
ইশ” এই শব্দটি এখন খুব মিস করি। এই আফসোস জনিত “ইশ” শব্দটি একটা সময় বাংলাদেশ দল যখন মোটামুটি খেলতে শুরু করলো বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবে পা রেখেছে তখন অনেক বেশী করে উচ্চারিত হতো আমাদের মুখে মুখে। ইশ যদি আজকে আশ্রাফুল আর ২০টা রান বেশী করতো? ইশ আজকে যদি পাইলট এমন অস্থির হয়ে আউট না হয়ে যেত তবে আরো ৩০টা রান বেশী হত। ইশ আমরা যদি আজকে টসে জিততাম? ইশ দলীয় রান যদি আর ৫০টা বেশী হত। ইশ শান্ত যদি আর দুইটা ওভার বেশী করতে পারতো। এমন হাজারটা ইস ছিল আমাদের মুখে মুখে। রাগে ক্ষোভে কত কত বার হাত কামড়েছি, টেবিলে চাপড় মারতে গিয়ে টেবিলই ভেঙ্গে ফেলেছি। আমরা দল বেঁধে খেলা দেখতে যেতাম আমাদের পাড়ার সবচেয়ে প্রিয় স্যারের বাসায় উনি খুব ভালো ক্রিকেট বুঝতেন, মজার মজার অভিজ্ঞতা শোনাতেন, গল্প বলতেন। আর স্যারের সহধর্মিণীর হাতে মাখা মুড়ি, চা, টোষ্ট বিস্কুট সব মিলিয়ে একটা মিনি স্টেডিয়ামের আমেজ তৈরি হতো। আর শুরু হতো তর্ক, কেউ কিছু বুঝুক না বুঝুক একটা মন্তব্য করতেই হবে। সেই সময় খেলা দেখার সময় আমাদের মাথা চাপড়ানো, হতাশ হওয়া, আফসোস করা এসবই ছিল নিত্য দিনের ব্যপার।

আজকের এইদিনে এসে বুঝি সেই হাজারটা ইশ ছিল বলেই বাংলাদেশ আজ এক বাঘের ডেরায় পরিনত হয়েছে। এই ইশ শব্দটা ছিল বলেই আজ এই ছেলেগুলো জান প্রাণ উজাড় করে খেলছে। ইশ শব্দটার মর্ম বুঝতে পেরেছে বলেই আজ আমাদের একজন সাকিব আল হাসান আছেন, আছেন মুস্তাফিজ, মিরাজ আর তামিমের মত এক একটা হিংস্র বাঘ। আর গর্ব করে বলতে পারি আমাদের একজন কাপ্তান আছেন যিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। কি আবগে, কি ভালোবাসায় ১১টা ছেলেকে এক অমোঘ সুতোয় বেঁধে নিয়ে শক্ত লড়াই করে প্রতিনিয়ত ছিড়ে খুড়ে দিচ্ছে বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তিদের। শত যন্ত্রনা নিয়েও যিনি খেলে যাচ্ছেন অবিরাম। বার কয়েক হাটুর অস্রপাচার ছিটকে দিয়েছে যাকে সে ফিরে এসেছে আর এসেছে একেবারে বাঘের শক্তি নিয়ে, ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে। এই কাপ্তান সেই কাপ্তান যে ভুলে যায়না তাঁদের এক একটি বিজয় এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে উৎসর্গ করতে। সে এমনই কাপ্তান যে ১৫কোটি বাঙ্গালীর একমাত্র আশা ভরসার কর্ণধার হয়ে উঠেছেন।
আজকে আপনাকে আমাকে যদি বলা হয় বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান কে? মুহূর্তের মধ্যে আপনাকে বসতে হবে হিসেব কষতে কে কার চেয়ে ভালো, কাকে এগিয়ে রাখা যায় কোন দিক দিয়ে। আর ঐ যে যখন ইশ শব্দটা আওড়াতাম তখন কি এমন কষ্ট হতো? এখন ভালো ক্রিকেটারের তালিকা করতে গেলে সত্যিই দ্বিধায় পরতে হবে ক্রমিক নম্বর সাজাতে গিয়ে। রোজকার খেলায় একজন আরেক জনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

অনেক আগে একটা সময় ছিল যখন ক্রিকইনফো তে গিয়ে খুঁজতে হতো বাংলাদেশের খেলোয়ারদের রান সংখ্যা কত? কত উইকেট আছে বোলারদের? কিন্তু সেই ক্রিকইনফোতে আজ যত ধরনের তথ্য আছে তার প্রায় প্রত্যেক ধরনের তথ্যের উপড়ের সারিতে চোখে বুলালেই সৌম্য, তামিম, নাসির, আর পুচকে মুস্তাফিজের নামও বড় বড় করে লেখা, আর সাকিব, মুসফিক, মাহমুদুল্লাহ, ম্যাশ আর মমিনুলের ছবিতো ভুড়ে ভুড়ে। এইতো সেদিনকার পুচকে ছেলে মিরাজ খেলতে এসেই দখল করে নিল রেকর্ডের খাতা। আরো আসছে দলে দলে দখল করতে ক্রিকেট বিশ্ব।
আমার মনে আছে সেই সময়টাতে আমি নিজেও ফেইসবুকে, বিভিন্ন জায়গায় লেখার খোঁচায়, বচনে অঙ্গভঙ্গিতে বাংলাদেশ দলকে অনেকবার জর্জরিত করেছি, খাটো করেছি। অনেকবার মুখ ফুটে গালিও বের হয়েছে, ধিক্কার দিয়েছি শতবার একসময় ধরেই নিয়েছিলাম এদের দিয়ে কিছুই হবেনা। হাজারটা রাগ, ক্ষোভ জমেছিল এদের জন্য। আজ এরজন্য কিন্তু আমার এক বিন্দুও অনুশোচনা নেই, নেই কোন খারাপ লাগা, বা লজ্জা কারন আমার মত হাজার হাজার খোঁচা, হাজারটা গালি, ধিক্কার, রাগ, ক্ষোভ অভিমান ঝড়ে পরেছিল বলেই আজ ওরা জ্বলে উঠতে পেরেছে, পেরেছে সেরাদের সেরা হতে আর হতে পেরেছে এক একটা বাঘ।

এতো কিছুর পর তাঁদেরকে ভুলে যেতে পারবেন? যারা এদের পূর্বসূরি ছিল, আজকের বাঘা বাঘা খেলোয়ারদের হাতেখড়ি হয়েছিল যাদের হাতে, তাঁদের কি ভুলে গেলে চলবে? যাদেরকে আমরা গালি দিতাম, ক্ষোভ ঝারতাম তাঁদেরকে ভুলে গেলে চলবে? আকরাম, নান্নু, রফিক, আতাহার, মনি এক একজন বীর আমার চোখে। আজকের মত এতো সুযোগ সুবিধা ছাড়াই এরা দিনের পর দিন খেলে গেছে। নিজেদের পানি নিজেরা টেনে নিয়ে খেয়েছে। আজকের মত প্রতি খেলায় এতো জার্সি পায়নি, ধুয়ে ধুয়ে বারবার পরতে হয়েছে, এর ওর গ্লাভস,প্যাড, ব্যাট নিয়ে খেলতে হয়েছে। সেই সময়টা ছিল বলেই আজ এই সময়ে আমরা এতো গর্ব করতে পারি আমাদের নতুন বীরদের নিয়ে।
আমাদের দেশে বাবা-মাদের উচিত সন্তানদের আরো বেশি করে ক্রিকেটের প্রতি উৎসাহ দেয়া। সরাকারের উচিত বেশি করে ক্রিকেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। ক্রিকেটের অবকাঠামো তৈরি করে দেয়া। স্কুল কলেজগুলোতে বেশি বেশি ক্রিকেটের চর্চা, প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পারে দেশে প্রতিবছর পেসার হান্ট, ব্যাটসম্যান হান্ট, ক্রিকেটার হান্ট আয়োজনে সহায়তা করতে।
গালি দিয়েছিলাম ঠিকই, এখনো যে রাগ করিনা তাও না, অভিমানও হয় তামিম সাকিবরা একদিন খারাপ খেললে। মেনে নিতে পারিনা। আর ওরা খারাপ খেললে আমরা যারা খেলা দেখি বা তাঁদের অন্ধভক্ত আমাদের রাগ বা ক্ষোভ হবেই কারন নয়নের মনি বাচ্চারা খারাপ করলে বাবা মা যেমন কষ্ট পায় আর রাগ হয় তেমনটি ওরাও তো আমাদের নয়ন মনিই। রাগ যেমন হয় ক্ষোভও হয় ঠিকই কিন্তু যখন ওরা জয় নিয়ে আসে আমাদের জন্য তখন আমাদের মনের অজান্তেই অন্তর থেকে এই বাঘদের জন্য আশীর্বাদ ঝরে পড়ে। ভালোবাসায় আচ্ছন্ন করে ফেলি মুহূর্তে, চোখের কোনে এক ফোঁটা জলও জমে হয়ত। তবে তা অবশ্যই আনন্দের সাথে আশীর্বাদ মিশ্রিত। সামনের দিন গুলোতে আমাদের এই ক্ষোভ, ভালোবাসা, আশীর্বাদ আরো বেড়ে যাবে তাই বাঘগুলোকেও সেটা মনে রাখতে হবে, যে কোটি কোটি ভক্ত তাকিয়ে তাঁদের দিকে। তাকিয়ে আছে ঐ গোল একটা বৃত্তে।
চলো বাংলাদেশ, বিশ্ব জয়ে সামনে এগিয়ে চলো।
ছবিঃ সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




