সুইডেনে এসেছি ৭ মাস হলো। প্রথম প্রথম এসেই কর্ম তালাশের তাড়াহুড়ো ছিলনা। কারণ পিতৃপ্রদত্ত কিছু ডলার তখনো পকেটে কচকচ করছিল। তাই প্রথম লক্ষ্য ছিল ঘুরাঘুরি সেই সাথে রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় একটা সুপ্ত জিজ্ঞাসাও মনে খোঁচাচ্ছিল -আমাকে জানতে হবে কেন পশ্চিমারা সভ্য(!) আর আমাদের বলা হয় অসভ্য(পশ্চিমাদের ভাষায়)।প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শেষ করেই বের হলাম শহর দেখতে আর আমার প্রশ্নের উত্তর ও খুঁজে পেতে শুরু করলাম।পরিচ্ছন্ন আর পরিকল্পিত শহরে প্রথমেই অবাক হলাম সবার ট্রাফিক আইন মেনে চলা দেখে। এখানে চোখবুজে আপনি জেব্রাক্রসিং পারহতে পারবেন(এখানে ট্রাফিক সিগনালও আছে আবার সিগনাল বাতি ছাড়া শুধু জেব্রাক্রসিং ও আছে আমি ২য় টির কথা বলছি কারণ সিগনাল বাতিতে ত সবাই সেটাই মেনে চলে)। কারণ আপনি ক্রসিং এ পা দেয়া মাত্রই দুইপাশের গাড়িগুলো থমকে দাঁড়াবে যতক্ষণ না আপনি রাস্তা পার হচ্ছেন।মনে হলো এই জন্যই বোধহয় এরা সভ্য। পরে মনে হলো না এটা সভ্য অসভ্যের মাপকাঠি হতে পারেনা।কারণ আমার দেশে মানুষ পার হওয়ার জন্য গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে
সারাদিনে একটি গাড়িও ঐ ক্রসিং পার হতে পারবেনা, কারনটা আপনাদের জানা(জনসংখ্যা বিষ্ফোরন)।এভাবে প্রতিদিনই সভ্য-অসভ্যের একটি একটি কারণ চোখেপড়ে আবার মনেহয় এটা বোধহয় পরিপূর্ণ কারন নয়। অবশেষে আমি একটি কারন খুঁজে পেলাম গত ৮ই ,১৩ই ফেব্রুয়ারী। আর কারণটি খুঁজতে আমাকে সহায়তা করল আমারই রুমমেট ডঃ জর্জিয়াস জেফরি।একজন পশ্চিমা ডাক্তার। তার আগে আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে বলছি-আমি এখানে যে ফ্ল্যটে ভাড়া থাকি সেখানে আমার সুইডিশ বাড়িওয়ালা লেফ পারসন ছাড়াও আমি,ডাঃ জর্জি (হাঙ্গেরিয়ান) এবং জার্মানীর ম্যাথিয়াস থাকি। আমরা প্রতিদিন একসাথে ডিনার সেরে গল্পে মেতে উঠি।সেই গল্পে রাজনীতি,অর্থনীতি,ধর্ম,ইতিহাস,চিকিৎসা সবই থাকে। থাকে তুমুল তর্কবিতর্ক ও যুক্তি এবং যুক্তিখন্ডনের পালা। ওরা তিনজনই ইউরোপিয়ান হওয়াতে আমাকে একই সাথে এশিয়া, বাংলাদেশ এবং ইসলাম এর প্রতিনিধিত্ত করতে হয় আলোচনার টেবিলে। তাই ডাঃ জর্জি আমাকে মাঝেমাঝে সহায়তা করে,আর সেজন্য সে প্রায়শই বাংলাদেশ সম্পর্কে অনলাইনে পড়ে এবং কিছু সংবাদপত্রও (ইংরেজি) পড়ে। প্রতিদিনের মত সেদিনও আমরা ভূড়িভোজ সেরে কিছু হালকা আলাপ করছিলাম,হঠাৎ জর্জি আমাকে যে প্রশ্নগুলো করল তাতে আমার মনে হল আমি সভ্য-অসভ্যর কারন খুজে পেয়েছি। আমি জর্জির করা প্রশ্ন গুলো বলছি -
১. তোমাদের দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাঙ্গন এ একজন ছাত্রকে অন্যছাত্ররা
মেরে ফেলল কেন? (এর কয়েকদিন আগে আমি ওদেরকে ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রদের গৌরবজ্জল ইতিহাস বলেছিলাম। )
২. আর সরকার এর বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ না নিয়ে তোমাদের একজন মন্ত্রী এটাকে স্বাভাবিক,বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলল কেন?
৩. তোমাদের দেশের সরকার কি ছাত্রদের নিরাপত্তা দেয়না আর যারা মারল তারা তো সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের বলে সংবাদপত্রে লিখলো তাহলে সরকার এদেরকে এরেষ্ট করছেনা কেন?
সম্মানিত পাঠক পাঠিকারা আপনারা বলতে পারেন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর?
আমার কাছে এর একটিই উত্তর আর তা হলো "আমরা অসভ্য"।
এর ঠিক কয়েকদিন পর আবারও আমাকে জর্জির প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো সেগুলো ছিল আরও কঠিন- ১৩ ই ফেব্রুয়ারী-
১. তোমার দেশে আরো ৩ জন ছাত্রকে মেরে ফেললো কেনো?
২. তোমার দেশের একটি সঙ্গঠনের ছাত্রদেরকে সারাদেশ থেকে এরেষ্ট করছে কেন? এটা কি নিষিদ্ধ সঙ্গঠন?এই সঙ্গঠনের সারা দেশের সব ছাত্ররাই কি খারাপ?
আলোচনার এক পর্যায়ে সে বললো
৩. তোমার কথা শুনে বুঝাগেলো ২ টা সঙ্গঠনেই সন্ত্রাসী রয়েছে তাহলে সরকার ১ টির বিরুদ্ধে এ্যকশন নিল অন্যটির বিরূদ্ধে নিচ্ছেনা কেনো? আর যে সঙ্গঠনটির বিরুদ্ধে এ্যকশন নিচ্ছে সেটা যেহেতু নিষিদ্ধ নয় তাদের নেতাকর্মীদেরকে গণগ্রেপ্তার করছে কেনো?
৪. তাহলে কি সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করছেনা? মানোবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না?
এখানেও আমার উত্তর একটাই- আমরা অসভ্য
কিন্তু আমি আমার এই উত্তর জর্জিকে দিতে পারিনি- লজ্জায়।
আপনি হলে কি উত্তর দিতেন?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




