দু'টো বর্ষা পার হয়ে গেছে, কিন্তু এই শহরটার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখিনি; শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত থেকেছি।এই বর্ষার শুরু থেকেই কেন জানি বৃষ্টি দেখতে দেখে এই শহরটার দিকে চোখ পড়ল, দেখলাম এই রূপসী নগরী আমার মতন ক্লান্ত মানুষের ক্লান্তির বোঝা বয়ে বয়ে প্রতিদিন আহত হচ্ছে। তবু তার যে জৌলুস দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে আমি এর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। তার প্রতি গলিতে, প্রতি রাজপথে হাঁটতে গিয়ে আমার যত ভোগান্তি, সব কিছুতে আমি এই সুন্দরীর কষ্ট টের পাই। আহারে, সহস্র বছর ধরে তার আনাচে কানাচে না জানি কত দুঃখ লুকিয়ে আছে! বর্ষায় তাকে দেখে মনে হয় সেই দুঃখের কিছুটা উপচে পড়ছে, আর তার পথে হাঁটতে গিয়ে তার কান্না দেখে আমি কষ্ট পাই।
আসলে খুব ভাল ছাত্র আমি কখনই ছিলাম না, শুধু জেদের জোরে এই দেশখ্যাত ভাল ছাত্রদের দলে এসে ভিড়েছি, ভাল হল না মন্দ হল জানিনা, কিন্তু এই স্থাপত্য বিভাগটায় না আসলে হয়তবা আমি টিকতেই পারতাম না। এই বিষয়টা আমাকে আর কিছু না হোক এই নগরীকে দেখতে শিখিয়েছে, আমি এই নগরীর জালে এর জন্যেই আটকে গেছি। এর প্রতি ভাঁজে আমি সুন্দরের চিহ্ন দেখতে পাই। আরে এ দেখি আমার আর এই শহরের প্রেম উপাক্ষ্যান হয়ে যাচ্ছে! হুম, আমি সত্যিই এর প্রেমে পড়েছি। এইতো, সেদিন খুব ভোরে বেরুলাম মতিঝিল আসব বলে, আর হেঁটেই চলে এলাম, সেদিন প্রথম দেখলাম যে এই শহরের মানুষের ভীড়ে আসলে শহরটাকেই দেখা হয় না, দেখলাম সে কত সুন্দর! অন্যরা হয়ত বলবে , "আরে , বল কি? এখানে আর সুন্দরের কি দেখলে?" কিন্তু আমি দেখলাম, হয়ত স্থাপত্যের ছাত্র বলেই দেখলাম, জানি আমি এর প্রথম প্রেমিক নই, তবে এটাও জানি এর সব প্রেমিক ই স্থাপত্যের ছাত্র ছিল না। আর কি জানি, আমার চোখেই কেন জানি এর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো মানুষ আর মানুষের গল্প চোখে পড়ে, আর চোখে পড়ে তার সাথে এই শহরের গল্প। আমি মাঝে মাঝে এর হাসি দেখতে পাই, মাঝে মাঝে এর কষ্ট স্পর্শ করতে পারি, চেয়ে দেখি তার খোলা চুলে জীবনের স্বপ্ন মেলে দিয়ে লাখ লাখ মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমায়, প্রেয়সীর হাতে হাত রেখে ফিসফিস করে কথা বলে। হায়তবা আমার হাতটা রাখার জন্যে আশেপাশে কারো হাত নেই তাই আমি এই শহরের একাকীত্ব দেখতে পেয়েছি, কিন্তু সবাই কি আর দেখতে পায়?সব চোখই পূর্ণিমা দেখে, কে বুঝতে পারে যে চাঁদ আসলে প্রেয়সী না, সে প্রেয়সীর কপালের টিপ মাত্র, অন্তত আমার প্রেয়সীর তো বটেই, দুঃখ একটাই আমি তার সব দুঃখ মুছে দিতে পারি না।
শহরের গল্পগুলো কি খালি আমার ই চোখে পড়ে কিনা , জানিনা, মানুষ হিসেবে মানুষের সাথে আমার যেটুকু কথাবার্তা হওয়ার কথা ছিল, কেন জানি আমি কখনো তার ধারে কাছেও যেতে পারিনি, কত কিছু নিয়ে যে কারো সাথে কথা বলা হয় নি! অনেক কিছুই ছিল, কাওকে পেলে তার সাথে কথা বলতাম, এর মধ্যে শহরের এই রহস্য গল্প একটা। কত গলিতে কত গল্প!শত শত হাসি কান্নার গল্প পথে পথে ঘুরে বেরায়, কারো জন্ম এখানেই, এই পথগুলোতেই, আবার কারো জন্ম বহুদূরে, হয়ত সাত সমুদ্র তের নদীও পার হয়ে আসে কোন গল্প, তাও এইসব পথে এইসব গল্প, গল্পের আর শেষ হয়না, এক গল্পের চক্করে আরেক গল্প এসে পড়ে। কখনো এমন হয় যে আমি কিছু গল্প বলি, আর সেই বিবৃতি কা্রো হৃদপিন্ডের সব ঊষ্ণতা কেড়ে নেয়, ... অনেক ঊষ্ণতার গল্প, অনেক ঊষ্ণতার অভাবের গল্প নিয়ে এই শহর বেঁচে থাকে , তাই দেখে আমিও থাকি, কিন্তু তাও মনে হয় আমার হৃদপিন্ডের ঊষ্ণতার দায়িত্ব কাওকে দিতে পারলে বোধহয় স্বস্তি পেতাম...। বোধ হয় এই শহরের মত কষ্ট পেতে হত না, হয়ত আমি এতটা ভালোইবাস্তে পারিনা, এই শহরের মত...
এই শহরের কিছু কিছু রাস্তায় যদি আরো গল্প থাকে, এই আশায় ঘুরে বেড়াই... আমার অনেক পছন্দের একটা ফুল নিম ফুল, কিন্তু আফসোস একটাই একে সম্পূর্ণ অবস্থায় হাতে নেয়া যায় না, তার আগেই টুকরো হয়ে ঝরে যায়, আমি এই শহরে নিম ফুলের মত গল্প খুঁজি, আর রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি, হয়তএকদিন একটা নিম গাছের নিচে একটা গোটা নিম ফুল খুঁজে পাবো।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




