somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুখ ও অসুখের গল্প

০৭ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গল্পের নায়ক, জুনায়েদ, ২৯ বছরের বেকার যুবক। মফস্বল থেকে বেড়া উঠা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের আদরের সন্তান। আদর বলতে খাবারের সময় চিনামাটির প্লেটে এক টুকুরো মাছ কারণ বাকি দুই বোনের জন্য নির্ধারিত ছিল সিলভারের বাটি সাথে একটুকরো মাছের অর্ধেক করে। আদর বলতে সারা বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে রোজার ঈদে ভালো একটা প্যান্ট, একটা শার্ট আর ৩০ টাকা দামের একজোড়া চটি জুতা। বাকি দুইবোন এবং মা বাবার কপালে কিছু জুটুক কিংবা না জুটুক। এইটাই একমাত্র ছেলে সন্তানের জন্য সর্ব্বোচটুকু। গল্পের নায়ক কিন্তু সিনেমার নায়কের মতোই দারিদ্র জয়ে অর্বতীণ হয়। মেট্রিক, ইন্টার পাশ করে ভার্সিটিতেও ভর্তি হয়। সারা গ্রাম জুড়ে প্রশংসা আর প্রশংসা। মা বাবা দুইজনই স্বপ্নে এখন আর হাবিজাবি দেখে না। স্বপ্ন তাদের এখন একটুকরো সুখ। যা গত কয়েক দশক ধরে তাদের কাছ থেকে দূরে। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে ঢের আগে। বাবা কর্ম অবসর। জুনায়েদ এখন টিউশন করে শহর জুড়ে, ভালোই নাম ডাক হয়েছে টিউশন মাস্টার হিসেবে। শহরের চোরাগলিতে হাঁটতে হাঁটতে সেও স্বপ্ন বুনে, সুখের স্বপ্ন, ছোট একটি কুটিরের স্বপ্ন, যেখানে স্বপ্নের অপ্সরী হেঁটে বেড়াবে, খিলখিল হাসি আর টোল পড়া মুখশ্রী ভেসে বেড়াবে সারা বিকাল জুড়ে, সমস্ত হৃদয় জুড়ে। অপ্সরীর খুঁনসুটি লজ্জাবতীর পাতার মতো নুয়ে পড়বে শ্বশুর শাশুড়ির উপস্থিতিতে। ব্যস্ততার দিনশেষে অবসান ঘটবে সন্ধ্যার আকাশে অন্ধকার নামা, তার পরিবর্তে প্রতিদিনই উঠবে জোসনা। প্রতিটি বিকেল বসবে পাখিদের কলরব, বোন, দুলাভাই, ভাগানা ভাগনিদের আনাগোনা, হাসি তামাশায় ভরে উঠবে সমম্ত সন্ধ্যা। ভালোবাসাই হবে যে নীড়ের অবলম্বন।

কিন্তু দিন শেষে টিউশনির টাকায় আর যাইহোক সুখ ধরা দেয় না, টানটান উত্তেজনায়, আর দাঁতমুখ খিঁচে চাপা পড়ে হাজারো চাহিদা, টিকে থাকে শুধু দুমুঠো অন্ন, ভাগিনা ভাগনিদের জন্য ইদে কিনতে না পারা শার্ট, প্যান্টের কষ্ট, বাবা মায়ের জন্য কিনতে না পারা ঔষুধের শিশির বুকচাপা আর্তনাদ, সামাজিক অনুষ্ঠানে না যাবার মুখ লোকানোর হাতেখড়ি। সুশান্ত পালের গালগল্প শুনে আবারও ডুব দেয় স্বপ্নে, নায়ক শুধু একা আর স্বপ্ন দেখিনা, স্বপ্ন দেখে বাবা মা, ভাগিনা ভাগনি, স্বপ্ন দেখে ছোট বোন, বড় বোন। স্বপ্নে সে রাজা হয়, সারা বিশ্বের সব দারিদ্র দূর করে এক নিমেষে, কত প্ল্যান করে অভুক্ত মানুষের জন্যে, কত দীর্ঘ চিঠি লেখে প্রেয়শীর তরে, যার সাথে তার দেখা হবে কোন এক ফ্ল্যাডলাইটের নিচে, চোখোচোখি হবার সাথে সাথে সে অনুভব করবে নায়কের সকল যাতনা, স্বাগ্রহে এগিয়ে জিজ্ঞাসিবে, খেয়েছে কিনা? নায়ক তখন তাকিয়ে থাকব তার দুটো টলমলে সমুদ্র পানে। তার স্পর্শ দূর করে দিবে নায়কের সমস্ত বিকালের ক্লান্তি। তার সকল দুঃখ সপে দিবো অপ্সীর কাছে, বিনিময় সে দিবে একটুকরো সুখ। অবসান হবে নায়কের দীর্ঘ অপেক্ষার। কিন্তু স্বপ্ন সে ত স্বপ্নই, দিবাস্বপ্নের বেড়াজালে আটকে থাকে নায়ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠচুকে চাকরির বাজারে সে এখন। আরো বড় শহরে পাড়ি দেয় সে। স্বপ্নের আকার ছোট হতে থাকে, স্বপ্ন দেখাও কিছুটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠে নায়কের বাবা মায়ের জন্য। তাদের স্বপ্ন ছেলে কিছু একটা করুক। দুইমুঠো অন্নের ব্যবস্থা অন্তত হোক। নায়ক যাপিত জীবন বাঁচাতে টিউশন খুঁজে, চাকুরির প্রস্তুতির জন্য সাধারণ জ্ঞান, ম্যাথের প্যাঁচ, বাংলা, ইংরেজি দ্বারা মাথা ভর্তি করে। সমানতালে চলে অসম জীবন, অসম স্বপ্ন। হাঁটতে হাঁটতে নায়ক স্বপ্নে বিভোর হয়, বিড়বিড় করে কথা বলতে থাকে, ভাবতে থাকে এই বুঝি রাস্তার ধারে কালো টাকায় ভরা কোন বস্তা বা সুটকেইস পেল বলে। যার ভিতরটা ভরা থাকবে চকচকে সংসদ ভবনের ছবি চাটা এক হাজারিতে। নায়ক কিছুটা দ্বিধায় পড়ে শুধু টাকার পরিমাণ নিয়ে ১ কোটি হবে নাকি ৭৫ লাখ। কিছুটা ধাতস্ত হতেই ভাবে স্বপ্ন যখন, তখন এক কোটিই হোক। ভেতরে ভেতরে হাসতে থাকে সে, হাসিটা কিছুটা সারা চেহারায় ফুটে উঠে, তবে রাত বলেই হয়ত এইসব দৃশ্য অন্ধকারে মিশে যায় লোক চুক্ষুর অন্তরালে।
অবশেষে নায়ক ইন্টারভিউ বোর্ডে, আধাঘন্টা প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে বের হয়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস, চাকুরি মনে হয় এবার হয়ে যাচ্ছে। বোর্ড কর্তাদের খুশিই মনে হলো। স্বপ্ন আবারও হানা দেন নায়কের অন্তর্জালে। পাশের সিটের মেয়েটাকে অসম্ভব ভালো লাগে, কি অসম্ভব মায়া সারা চোখ জুড়ে। অথচ কখনও কথাই বলা হবে না ভেবেও স্বপ্ন বুনে সে। দিন যায়, রাত যায় নায়কের তৃপ্তির অপেক্ষা শেষ হয়না। অবশেষ এলো সে অবেলা, সুখ নিয়ে নয়, অসুখের মাত্রা খানিকটা আরো বাড়ে। অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে সে। রাস্তার ফ্লাডলাইটের আলোও বিষন্নতা ছড়ায় চারিধারে। মানুষ থেকে আরো দূরে সে সরে পড়ে, রাতের ঘুমের জন্য আদিম যৌনতার আশ্রয় নেয় সে। সুখ বলতে ঐটুকুই।

করোনা ভাইরাসের হানা আঘাতের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। টাকার প্রবাহ কমে আসে। ছোট বোনের জামাই মশায়ের ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ে। বোন ভাগিনা ভাগনি নিয়ে উঠে আসে নায়কের বাড়ি। মা কল দেয় জুনায়েদকে, " কিরে ক্যান আছস?
-জ্বী, মা ভালো।
- কি খাইছস?
- এই ত খাইছি।
- নাহিদা আইছে, আন্ডা এইয়ানে? তুইও চলে আয়, ঢাকা কষ্ট হানোর চ্যে, বাইত ভাত হ্যান খাই চলমু, তুই চলে আয়।
- আচ্ছা দেই মা। দোয়া কইরো।
জুনায়েদ জানে, মা কখনও তার কাছে টাকা চাইবে না, তার বাবাও কখনও তার কাছে টাকা চায় না, কিন্তু সে বুঝতে পারে, অর্থই সকল সুখের উৎস। পরেরদিন কিছু টাকা রুমমেটের কাছ থেকে ধার করে বাড়িতে পাঠায়। বোন আসছে, তার ওপর ভাগিনাটা মাংস খেতে পছন্দ করে। সময় অদ্ভুত করোনার একবছর অতিক্রম হয়, কিন্তু জুনায়েদের ভাগ্যাকাশে কোন চাকুরি জুটে নি। না সরকারি, না বেসরকারি। আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকে সে, আত্মবিশ্বাস হারায় তার পরিবার, তার বন্ধু বান্ধব, আত্মবিশ্বাস হারায় রুমমেটরা। প্রচন্ড বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে। শহরের অলিগলিতে সে আর স্বপ্ন দেখে না, শুধু ফাঁদ খুঁজতে থাকে, মৃত্যুর ফাঁদ। সে আফসোস করতে থাকে, প্রার্থনা করে মনে মনে "ইশ, যদি একটা কনাস্ট্রাকসন বিল্ডিং থেকে একটা ইট কিংবা রড যদি তার মাথা এসে পড়ত, তবে অন্তত এই অসীম যন্ত্রনা থেকে মুক্তি মিলত"। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিংয়ের তল দিয়ে সে হেঁটে যেত সজ্ঞানে। মৃত্যুও আজ আমার থেকে পালালো তবে, আনমনে একা একা প্রায় বলে বেড়ায় সে। তবুও ফাঁদ খুঁজে সে কখনও রাস্তা পারাপারের সময়, কখনও ছাদে হাঁটার সময় কিংবা রুমমেট হীন ঘরে।
তারও কিছুকাল পর কোন এক শীতে বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পায় সে। খবরটা শুনে সে কিছুক্ষণ নির্বাক থাকে, চোখও তার সাথে ছলনা করে, সকল অশ্রু এসে যে বরফ জমাট হয়েছে কোটরে। আত্মহত্যার পথে হেঁটে গেছে একজন, তারই ছোট বোনের জামাই। সমস্ত সত্তা যেন সে হারিয়ে ফেলেছে, সে বুঝতে পারে তার বেঁচে থাকার গুরুত্ব টা। ছোটবোনের গায়ে সাদা কাপড় যেন চেয়ে গেছে তার সমস্ত স্বপ্ন জুড়ে, চারিধারের সব রং যেন বিলীন হয়েছে ধূসরে। ইশ্বরের প্রতি তার শেষ বিশ্বাসটুকুও যেন উঠে যায়, আর আনমনে বলতে থাকে, কষ্টের পাহাড়ে তুমি কি কভু ঝরণা ধারা প্রবাহিত কর নাকি ঝরণা ধারাটাই পাহাড়ের কষ্ট। আমাদের নায়ক আবার ফিরে আসে এই শহরে, আমাদেরই মাঝে।
সে আবার হেঁটে বেড়ায় টিএসসি থেকে নীলখেতে, শাহবাগ থেকে জাতীয় সংসদে তার ক্লান্তি নেই, সে অবসাদগ্রস্থ হয়, তবে মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারে না, সে কষ্ট পায় তবে কষ্ট তার অশ্রু ঝরাতে পারে না। সে প্রচন্ড একা তবুও সে আনমনে স্বপ্ন বুনতে ভুলে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১২:৪৭
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×