somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোন এক বিষুদবারের পাঁচটার পরের পৃথিবী

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখন তিন তারকা হোটেলের পাঁচশ কুড়ি নম্বর রুমের দরোজায় কেউ একজন চরম মাত্রার উত্তেজনা নিয়ে ক্রমাগত কড়া নেড়ে যাচ্ছিল।

প্রথমে তোরাব আলী সিকদার তার ছোট ভাইকে ফোন করলেন। হয়ত ফোন করার কথা ভাবছিলেন। তিনি ভাব্বার চেষ্টা করলেন- খুব জরুরি কিছু বিষয়ে তার সাথে আলোচনা করতে হবে। সদ্য কলেজ পাশ করা ছোট ভাই। কী করছে না করছে। কোথায় পড়বে না পড়বে। তার পরিকল্পনা সম্পর্কেও জানা দরকার কী না ইত্যাদি আরো জরুরি বিষয়ে আলোচনা করতে হবে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হতে চাইলেন।

পাঁচ বছর পরে, যেদিন তার ছোট ভাই কলেজ পাশ করলেন, তোরাব আলী সিকদার সেদিন বুঝলেন যে, তাকে তার চাচারা কোন দিক-নির্দেশনা দেননি অথবা দিতে পারেননি কিংবা দিক-নির্দেশনা দেবার মতন কেউ ছিল না বিধায়, তোরাব আলী সিকদার সকলের মতই কিছু না কিছু হবার জন্য ছুটছেন। কিন্তু তিনি একদিন কিছু না হবার স্থির সিদ্ধান্তটা তার চাচাদের জানাতে চেয়েছিলেন এবং এটাও জানাতে চেয়েছিলেন যে যেটা ভালো মনে করি, সেটাই পড়া উচিত, সেটা তিনি জানতেন না বলেই তিনি জানতে চেয়েছিলেন কোনটা ভালো মনে করা উচিত।

তোরাব আলী সিকদার তিন নাম্বার পেগটা ঢক করে চালান করে দিয়েই বুঝলেন যে- ছোট ভাই ফোন ধরেনি। তিনি দ্বিতীয়বার ফোন করার আগে মনে করলেন- মাকে ফোন করা দরকার। নানান বিষয়ে কথা বলতে হবে। এই যেমন জিজ্ঞেস করতে হবে- শরীর কেমন। বাবার সাথে ঝগড়া হয় কী না সেটা জানা দরকার বলে মনে করলেন। ছোট বোনের কী অবস্থা সেটাও জানা জরুরী। সে কী এখনো হুইলচেয়ারেই? অথবা তিনি জিজ্ঞেস করবেন- টাকা-পয়সা আছে কী না। এইসব বিষয়ে জানার দরকার আছে বলেও তিনি মনে করতে চাইলেন।
কিন্তু মা ফোন ধরেননি। তিনি তখন ছোট ভাইকে দ্বিতীয়বার ফোন করবেন বলে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তিনি মাকেও পুনরায় ফোন করলেন। তিনি সবাইকে বাদ দিয়ে এবার বাবাকে ফোন করলেন। না। তিনি এবার ছোট ভাইকে ফোন করলেন। আবার মাকে ফোন করলেন। তখন তিনি স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হলেন যে- এবার সেঝটাকে ফোন করতে হবে।
যখন তোরাব আলী সিকদারের ছোট বোনের বাথরুমে পড়ে যাওয়া এবং বাথরুমে পড়ে যাওয়ার ফলে যে চিরকালের পঙ্গুত্ব বরণ করা, এ বিষয়ে তোরাব আলী সিকদার নিজে যেমন প্রতিনিয়ত অপরাধবোধে আক্রান্ত, যখন এবিষয়ে পরিবারের সকলেই এক রকম তোরাব আলী সিকদারকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল, যখন দোষী সাব্যস্ত করে সকলেই তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন এই সেঝ ভাইটাই তোরাব আলী সিকদারের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। তোরাব আলী সিকদার ভাবতে চাইছিলেন সেঝ ভাইটা ফোন ধরবে, আর সে ফোন ধরলে সবাইকে পাওয়া যাবে। সব খবর পাওয়া যাবে। তার আগে কাঁচের গ্লাসে বরফ কুচি ফেললেন। ছোট্ট করে একটা পেগ চালান করে দিলেন। তিনি চূড়ান্তভাবে বুঝতে সক্ষম হলেন- কেউই ফোন ধরেনি।


তোরাব আলী সিকদার তিন তারকা হোটেলের পাঁচশ কুড়ি নম্বর রুমে, ঠিক সন্ধ্যার সময়, যখন আসমান আর জমিনকে একটা আড়াই থেকে সাড়ে তিন ইঞ্চি মাপের লালচে উজ্জ্বল আলোর রেখা জোড়া লাগিয়ে দিতে প্রস্তুতি নেয়, তখন আবারো তিনি সবাইকে ফোন করলেন।
এইভাবে এক সপ্তাহ জুড়ে তিনি সবাইকে ফোন করলেন। কিন্তু কেউই ফোন ধরলেন না, এবং আশ্চর্যজনকভাবে তোরাব আলী সিকদার গত আড়াই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতন অনুভব করলেন যে- পরিবারের সদস্যদের জন্য তার ভেতর অদ্ভূত শূণ্যতা কাজ করছে। তিনি আরো টের পেলেন যে- তিনি ক্রমশঃ বৃত্ত থেকে বিন্দুতে পরিণত হচ্ছেন। তিনি মায়ের নির্লিপ্ত চোখের চাহনি দ্যাখতে পেলেন। তিনি ছোট ভায়ের সিদ্ধান্ত নেবার জন্য যে দিক-নির্দেশনা না পাওয়ার অসহায়ত্ব, সেটা অনুভব করলেন। তিনি ছোট বোনের হুইল চেয়ারে মিইয়ে পড়া নতমুখ দ্যাখতে পেলেন। তিনি বাবার অসহায়ত্ব অনুভব করলেন এবং একইসাথে পরিবারে নিজের অস্তিত্বহীনতা টের পেলেন। পরিবারের সদস্যরা ফোন না ধরলে কী যে পীড়া দেয় সেটাও তিনি জীবনে প্রথমবারের মতন অনুভব করলেন। এবার তিনি গ্লাসে বরফ কুচি না ঢেলেই পরের পেগটি ঢক করে চালান করে দিলেন।

তোরাব আলী সিকদার বাথটাবে ঘুমিয়ে পড়লেন। আদতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। এবং তিনি বাথটাবে শিশুদের মত হাঁটু ভাঁজ করে বুকের কাছে গুঁজে ঘুমাচ্ছিলেন। বাথটাবের পানি ছিল ঈষদুষ্ণ। ঈষদুষ্ণ বাথটাবের পানিতে ঘুমাতে ঘুমাতে তিনি হিসাব করে দ্যাখলেন যে- গত আড়াই বছর ধরে তিনি বাড়ি যাননি। গত আড়াই বছর ধরে তিনি তার সেসব বন্ধুদের সম্ভবত ফোন করেননি। সেসব বন্ধুরা, যারা, তোরাব আলী সিকদার বাড়ি গেলে নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে সারাক্ষণ তার সাথে লেগে থাকে। কত্তদিন পর বন্ধু গ্রামে এলো। তারে সময় দেওয়াটা তারা কর্তব্য জ্ঞান মনে করে। তিনি দেখলেন যে- গত আড়াই বছরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সবচে কাছের বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলেননি। তিনি দেখলেন যে- গত আড়াই মাস ধরে তিনি বাবা, মা আর ভাই-বোনদের ফোন করেননি। তিনি আরো খেয়াল করলেন যে, তোরাব আলী সিকদারের কর্মস্থলের সবচে কাছের বন্ধু জনাব শেখ মাসুদুল হাসানকে গত সতেরো দিন ধরে ফোন করেননি। তিনি খেয়াল করলেন যে- গত আড়াই বছর ধরে শত শত ইমেইলের উত্তর দিয়েছেন খুব যত্নে, শত শত ঘন্টার স্কাইপে কলে সংযোগ থেকেছিলেন চরম ধৈর্য নিয়ে, শত শত ঘন্টার অফিসের ফোন কলে সংযুক্ত ছিলেন কোনরূপ বিরক্তি প্রকাশ না করেই। তিনি আরো দেখলেন যে- তিনি অফিসের কাজে শত শত মাইল বাসে, ট্রেনে, অটোরিক্সা-ভ্যানে ছুটেছেন কোনরূপ বিরক্তি প্রকাশ না করেই। তিনি আরো দেখলেন যে- তিনি অফিসের কাজ করতে গিয়ে একদিন জনসম্মুখে কোন এক উপজেলা চেয়ারম্যানের থাপ্পড় গালে মেখেছিলেন- এতোটা সজোরে যে, তিনি মনে করতে পারেননি- এভাবে তার বাবা তাকে কোনদিন অথবা আদৌ মেরেছিলেন কী না।
তিনি খেয়াল করলেন যে- তিনি গত আড়াই বছরে খুব কম দিনই সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবার ঠিকমত খেয়েছেন। তিনি মনে করতে পারলেন না, গত আড়াই বছরে কোন সূর্যাস্ত দ্যাখেছেন কী না? তিনি মনে করতে পারলেন না, সর্বশেষ কবে বিকেলের সূর্যের ঠিকরে পড়া আলো তার চোখ-মুখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। তিনি মনে করতে পারলেন না, সবুজ পাতার রঙ কেমন। আমের মুকুল দেখতে কেমন। শরতের বিকেলগুলো দ্যাখতে কেমন। তিনি ভুলে গেছেন ভোরের উজ্জ্বল আলো দ্যাখতে কেমন। তিনি শুধু একটা ল্যাপটপের স্ক্রীণে নিজেকে দ্যাখতে পান আর একটা মোটরবাইকের চেহারা মনে রাখতে পেরেছেন। তিনি মনে করতে পারলেন না- কতবার মা, বাবা, বন্ধুদের ফোন কল ব্যস্ততার কারণে ক্যান্সেল করে ফিরতি কল করেছিলেন। তিনি মনে করতে পারলেন না, বাজারের থলেতে কখনো ভালোবাসা ছিল কী না? তিনি শুধু মনে করতে পারলেন- তিনি এখন ডাইনিং টেবিলের অ্যাটিকেট রপ্ত করতে অনুশীলন করছেন। তিনি অনুশীলন করছেন- খাবার দিকে না ঝুঁকে, খাবারকে কীভাবে নিজেদের দিকে ঝুঁকানো যায়। প্রকল্পের উপকারভোগীদের সাথে কাস্টমার কেয়ারের ভাষায় কথা বলা রপ্ত করছেন। তিনি মনে করতে পারলেন না, নেতারা এখন কোন ভাষায় কথা বলেন। তিনি ভুলে গেছেন- নিজের ভাষাও। তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন- নয়টা-পাঁচটার পরের পৃথিবীতে দ্যাখতে কেমন।

হঠাৎ তার চিন্তায় ছেঁদ পড়ল। তিনি দ্যাখতে পেলেন মস্তিষ্কের সমস্ত তারগুলো ঠাস ঠাস করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। তিনি স্পষ্ট দ্যাখলেন বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে- তোরাব আলী সিকদারের সহকর্মী কাম বন্ধু জনাব স্টিফেন হেমব্রম তিন তারকা হোটেলের পাঁচশ বিশ নম্বর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এবং ভয়ঙ্কর চীৎকার করছেন। বিকট চীৎকারে গোটা তিন তারকা হোটেলটি খসে পড়ছিল, আর রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছিল আর অদ্ভূত স্বরে বলছিল- বন্ধু! তোমার মাথা কোথায়? বন্ধু! তোমার ধড়ে মাথা নেই কেন? তোমার মাথা কোথায়? তোরাব আলী সিকদার তার হাত দুটি মাথার দিকে তুলছিলেন। তিনি হাতের অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলেন না।

ফটো ক্রেডিটঃ DownTown Pictures
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:১৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×