somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এডভেঞ্চার পুবের পাহাড় ৭-বাংলাদেশের ছাঁদে।

০২ রা আগস্ট, ২০১০ রাত ১২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দৃশ্য। সামনের ঘাসগুলোর পরেই শুরু হয়েছে বার্মার সীমান্ত। বার্মার সবচাইতে বিদ্রোহ আর সংঘাত পূর্ন এলাকার একটা। পিছে বাংলাদেশের অংশে জঙ্গল অতিরিক্ত ঘন হওয়ায় কিছুই দেখা যায়না।

বাংলাদেশের নতুন আবিষ্কৃত সর্বোচ্চ চুড়ার নাম তল্যাং ময় বা সাকা হাফং। তল্যাং ময় বম শব্দ অর্থ সুন্দর পাহাড়। আর সাকা হাফং ত্রিপুরা বা টিপরা। অর্থ পুবের পাহাড়। এডভেঞ্চার পুবের পাহাড়ের আগের পর্ব নদীর নাম রেমাক্রিঃ Click This Link

সারাদিন রুপসী রেমাক্রি ধরে ট্রেক করে মদক মোয়াল (মদক মোয়াল কোন আলাদা পাহাড় নয়, মোয়াল শব্দের অর্থ পার্বত্য রেঞ্জ, মদক পাহাড়ের রেঞ্জকে মদক মুয়াল বলে) এর গায়ে আকাশের কাছা কাছি ছবির মতো ত্রিপুরা গ্রাম শালুকীয়া পাড়ায় আমরা পৌছালাম। সন্ধ্যা বেলায় নলীরাম ত্রিপুরা আমাদের নাস্তার দাওয়াত দিলেন। নলীরাম গ্রামের শিক্ষক এবং ব্যাবসায়ী। সবচাইতে অবস্থাপন্ন লোক। এ অঞ্চলে দোকানের চল নেই, তাই সফল ব্যাবসায়ী নলীরাম দা, পাশের গ্রামের জঙ্গলে তার অনেক গুলো গয়াল আছে। সবচে কাছে মোবাইল নেটওয়ার্ক ৩/৪দিনের রাস্তা। কিন্তু নলীদার একটা নোকিয়া মোবাইল আছে যাতে এমপিথ্রি বাজানো যায়, ভিডিও দেখা যায়। নলীদা আদিবাসী কিছু গান বাজাচ্ছিলেন। অত্যন্তু সুরেলা গলার এক মেয়ে মারমা ভাষায় গান গাইছে। থানছি শহরে মোবাইলের দোকানে নাকি হরহামেশাই তার গান পাওয়া যায়। বান্দারবান শহরের শিল্পী। কিন্তু সীমান্তের এপারে ওপারে দু-দিকেই দারুন জনপ্রিয়।
পাহাড়ী আলু সেদ্ধ আর গরম চা দিয়ে খেতে খেতে নলীদা আগামী কালের প্ল্যান সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমরা জানালাম ইতিমধ্যেই আমরা যোগার যন্ত করে রেখেছি। মরা, ন্যাচার এডভেঞ্চার ক্লাবের সাথে প্রথম সাকা হাফং অভিযানে সঙ্গী হয়েছিল কাটার হিসাবে। যেহেতু আমাদের ছোট দল আমাদের বেশী কেউ লাগবে না। আমরাই জঙ্গল সাফ করবো, আর মরা থাকবে পথ দেখিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু নলীদার ব্যাপারটা মনপুত হলো না। বার বার করে বললেন এত ছোট দল নিয়ে যাওয়া যাবে না। পথ ভয়ঙ্কর। আমরা মোটে দুজনের দল, তাই কাটার আর গাইড বাবদ মজুরীর বাজেটও খুব কম। নলীদা গ্রামের বুড়ো কারবারী আর অন্যান্যদের সাথে নিজেদের ভাষায় কি কি জানি আলাপ করলেন। আমাদের বললেন, আমি নিজ দায়িত্বে আপনাদের যাবার ব্যাবস্থা করছি। আমরা প্রচুর ওষুধ এনেছিলাম। এই অঞ্চলে সামান্য প্যারাসিটামল কিনতে হলেও ৪দিনের রাস্তা পাহড়ী পথ ডিঙ্গাতে হয়। গ্রামের কারবারীর কাছে ওষুধ পত্র গুলো বিতরন করলাম নলীদা একটু পড়ে বললেন, মরার বাসায় থাকার সমস্যা আর তার ছেলের ম্যালারিয়া, আপনারা আমার বাসায় থাকেন। আমরা একটু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু তা ধোপে টিকলো না। একটু পড়ে দেখি লোকজন মরার বাসা থেকে আমাদের জিনিসপত্র গাট্টি বোঁচকা মেরে এখানে নিয়ে এসেছে। অজ্ঞাত কোন কারনে মরা ভ্যানিশ। সন্ধ্যা থেকেই চোখের আড়ালে।

রাতে বাঘ পালানো শীত পড়লো। ঘরে দাউ দাউ করে চুলা জ্বালিয়ে রাখে পাহাড়ীরা শীতের দিনে। মোটা মোটা কাপড় পড়ে স্লিপিং ব্যাগে থর থর করে কাঁপছিলাম। সারা রাত ছাড়া ছাড়া ভাবে ঘুম হলো প্রচন্ড ঠান্ডার কারনে। সুবহে সাদিকের দিকে একবার ঘুম ভাঙ্গলে দেখি নলীদা ঘরের যীশু খ্রিষ্টের ছবির সামনে সুর করে প্রার্থনা সঙ্গিত গাইছেন। গান শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোড়ে উঠে নলীদা’কে কোথাও পাই না। নলীদা’র স্ত্রী বাংলা জানেননা। ইশারা ইঙ্গিত আর টুকটাক ভাষায় যা বললেন তা হলো নলীদা খুব ভোড়ে উঠে খুব জরুরী কাজে বাইরে গেছেন। আজকে আর ফিরবেন না। পুরো ব্যাপারটাই গোলমেলে লাগলো। কিন্তু চেপে গেলাম। সকাল ৭টা নাগাদ মরার আসার কথা। কিন্তু তার আর দেখা নেই। আমরা হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়ায় যাবার প্রস্তুতী নিলাম। ৮টা বেজে গেল, কিন্তু তবুও মরার দেখা নেই। শেষে বাধ্য হয়ে মড়াকে খুঁজতে বেরুলাম। সকাল ৯টার দিকে মড়াকে পেলাম গ্রামের অন্য মাথায়। চুপচাপ বসে আগুন পোহাচ্ছে। মড়ার কথাতে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে একা আমাদের নিয়ে যাবে না। তাকে কমপক্ষে আরো একজন লোক নিতে হবে এবং গতকাল আমাদের সাথে যেই রেটএ কথা ঠিক হয়েছে সেটা এখন তার বড্ড কম মনে হচ্ছে। তাকে এর পাঁচগুন টাকা দিতে হবে।
মরার কথার ভঙ্গিতেই পরিষ্কার হলো গ্রামের কেউ তাকে বুঝিয়েছে এরা ৭দিনের রাস্তা পার হয়ে এতদুর এসেছে তল্যাং ময়ে উঠতে। এখন না গিয়ে ফিরবে না। তাই সুযোগ বুঝে আচ্ছা মতো টাকা আদায় করা যাবে। কে মড়াকে কান পড়া দিলো বুঝতে দেরী হলো না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। পাহাড়ে অনেক দিন ধরেই ঘুরছি। টাকা পয়সা নিয়ে এধরনের নোংরামীতে আর পড়তে হয়নি। মড়া শাইলক স্টাইলে আমাদের কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলে সামনে উৎসব, আমার অনেক কাজ, গেলে যেই টাকা বললাম তাতে রাজী হন, নইলে থাকেন, গ্রাম ঘুরেন।
গতকাল মড়ার সাথে দেখা হয়েছিল শালুকীয়া ঝর্নায়, মরার ছেলে অসুস্থ তাই সে চারদিনের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে থানছি যাচ্ছিলো ওষুধ আনতে। আমাদের সাথে ওষুধ গুলো ছিল তাই সে ফিরে আসে গ্রামে। তখনই কথা বার্তা ঠিক করে রেখেছিলাম। এদিকে বেলা বাড়ছে। প্রথম সাকা হাফং অভিযানে ওরা সকাল আটটায় রওনা হয়ে বিকালের দিকে ফিরে আসছিলো। আর আমাদের এখানেই ১১টার মতো বাজে। ফিরতে রাত হবে। এই ভয়ঙ্কর পথে কোন অবস্থাতেই রাতে যাতায়াত সম্ভব না। তাই মড়ার কথায় রাজী হয়ে গেলাম। আমরা রাজী হতেই মড়া আরো দাবী তুললো। তার সঙ্গী ছেলেটাকেও সমপরিমান অর্থাৎ আসল রেটের পাঁচগুন টাকা দিতে হবে। স্বাভাবিক রেটের ১০গুন বেশী রেটে যে দুজনকে পেলাম তাদের অন্যজনের নাম অজারাম ত্রিপুরা। আমাদের নলী’দার শালা। ২০এর মতো বয়স। দুটো বাচ্চা আছে। কোন কাজকর্ম করেনা, কিছুদিন থানছিতে বাংলায় পড়াশুনা করেছে তাই বাংলা ভালোই জানে। সে তল্যাং ময়ের পথে কোনদিনও যায়নি।
মড়া পরে কথায় কথায় ফাঁস করে দিয়েছিলো কার স্বার্থে আমাদের এরকম প্যাচে ফেলে। এবং এও জানলাম এইটা করে মড়ার যেমন লাভ তেমনি অন্যজনেরও লাভ কেননা মড়া আর অজারামের আজকের ইনকাম তার বুদ্ধিতে হওয়ায় তাদের মজুরীর ২৫% তাকে দিতে হবে। মগের মুল্লুকে শুধু মং (মারমা বা মগ) রাই থাকে না ত্রিপুরারাও থাকে। মনে পড়লো চ্যামাখাল ট্রেকে সুভাষ ত্রিপুরার বন্ধুত্ব কিংবা আগের গ্রামের দোনারাং ত্রিপুরার কথা। গতরাতে নলীরাম ত্রিপুরা আগ বাড়িয়ে জানালো যে ন্যাচার ক্লাব তাকে হাজার খানেক টাকা দিয়েছিল তল্যাং ময়ের পথে একটা সাইনবোর্ড লাগাতে যে এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া। সে খামোখাই সে প্রসঙ্গ তুলে জানালো সে ঐটাকা দিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলো কিন্তু মুরংরা সেটা ভেঙ্গে ফেলেছে।শোনার সময়ই ঠাকুর ঘরে কে’রে ভাব হচ্ছিলো।
আমরা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়ায় ওঠার জন্যে রওনা হলাম সকাল সাড়ে দশটারও পরে। আলমভাই হতে যাচ্ছেন প্রথমজন যিনি দ্বিতীয়বার তল্যাংময়ে পা রেখেছেন। আলমভাই জানালেন সাকাহাফং এ প্রথম যাবার সময় তারা সকাল ৭টায় রওনা দিয়ে দুপুরে চুড়ায় পৌছেছিলেন। আর ফিরতে গিয়ে বিকেল গড়িয়ে গেছে। সেই হিসাবে আমাদের ফিরতে হয়তো রাত হবে। আর রাস্তার অবস্থা দেখে বুঝতে পারছি তাহলে কি সর্বনাশ হবে।
বাংলা গ্রামার বইতে ব্যাকারনগত ভুলের উদাহরন হিসাবে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ শব্দটা থাকে। যারা গ্রামার বই লিখে তাদেরকে রাস্তাটা দেখাতে পারলে হতো। খাড়া উচু থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ঝিরি নামছে। বেশীর ভাগ যায়গাতেই এতোই খাড়া যে প্রায় ঝর্না হয়ে গেছে। দিনমানে অন্ধকার হয়ে আছে। না মেঘলা দিন না। এদিকে অরন্যের রাজত্ব। মানুষের হামলা নেই বলে ঘন সবুজ বনের হাতে সূর্যের আলো হেরে গেছে নিদারুন ভাবে। দৈত্যাকার সব বিশালকায় পাথর শ্যাওলা পড়ে সবুজ। আকাশ ছোঁয়া প্রকান্ড গাছগুলোর মোটা মোটা কান্ডে শ্যাতলা জমে আছে। গাছগুলো থেকে ঝুলে পড়া সবুজ সবুজ লতানো গাছগুলো কি যেন কি রহস্যে ভরপুর। বড় বড় ফার্ন আর লতানো অর্কিড। দুর্ভেদ্য ঘন বনে পাখি, বানর (বান্দরবানে বানর খুবই কম দেখা যায়, বিশেষ করে রুমা, মদক এই দিকে) আর অচেনা পশুর ডাক। বিষ্ময়ের ব্যাপার, এই দুপুর বেলায় ঘুঘুর ডাকের সাথে তাল মিলিয়ে ডাকছে লাল হরীন। এই তল্যাং ময় ট্যুরে লাল-হরীনের সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছে। লাল রঙের ছোট ছাগলের মতো। সম্ভবত ইংরেজীতে বলে বার্কিং ডিয়ার। নিঃস্বং টিঁয়াও টিঁওয়াও আওয়াজ। মাঝে মাঝেই প্রকান্ড বেধের বিশাল সব গাছ আড়া আড়ি পড়ে আছে। কোথাও কোথাও তলা দিয়ে হামাগুড়ি দিতে হয় আবার কোথাও কোথাও হাচড়ে পাচড়ে দাওয়াল টপকানোর চেষ্টা। ঝিরির পানি ভয়ঙ্কর হিম ঠান্ডা। আমরা উজানে যাচ্ছি। হিম শিতল পানির ভয়ঙ্কর স্রোতের মুখে থাকা শ্যাওলা জমা বিশালদেহী পাথরগুলো যে কি রকমের পিচ্ছিল হতে পারে তার জানান দিতেই আমরা ক্রমাগত আছাড় খেতে থাকলাম।
একজায়গায় ঝিরিটা দুই দিক থেকে দেয়ালের মতো একটা পাহাড়কে চক্র কেটে নেমে এসেছে, মরা জানালো এই পথে ওঠা লাগবে। হাত পা খিমছে খিমছে স্পাইডার ম্যানের মতো করে পাহাড় বাওয়া শুরু করলাম। উচুতে ভয়ঙ্কর ঘন জঙ্গল। আর লতাপাতায় বিছুটি জাতীয় কিছু। বাঁশ ঝারের গায়ে হাত দিলেই হাত চুলকায়। না দিয়ে উপায় নেই। পায়ের নিচে এক চিলতে মাটি। দুপাশে গভীর খাদ। বাঁশ ধরে ঝুলে ঝুলে যেতে হয়। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার অনেক জায়গাতেই বাঁশ গুলো মরা, ধরে ভর দিলেই মরাত করে ভেঙ্গে পড়ে। অজ্ঞাত কারনে জায়গাটায় মাকড়শার জালে ভর্তি। এগুলো কি প্রজাতীর মাকড়শা জানিনা, জালগুলো বেশ শক্ত আর আঠালো। চোখে মুখে বসে গেলে টেনে টেনে তুলতে হয়। টিভিতে, বইপত্রে টরেন্টুলার ছবি দেখেছি।আজকে এই বাঁশবনে আঠালো জালের আট-পেয়ে মালিকেরে চেহাড়া দেখে টরেন্ট্যুলা বাস্তবে দেখার উৎসাহ উবে গেল। সাধারন মাকড়শারই হয়তো কোন প্রজাতী। সাইজে আমার হাতের তালুর সমান, সবুজ আর কালো মেশানো বিকট দেহ। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
বিপদজনক রাস্তাটা পেড়িয়ে এসে মোটামুটি একটা রাস্তায় উঠলাম। ন্যাড়া পাহাড়ে জুম লাগিয়েছে। শিশির জমে জুমের আলগা জমি।একে বেঁকে বিশাল পাহাড়টার একদম চুড়ায় উঠতে হলো। আকাশ স্বচ্ছ গাড় নীল হয়ে এসেছে।রোমান্টিকেরা একে হাই অল্টিচিউড ব্লু বলতে পছন্দ করে। এই দুর্ভেদ্য জুমের পাহাড়টা মুরংদের গ্রাম চিকনকালা মৌজার। বাংলাদেশের অন্যতম উচু আর সবচাইতে দুর্গম গ্রামগুলোর একটা। মুরং বা ম্রো-রা চমতকার উপভোগ্য মানুষ। কিন্তু কিছু উগ্র কাজকারবারের কারনে (মুরং গ্রাম বোর্ডিং হেডম্যান পাড়ায় রাত্রিবাসের ঘটনা দ্রষ্টব্য) মুরংরা অনেকটাই একঘরে। শালুকীয়া পাড়া নিজেই প্রাকৃতিক বর্মে ঢাকা। শালুকীয়া পাড়ার ত্রিপুরারা বা অন্যগ্রামের লোকেরা চিকনকালা পাড়ায় আসতে হলে রেমাক্রির পথে আসে। এ অঞ্চলটা একদমই যেন পৃথিবীর বাইরে। চিকনকালা পাড়ার জুমঘরে এসে আমরা একটা বিরতী নিলাম।আমাদের জিপিএস জানাচ্ছে আমরা ২৭০০ফুট উপরে। মানে তাজিনডং মুল চুড়ারও উচুতে।সবার গা থেকেই অনেক গুলো করে জোঁক বেরুলো। তাছাড়া ঝিরির পরের বিপদজনক ঢালটার বাঁশবনে জায়গায় জায়গায় ছিলে গিয়েছিলো।কিছুক্ষন জিরিয়ে নিলাম। অজারাম অনেকক্ষন থেকে খন খন করছিল, খুব বাজে জায়গা বলে। কোন দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখা চিহ্নিত করা হয় বড় কোন পর্বতের রীজ বা নদী বরাবর।মদকের এই অঞ্চলে বাংলাদেশ-বার্মার সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়েছে তল্যাং ময়ের (ব্রিটিশদের ম্যাপে মদক তোয়াং) বরাবর। তল্যাং ময় বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে কোনাকুনি উঠেছে আর বার্মার দিকে প্রায় দেয়ালের মতো খাড়া ৯০ডিগ্রি করে নেমে গেছে।প্রাকৃতিক দেয়াল অর্থাৎ চুড়ার ঠিক নিচেই সীমান্ত পিলার। গুগল আর্থে তল্যাং ময়কে বার্মা সীমান্তের ওপারে দেখিয়েছে। তল্যাং ময়ের অস্তিত্ব প্রকাশ পেলে এডভেঞ্চার কম্যুনিটির অনেকেই একে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া বলতে অস্বীকার করেছিলেন বার্মার ভেতরে সন্দেহ করে। কিন্তু চুড়ায় উঠলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় এটা স্বার্বভৌম বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরেই।
সীমান্তের ঠিক ওপারেই বার্মার প্রথম গ্রামটার নাম পীক্ষ্যং পাড়া। বমদের গ্রাম। অজারাম জানালো বার্মিজ আর্মি নাকি পিক্ষং পাড়ায় সমাবেশ করছে। র‌্যাম্বো বা এধরনের মুভীগুলোতে বার্মিজ আর্মির অত্যাচারের দৃশ্য থাকে। ব্যাপারটা মিথ্যে নয়। ১৯৪৮সালে স্বাধীনতার পর থেকেই বার্মার রাষ্ট্রযন্ত্র অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে বার্মিজ আর্মি। গ্রামের আদিবাসীদের মানুষ বলে মনে করে না। কিছু হলেই গুলি। অজারাম জানালো সে নাকি গতরাতে স্বপ্ন দেখেছে তল্যাং ময়ের নিচে বার্মিজ আর্মি জমায়েত হয়েছে আর আমাদের দেখেই ঠা ঠা করে গুলি করা শুরু করছে। আর আমরা সবাই ধপাধপ মারা গেছি। সেটা দেখে নাকি সে আতঙ্কে অস্থির। মেজাজ এত বেশী খারাপ হলো যে কি বলবো?
১ঘন্টার মধ্যেই আমরা অতি সুন্দর একটা উপত্যকায় এসে নামলাম। চারপাশে বিশালদেহী সব গাছের রেইন ফরেস্ট। অগুনিত পাখি সারাক্ষনই কিচির মিচির করছে। এর মধ্যে আঁকা বাঁকা একচিলতে মেঠোপথ। সমতল রাস্তা। দির্ঘ পথ খুব দ্রুতই চলে এলাম। পথের শেষে একটা ছোট্ট ঝিরি। এই ঝিরিটার জন্ম বার্মায়। কিন্তু একে বেঁকে সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গুলে বাঁশের বন (আগের দুটো এক্সপিডিশান এবং জীন ফুলেনের প্রথম এক্সপিডাশানে ওরা যে পথ দিয়ে এসেছে আমাদেরকে অন্য পথে এনেছে মড়া) পেড়িয়ে শালুকীয়া ঝিরিতে পড়েছে। এর পরে প্রায় ঝর্নার মতো করে একদম খাড়া নেমে মিশেছে রেমাক্রি’তে। ঝিরির অন্যমাথায় এক নেংটি পড়া লোক কাঠ কাটছিলো। এটা মুরং পাড়া। চিকনকালা। আগেই শুনেছিলাম এটা বাংলাদেশের সবচাইতে স্যাভেজ গ্রামের একটা। ধাপে ধাপে খাড়া উঠে গেছে ঝিরির পাশা পাশি চিকনকালা রেইনফরেস্টের দিকে।
মুরং মেয়েদের টপলেস থাকার দৃশ্য অনেক। সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের আত্মজীবনী বলপয়েন্ট বা কাঠপেন্সিল কোনটাতে বান্দারবান শহরে এমন দৃশ্যের কথা লিখেছিলেন। মুরং মেয়েরা ঘরে বাইরে প্রায় সব কাজই করে। তাই কাজের সুবিধার জন্যে উর্ধাঙ্গে কিছু রাখে না। তাই তাদের দেখে বিব্রত না হলেও বিব্রত না হয়ে পারলাম না প্রায় দিগম্বর কিছু পুরুষকে গেরোস্থালীর কাজ করতে। যে কয়জন পুরুষকে দেখলাম কেউ কাঠ কাটছে না হয় অন্য কাজ করছে। আমাদের দেখে গ্রামের কারবারী এগিয়ে এলেন।মাথায় বিশাল লাল পাগড়ী আর পরনে বড় রুমালের সাইজের একখন্ড কাপড়ের ন্যাংটি পড়া। গ্রামে সময়ক্ষেপনের মানে নেই। আমাদের তাড়াছিল। কিন্তু চোখ আটকে গেল একটা খোলা জায়গার লাল মরিচ শুকোতে দিয়েছে চাতালের মতো করে। লাল মরিচের মধ্যে এক কোনায় রোদে শুকোতে দেয়া একটা চিতা বেড়ালের চামড়া।অতীতে একবার থানছিতেই এক মুরং গ্রামে খাবারের খোঁজ করাতে ওরা জানায় দু-দিন আগে আসলে ভাল্লুকের মাংস খাওয়াতে পারতাম। তাই চিতাটাকে মেরে তার মাংসগুলো কি করেছে সেটা খামোখা জিজ্ঞেস করলাম না। মাথাটা আস্তই আছে। প্রকান্ড শ্ব-দন্ত মেলে ভয়ঙ্কর মুখব্যাদন করা মৃত জন্তুটার অসহায় ভরা করুন চেহারাটা দাগ কেটে যায়।
চিকনকালা গ্রাম থেকে পথটা ধিরে ধিরে উঠে যাচ্ছিলো। মাথার উপরে ঘন অশুভ কালো এক রেইন ফরেস্ট। অনেকটা লাউয়াছড়া ঘরানার। বিশাল বিশাল প্রকান্ড মোটা কান্ডের গাছ।আকাশ থেকে সূর্যের আলো আটকে দেয়। অনেক দিনের জমা পাতার উপরে গাছের পাতা খসে পড়ে, আর তার উপরে নতুন পাতা পড়ে। চারপাশে ফার্ন, লতা গুল্ম আর পরগাছার দল গাছগুলোকে আরো রহস্যময় করে তোলে।
চিকনকালা বনের একটা রহস্যময় মীথ আছে। কু-সংস্কারের ঢেঁকী অজারাম সবিস্তারে জানালো। চিকনকালা গ্রামের লোকেরা বেঁচে থাকার জন্যে এই বনটার উপর নির্ভরশীল। ওরা আলাদা থাকতে পছন্দ করে। দৈবাত বাইরের গ্রামগুলোতে যায়। বাইরের লোকেরা আসে খুবই কম।রাস্তা দুর্গম বলে। আর আসলেও আসে শুধুই শিকারের লোভে। অসংখ্য শিকারের মাঝে আছে হরীন,বুনো শুকর, বন মোরগ আর বন্য ময়ুর। চিকনকালা গ্রামের লোকেদের ধারনা এই জঙ্গলে অতৃপ্ত অপদেবতার বাস। প্রতিবছরেই হঠাতই একদিন কোন জানান না দিয়ে বনের ভেতরে বিচিত্র একটা ধুপধাপ আওয়াজ আসে। এই আওয়াজ শুনলে গ্রামের শিশু বৃদ্ধ সবাই আতঙ্কে জমে যায়। পিশাচের ঘুম ভেঙ্গেছে। বনের ভেতরে থাকা কাঠুরে বা শিকারীরদল উর্ধশ্বাসে জান হাতে নিয়ে ছুটে বন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবছরেই এক দুজন পিছনে রয়ে যায়। তারা আর কোনদিন গ্রামে ফিরে আসে না। ক-দিন পরে হয়তো জঙ্গলে তাদের মৃতদেহ আবিষ্কার হয়। সারা শরীরে কোন আঘাতে চিহ্ন নেই। কিন্তু লাশের চেহারা দেখে মনে হয় সাংঘাতিক ক্লান্ত আর ভয়ঙ্কর কোন কিছু দেখে দারুন আতঙ্কে অস্থির। কি দেখে ভয় পেয়েছে আর কিভাবে কোন ক্ষতচিহ্ন ছাড়া মারা গেছে সেই রহস্য এখনো চিকনকালার লোকেরা ভেদ করতে পারে নি।
চিকনকালার অরন্যের ভেতরে ঢূকে উত্তর দিকে একটা বাঁক নিয়ে আমরা আবার ঝিরির পাশে আসলাম। এটা শিকারীদের রাস্তা। একদম খাড়া। উঠতে উঠতে দম ফুরিয়ে যায়। ঝিরি থাকায় রক্ষা। একটু পড়েই রাস্তা শেষ হয়ে গেল। এর পরে আর লোক যায়না।
সিপ্পি অভিযানের কথা মনে পড়লো।এই জঙ্গলটাও ভয়ঙ্কর ঘন। এত বেশী ঘনত্ব যে ২ হাত দূরে গাইডকে দেখতে পারছি না। ক্রমাগত কথা বলছি নিজেদের সাথে। যাতে একজন আরেকজনকে দেখা যায়। মড়ার উপরে শ্রদ্ধা আসলো। এর মধ্যেও কিভাবে যে পথ চিনে চলছে। প্রথমে মনে হলো আমরা উলটো দিকে যাচ্ছি। ঘন জঙ্গলের জন্যে সামনের লোককেই দেখা যায়না, তল্যাং-ময় চুড়া আরো দুরের ব্যাপার। মড়া ব্যাপারটা খোলাসা করলো।‘আমি পাহাড়ী শিকারী’। শিকারের ধান্ধায় দুনিয়ার সব ভয়ঙ্কর জায়গাতে ফাঁদ পাতি।এই পথে আসিনি তো কি হয়েছে, আমাকে একটা জায়গা দেখায়া দিবেন, আমি ঠিক ঠাক পৌছে যাব। অচেনা জঙ্গলে পথ চলা একটা বিদ্যা। এটা এক দুই দিনে শেখা যায়না। মড়ার মতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা পারে এটা শেখাতে। মড়া একটু পড় পড় কোন গাছের ডাল ভেঙ্গে দিচ্ছে বা গাছের মধ্যে কাস্তে দিয়ে ক্রস আকঁছে ফেরার সময় দিক চেনার জন্যে।
নিরেট পাথুরে মাটি, কিন্তু বছরের পর বছর পাতা জমে জমে মাটির চিহ্ন পর্যন্ত নেই।একটা খোলা জায়গায় এসে আমরা বনমোরগ পেলাম। ঝপ করে উড়ে গেল (আসলে লাফালো)। তাদের রাজ্যে সহজে মানুষের দেখা মেলেনা। আমরা নিশ্চিত ভাবে চমকে দিয়েছি তাদের। জঙ্গলের ভেতর থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে পশুপাখির ডাক আসছিলো। এর মাঝে বানর আর লাল হরীণের ডাক চিনতে পারলাম। অনেক গুলোর আওয়াজ অদ্ভুত লাগলো। এই ভর দুপুরে হরীণের ডাক সত্যি বিষ্মিত করে। এই পথটা ভয়ঙ্কর খাড়া। প্রায় পুরো রাস্তাটাই চারহাত পায়ে যেতে হলো।
এর পরে একটু কম খাড়া রাস্তা। কিন্তু চলাচল আরো বেশী কষ্টের। কারন ভয়ঙ্কর জঙ্গল। কাঁটাঝোপ,বাঁশবন আর বড় কিছু গুল্ম জাতীয় গাছ। মরা বাঁশের ভাঙ্গা অংশে হাত পা ছড়ে শেষ, কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার নিজেকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারিনা জঙ্গলের ঘনত্বের জন্যে। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো শুধু অন্যদের কন্ঠ শুনে শুনে জঙ্গল কেটে চল্লাম। প্রায় সমতল একটা রাস্তা। বুঝতে পারলাম তল্যাং ময় প্রাচীরের উপরের। আমাদের ফুট খানেক দুরেই বার্মার সীমান্ত।হাচড়ে পাচড়ে একটা গোল জায়গায় আসলাম। নিচে একটা গভির গর্ত। জঙ্গলটার মাঝে ৫/৭ফুট এলাকা পরিষ্কার করে কাটা। বছর খানেক আগে পরিষ্কার করা। আমাদের জিপিএস আর মড়া দুজনেই জানালো আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবচেয়ে উচু জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে লতা ঘাসের জঙ্গলের ওপাশে বার্মা। বাংলাদেশ অংশের কিছুই দেখার উপায় নেই ঘন জঙ্গলের জন্যে। কিন্তু মনে মনে বললাম বাংলাদেশের ছাঁদে পা রাখার দির্ঘ স্বপ্নটা সফল হলো আজ।। আমি সাথে করে আনা লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা তুলে দিলাম।
ঘড়িতে বাজে আড়াইটা। আমি খাবার দাবারের প্যাকেট খুললাম। আলম ভাই তার দুইটা ভিন্ন মডেলের জিপিএস নিয়ে ব্যাস্ত হলেন।ব্যাপারটা অনেক বড় কিছু। কিন্তু আজকে আলম ভাই হয়ে গেলেন প্রথম ট্রেকার যে কিনা একাধিকবার তল্যাং ময় বা সাকা-হাফং এ পা রেখেছেন। উইকিপিডিয়াতে তল্যাং-ময়ের উচ্চতা ৩৪৮৮ফুট বলে লেখা আছে যেটা আলম ভাইয়েরই মাপা। কিন্তু উনি নিজেই নিশ্চিত নন। আমরা সর্বোচ্চ উচ্চতা রেকর্ড করেছি ৩৫০০ফুটের একটু বেশী আর সর্বনিম্ন ৩৪৬০ফুট (কেওকারাডং ৩১৭৬ফুট সরকারীভাবে, আর তাজিংডং ২৭৪০ফুট। আলম ভাই জিপিএস এক্সপার্ট। পুরো সময়টাতে ছবি তোলা এমনি খাবার খেতেও আগ্রহ দেখালেন না। পুরো সময়টাতেই অঙ্ক টঙ্ক করে শেষে জানালেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়ার স্ট্যান্ডার্ড উচ্চতা ৩৪৭৫ফুট সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য (যদিও ব্রিটিশ এক্সপ্লোরার জীন ফুলেন লিখেছিলেন ৩৪৯০ফুট, কিন্তু জীন ফুলেনের সাথে আমি মেসেঞ্জারে কথা বলেছিলাম, সে নিজেই এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত নন।) আলম ভাই জানালেন গতবারে তার জিপিএসে সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ৩৪৮৮।এবারে অনেক গুলো রিডিং নিয়ে তার পরে সেগুলোর গড় করে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উচ্চতা ৩৪৭৫ফুট পেয়েছেন।
আমরা ছবি নিলাম। একটা চিঠি লিখলাম। এটা একটা ট্রাডিশান। প্রথম অভিযানে জীন ফুলেন পরবর্তি অভিযাত্রীদের জন্যে চিঠি রেখে এসেছিলেন একটা বোতলে, যেটা বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের কাছে (সুত্রঃ চিত্রপরিচালক আর অন্নপূর্না বিজয়ী মাউন্টেনিয়ার সজল খালেদ) আছে। আর আলম ভাই ন্যাচার ক্লাবের সাথে গিয়ে আরেকটি চিঠি রেখেছিলেন।এর মাঝে আকাশ ভাই দের দলটাও সাকা হাফং জয় করে।আমরাও প্লাস্টিকের বোতলে পরের অভিযাত্রীদের জন্যে চিঠি লিখে রাখলাম। আমাদের দু মাস পড়ে আরেকটি দল চিঠি পেয়েছিল। চিঠিতে রাখা ই-মেইল আর ফোন নম্বর দেখে যোগাযোগ করে, পরে ফেসবুকের মাধ্যমে আমার লেখা চিঠির কপি পেয়েছিলাম।
ফেরার পথটা বেশী কঠিন হলো। পাহাড়ে উঠার চেয়ে নামাই বেশী কষ্ট। সময় কম লাগে ঠিকই কিন্তু বড় এক্সিডেন্টগুলো পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামার সময়ই বেশী হয়। আমরা নিরাপদেই চিকন কালা পর্যন্ত আসলাম। মড়া আর আমি, আলমভাই আর অজারাম দু-গ্রুপ করে আসছিলাম।কাটা ঝোপের জঙ্গলে পথ হারিয়ে দু গ্রুপ আলাদা হয়ে গিয়েছিলোএকবার।মড়ার কল্যানে বড় কোন বিপদ হয়নি।আর ঘন মরা পাতার জঙ্গলটায় এসে একবার মড়াই পিছলে প্রায় ১০/১২ফুট নিচে গড়িয়ে পড়ে। ভাগ্যিস মরা পাতার পুরো আস্তর ছিল। তাই কিছু কেটে ছিড়ে যাওয়া ছাড়া আর বড় কিছু হয়নি। এখানেই আমি জীবনে প্রথমবার বন্য ময়ুর দেখলাম।চিড়িয়াখানায় দেখা ময়ুরের মতো না। বরং অনেক ছোট আর কম আকর্ষনীয়। তবুও ময়ুর বলে কথা।
চিকনকালার ভৌতিক অরন্যে একা একটা বন্য দাঁতালো শুকর চোখে পড়লো। এটা খুবই বিপদ জনক প্রানী। একটু আওয়াজেই ভাবে তাকে আক্রমন করা হচ্ছে। ধারালো দাঁত নিয়ে আক্রমনে আসে। রোয়াংছড়িতে একবার দেখেছিলাম একজন বম শিকারী তিন ঠেঙ্গে কুকুর নিয়ে।কুকুরের চতুর্থ পা টা শুকরে কেটে দিয়েছিল। আকৃতিতে ভয়াবহ। সাধারন শুকরের চেয়ে তিন চারগুন। আর সারা শরীর মাংসে থল থল করছে। মড়া আর অজারাম জানালো একটা বন্য শুকর শিকার করলে নাকি প্রায় গরুর সমান মাংস পাওয়া যায়। বন্য শুকরের বিশ্বাস নেই। হঠাত যদি ধারনা করে আমরা তাকে আক্রমন করতে আসছি তাহলেই দাঁত বাগিয় ছুটে আসতে পারে। আমরা সাবধানে সম্মানজনক দুরত্ব বজায় রেখে তাকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে চলে আসলাম। একসাথে চারজন সেও আমাদের দিকে খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। শুধু গম্ভীর সাবধানী চোখে কয়েকবার মাথা তুলে দেখলো। চিকনকালা গ্রামের সীমান্তের ঝিরিটা লাফিয়ে পার হলাম দ্রুত। অর্ধনগ্ন এক লোক দু বাচ্চা নিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। একটা কুকুর জবাই করেছে। কুকুরটার পেট চিড়ে নাড়ি-ভুড়ি পরিষ্কার করছে। সম্ভবত আগুনে ঝলসে কুকুরের রোষ্ট করবে। তল্যনং ময়ে প্রথম বিএমটিসির জনৈক সদস্য সেবারে কুকুরের রোষ্ট খেয়ে ভুয়সী প্রসংসা করেছিলো আমার কাছে। খাদ্যরীতি একেকদলের একেক রকম, আমার কাছে গ্রহনযোগ্য নয়, তাই দ্রুত এলাকাটা পার হলাম।
চিকনকালা গ্রামে আসতে আসতেই আমার ক্যামেরা চার্জ শেষে ইন্তিকাল করলো। শালুকীয়া পাড়ায় ব্যাকপ্যাকে ইনভার্টার রেখেছিলাম।১২ভোল্টের ব্যাটারীটা জিপিএস্ চালতে গিয়ে বসে গেছে পুরোপুরি।সোলার ইলেক্ট্রিসিটি পেলেও চার্জ দিতে পারবো, কিন্তু ধারে কাছে সোলার পাওয়ার নেই।
চিকনকালার জুমক্ষেতে আসতে আসতেই সূর্য ডুবে গেলো। উচু জায়গা অনেক প্রায় আধাঘন্টা আলো থাকবে। প্রায় ছুটে ছুটে নামলাম। মাকড়শার এলাকাতে আমি আর আলম ভাই দুজনেই গড়িয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি।শালুকীয়া ঝিরি আসতে আসতেই পুরো জমাট অন্ধকার।সাথে টর্চ নেই। কিন্তু গ্রামের আলো খুব কাছেই দেখা যাচ্ছে। সারা শরীর ক্লান্তিতে অবসন্ন। জামা কাপড় খুলে ঝিরিতে লাফিয়ে নামলাম। বরফ শিতল জলের কামড়ে শরীর অবশ হবার দশা। কিন্তু গোসল সারতেই আশ্চর্য ফ্রেশ। আয়েশ করে সফল ভাবে সামিট শেষে গ্রামে ফিরে এলাম।
আগামী কাল ১৬ই ডিসেম্বর। বিজয় দিবস।আমরা প্ল্যান করেছিলাম এক ভাবে, তখনও জানিনা এবারেও হিসাব পালটে যাবে। বিপদজনক পাহাড়ী রাস্তায় কৃষ্ণপক্ষের রাতে টানা ১৪ঘন্টা পাহাড় বাইতে হবে,এধরনের আশঙ্কা মনে আসেনা এমনিতে।

তল্যাং ময় বা সাকা হাফং এর অবস্থানঃ
21°47'18.68"N,
92°36'33.31"E


ছবিঃ

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দৃশ্য।


গুগল আর্থে তল্যাং ময় বা সাকা হাফং এর অবস্থান। মাঝখানে হলুদ রেখাটা আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখা। দ্রষ্টব্য গুগল আর্থে চুড়াটাকে বার্মার ভেতরে দেখাচ্ছে। বাস্তবে রেমাক্রি নদীর ওপারে মদকের দিকে গেলেই দেখা যায় কোন ম্যাপই বাস্তবের সাথে মেলে না। গুগল আর্থে সবসময় একটু বার্মার দিকে সরে আসে।


পড়ের অভিযাত্রীদের জন্যে লেখা চিঠি বোতল বন্দী করছি আলম ভাই এবং আমি।


শালুকীয়া পাড়ায় প্রবেশ পথ। দুর্দান্ত সুন্দর ভ্যালিটা। ছবিঃ সামসুল আলম ভাই।


এই ছবিটাকে আমি ডাকি দি এঞ্জেল অফ রেমাক্রি নামে।


রেমাক্রিকে ফ্রেম বন্দীর চেষ্টায় আমি, ছবি আলম ভাইএর।


রেমাক্রিকে ফ্রেম বন্দী করলাম।


এ অঞ্চলে পোচার বা চোরা শিকারী নেই। কিন্তু বাংলার শ্বাপদ বংশ ধ্বংস হবার আরেকটা কারন মুরং দের বৈচিত্রময় খাদ্যরীতি।


চিকনকালা পাড়া। ছবিঃ আলম ভাই।


রহস্যময় চিকনকালা অরণ্য। গ্রামবাসীর ধারনা এই জঙ্গলে দানো থাকে। বছরে একদিন সে বেরোয় মানুষ শিকারে।


বাংলাদেশের ছাঁদে জাতীয় পতাকার সাথে। ডান দিক থেকে, মড়া এর পরে অজারাম।


এখানে রিডিং দেখাচ্ছে ৩৪৬৫ফুট। আমরা সর্বোচ্চ পেয়েছি ৩৪৯০ আর সর্বনিম্ন ৩৪৪০। আমার ধারনা আসলে হবে ৩৪৭৫ফুটের মতো। ন্যাচার এডভেঞ্চার ক্লাব (মেপেছিলেন একই ব্যাক্তি আলম ভাই) রিডিং দিয়েছিল ৩৪৮৮ফুট যেটাকে সবাই গ্রহন করেছে। আর ব্রিটিশ এক্সপ্লোরার জীন ফুলেন দিয়েছিলেন ৩৪৯০ফুট (উনি নিজেই মেসেঞ্জারে আমাকে বলেছিলেন এটা কনফার্ম না)। কেওকারাডং এর চুড়ায় উচ্চতা ৩১৭৬ফুট। যেটাই হোক সন্দেহ নাই এটাই বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ রিডিং।


বুনো শুকর। ওয়াইল্ড হগের দাঁত দেখে ভুল বুঝবেননা। আমি নিজে রোয়াংছড়িতে একটা তিন ঠেঙ্গে কুকুর পেয়েছিলাম। তার মনিব জানিয়েছিল অপর পা টা শিকারের সময় আহত বুনো শুকর কামড়ে ছিড়ে ফেলেছিল।


সেই কুচ্ছিত বিছুটি আর পচা বাঁশের জঙ্গলে দৈত্যাকার মাকড়শা।


চুড়োয় বসে শেষ কাজ। পড়ের অভিযাত্রীদের জন্যে শুভেচ্ছা বার্তা লেখা। কাগজটা এখনো একটা ড্রিংক্সের বোতলে আছে। পড়ের অভিযাত্রীরা একটু খুঁজলেই পাবেন। ছবিঃ আলম ভাই।


শিকারের অপেক্ষায় মাকড়শা।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৯:০১
৩৪টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×