somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এলিজিঃ আমাদের বাবারা; যাঁরা চলে গেছেন

১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তারা সকলে খেয়াল করলেন যে; সে রাতে, আকাশে- একটা নতুন তারা উদিত হয়েছে। তখন তারা, তাদের বাবাকে বিদায় জানিয়ে আসছিলেন। এই তারাটা, তারা ইতিপূর্বে কোনদিন দেখেছেন বলে- মনে করতে পারলেন না। এবং তারা আরো খেয়াল করলেন যে, তারাটা তাদেরকে অনুসরণ করছেন আর মিটমিট করে হাসছেন। সে রাতে উদিত নতুন তারাটার ওজন ছিল একুশ গ্রাম। আকাশে প্রতি রাতে এরকম অনেকগুলো নতুন নতুন তারা উদিত হয়। প্রত্যেকটার ওজন একুশ গ্রাম। তারা নিজেদের প্রশ্ন করলেন যে, পৃথিবীর সব বাবারা বুঝি, চলে যাবার পরও, এরকম তারা হয়ে, সন্তানদের নরোম কোমল আলোয় এভাবে আগলে রাখেন। তারা সেদিন, প্রত্যেকে নিজেদের বললেন যে, বাবা আমাদের শীঘ্রই দেখা হবে।

অচিন্ত্যপুরের দিকে যখন, তারা তাদের বাবাকে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছিলেন, আশ্চর্জনকভাবে সে রাতে দুধ জ্যোস্নায় মাঠ-ঘাট থৈ থৈ করছিল। মনে হচ্ছিল, সে চাঁদটা ও, সে রাতে নতুন করে উদিত হয়েছে। এরকম প্রতি রাতে নতুনরুপে একটা জ্যোস্নাভরা চাঁদ উদিত হয়।

বাসায় ফিরে এসে, তারা দেখলেন যে, ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার খুব একা, ভীষণ বিমর্ষভাবে, তাদের বাবার জন্য অপেক্ষমাণ। একটা মোটা কাঁচের চশমা, ঠাণ্ডা হীম হয়ে উঠা খাটের পাশেই করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। দেয়ালে খুব আনমনা হয়ে ঝুলে থাকা বাবার ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি আর জায়নামাজ আশ্চর্য শান্ত শীতল দ্যোতি ছড়াচ্ছে। বাড়িটার প্রতিটা কঙ্ক্রিট, সফেদ দেয়াল, বৃষ্টিস্নাত জানালার কাঁচ, দরোজার কবাট, প্রতিটি ইটের গাঁথুনিতে লেগে থাকা বাবার কোমল স্পর্শ, প্রচন্ড পরিশ্রমে মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা তেতলা বাড়ির চারদিকে সততার মোলায়েম পরশ আর কোমল পেলব স্নিগ্ধ নীরবতা, সমস্ত গ্রামকে ভীষণ নীরব করে তুলেছে। সমস্ত গ্রামবাসীর মনে হচ্ছিল, আজকে এতো করুণ সুরে, কোন সে ধ্যানমগ্ন বেহালা বাদক বেহাগের সুর বাঁজিয়ে চলেছেন। কেমন ছিঁড়ে-খুঁড়ে যাচ্ছে পরাণের গহণে।

তারা মনে করতে লাগলেন, তাদের বাবা, এমন অনেক দিন গেছে, পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য এবং সেটা আমাদের জন্য, কত কত দীর্ঘ পথ হেঁটে এসেছেন, বাজারের থলে কাঁধে নিয়ে। খেতে খুব পছন্দ করতেন। ছেল-মেয়েদের, মেয়ে জামাইদের, পাড়ার যত চেনা জানা মুখ আছে, আনন্দ নিয়ে খাওয়াতেন। পাড়ার কার ছেলের অসুখ, কার ছেলে গ্রাম থেকে এসে থাকার জায়গা পাচ্ছে না, কার সংসারে কর্জের ভারে অশান্তি লেগে আছে, কার ঘরে উনুনে ভাতের হাঁড়ি চাপেনি, সব খবর তাদের বাবার কাছে থাকত। ছুটে যেতে হবে তো সেখানে!

শেষবারের মতন বিদায় বলার জন্য যখন সকলে সারে সারে দাঁড়িয়ে আছেন, তারা দেখলেন যে, অগণিত মানুষের সারিতে, আরো কেউ কেউ শামিল হয়েছেন। আসমান থেকে অগণিত তারা, যারা পৃথিবী থেকে বহুদিন আগে চলে গিয়েছিলেন, তাদের বাবার ভায়েরা, বন্ধুরা, তারাও সেদিন তাদের অকৃত্রিম বন্ধুকে বরণ করে নেবার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। তারা খেয়াল করলেন যে, নদীর জল সেদিন শান্ত হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের সন্ধ্যাটা সোনাঝরা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল। মাঠ-ঘাট-কোলাহল সব আশ্চর্য শান্ত হয়ে উঠেছিল। এতোটা স্নিগ্ধতা তারা ইতিপূর্বে কোনদিন অনুভব করেননি। যেদিন, মেয়ের বিয়ে হয়, যেদিন একমাত্র ছেলের বিয়ে হয়, যেদিন ভায়ের মৃত্যু হয়, সেদিন তারা তাদের বাবার কাঠিন্যতা বিপন্ন হতে দেখেছিলেন। সেদিন তারা দেখেছিলেন, তাদের বাবা কতোটা শান্ত।

সেদিন ছোট মেয়ের হাতে মেহেদীর রঙ মুছেই যায়নি। তাঁর বোধয় তাড়া ছিল। কীসের সে তাড়া? দীর্ঘ সংসার জীবনের কোথাও কোন খেদ ছিল না। যেদিন তাদের বাবা চলে যান, সেদিন তারা তাদের মায়ের কান্না দেখতে পেলেন। সে কী ব্যাথাতুর কান্না। গহন রাতের একেলা ডাহুকের সে কী তীব্র ব্যথা জড়ানো ক্রন্দন। সেদিন বোনেরা তাদের ভায়ের গগনবিদারী কান্না দেখেছেন। ইতিপূর্বে কেউ কোনদিন, তাদের ভাইকে কাঁদতে দেখেননি। যে মেয়েটা অনেক দূরে থাকে বলে, পৌঁছুতে পারেনি, যে তার বাবাকে দ্যাখেছিলেন, বহুদিন আগে, সে শুধু বলেছিল, তবে কী আমার বাবার সাথে আর দ্যাখা হবে না। এক দলা বোবা কান্না গলা বরাবর এসে আঁটকে যাচ্ছিল তার। সেদিন সে বলেছিল, কত্ত বড় নদীর ঢেউগুলো, আর, আর আমরা কতো ছোট। কতোটা অসহায়!
ইতিপূর্বে তারা সকলেই এতোটা শূণ্যতা অনুভব করেননি। তারা প্রত্যেকে খেয়াল করলেন যে, তাদের জ্বরালো কপালে একটা হাতের স্পর্শ কমে গেছে। তারা দেখলেন যে, তাদের সামান্য জ্বরে একজন বাবাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখছেন না আর। তারা খেয়াল করলেন যে, মাঝ রাতে নিমগ্ন অপেক্ষায় আর কোন বাবা অস্থির পায়চারি করছেন না। ঘরে ঢুকেই একজন বাবাকে সন্তানের মুখ না দেখার কারণে উদগ্রীব হয়ে উঠতে দেখেছেন না। তাদের কারোরই ইতিপূর্বে কোনদিন বুকের ভেতরটা এতোটা ফাঁকা লাগেনি। কিন্তু সেদিন, যেদিন আকাশে একটা একুশ গ্রাম ওজনের নতুন তারা উদিত হল, সেদিন প্রচন্ড বেদনায় তারা প্রত্যেকে হু হু করে ঢুকরে কেঁদে উঠেছিল।

হঠাৎ দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে বড় মেয়েটা আব্বা বলে দরোজা খুলে দেখেন, সেখানে কেউ নেই। মেঝ মেয়েটা বলে উঠলেন, আব্বা আসেননি? এতো দেরি করছে কেন আজকে? খাবার টেবিলে সকলে দেখলেন, একটা বিমর্ষ চেয়ার ফাঁকা পড়ে আছে। গহণ রাতে ডাহুকের কান্নার শব্দে তাদের মায়েরা পাগলের মতন ছুটে ছুটে যাচ্ছিলেন অচিন্ত্যপুরের দিকে। তারা সকলে দরোজা-জানালা খুলে রেখেছেন, বাবা এসে যদি, ঘরে ঢুকতে না পারেন। নির্ঘুম রাতে দীর্ঘ অপেক্ষমাণ প্রত্যেকে, যদি বাবা এসে ঘুমাতে দেখে অভিমানে ফিরে যায়!

কিন্তু সে রাতে আকাশে একটি আনকোরা তারা উদিত হল; অনেক তারাদের ভীড়ে। তারা প্রত্যেকে তাদের তেতলা বাড়ির ছাঁদের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা নতুন উদিত তারাটা আলাদা করে চিনতে পারলেন।

তারা নিজেদের জিজ্ঞেস করলেন যে, আমাদের বাবার জীবন অপূর্ণ ছিল কী না! তখন তাদের একমাত্র ভাই, তার বোনদের বললেন, পৃথিবীর সব বাবাদের জীবন অপূর্ণ থাকে, এজন্য প্রকৃতি বাবাদেরকে মেয়ের পাশাপাশি ছেলেও দিয়েছেন।

সেদিন পৃথিবীর সব সন্তানেরা, সকল অনাগত শিশুরা, চীৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, আমাদের বাবারা, আমরা তোমাদের ভালোবাসি, কিন্তু তোমাদের সমান পারবো না। আমাদের বাবারা, আমরা আমাদের মায়েদের ভালোবাসব, এই প্রতিশ্রুতি তোমাদের দিলাম। আমাদের বাবারা, তোমরা ভালো থেকো। আমাদের শীঘ্রই দেখা হবে।

(যে সব বাবারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তাদের পদতলে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। যে সব বাবারা আমাদের মধ্যে আছেন, তাদের সকলের জন্য আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গভীর ভালোবাসা)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:২২
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×