somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিপ্পি আরসুয়াং ৪র্থ পর্বঃ আরসুয়াং সামিট।

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিপ্পির প্রথম শিঙ শেষ, এখন আরসুয়াং (সবচে উচু চুড়ার পথে)

রনীন পাড়ায় পৌছে দুপুরে আমরা রান্না চড়ালাম। যে বাসাটায় আছি বাসার পুরুষেরা উঠানে বসে সিগারেট ফোঁকা আর গাল গল্প করা ছাড়া আর কিছু করে মনে হলো না। সব কাজকর্ম মহিলারাই করে। সমস্যা হলো মহিলারা বাংলা বলতে পারে না। দিদি (বাড়ির কর্তৃ) শুধু দুটো বাংলা শব্দ জানে যার ১টা হলো ‘ডেকচি’ আরেকটা ‘আমি বাংলা জানি না’। দিদির ননদ মেয়েটা আরো কিছুই বুঝে না। তাই রান্নার সময় সহায়তা পাওয়া কষ্ট। দিদি অবশ্য ইশারা ইঙ্গিতে কমিউনিকেশন করে খিচুরী রান্নায় যোগ দিলেন। খিছুরী আর মিষ্টি কুমড়া।

সন্ধ্যায় আরাম বম কয়েকজন লোক ঠিক করলেন আমাদের জন্যে। সিপ্পি একটা টেবল মাউন্টেন্ট। শয়তানের শিং দুটো প্রচন্ড ঘন কিন্তু মাথাটা আরো বেশী ঘন। জঙ্গল কেটে কেটে পথ করে নিতে হবে। এরা আমাদের কাটার কাম গাইড। বছর খানেক আগেও সিপ্পি এত ঘন জঙ্গল ছিল না। ২০০২ এ নাকি রনীন পাড়ার লোকজন চুড়ায় উঠে পিকনিক করে। মাইক লাগিয়ে দিলে আসে পাশের লোকেরা হতবম্ভ হয়ে যায় এত উচুতে উঠে গ্রামবাসীর পিকনিকে। ২০০৬এ প্রথম বাঙ্গালী ট্রেকারদের দলটা যখন আসে তখন জঙ্গল এত ঘন ছিল না। কিন্তু মেঘের জলে সবসময় দুর্গম খাড়া রাস্তা ভিজে থাকে তাই ওরাও ব্যর্থ হয়েছে (যদিও দাবী করে ওরাই সিপ্পি জয়ী প্রথম ট্রেকার, কিন্তু রণীন পাড়ায় আরাম বম জানায় তারা জুম ক্ষেত পর্যন্ত গিয়ে ফেরত আসে, ঢাকায়্ ফিরে জিপিএস রিডিং জানায় ৫হাজার ফিট। লোকজন সব টাশকি খেয়ে যায় বাংলাদেশের ভেতরেই ৫ হাজার ফিট মাউন্টেইন। পড়ে অবশ্য চাপাবাজী ফাঁস হয়ে যায়)।

সন্ধ্যায় কিছু করার নেই দেখে আমি আর ইফতি গ্রামে বেড়াতে বেড়ুলাম। রাস্তা ক্রমে উপরে উঠতে উঠতে পর্বতের ওপাশে জুম ক্ষেতে চলে গেছে। নিচের দিকে বম পাড়ায় উতসব হচ্ছিল। বিশাল এক শুকরকে আগুনে ঝলসে বারবিকিউ করছিলো। চামড়া ছাড়ানো শূকর দেখলেই আমার অস্বস্তি লাগে আর পাহাড়িদের খুব প্রিয় খাবার তাই কোন অপ্রিতীকর পরিস্থিতি যাতে না হয় তাই দিক পালটে কবর স্থানের দিকে চলে গেলাম। ফিরে দেখি সবাই গোল হয়ে বসে চাঁদ দেখছে। আকাশে অনেক তারা। সবাই স্তব্ধ। আস্তে আস্তে গ্রামের ঢোলের আওয়াজ থেমে গেল। আরো পড়ে লোকজন আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে গেল কিন্তু বন পাহাড়ের নিস্তব্ধতা অদ্ভুত মায়াময় হয়ে ওঠে।

যাদের ছাড়া আরসুয়াং দর্শন অসম্ভব হত। মাঝখানে আরাম বম দা, আর দুজন কাটার।

অনেক ভোরে উঠলাম সবাই। আজকে সবচেয়ে বড় সুবিধা ব্যাগপ্যাক ক্যারি করা লাগবে না। রাহাত ভাই আর হাসিব ওদের ব্যাগপ্যাকটা নিল খালি হালকা খাবার পানি ভর্তি করে। বাকিরা খালি। আশা করি দুপুর ১২টা নাগাদ আমরা সিপ্পি সামিট করতে পারবো। সব ঠিক ঠাক থাকলে সুর্য ডোবার আগেই গ্রামে ফেরত আসতে পারবো। আমরা চিড়া গুড় মেখে ব্রেকফাস্ট করে ফেললাম। শুকনা চিড়া গলা দিয়ে নামে না। তাই খুব অল্প খেলাম। এটা বড় ভুল ছিল। কি পরিমান শারীরিক কষ্ট হবে তার কোন ধারনাই ছিল না। খিদে না পেলেও যে খাবারের চাহিদা থাকে শরীরে মনে ছিল না। আরাম দা, আর গাইড দুজন (এরা বাংলা জানে না, কিন্তু ইশারা আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা, বম শব্দ মিশিয়ে কথা হচ্ছিলো) নিয়ে আমরা রওনা হলাম। পথে প্রচন্ড জোক হবে, তাই আমি আরাম দায়ক হবে ভেবে কনভার্স পায়ে রওনা হলাম। পাহাড়ি পথ দিয়ে সুন্দর ভাবেই যাচ্ছিলাম। জুম ক্ষেত দিয়েও আরামে গেলাম। গাইড দের একজন জানালো মাসখানেক আগে মেয়েরা যখন ক্ষেতে কাজ করছিলো হঠাত এখানে একটা বিরাট ভাল্লুক বের হয়ে আসে। মিনিট পনেরো টানা ওঠার ফলে আমরা অনেক উচুতে উঠে এলাম। দূরে সব নিচে। অনেক অনেক দূর পর্যন্ত সব দেখা যায়। ৫ হাজার ফিট রিডিং দেয়া প্রথম দলটা এপর্যন্তই এসেছিল। সফল সিপ্পি জয় করে নেচার এডভেঞ্চার ক্লাব। সাকা হাফলং জয় করে ওরা পেপারে টেপারে বেশ ছবি টবি ছাপায়। ওদের সাজ্জাদের সাথে সিপ্পি সম্পর্কে ডিটেইলস জেনে এসেছিলাম। কিন্তু মাসছয়েকের মধ্যে জঙ্গল এত বেশী ঘন হয়ে গেছে যে ওরা যেই ট্রেইল দিয়ে গিয়েছিল সেটা সম্পুর্ন ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।

জুম ক্ষেত পর্যন্ত আমি বেশ আরামে গেলাম কনভার্স পায়ে। কিন্তু একটু পরেই যখন একটা নিদৃষ্ট লেভেলে গেলাম দেখি মেঘ বার বার এসে জঙ্গলকে প্রচন্ড ভিজিয়ে রাখে। পায়ের নিচে খালি ঘাস কিংবা লতা পাতা, অনেকক্ষন মাটি পাই না। আমি ধপা ধপ আছার খাচ্ছি। পাশের খাদগুলো হাজার ফুট পর্যন্ত হতে পারে। তাকানোর মত সাহস নাই। জুম শেষ হলে আমরা পাহাড়টা শেষ করে সিপ্পি মাউন্টেনের পাদদেশে হাজির হলাম। এতক্ষন চমতকার আকাশ দেখা যাচ্ছিলো। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে ঝিরি ধরে উঠে যাব। ট্রেইলটা ভেজা, পিছলা পাথর ভর্তি এবং প্রচন্ড ঘন জঙ্গল। আকাশ দেখা যায় না। ইতিমধ্যে ঢাল বেয়ে নামার সময় আছাড় খেতে খেতে শরীরের অর্ধেক জিনিসপত্র আলগা হয়ে গেছে। আর শুরু হলো অসম্ভব জোকের উতপাত। জোক ছাড়াও এখানে একধরনের মাছি (এগুলো কামড়ায়) এবং হাতি পোকার উতপাত। হাতি পোকার কামড় গুলো রিতিমত জ্বালা ধরায়। উচু উচু কয়েকটা ঢাল পেরিয়ে আমরা যখন কাহিল, অনেকক্ষন ধরে কুল কুল করে পানির আওয়াজ আসে পানি দেখি না। ঘন জঙ্গলের জন্যে ফুট খানেক দুরের কিছু দেখা যায় না। তখন প্রথম ব্রেক নিলাম ছোট একটা ঝর্নার গা ঘেসে। চারপাশে অসম্ভব রকম ঘন জঙ্গল, অনেক আগে একুশে টিভিতে আমাজন নামের একটা টিভি সিরিয়ালে দেখা সেটের মত। একটু পর পর উচু নিচু। পানির স্তর গুলো ঘন শ্যাওলা, ফার্ন আর বিচিত্র অর্কিড ভর্তি। দ্বিতিয় ব্রেক নিলাম এরকম আরেক ঝিরিতে। এখানে পাহাড় গুলো নিরেট পাথরের। শ্যাওলা তাই বেশি পিচ্ছিল। প্রচন্ড ঘন জঙ্গল তাই দিনমানেও অন্ধকার হয়ে থাকে।


একটু পড়েই আমরা সিপ্পির প্রথম ১নাম্বার চুড়ায় হাজির হলাম। এর পরে রাস্তা পাহাড়ে গা ঘেসে। এজায়গাটাকে পুলসিরাত ছাড়া অন্যকিছু নাম দেয়া যায় না। চিকন রাস্তা। একপাশে ঝোপ জঙ্গল আর মেঘের জল আর শিশিরে ভেজা বাশ বন। বাম পাশে কিছু নাই। তাকিয়ে দেখার আগ্রহ হচ্ছে না নিচে কত গভীর। কনভার্সের তলা ভিজে গিয়ে পুরো স্কেট বোর্ডের মত। ঘাসে পা পড়লেই ধরাম করে পড়ে যাই। এতক্ষন জঙ্গলের লতা পাতা ধরে আটকাচ্ছিলাম। এখন অবস্থা খুব খারাপ কারন পাশের গাছ গুলো হয় কাটা ঝোপ নইলে বিছুটি লাগা বাশ।

জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে আরাম দা কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা এখানে যদি আমি নিচে পরে যাই কি করা হবে’।

নিপাট ভালো মানুষের মত তার মঙ্গোলয়েড হাসি হাসি চেহারা একই রকম থাকলো, ‘আর্মি ক্যাম্পে জানাবো’।

উদ্ধারের চেষ্টা করবেন না?

আমি বলতে চাচ্ছিলাম হসপিটালের কথা, কিন্তু সেটা বোধহয় একটু বেশী আশা করেছিলাম, কারন দাদা উত্তর দিল “নাহ, এখান থেকে লাশটা আস্ত পাওয়া যাবে না। নিচে অনেক নিচু। লাশ উঠানোর কোন চান্স নাই’।

ও আচ্ছা। আগের ট্রেকিং গুলোর মত এবারো শপথ করলাম প্রকাশ্যে সব কজন কে স্বাক্ষি রেখে, আমি জীবনে আর পাহাড়ে আসবো না। তারাও আমার সাথে শপথ করলো। জানি ঢাকায় ফিরলেই বেমালুম সব ভুলে যাবে।

সিপ্পির একনাম্বার শিংটা অতিক্রম করে আমরা ঢাল বেয়ে আমরা মুল চুড়া (আরসুয়াং বা সবচেয়ে উচু চুড়া) পথে। এখন একটু রোদ আসছে। কিন্তু জঙ্গল অসম্ভব রকম ঘন। দুপাশে মাথা সমান লম্বা লতা ঝোপ নইলে বাশ গাছ। একটাই সুবিধা আমরা এখন গিরি পথ দিয়ে যাচ্ছি। দুপাশে গাছ নইলে পাহাড়ের দেওয়াল পরে যাবার চান্স নাই। খালি উঠতেই আছি। চারপাশে অত্যন্ত বেশি গাড় সবুজ। একটু পর ঝোপের জঙ্গল ছেড়ে বের হলাম। ইতিমধ্যে প্রায় ছ ঘন্টা রাস্তা হেটেছি। আরাম দা জানালেন এখানে আমাদের সামিটের আগে শেষ ব্রেক। সামনে বিরাট খাদ। কত নিচু মাপার কোন ইচ্ছাও হলো না। মনে হয় হাজার খানেক ফিট। কেউ চাপা বাজ বলতে পারেন, তাও বলছি পাহাড়ি দেয়ালটা কমকরে হলেও দুই হাজার ফিট নেমে গেছে। নিচে সব কিছু ছোট ছোট কিছুই মার্ক করা যায় না। মাঝে মাঝে নিচ দিয়ে মেঘের দল যাচ্ছে। অনেক দূরে ভারতের ত্রিপুরার পাহাড় গুলো দেখা যায়। এখান থেকে সিপ্পির তিন নাম্বার পিকের পিছে আর কিছু গ্রাম। আরো ওদিকে রুমা উপজেলা। এখান থেকে উঠাতে ইচ্ছা করে না, এত পরিশ্রম সব ধুয়ে মুছে গেল। আমার অনেক নিচ দিয়ে যখন মেঘের দল দলা পাকিয়ে ভেসে যাচ্ছে তখন চিতকার করে বলতে ইচ্ছা করে, ‘আকাশ যারা করল জয়’। এই নামে একটা বই পড়েছিলাম রাইট ব্রাদার্সের উপরে। প্রথমবার আকাশ জয় করায় তাদের কেমন লেগেছিল?

এরপরে বাশের জঙ্গল বেশ ঘন। দেয়ালের মত জমে আছে। কাটারের দল বাশ কেটে কুটে চিপা রাস্তা করে দেয়। আমরা উঠতে থাকি। আধাঘন্টা পর হিসাব অনুযায়ী ৬ ঘন্টার মাথায় আমরা সিপ্পির চুড়ায় হাজির হলাম। সিপ্পি একটা টেবিল মাউন্টেন। উপরটা সমতল। দু পাশে দুই শিং ১ নাম্বার আর দু নাম্বার পিক যার একটা মুল চুড়ায় আসতে হলে পার হতে হয়। প্রচন্ড রকম ঘন জঙ্গল উপরে।কাটারেরা একটা অংশ কেটে পরিস্কার করার চেষ্টা করলো। বিশেষ সুবিধা হলো না। একটা গর্ত আছে। আমরা সেখানেই নামলাম। সামনে একটা অংশ কেটে পরিষ্কার করা হলো। সিপ্পির উচ্চতা ৩০২৭ ফিট। সাকা হাফলং ৩৪৮৮ ফিট। কিন্তু সিপ্পির সবচেয়ে বড় সুবিধা আসে পাশে অনেক পর্বত থাকলেও এরকম জায়ান্ট একটাও না। অনেক অনেক দূর দেখা যায়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল। বুঝলাম ৩ হাজার এন্ড এবোভ ফিট সী লেভেল মুখের কথা না। দূরে রুমার ওদিকে কেও কারাডং এর রেঞ্জের কিছু অংশ। পিছে রাঙ্গামাটির পাহাড় গুলো এমনকি দূরে ত্রিপুরা এমনকি বঙ্গোপসাগরের আউটলাইন দেখতে পেয়ে হতবম্ভ হওয়া ছাড়া আর কিছু নাই।

আমি লাল-সবুজ ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ ক্যারি করছিলাম। আরাম দা আর আমি মিলে একটা বড় বাশের মাথায় পুতে এটাকে উপরে উঠিয়ে দিলাম। ক্ষুদায় তৃষ্ণায় মর মর সবাই। রাহাত ভাইয়ের ব্যাগে চিড়া আর গুড় ছিল। জীবনে এত সুখাদ্য আর খাই নাই। সবাই হামলে পড়াতে নিমিষেই ফুরুত। পেটে রাক্ষুসে ক্ষুদা। বেশি সময় নেই। তারা তারি নামতে হবে। এমনিতে খাবার শেষ। নামার সময় সময় কম লাগে। কিন্তু ৫ঘন্টা ধরলেও আমরা ঠিক সুর্যাস্তের মধ্যেই গ্রামে ফিরতে পারবো। খুব দ্রুত প্যাক করে নিয়ে সামিট পর্ব শেষ করে ফেরত আসা শুরু করলাম। এতক্ষন কষ্ট করছিলাম এই মোমেন্টটার জন্যে।

আসার সময় বেশ দ্রুত নামছিলাম। কিন্তু ক্ষুধায় তৃষ্ণায় বার বার আছাড় খেতে খেতে জীবন শেষ। একই ট্র্যাক ধরে ফিরছিলাম। পায়ে জোড় পাচ্ছি না আর। জঙ্গলের ধারালো লতা লেগে দুই হাতের কবজী কেটে গেছে। আগেরবারের ঝর্ণাতে এসে শার্ট খুলে ফেললাম। জায়গা জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। আমার রক্ত বোধহয় বেশী মিষ্টি। জোক ধরে শেষ। জোকের ভয়ে প্যারাসুট কাপড়ে পিচ্ছিল ট্রাউজার পড়েছিলাম। পায়ের মোজার সাথে ইন করে সংযোগস্থল ইলাস্টিক দিয়ে বেধে রেখেছি। একই ভাবে কোমড়ে বেল্ট না পড়ে এক খন্ড ইলাস্টিক শক্ত করে পেচিয়ে বেধেছি। বাথরুমের রাস্তা দিয়ে জোক ভিতরে ঢুকে গেলে বিপদ। তাই আন্ডারওয়ারের বদলে পিচ্ছিল টাইটস পড়েছি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এতে হাটতেও সুবিধা, উড়ু ছিলে যায় না। আরাম দা বাশের পাত্রে লবন পানি নিয়ে গিয়েছিলেন। কাপড়ের সুতলীতে ভিজিয়ে সারা গায়ে মাখছিলাম বার বার। কিন্তু জোকের আর বিরাম নেই।

শেষ ঢালটা পার হবার সময় ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ছিলাম সবাই। পা বার বার কাঁপছিলো। আমি নিজে টের পাইনি। পিছন থেকে জ্যাজ বলছে “দোস্ত তোর পা কাপতেছে”। বুঝতে পারলাম ডি-হাইড্রেশন হচ্ছে। শেষ খাবার আর পানির বিন্দুটা শেষ ঘন্টা তিনেক আগে। খাবার এবং পানির অভাবে পাহাড় থেকে নেমে আসার শক্তি শেষ। কিন্তু যেভাবেই হোক নামতে হবে। এই জঙ্গল থেকে সুর্য ডোবার আগেই গ্রামে ফিরতে হবে। আরাম দায়ের বুদ্ধিতে কিছু রাস্তা পিছলে নামলাম। সিপ্পি পর্বত শেষ হলো। কিন্তু পরে আরেকটা বিশাল ৫-৬টা পাহাড় শেষ করলে গ্রাম। এখানে জুম ক্ষেত আছে। পায়ে জোড় নেই, পাশে গভীর খাদ পিছলে পিছলে নামছি। পাশের ক্ষেতে কিছু তঞ্চংগ্যা মেয়ে ক্ষেতে কাজ করছিলো। আমার আছাড় খাওয়া আর নামার স্টাইল থেকে তারা গলা ফাটিয়ে হাসা শুরু করলো। এত জোড়ে যে এই পাহাড় থেকেও শোনা যায়। সিপ্পির পরের পাহাড়টায় উঠার সময় গায়ে বিন্দুমাত্র জোড় নেই। রাহাত ভাই, ইফতি আর রাব্বী ভাই অনেক এগিয়ে গেছে। আমার জন্যে আরাম দা, জ্যাজ আর ঘোড়া পিছে। একটা ভ্যালিতে পুরো শুয়ে পড়লাম। আরাম দা আমাকে রেখে জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। আসার সময় হাতে কয়েকটা মারফা নিয়ে ফিরলেন। মারফা একধরনের পাহাড়ি ফল। আমাদের ক্ষীরার মত, কিন্তু আকারে অনেক বড় অনেকটা ছোট লাউয়ের মত। শষার বিকল্প। লাফিয়ে পরে খোসা শুদ্ধ খেয়ে ফেললাম, এক নিঃশ্বাসে কয়েকটা মারফা খেলে পেটের জ্বলুনীটা কমলো। শষার মত তাই পানির অভাবটাও অনেক পুরণ হলো। এরপরে আমরা দ্রুত হেটে মুল দলকে ধরে ফেললাম। ওদের কাছে কিছু এনার্জি বিস্কুট আর প্রান চাটনী অবশিষ্ট ছিল। শেষ বিকেলের আলোয় একটা ছোট্ট ভ্যালীতে আমরা মারফার সাথে এগুলো শেষ করলাম। পানি নেই, কিন্তু মারফা অনেক শক্তি আর পানি দিল। পায়ের জুতো খুলে মুজা পড়েই হাটা দিলাম। এবার গায়ে জোড় এসে গেছে।

শেষ ঢালটায় আসতে আসতে সূর্য ডুবে গেছে। দিনের শেষ আলো আর কিছুক্ষন থাকবে। নিজেদের ভুলে প্রয়োজনীয় পরিমান পানি আর খাবার না নিয়ে বিপদে পরেছিলাম। কোন রকমে উদ্ধার পেতেই সব দৌড়। নামার সময় এমনিতেই ত্বরন আসে। আর সুর্যের শেষ আলো মিলাবার আগেই গ্রামে পৌছাতে হবে। জোড়ে দৌড়ে নেমে গ্রামে পৌছালাম অন্ধকার হবার আগেই। সবাইকে কারবারীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। এরা গোসল করে হালকা নাস্তার আয়োজন করবে। আমি আর রাহাত ভাই টর্চ জ্বালীয়ে ঘাস বন পেড়িয়ে আর্মি ক্যাম্পের দিকে হাটা দিলাম আমরা আস্ত ফেরত এসেছি জানাতে।

মুল চুড়ার উঠতে আর মিনিট বিশেক বাকি, কিন্তু জঙ্গল পাতলা হবার চিহ্ন নেই। জঙ্গল কেটে কেটে উঠতে হচ্ছে।

নামার পথে।

জুম ক্ষেত থেকে সিপ্পি পর্বতে ঢোকার সময়।


মারফার খোজে জঙ্গলে অনুসন্ধান


চুড়ায়

নামার পথে

জোকের কামড়ে হয়রান

রাহাত ভাই, গতকালকে কথা হলো, আজ গেছেন বরিশাল, পরশু সুন্দরবন। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে সরাসরি সেন্ট মার্টিন। অসম্ভব এডভেঞ্চার ফ্রিক একজন।


চুড়ায়।

ভিউ ফ্রম দি টপ

ভিউ



এই পর্বের ছবি গুলোর ১টি আরাম বমের তোলা, জোকের কামড়ে আমার বসে থাকারটা রাহাত ভাইয়ের তোলা, আর বাকী সবগুলো ফজলে রাব্বীভাই (ইউনিসেফ) তুলেছেন।

আগামী পর্বঃ (শেষ পর্ব) শহরে বিভ্রাট।

১ম পর্বঃ Click This Link
২য়ঃ Click This Link
৩য় পর্বঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:১২
১৪টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×