মান্নান মিয়া মিডিলইস্টে ছিলেন দীর্ঘদিন। সেখানে থাকা খাওয়ার বেজায় কষ্ট,তবু সেই কষ্ট সহ্য করে তিনি প্রায় এক যুগ কাটিয়ে এসেছেন বাহরাইনে। মাঝখানে একবার দেশে এসে বিয়ে করেছিলেন,বিয়ের পর দিন পনেরো থেকেও গেছেন। সেই পনেরো দিনের ফসল এই টাবলু মিয়া। ছেলের জন্মের সময় তিনি ছিলেন বাহরাইন, পই পই করে বলে দিয়েছেন ছেলের নাম আহসান উদ্দিন রাখার জন্য,দেশ থেকে তাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে যে,ছেলের নাম আহসান উদ্দিনই রাখা হয়েছে,কিন্তু দেশে ফিরে দেখছেন, 8 বছরের গাব্দা গোব্দা ছেলেকে সবাই ডাকছে 'টাবলু'। আহসান উদ্দিন নাকি আসল নাম, টাবলু হচ্ছে ডাক নাম। মান্নান মিয়া বিরক্তিতে কথা বলতে পারেননি,আসল নাম আর ডাকনাম কী,যে নামে সবাই ডাকে,সেটাই তো আসল নাম। তার নিজের নাম একটা,সেটা নিয়ে তো তার কোন সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে এক লোকের দুই নাম দেয়ার দরকারটা কী?
তিনি কয়েকবার আহসান উদ্দিন বলে ডেকে দেখেছেন,ছেলে সাড়া দেয় না। টাবলু বলে ডাকলে দৌড়ে চলে আসে। এ নিয়ে রাগারাগি করতেই বউ মিনমিন করে বলল,নামে কি আসে যায়? আপনি এমন করছেন কেন ?
এ কথা শুনে মান্নান মিয়ার মাথা রাগে চিড়বিড় করে ওঠে।বেকুব মহিল বলে কী! নামে অনেক কিছু্ই যায় আসে।গোলাপকে গোলাপ নামেই ডাকতে হয়,গোলাপের নাম গন্ধমাতারি দিলে কেউ পুছবে না। এই যে কচুরি পানা ফুল,কতো সুন্দর তার রং,কিন্তু নামের জন্যই তো সে কদর পাচ্ছে না।এর নাম হতো ক্যান্ডিফ্লস,দেখতা বড়োলোকের বাড়িতে তার কদর কতো হতো।
তার ছেলে যখন একদিন বিরাট নামিদামি মানুষ হবে তখন কি টাবলু নামে চলবে? কেউ কি বলতে পারবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক টাবলু মিয়া,নয়তো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর টাবলু মিয়া। দেখা যাবে এই নামের কারনেই ছেলের চাকরিটা পর্যন্ত হচ্ছে না।
ছেলে যে বিখ্যাত কেউ হবে,তা নিয়ে মান্নান মিয়ার কোন সন্দেহ নেই।সব বাবাই চায় তার ছেলে হোমড়া চোমড়া কেউ হোক,মান্নান মিয়া তা চান না। তিনি চান তার ছেলে মানুষের মতো মানুষ হোক,সমাজের জন্য কিছু একটা করুক। সে জন্য তার চেষ্টার অন্ত নেই। ছেলেকে অনেক মহৎ মানুষের জীবনী কিনে দিয়েছেন,চেষ্টা করছেন ভালো কিছু করার দিকে ছেলেকে ঝুকাতে। ছেলেকে নিয়ে শহীদ মিনার,স্মৃতি সৌধ ইত্যাদিও ঘুরে এসেছেন কয়েকদিন। ইচ্ছে ছিল,ছেলেকে নিয়ে কয়েকজন মহান মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাবেন, মহান মানুষদের কাছ থেকে দেখলে ছেলের অনেক উপকার হতো।
মুশকিল হচ্ছে ,সেরকম মহান মানুষদের আকাল আছে দেশে। এই পোড়ার দেশে যতো ভালো মানুষ জন্মেছিলেন ,তাদের প্রায় সবাই মরে গেছেন। জীবিত মহামানব পাওয়াটা বড়ো দুষ্কর।
আজ একজন অসাধারন মানুষের খবর পেয়েছেন মান্নান মিয়া।প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় সেই মানুষটির খবর ছেপেছে। সেই মহাপুরুষের নাম আমিনুল হক ভুঞা। তিনি ছিলেন শেরে বাংলা নগর বালক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। এমন বড়ো কোন পদ নয়,এরকম গন্ডায় গন্ডায় সহকারী প্রধান শিক্ষক দেশের কোনায় কানায় ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই আমিনুল হক যে কাজটি করেছেন,সেটা করার হিম্মত আছে এমন লোক দেশে খুব বেশি নেই। বিচারপতি আজিজের যুগে ভূয়া ভোটার লিস্টে 900 ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্ত করার আদেশ এসেছিল তার উপর। এরকম তো কতো হচ্ছে,সারা দেশেই প্রতিটি সেন্টারে ভোটার বাড়ানো হচ্ছে বি.এন.পি র সুবিধার জন্য,কোন শিক্ষকই উচ্চবাচ্য করছেন না। কিন্তু আমিনুল হক বেকে বসলেন,তিনি গলার রগ ফুলিয়ে বলে উঠলেন,'না।' তারপর তার উপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝঞ্জা গেছে,নিরুপায় হয়ে আমিনুল পুরো ব্যাপারটি সাংবাদিকদের জানালেন।
এতে করে বেকায়দায় পড়ে গেল বি.এন.পি সরকার।তার অভিযোগ প্রত্যাহারের বিনিময়ে না না সুযোগ সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব এলো তার কাছে। কিন্তু তিনি টললেন না।এতে করে তার উপর নেমে এলো প্রতিশোধের খড়গ। 27 বছরের পুরোনো চাকরি থেকে বাধ্যতামুলক অবসর নিতে হলো,চাপের মুখে সরকারি চাকরি ছাড়লেন তার পুত্রবধু, সরকারি চাকরি তে 6 মাসে 6 জায়গায় বদলি হলেন তার ছেলে।
এতো করেও আমিনুল হককে টলাতে পারে নি বি.এন.পির লোকজন।
এখন তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। সরকার আর বড়ো দলের বিরুদ্ধে এরকম ঢাল তলোয়ার ছাড়া লড়াই চালিয়ে যাওয়া সোজা কথা নয়।
আমিনুল হকের প্রতি শ্রদ্ধায় মান্নান মিয়ার মাথা নিচু হয়ে আসে। এ রকম আমিনুল হক যদি দেশের সবগুলো অফিসে থাকতো,তাহলে এই দেশের আর কোন দূ:খ থাকতো না।
তিনি ঠিক করেন,টাবলু মিয়াকে নিয়ে তিনি আমিনুল হকের বাসায় যাবেন। ছেলেকে সামনে বসিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসবেন এ রকম মেরুদন্ডঅলা লোককে...।একজন মহাপুরুষকে দেখলে টাবলু নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিখতে পারবে।
[ইটালিক](দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)[/ইটালিক]
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০