ডেথ সেনটেন্স
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আমাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। জোর করে না, স্বেচ্ছামৃত্যু।
একটা সুন্দর সময়ে মরতে পারার প্রতীক্ষা করছি এখন। আমার পছন্দ ঘুটঘুটে কালো ভূতুরে রাত। এত বড় একটা কাজ করতে যাচ্ছি অথচ অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকে সহায়তা পাবো না সেটা ভেবে খারাপ লাগছে। কোন কাজ করার আগে কাছের বন্ধুদের কাছ থেকে হেল্প নেয়াটা সামাজিক নিয়মের মধ্যেই পরে। আপাতত কোন বন্ধুকেই এই ছোট আপাত দৃষ্টিতে অর্থহীন কাজের জন্য বিরক্ত করতে চাচ্ছি না।
দেখা গেল কাউকে বললাম আর সে বিরক্ত হলো।
-আজব তো এই একটা কাজ কেমনে করবি সেটা আস্ক করার কি আছে? কয়েকটা ঘুমের বড়ি কিনবি। পানি দিয়ে কোত্ করে গিলে শুয়ে থাকবি। খালাস।
এই ধরনের জবাব শুনে কিছুটা হলেও লজ্জিত হওয়া উচিত। ঠিকই তো এই ছোট্ট বুদ্ধিটা মাথায় আসলো না কেন?
আমি আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সাবধানের মার নেই। কয়েকটা ট্যাবলেট বেশী নিয়ে আসতে হবে পরে দেখা গেল ডোজ কম হয়ে গেসে কিন্তু মরতে পারতেসি না। থাক এইবার শুয়ে বসে। একটা কাজও ঠিকমত করতে পারলি না। মরার মত ছোট একটা কাজ করতে গিয়েও ফেইল। লজ্জায় মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।
এখন সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকি। মৃত্যুবিষয়ক চিন্তাভাবনা করি। গতকালকে দেখলাম পৌরসভার গাড়ি টহল দিচ্ছে। কুকুর নিধন কমিটির গাড়ি। গাড়ির দরজা খোলা একটার পর একটা চতুষ্পদ প্রাণী এসে উঠে পড়ছে গাড়িতে।
এদেরকে নাকি বিষ প্রয়োগ করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আমি কখনো দেখি নাই। শুনেছি একটা বড় সিরিন্জে এক ধরনের স্বচ্ছ তরল পদার্থ ঢুকিয়ে পুশ করা হয়। তিন সেকেন্ডে মৃত্যুদেবতা এসে হাজির।
কি পাষন্ড লোকজনগুলা। এইভাবে মৃত্যুতে কোন অনুভূতি আছে। মৃত্যুর মত একটা কাজ একটু ভালো করে উপভোগই যদি না করা গেল তাহলে কিভাবে হলো। কাজ করার আনন্দ থাকা উচিত।
এসব ক্ষুদ্র প্রাণী নিয়ে অযথা চিন্তা করে সময় নষ্টের কোন মানে হয় না। আমি নিজের কাজ নিয়ে ভাবতে বসা উচিত। উপভোগ্য মৃত্যুর ব্যবস্থা না করা গেলে শান্তি পাচ্ছি না।
আমার ব্যক্তিগত পছন্দ রোলারে পিষ্ট হয়ে মরা। একটা রোলার আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার গড়িয়ে গেলেই হবে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য এই প্রসেসটা কয়েকবার করা যেতে পারে।
এই বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল টম এন্ড জেরী দেখে। টমের উপর দিয়ে ভারী কিছু একটা চলে যায় আর সে ছবি হয়ে পিচঢালা রাস্তায় লেগে থাকে।
এই দৃশ্য দেখে হাসি আটকে রাখতে পারে এমন লোক খুব কম আছে। তাহলে নিশ্চয় এই মৃত্যুটা অনেক উপভোগ্য হবে।
উহু মনে হয় না। দিনে দুপুরে মরে গিয়ে হাস্যকর বস্তুতে পরিনত হবার কোন ইচ্ছা নাই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার নিজে আনন্দ পেতে হবে। লোক হাসানো মৃত্যুতে কোন আনন্দ নেই।
নাকি ফাস লাগিয়ে মরে যাবো? নাহ একেবারে ট্রাডিশনাল হয়ে যায় ব্যাপারটা। আমাদের পাশের বিল্ডিংয়েই একটা মেয়ে মারা গিয়েছিল এইভাবে। ফ্যানের সাথে ঝুলে ঝুলে মৃত্যু। থার্ডক্লাস আইডিয়া। কেউ একজন ছবি তুলে নিয়ে এসেছিল। আমি অনেকবার খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছি ছবিটা। তেমন ইনোভেটিভ কিছু পেলাম না। এবং হতাশ হলাম।
আচ্ছা একদম ভিন্নরকম একটা পরিবেশে গিয়ে মারা গেলে কেমন হয়। অবশ্য ভিন্ন পরিবেশটা যে কি সেটা বুঝতে পারছি না।
পানিতে ডুব মরব?
দারুন আইডিয়া। সবসময়তো বাতাসের মধ্যে থাকি তাহলে পানিতে ডুবে মরাটা ইনোভেটিভ বলা যায়।
রাষ্ট্র সচেতন এক বন্ধুর সাথে এবিষয়ে আলোচনা করলাম এবং তাকে আমার এই চমকপ্রচ আইডিয়া সম্পর্কে অবহিত করলাম।
সে আমাকে পুরোপুরি হতাশ করে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যান দেখাতে লাগলো। ফি বছর কি পরিমান লোক পানিতে ডুবে অক্কা পায় এবং মৃত্যুপরবর্তী হাস্যরস সম্পর্কেও জানাতে ভুললো না। আমি বিষ্ফোরিত কিছুটা আহত চোখে তাকালাম। মৃত্যুর মত বিষয়ে হাস্যরস খুজে পেলি কি করে?
পানিতে ডুবে মৃতদের দল অনেক ভারী এবং পানিতে ডুবে মারা গিয়ে থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে আমার পরিবারকে ছাগল প্রদানের মত ঘটনার আশংকাকে সে উড়িয়ে দিতে পারল না।
কি বিতিকিচ্ছরী অবস্থা। আমি মারা গিয়েছি অথচ আমার ঘরে একটা ছাগল হেটে বেড়াচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত মরতে পারব কি না সেটাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আসলে বোকারমত সচেতন লোকদেরকে জিজ্ঞেস করাটা আমার উচিত হয় নাই।
কোন কবি বন্ধুকে ব্যাপারটা বলা উচিত ছিল। কাব্যলেখকরা ভয়ংকর ইনোভেটিভ হয়। অন্তত সুন্দর একটা মৃত্যুপরিবেশের ধারণা আমাকে দিতে পারবে।
-পানিতে ডুবে মারা যাওয়া যায়?
তার চোখ চিকচিক করে উঠলো। মনে হচ্ছে ঠিক এই প্রশ্নটা শুনতেই সে তৈরী হয়ে ছিল। আমি একটু আশ্বস্ত হলাম। সে খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে বুঝাতে লাগলো।
বড় একটা ঝিলের মত জায়গা। জলজ উদ্ভিদের আধিক্য তেমন একটা নেই। তবে প্রচুর শাপলা ফুল দেখা যাচ্ছে। চাদের অবস্থা খুব একটা সুবিধার না সেদিন। একটু বেগতিক।
প্রচুর জ্বলজল করতে হচ্ছে। এতবেশি উজ্জল চাদের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। তবে আশার কথা এই যে অল্প অল্প মেঘ আছে সেজন্যই তাকিয়ে থাকতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না।
জোনাক পোকা থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। থাকলে ক্যাটালিস্টের কাজ করবে।
তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, মরতে যাচ্ছি নাকি হানিমুনে গেসি?
এই ধরনের প্রশ্ন শুনবে এমন ধারণা তার ছিল না।
ধুর গাজাখোর কাব্যলেখককে জিজ্ঞেস করাটাই উচিত হয় নাই। তারচেয়ে বরং ঘুমিয়ে থাকাটাই ভালো ছিল। অনেকদিন জোর করেও ঘুমাতে পারছি না। ঘুমাতে হবে ভাবলেই গা জালা করতে থাকে। অনিদ্রা রোগ আছে নাকি আবার কে জানে।
থাকুক অনিদ্রা। এখন মৃত্যুচিন্তাটাই মুখ্য।
বেশ কয়েকদিন সময় নষ্ট হয়েছে। কতদিন জানি না। অবশ্য গুনে দেখা যায়। প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গে আমার। এইসময় আকাশ থাকে পুরোপুরি নীল।
একটা অদ্ভূত ব্যাপার খেয়াল করলাম কয়েকদিনে।
একেবারে ভোরে কোন পাখি ডাকে না। তারা কি এই সময় ঘুমায় নাকি কোন কারণে ভয় পেয়ে ডাকাডাকি বন্ধ করে রাখে কে জানে। পাখিরা আরো একটু পরে ডাকতে শুরু করে।
আমি তরল মনে এইসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করি।
কে যেন বলেছিল সকাল বেলার হাওয়া নাকি বেহেশতী হাওয়া। এই সময় মুখ হা করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়ার নিয়ম। এভাবে শ্বাস নিলে মন তরল হয়।
আমি অবশ্য জোরে জোরে নিশ্বাস নেই না।
বেহেশতী হাওয়া গায়ে লাগলেই আমার মন তরল হয়ে যায়।
তরল মনে ব্লেড দিয়ে আঁকাউকি করি। আঁকিবুকি করার জন্য প্রিয় ক্যানভাস হল হাত।
লাল রংটা দেখতে সুন্দর। বিশেষ করে রক্তের রং। আমি ছোট ছোট আচর দেই হাতে। দিয়ে হিসাব রাখি কতদিন হল।
আজকে নিয়ে সপ্তম দিন।
আর কারো কাছ থেকে মৃত্যুবিষয়ক উপদেশ বা সাজেশন নিতে ভালো লাগছে না।
পরিশেষ
এতক্ষণ ধরে রেলস্টেশনে বসে আছি। একা একটা মেয়ের এভাবে বসে থাকাটা অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না হয়তো। এসব এতক্ষণ পাত্তা দেই নাই।
গত সাতদিনের স্মৃতি জাবর কাটতে কাটতেই সময় কেটে যাচ্ছালো।
ট্রেন লেট। অনেক লেট হবে আজকে। এতক্ষণে চলে আসার কথা ছিল।
ঐতো আসছে বোধহয়। লোকজনের মধ্যেও একটু তাড়াহুড়া লক্ষ্য করলাম। আমি প্লাটফর্মের একেবারে ধারে গিয়ে দাড়ালাম।
সামনে আসা মাত্রই লাফিয়ে পড়ব।
কিন্তু এত কোলাহলের মধ্যে কাজটা করা কি ঠিক হবে?
প্লাটফর্মের উল্টা পাশে দাড়িয়ে আছে কবিবন্ধু, ডুবে যাওয়া মৃতদের পরিসংখ্যান দেখানো সেই প্রতিবাদী বন্ধু। যাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম ঘুমের ঔষধ এনে দিতে, সেও এসে দাড়ালো।
আমারই প্রতিরুপ। আমার মৃত্যুর সাথে সাথেই তাদের অস্তিত্ব লীন হয়ে যাবে।
ট্রেনটা একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে!!!
উৎসর্গ:
চার বছরের একটা পিচ্চি মেয়ে। বড় বড় চুল নিয়ে সারা ঘরে দৌড়ে বেড়ায়। নীল রংয়ের দুইটা ক্লিপ থাকার কথা তার চুলে। দুষ্টামী করতে করতে একটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। সে এখন ক্লিপটা খুজে বেড়াচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না। খুজে না পেয়ে মেয়েটার চোখে রাজ্যের হতাশা!!!
৬১টি মন্তব্য ৬০টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।
ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক
বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )
যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন
কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন
একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।
এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।
ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন