো প্রশ্ন করত আর তার স্ত্রীর দিকে চেয়ে থেকে সময় কাটাত। মানসিক শান্তির জন্য পূন্যবানদের মাযার পরিদর্শনে যেত আর তার দু:স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজত।

সে রাতের পর রাত নিদ্রাহীন থেকেছে শুধু এই রুগ্ননারীর দিকে চেয়ে থেকে। অজানা আশংকায় সে শতক্লান্তি সত্ত্বেও চোখ বুজতে পারেনি। মেয়েটি এত হতভাগ্য যে সত্যিই তার জন্য শোক করা যায়। সে ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠত ঘুমের মধ্যে এবং জাগ্রত অবস্থায়। মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে সে প্রলাপ বকত। প্রলাপে মানুষ যেমন নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তেমনি অন্যদের সাথেও করে। সে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনার চেষ্টা করেছে। সে অনেকের নাম বলত, অনেক ঘটনা ও স্থানের কথা বলে যেত। অনেক কথা ও ঘটনাই সে জানতো তাই হাসত এসব অর্থহীন কথা শুনে আবার কখনো তার চোখ অশ্র“পূর্ণ হয়ে যেত।
এমনি একরাতে সে শুনতে পায় মেয়েটি তাকে ডাকছে, সাবের! সে দ্রুত ঝুঁকে পড়ে জানতে চাইল, নাঈমা ! কিছু চাইছ ? কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝল সে ভুল শুনেছে কারন নাঈমা চোখ বন্ধ করে আছে এবং বরাবরের মতই সে অচেতন। সে ফিরে আসে তার শয্যায়, আবার সে শুনল নাঈমা যেন তার সাথে কথা বলছে, সাবের ! আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি, আমি অত্যন্ত লজ্জিত। ক্লান্ত, ভারী মাথা উঁচু করে সে বলল,অবশ্যই তুমি যন্ত্রনা পাচ্ছ। আল্লাহ তোমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন। কিন্তু তুমি লজ্জিত হবে কেন? এটা একটা বিপদ। বিপদে পড়ে কেউ লজ্জিত হয় না। এটা সবাইকে চিন্তিত করে। সে মনে করল সে রাত জেগে তার সেবা করছে তাই সে লজ্জিত। পরম মমতা নিয়ে সে মেয়েটির দিকে তাকালো,অন্তর দিয়ে কামনা করল তার সুস্থতা। নাঈমা আবার বলল, আমার স্বামী! তুমি শ্রেষ্ঠ স্বামী ! আমিই হতভাগ্য,আমি তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি। যুবকটি দুশ্চিন্তাগ্রন্থ হয়ে বলল, তুমি অবশ্যই ভাল। সে ভাবল জ্বরের ঘোরে এরকম চিন্তা করছে তাই তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই সে ছটফট করে বলে উঠল, “রাশেদ! ..যথেষ্ঠ হয়েছে আমাকে ছেড়ে দাও, দূর হয়ে যাও। দূরে চলে যাও আমাকে ছেড়ে।” সাবের নির্বাক হয়ে গেল এই কথাগুলো শুনে, ক্লান্ত চোখে দীর্ঘক্ষণ পলকহীন চেয়ে থাকল তার বৌ এর দিকে।তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল অবিশ্বাস আর ঘৃনা। বিছানায় বসে সে ভাবল, রাশেদ! এ কোন রাশেদ! তার মনে পড়ল এই নাম সে আগেও শুনেছে। হাতের উপর মাথা রেখে সে চোখ বন্ধ করল তীব্র কষ্টে। এই লোকের স্মৃতি তার কাছে অস্পষ্ট,সে হয়তো তাকে দেখেছে এবং চিনে। তাই সে গভীর দুশ্চিন্তায় হাবুডুবু খেতে লাগল....রাশেদ আমীন ..নাকি আমীন রাশেদ,সে মনে করতে পারে না।এই যুবক বোধহয় নাঈমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল, যদি তার পিতা তাকে প্রাধান্য দিত এবং জামাই হিসেবে নির্বাচন করত তবে আজ নাঈমার সাথে তার বিয়ে হত।সে স্মরণ করতে পারল একবার সে তাকে দেখেছে কিন্তু তার চেহারা তার মনে নেই। আবার সে মাথা উঁচু করে তার বৌ কে দেখল,সে কিছুই বিশ্বাস করতে চাইল না। তার তীব্র ইচ্ছা হল তাকে এ ব্যাপারে আরো জিজ্ঞাসা করার কিন্তু সে বুঝতে পারল না কিভাবে তার সাথে কথা বলব্ েসে দেখল তার দূর্বল ঠোঁট দুটো নড়ছে। নাঈমার পাশে দাঁড়াল সে আর নিঃশব্দে তার কথাগুলো শোনার চেষ্ঠা করল। বিলাপের স্বরে সে বলছে, “কে বলেছে এটা..উফ..বিশ্বাসঘাতকতা...রাশেদ..সাবের..বিশ্বাসঘাতকতা কত নিকৃষ্ট কাজ।” সাবের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বুকে আঘাত করতে লাগল। অজানা আশংকায় সে ভয় পেল। মন প্রান দিয়ে সে যেন বাধা দিতে চাইল একটি অনিবার্য দূর্ঘটনাকে। দীর্ঘক্ষণ সে তাকিয়ে থাকল নাঈমার মুখের দিকে । একসময় সেই মুখ ছাড়া আর সবকিছু তার দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল,কল্পনায় সে একটি কুৎসিত মুখ দেখতে পেল এই সুন্দর মুখশ্রীর পরিবর্তে। তার কথাগুলো অনুরিত হতে থাকল তার কানে। তীব্রস্বরে তার কথাগুলো সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। তার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠল,কন্ঠ শুকিয়ে গেল ...কার কথা..কিসের কথা বলছে নাঈমা! কোন বিশ্বাসভঙ্গের কথা বলছে সে অবচেতন মনে, সেটা কি এই জ্বরের চেয়েও কষ্টের কিছু যা সে বলতে বাধ্য হচ্ছে? অবচেতন মনে মানুষ কি মিথ্যা বলতে পারে? কিন্তু কিভাবে মিথ্যা বলবে? কিন্তু সে তার কানকে কিভাবে অবিশ্বাস করবে। একজন স্বামী তার স্ত্রীর জন্য অনেককিছু করতে পারে, এক স্ত্রীও তার স্বামীর জন্য অনেক কিছু করে কিন্তু তাদের সম্পর্কটা অবশ্যই স্বচ্ছ এবং একনিষ্ঠ হওয়া উচিৎ। এমন একটা নিকৃষ্ট বিষয়কে সে কিভাবে মন থেকে মুছে ফেলবে? হে আল্লাহ! সেই তো বলছে বিশ্বাসভঙ্গতা একটি নিকৃষ্ট বিষয় অথচ সে এই কাজই করেছে। এই অবস্থাতেও সে ভুলতে পারেনি সে কথা... ওহ প্রভু! সে ভাবল মানুষ যত রকম বিপদ আপদে পড়ে তার মধ্যে তার স্ত্রীর এই অসুখ নি:সন্দেহে গুরুতর,যদি এটা সামান্য অসুখ হত তবে কখনোই তার কাছে এই সত্য প্রকাশিত হত না। এসব ভাবতে ভাবতে সে হতাশ হয়ে পড়ল। সাবের সরল ও হৃদয়বান,রাগের বশবর্তী হয়ে কোন সিদ্ধান্ত সে নেয় না বরং নিশ্চল নির্বাক হয়ে যায় এমনক্ষেত্রে, তার অবস্থা হয় একটা গাড়ীর মত,চলতে চলতে যার গতি হঠাৎ থেমে যায়। তা সত্ত্বেও সে প্রচন্ড ঘৃনা নিয়ে শিশুটির দোলনার দিকে তাকালো,নি:শব্দে বিছানা ত্যাগ করে বাচ্চাটির কাছে যেয়ে তার পর্দা সরালো। সে তার ছোট্ট মুখের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল অচেনা দৃষ্টিতে।সন্দেহ আর কষ্ট তার অন্তরকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তার স্ত্রীকে দেখল জিজ্ঞাসাপূর্ণ দৃষ্টিতে,সে তার কাছে জানতে চায় অনেক কিছু। ধীরে ধীরে সে মেয়েটির বিছানার কাছে গেল। বিবর্ণ দূর্বল মেয়েটি চোখ বন্ধ করে ডানে বামে মাথা ঘোরাচ্ছিল। স্থিরদৃষ্টিতে সে মেয়েটিকে দেখল। তার থমথমে মুখ আর দৃষ্টিতে ছিল বিদ্যুতের চমক। অন্ধকার মেঘের মধ্যে যেমন বিদ্যুতের ছটা দেখা যায় ঠিক তেমনি। অথচ আগে দয়া ও মমতায় কম্পিত দেহে সে তাকিয়ে থাকত তার দিকে। কিন্তু এখন তার অন্তর পাথরের মত কঠিন। তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে সে জানতে চাইল,নাঈমা! নাঈমা! কি করেছে রাশেদ? কিন্তু সে জেগেও উঠল না তার ডাকে সাড়াও দিল না। নিরুপায় হয়ে সে উচ্চস্বরে ডাকতে লাগল নাঈমা! তার কন্ঠ পাশের ঘরে নাঈমার মা শুনতে পেয়ে অস্থির হয়ে উঠল,খারাপ কিছু আশংকা করে সে জানতে চাইল,কি হয়েছে নাঈমার...তুমি কি তাকে ঔষধ খাইয়েছ? সাবের তখনও তাকে ঔষধ দেয়নি সে চায় ঘোরের মধ্যে থেকেই নাঈমা আরো কিছু বলুক,যা শোনার জন্য সে উদগ্রীব। তাই সে মিথ্যা বলল,“জ্বি আল্হামদুলিল্লাহ! সে ভালো আছে।” বিছানায় এসে সে তার ব্যাথায় ভারী হয়ে যাওয়া মাথাটা বালিশে রাখল। এ সময় তার শাশুড়ী এসে দেখল নাঈমা শান্ত হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মেয়েকে দেখে সে চলে গেল। সাবের মন প্রাণ দিয়ে কামনা করল নাঈমা আবার জেগে উঠুক। সে তাকে জাগাতে চাইল কিন্তু তার শাশুড়ী শুনতে পাবে ভেবে আর সাহস করল না। অবশিষ্ট রাত সে নির্ঘুম কাটালো। অনেক রকম বাজে চিন্তা ভাবনায় তার আর ঘুম আসল না। একবার মেয়েটির দিকে আর একবার শিশুটির দিকে তাকিয়ে সে রাত অতিবাহিত করল।

ভোরবেলা মেয়েটি জেগে উঠল,উদভ্রান্তের মত এদিক সেদিক তাকিয়ে সে সাবেরকে দেখল। ক্ষীণ দূর্বল কন্ঠে সে কথা বলল,যেন একটি ছোট্ট পাখি ডেকে উঠল। “তুমি জেগে আছ কেন? কেন নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ?” আজ মেয়েটিকে আরো জীর্ণ শীর্ণ দেখাচ্ছে। তার চোখে মৃত্যুর হাতছানি। কিন্তু সাবের এসব লক্ষ্য করল না একটা চিন্তা নিয়েই সে নিদ্রাহীন থেকেছে সারারাত। মুমূর্ষ মেয়েটির কোন কিছুই তাকে প্রভাবিত করতে পারল না। ঘৃনা আর অবজ্ঞাভরে সে স্থিরদৃষ্টিতে তাকে দেখল। তার মনে জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন। সে বলল,গতরাতে তুমি অনেক কথা বলেছ,ছটফট করে এদিক সেদিক হয়েছ। জ্বরের ঘোরে তুমি এমন কিছু উচ্চারন করেছ যা বিস্তারিত জানা দরকার। কিছুই বুঝতে না পেরে মেয়েটি অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। সে অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ শিশুটি চিৎকার করায় কিছুই বলা হল না। তার শাশুড়ী এসে বাচ্চাটিকে কোলে নিল। তীব্র আক্রশে হাতমুষ্টিবদ্ধ করে সে মনে মনে বলল, এই অভিশপ্ত বাচ্চাটি তার পিতা-মাতার কলঙ্ককে আড়াল করে দিল। আমার অবশ্যই জানা উচিৎ সবকিছু আর সে সুযোগও এসেছিল কিন্তু কেন এই বাচ্চার চিৎকারে আমি থেমে গেলাম? আর তার নানীর উপস্থিতিতেই কেন আমি নীরব হলাম? সত্যিই আমি দূর্বল অন্তরের। সবসময় এই মায়া মমতার কারনেই আমি কিছু করতে পারি না। একটা সেবিকার মত আমি তার সেবা করে যাচ্ছি। অথচ আমি একজন পুরুষ..না না আমি পুরুষ নই কারো স্বামীও নই। আমার অবস্থা নারীদের মত অথবা উদাসীন পূরুষদের মত। আর কোন দলীল প্রমাণের প্রয়োজন আছে কি এই কথা শোনার পর? উহ্ আমার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে,সবকিছু শেষ।
সারাদিন সে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করল,কিন্তু কোন সিদ্ধান্তেই সে উপনীত হতে পারল না। প্রায় সন্ধ্যের দিকে সে বাড়ী ফিরে দেখল নাঈমার অবস্থা খুবই শোচনীয়। তার শাশুড়ী জানতে চাইল, “কোথায় ছিলে সারাদিন? ডাক্তার বলে গেছে ওর অবস্থা খুবই খারাপ।” শাশুড়ীর কোন কথায় সে মনোযোগ দিতে পারল না বিরক্ত হয়ে দু’একটা কথার জবাব দিল। নাঈমার অবস্থা খুবই খারাপ,যন্ত্রণায় সে অস্থির। সাবের কিভাবে তাকে বোঝাবে যে সে সবকিছুই জানে। আর এই অবস্থায় সে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কিভাবে নাঈমার সাথে কথা বলবে? তার মা তো এই অবস্থায় মেয়ে ছেড়ে থাকবে না। তার ক্রোধ বেড়ে গেল এসব ভাবতে ভাবতে। সে মনে মনে স্থির করল কিছুতেই সে তাকে আর ঔষধ খাওয়াবে না, তাহলে আবার সে জ্বরের ঘোরে কথা বলবে। তার কাছ থেকে সে সবকথা শুনতে চায় যা সে জাগ্রত অবস্থায় বলবে না। পেয়ালায় শুধু পানি নিয়ে সে মেয়েটিকে খাইয়ে দিল চরম ঘৃণা নিয়ে। এরপর বিছানায় ফিরে এসে সে অপেক্ষা করতে লাগল কখন সে প্রলাপ বকা শুরু করে। কিন্তু সে রাতে তার স্ত্রী ঘুমালো না কিংবা অচেতনও হল না। তীব্র যন্ত্রণায় সে অস্থির হয়ে গেল। এরপর ডাক্তার এসে তাকে দেখল এবং সাবেরকে বলল তার অবস্থা একেবারে চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। এ কথার মাত্র আধাঘন্টা পরেই মেয়েটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।
নি:সঙ্গতা আর অজানা ভয় তাকে পেয়ে বসল। এই মৃত্যু এবং স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা দুটোই তাকে সমান কষ্ট দিচ্ছে। নাঈমা চলে গেছে চিরতরে কিন্তু তার বিদায়ে সে দু:খিত নয়। তবে চোখের সামনে এই মৃত্যুর ঘটনায় তার কোমল হৃদয় বিগলিত। সে আনমনে বলল,“সে মারা যায় নি ..আমিই তাকে হত্যা করেছি। আমিই হত্যাকারী কারণ গত দুই রাত আমি তাকে ঔষধ দেইনি। আমিই তো তাকে মেরে ফেলেছি। বারবার সে এইকথাই বলতে থাকল। এই মৃত্যু তার কাছে একই সাথে ভয়ের এবং আনন্দের। সে আবার বলল,“নাঈমা আমাকে জীবিত অবস্থাতেই হত্যা করেছে,আমার নাম সে অন্য একটি মানুষের সন্তানের সাথে সংশ্লিষ্ট করেছে। সে প্রচন্ড আবেগে মাথা চেপে ধরল। তীব্র ঠান্ডা আর ভয়ে সে কেঁপে উঠল।

নাঈমার মৃত্যুর পর কিভাবে কাটছিল সাবেরের দিনগুলো? সে ছিল চরম অস্থিরতায় খুবই কষ্টে যা চিন্তা করাও অন্য কারো পক্ষে দু:সাধ্য। একদিন সে জানাল সে লেবাননে বেড়াতে যেতে চায় তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য। আসলে সে পালাতে চাইছে তার কষ্টের চিন্তাগুলো থেকে এবং শিশুটির কাছ থেকে। আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর থেকে সে লেবাননের উদ্দেশ্যে জাহাজে উঠে। সাগরের কাছে সমর্পন করে তার কষ্টের কথা। দুনিয়ার সকল বিষয়ে সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার অসহনীয় কষ্ট ও যন্ত্রণার উপশম করতে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাগরের বুকে। গোপন কথা অন্তরে রেখে সে মাছের খাদ্যে পরিণত হল।
সবাই আফসোস করল তার জন্য,তারা বলল মরহুম সাবেরের মত কেউ স্ত্রীকে এত ভালবাসতে পারেনা। স্ত্রীকে ছাড়া বেঁচে থাকা তার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছে তাই সে নিজেকে এভাবে শেষ করে দিল। আল্লাহ তাকে রহম করুন।
(দৈনিক যায় যায় দিন এ প্রকাশিত।আরবী থেকে অনুবাদ:তাসনীম আলম)

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১০ সকাল ৭:৪০
১৩টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×